“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০

সোনার ধরিত্রী


।। পার্থঙ্কর চৌধুরী।।

সাময়িক প্রসঙ্গে, ২২শে এপ্রিল, ২০২০
রিত্রী দিবসের আজ সুবর্ণ জয়ন্তী। না! এই দিবসটার সাথে আমরা তেমন পরিচিত নই। ২২ এপ্রিল, ১৯৭০ সালে প্রথম বারের মত দুশো লক্ষেরও বেশী আমেরিকার আম-আদমি সেখানকার শতাধিক শহর জুড়ে প্রথম বারের মত এই দিনটি পালন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, ‘পরিবেশ-অজ্ঞতা’- বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদ করা। কবি সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতার মত, ‘ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য রে যাব আমি নবজাতকের কাছে আমার দৃঢ় অঙ্গীকারগোছের একটা দৃঢ় প্রত্যয়ও অবশ্য সেখানে মনে মনে কাজ করছিল।
            সেই অর্থে বছর পঞ্চাশতম ধরিত্রী দিবস। এবছরের ধরিত্রী দিবসের বিষয়(Theme) হচ্ছে, ‘ক্লাইমেট একশন’(Climate action), অর্থাৎ, গোটা মানব জাতি, এবং তাদের জীবন  ধারণের পদ্ধতি (Life Support System) যাতে ভবিষ্যৎ দিনে মানুষ তথা সমস্ত উদ্ভিদ প্রাণীকুলের  অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দীর্ঘস্থায়ী রূপে অনুকূল পরিস্থিতি করে রাখা যায়; যাতে করে এদের কেউই বিলুপ্তির মুখ না দেখে, সেইমত কাজ করে যাওয়া। এর জন্য যেটা অতি আবশ্যক, তা হচ্ছে, ব্যক্তি স্তরে (এবং সমষ্টিগত ভাবে) কার্বন ফুটপ্রিন্ট ন্যূনতম মাত্রায় কমিয়ে আনা। বলা বাহুল্য, এক এক জনের কার্বন ফুটপ্রিন্ট নির্ধারিত হয় তিনি কি রকম জীবন যাপন করছেন, কি ধরনের গাড়ী দিয়ে অফিস যাতায়াত করেন, কতটুকু দূর গাড়ী নিয়ে রোজ পাড়ি দিচ্ছেন, দিনে গড়পড়তা কতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন, যে খাবারটা খাচ্ছেন, সেটা কোথায় এবং কিভাবে বানানো হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, এককথায়, ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে প্রতি এক জনের জন্য কতটুকু কার্বন পৃথিবীর বুকে এসে জমা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, কার্বন ফুটপ্রিন্টের আজকের দিনে গড়পড়তা মাথাপিছু (Global average) হলো প্রায় টন এবং শুধুমাত্র আমেরিকাবাসীদের জন্য এই মাত্রা ১৬ টন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি যদি ডিগ্রী  সেন্টিগ্রেড দমিয়ে রাখতে হয়, তার জন্য  বিশ্বজুড়ে মাথাপিছু এই কার্বন ফুটপ্রিন্টের মাত্রা -টনের নিচে নিয়ে আসাটা  নিতান্তই জরুরি। কি ভাবছেন?
এবার তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তার জন্য  ধরিত্রী দিবসের এই সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে গৃহবন্দী অধিকাংশ বিশ্ববাসীর, সঙ্গে ভারতবাসীরাও কি করবে? এই লক ডাউনে? আচ্ছা, এটা তো আর এক দিবসীয় কর্মসূচী নয়, যে এইদিনটাতেই শুধু করতে হবে। অন্তত পক্ষে, আমাদের চেতনার উন্মেষ (Consciousness)-টাকে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রচলিত লক ডাউন কোনও ভাবেই পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াতে পারে না!
