ll জাকারিয়া ইছলাম ll
ভদ্রলোক খুব বিরক্তিভরে ফোনগুলো রিসিভ
করেন। তার কথার মধ্যে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ পায়। কয়েকজনকে তিনি বলেই ফেলেন, দু’এক
মাস বাঁচবেন কিনা ঠিক নেই; পরের মাসের কথা তিনি কিভাবে বলবেন ?
সারকথা এইযে, করোনা ভাইরাস নিয়ে তিনি খুবই আতংকিত । কেমন যেন
মৃত্যুভয় পেয়েছেন তিনি । এই কয়েক দিনে আমি আরও কয়েকজনের কথা শুনেছি; ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিভিন্ন জনের মতামত বোঝার চেষ্টা করেছি । আমার মনে
হয়েছে করোনা ভাইরাসকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাতে এরূপ ধারণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে,
বর্তমান মানব সভ্যতার বিলীন হওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু, প্রশ্ন হোল, পৃথিবীর জন্য এ ধরণের ভয়াবহ বিপদ কি এই
প্রথম? করোনা ভাইরাস কি পুরাতন সব কয়টি বিপদের থেকে অনেক
বেশী মারাত্মক?
যেমন
২০০৩ সালে সারস ভাইরাসে অ্যাটাক করেছিলো প্রায় ২৬ টি দেশ। মৃত্যুহার ছিলো ১০%।২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে ৫৭ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। মৃত্যুহার ৪.৫%২০১৪ সালে ইবোলায় মৃত্যুহার ২৫% । মারা যায় ১১,৩১০ জন।আর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুহার মাত্র ২%। মারা গেছে এ পর্যন্ত ৬২৩৯৯ জন।
এই দুটি প্রশ্নের উত্তরও আমি ইতোমধ্যে
জেনেছি । জেনেছি পৃথিবীতে এ ধরণের বিপদ এই
প্রথম নয় এবং এই বিপদ পূর্বের বিপদের তুলনায় ভয়াবহতমও নয় । তবে পার্থক্য হোল, আগের মানুষ এসব বিপদের কথা
সাথে সাথে জানতে পারত না । ২০০৩ সালে ফেসবুক , হোয়াটসআপ ছিলোনা।
যখন সারস ভাইরাসে ২৬ টি দেশ আক্রান্ত হয়। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুর সময় দুনিয়া
ব্যাপী ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিলো মাত্র ১৫০ মিলিয়ন। ২০১৪ সালে ইবোলার সময়
হোয়াটস্যাপ ব্যবহার কারী মাত্র ২৫০ মিলিয়ন। আর ২০২০ সালে অন্যান্য মিডিয়া বাদ শুধু
ফেসবুক আর হোয়াটসআপ ব্যবহার করছে লাখ, কোটি, মিলিয়ন না। প্রায় চার বিলিয়ন মানুষ। সোসালমিডিয়ার এই শক্তি ব্যাপক। প্রতি সেকেন্ডেই
খবর ছড়াচ্ছে। কথায় বলে দুঃসংবাদ ঘোড়ার আগে ছুটে। একটা ভাইরাসে একজন মানুষের মৃত্যু
সংবাদ এখন মুহূর্তেই বিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার সুবিধার কারণে স্বল্পতম সময়ে যে কেউ দেশী
বিদেশী সব ঘটনার খুঁটিনাটি জানতে
পারছে । কোন বিষয়ে বেশী জানলে মানুষ অনেক বেশী সচেতন হবার কথা । সেই সচেতন করার
জন্যই সরকারি এবং বেসরকারি
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে বার বার বলা হলেও ফল হচ্ছে বিপরীত । বিভিন্ন
প্রচারণায় মানুষ সচেতন না হয়ে অনেক বেশী আতংকিত হচ্ছে । আতংকিত মানুষ কোন সমস্যার সমাধান করতে
পারে না; বরং নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে । এ কারণে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলের
ভেবে দেখা এখনই প্রয়োজন ।
প্রাণীজগতে মানুষ অন্য সকল প্রাণী থেকে
আলাদা। দর্শনশাস্ত্র মতে মানুষ একটি ‘বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন’ প্রাণী । পবিত্র কোরআনে
বলা হয়েছে, ‘মানুষ সহজাত বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন’ একটি প্রাণী । এই ‘বুদ্ধিবৃত্তি’ বা ‘ সহজাত বিচারবুদ্ধি’ গুণই
মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে । আর একটি বিশেষ গুণও মানুষের আছে । সে
গুণটি হোল ‘খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা’ । একজন মানুষ যেকোনো
পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে খুব সহজে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে – যা
অন্য কোন প্রাণী পারে না । একসময় ডাউনোসরের মত বিশালদেহী প্রাণী এই পৃথিবীতে ছিল ।
কিন্তু, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে, ডাইনোসোর