বিজ্ঞজনেরা বলেন, শিক্ষা না কি দুরকমের হয়, এক দেখে শেখা, আরেকটা, ঠেকে শেখা! তারই রেশ ধরে বলছি, ভাবেই হোক, কিম্বা ভাবলেশ মতেই হোক, এবছর আমরা, মানে শুধু উপত্যকাবাসী নয়, বরং স্বীকার করে নেওয়া উচিত, সমগ্র ভারতবাসী, নির্ধারিত এই দিনের (অর্থাৎ ২২ এপ্রিলের) আঠাশ দিনে আগে থেকেই ধরিত্রী দিবস নামক চল্লিশ দিবসীয় ব্রতকথা পালন করতে উদ্যত হয়েছি, এবং মজার খবর এই যে, নির্ধারিত এই দিনের পরও আরো এগারো দিন আমরা তা পালন করব। কি অপূর্ব সমাপতন! বলছিলাম, যে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে এই চল্লিশার দশাকাটাতে হচ্ছে, তাতে করে একাংশ লোকের কম বেশী হলেও এতদিনে সম্বিৎ ফিরেছে, এবং ফিরছেও। এখন দেখার কথা, চেতনার এই উন্মেষটুকুর কত খানি প্রতিফলন হয়, ব্যক্তি তথা সামূহিক জীবনের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডে!
আচ্ছা, একবার ভাবুন তো, বিলাসবহুল জীবন যাপনে লিপ্ত আত্মঘাতী মানবকুল এই পৃথিবীর উপর নিরন্তর এবং উপর্যুপরি অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে কি না? গোটা বিশ্ব তথা দেশের কথা ছাড়ুন। যদি আমাদের এই উত্তর পূর্বাঞ্চল, তথা অসম রাজ্য, এমন কি এই বরাক উপত্যকার প্রসঙ্গে কথাগুলো তোলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সারা বিশ্ব তথা দেশের তুলনায় আমরা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই!
অসুখের ক্ষেত্রে যেমন কিছু কিছু অসুখ রয়েছে যাদেরকে লাইফ স্টাইল রিলেটেড ডিসিজ’ (Life style related disease) বলা হয় (যেমন, হার্ট এটাক, স্ট্রোক, লিভার পচে যাওয়া ইত্যাদি), ঠিক তেমনি আমাদের দৈনন্দিন জীবন কাটানোর পদ্ধতির উপরও পরিবেশের অসুখ হওয়াটা অনেক খানি নির্ভর করে বৈকি!  আচ্ছা, দশ টাকার জলের বোতলের ব্যবহার কি সামান্য একটুখানি চেষ্টা করলেই আমরা বাদ দিতে পারি না? ঠিক একই ভাবে পলিইথিলিন জাতীয় একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক? শহরাঞ্চল বলুন, কিম্বা গ্রামের। নালা- নর্দমা সর্বত্রই যে এরা জলের মুক্ত ধারাকে ব্যাহত করছে! আবার অতি শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত কিম্বা অশিক্ষিত ফ্লাট-বাড়ির মালিক কিম্বা গ্রামের গৃহস্থের কথাই বলুন। বাড়ির সামনে রাস্তায় কিম্বা নালায় ধুম করে রোজকার শাক-সবজির খোসার আবর্জনা পোটলা বেঁধে বাইরে ফেলে তো বাড়ির ভেতরের চৌহদটা পরিষ্কার রাখেন। একটিবারের জন্য তাদের ভাববার অবকাশ নেই, এই ফেলে দেওয়া আবর্জনার শেষ গন্তব্যস্থলটা কৈ? এই আবর্জনা মানে শাক-সবজির খোসা থেকে যে সম্পদ (Waste to Wealth) বানানো সম্ভব, সেটা কে কাকে বোঝায়?
বেশ ঘটা করে গেলো বছরের রাজ্যিক স্তরে পরিবেশ দিবস তো এই বরাক উপত্যকায় হয়েছিল। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী (৫ই জুন, ২০১৯ইং) শিলচরের পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে দেওয়া ভাষণে প্রত্যেক রাজ্যবাসীকে দুটো-হাতে দুটো-গাছলাগানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। উনার বক্তব্য মাথায় রেখে, এপক্ষ এবং ওপক্ষের বরাকবাসী (এবং রাজ্যবাসী) মাথাপিছু এখন অব্দি কটা গাছ লাগিয়েছেন, তার কি কোনও তথ্য পাওয়া যাবে?
বেশ কয়েক মাস আগের কথা বলছি। এক ছাত্র মারফৎ জেলারই জয়পুর-রাজাবাজার এলাকা থেকে মুঠোফোনে একটা স্ক্রিন-শট ফোটো পেয়েছিলাম।  অজগরকে একটাকে মেরে তার লেজটা উঁচু গাছে বেঁধে রেখে (অনেকটা পাঁঠা ছোলানোর মত) মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে চামড়াটা ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছিল, এবং সদর্পে সেটা জনৈক সেই ব্যক্তি হোয়াটসএপ- স্টেটাস দিয়ে রেখেছিলেন।
এরকম পথচলতি জীবনে অনেক অভিজ্ঞতারই সঞ্চয় হয়। সেরকম