প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে, মানুষ সেই ডাইনোসোর নয়। মানুষ বিরল গুণসম্পন্ন একটি প্রাণী । পবিত্র
কোরআনের ভাষায় ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’। কিন্তু, এই সৃষ্টির সেরা জীবের সবচেয়ে দুর্বল দিক হোল, এই ‘বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন’ প্রাণী
কোন বিষয়ে নিজের সহজাত
বিচারবুদ্ধি’ প্রয়োগ
করতে চায় না । এই মানুষ, বিশেষ করে আমাদের দেশের মানুষ বেশীরভাগ
ক্ষেত্রে গুজব এবং অন্যের কথা দ্বারা পরিচালিত হয়। করোনাভাইরাস জনিত এই সংকটময় মুহূর্তেও আমরা প্রায়
সকলেই একই কাজ করছি । আতংকিত না
হয়ে সচেতন হবার কথা বলে হলেও, আমরা অন্যের দেখাদেখি নিজেরাই অনেক বেশী আতংকিত হচ্ছি।
কিন্তু, ভবিষ্যৎ অনিবার্য বাস্তবতা হোল, এই মানুষ করোনা সংকটও কাটিয়ে উঠবে। বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকবে এই সৃষ্টির সেরা জীব ।
আজ ফেসবুকে দেখলাম অফিসে কর্মরত
একজন কর্মকর্তার ছবি পোস্ট করা
হয়েছে । ছবিটি নিচে দেওয়া হোল। ছবির ভদ্রলোক করোনার ভয়ে রীতিমত একজন নভোচারীর পোশাক
পরে অফিস করছেন ।
আমার ম্যাসেঞ্জারে একজন ফেসবুক বন্ধু একটি খুদেবার্তা
পাঠিয়েছেন । বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘করোনাভাইরাস এর এই মহা-দুর্যোগের পর
কার সাথে কার দেখা হবে অনিশ্চিত! আমরা সবাই কি বেচে থাকব? তাই,
আসুন আমরা পরস্পর পরস্পরকে ক্ষমা করে দেই।
আমিও একজন ক্ষমা প্রার্থী’।
তারমানে আমার ফেসবুক বন্ধু রীতিমত সবার কাছ থেকে শেষ
বিদায় নিয়েছেন ।
কিন্তু,আমার প্রশ্ন করোনা ভাইরাস
সত্যিই কি এমন প্রাণঘাতী? সত্যিই কি এত ভয়ংকর ? আমি নিজেও অবশ্য করোনা ভাইরাস
যে ভয়ংকর নয়, তা বলতে চাইনে ।
করোনাভাইরাস অবশ্যই ভয়ংকর । কারণ, এই ভাইরাস মানুষের মাধ্যমে
অতিদ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করে । ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে ব্যবস্থা না নিলে, মহামারি আকার ধারণ করে । কিন্তু, এই ভাইরাস যে খুব
বেশী প্রাণঘাতী নয়, তা পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণিত। এই ভাইরাসে
গড় মৃত্যুর হার ২% । সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইতালির। সে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হার
১০% । ইতালির খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও করোনা আক্রান্ত শতকরা ৯০ জন মানুষ সুস্থ হয়ে
উঠেছেন। তাই, পৃথিবীর অনেক ভাইরাস থেকে এই ভাইরাস অনেক কম প্রাণঘাতী।
সুস্থসবল মানুষ করোনাভাইরাসে মারা যাচ্ছেন - তাও নয়। সাধারণত যারা বয়স্ক এবং অন্য কোন রোগের কারণে শরীরে রোগপ্রতিরোধ
শক্তি কম- মূলত তাঁরাই করোনা ভাইরাসের মূল শিকার। দ্রুত রোগ সনাক্ত করা এবং
আক্রান্ত রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া- এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এই পদ্ধতি অনুসরণ
করে ইতোমধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ
কোরিয়া, তাইওয়ান, সিংগাপুর ইত্যাদি দেশ
সফলতা পেয়েছে। আমাদের সরকার সেভাবেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন । কিন্তু আতংকিত মানুষ এবং
তাঁদের অযৌক্তিক কৌতূহল এখানে বড় বাঁধা। অযৌক্তিক কৌতূহল এই পর্যায়ে যে, করোনা আক্রান্ত আলাদা করা রোগী দেখতে শত শত মানুষের ভিড় হচ্ছে। একজন মানুষ এই আতংকবোধ এবং অযৌক্তিক
কৌতূহল নিজের সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেই দূর করতে পারে । কিন্তু, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে না।
আমাদের বুঝতে হবে ভয়ংকর কোন
বিষয়ের মোকাবেলা করতে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
একজন আতংকিত মানুষের মাথা ঠাণ্ডা থাকে না । ফলে, আতংকিত মানুষ কোন সমস্যার
সমাধান করতে পারে না। চীনের করোনাভাইরাসের কথা প্রকাশ পায় ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর । আজ থেকে ঠিক ৯১ দিন আগে । চীনের দ্রুতগতির
উন্নতি যারা পছন্দ করেননি, তাঁরাই এ বিষয়টি ‘হাতী কাদায় পড়েছে’ হিসেবে
গ্রহণ করেন। সে সময়ে এমনভাবে পরিকল্পিত উপায়ে করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচারণা শুরু করা
হয়, যেন সবাই আতংকিত হয় এবং
চীনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে। তাঁদের সেই চেষ্টা সফলও হয়। সত্যিই অতিঅল্প সময়ে
চীনের অর্থনীতিতে ধ্বস নামে । কিন্তু, তাঁরা কখনও ভাবেননি যে, করোনা ভাইরাস তাঁদের
নিজেদের দেশ আক্রমণ করবে। তাই কোন রকম প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি।
সত্যিই যখন তাঁদের দেশ আক্রান্ত হয়, তখন নিজেদের ছড়ানো আতংকে
তাঁরা নিজেরাই বেশী আতংকিত হয়ে পড়েন। সব লেজেগোবরে জড়িয়ে যায়। অথচ প্রথম দিকে আতংক
সৃষ্টি না করে সবাইকে করোনা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কথা বলা হলে, বর্তমানের দৃশ্যপট
ভিন্ন রকম হত। যাহোক, এসব কথা এখন বলে লাভ নেই । আতংকও এক
ধরণের সংক্রামক ব্যাধি। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রথম দিকের সেই ছড়ানো আতংকে আমাদের
দেশের সাধারণ মানুষও আক্রান্ত হয়। আতংকিত মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বেশ কিছুটা
সময় লাগে। আমরা বোধ হয় সেই ক্রান্তিকালে আছি। এখন নিজেদের সামলে নেওয়া খুবই জরুরি।
একজন মানুষ দৈনন্দিন জীবনে লক্ষকোটি অদৃশ্য ভাইরাসের সাথে
যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। করোনা ভাইরাসও একটি ভাইরাস। তার শক্তি একটু বেশী। সেই বেশী
শক্তির সাথে মোকাবেলা করতে কি ধরণের খাদ্য দরকার; কি পদ্ধতি
অবলম্বন করতে হবে –সবই বিস্তারিত বলা হচ্ছে। এখন সংশ্লিষ্ট সকলের মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। ব্যক্তিগত
সুরক্ষার জন্য যে উপকরণের কথা বলা হচ্ছে; প্রয়োজনীয় যে কিটের
কথা বলা হচ্ছে নিজেদের সক্ষমতায় কিভাবে তা নির্বাহ করা যায়- সরকারি, বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ের সার্বিক
সহযোগিতায় কিভাবে এই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
তার আগে এই বিশ্বাস থাকা জরুরি যে, এ ধরণের দুর্যোগ মোকাবেলা
মানুষই করতে পারে এবং আমরাই তা পারি।
আর একটা বিষয় এখানে না বললেই নয়। পৃথিবীর কোন দেশ
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের গুলি করে মারছে; কোন দেশ বৃদ্ধদের বাদ দিয়ে শুধু অল্প বয়সীদের চিকিৎসা দিচ্ছে-এটা আমাদের
বিষয় নয়। আমাদের সমাজে বয়স্কদের সম্মান করা হয়, রোগীদের
সম্মান করা হয়- রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্সকে ভি.আই.পি মর্যাদা দেওয়া হয়। এটা আমাদের নিজেদের ধর্ম
এবং সংস্কৃতির অঙ্গ। সামান্য একটা ভাইরাস আমাদের এতদিনের লালিত ঐতিহ্য নষ্ট করুক
এটাও কাম্য নয়। আমাদের মিডিয়া আমাদেরকে গুমরাহ করছে, আমাদের
মধ্যে অনেকেই ব্যাপারটা বোঝতে পারছেনা, আমাদের সমাজের
শিক্ষিত ব্যক্তিদের উচিত তাদের না বোঝা বিষয়গুলো তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করা।
তাঁদেরকে আমরা যেন অসম্মান না করি; নিজেদের নিরাপদে রেখে,
সকলের সম্মান বজায় রেখে আমরা যেন এই জাতীয় সমস্যা মোকাবেলা করি ।
দেশের সমস্ত শহর এখন ফাঁকা। মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষেরা এখন
তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় । মাঠ প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য এখন এটা অনেক বড়
চ্যালেঞ্জ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা
দিচ্ছেন। তবে, সরকারের একার পক্ষে এই জাতীয় মহাদুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আমাদের সকলকে যার
যার সামর্থ্য অনুযায়ী মেধা, অর্থ ও শ্রম দিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবেলায়
অংশ নিতে হবে। আমরা নিজেরা যদি এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই এবং এতে যদি
মৃত্যুবরণও করি; আমরা যেন সত্যিকার ধার্মিক এবং মানুষ হিসাবে
তা করি । কোন আতংকিত অর্থহীন জীবন নিয়ে আমরা যেন বিদায় না নিই ।
মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হউন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন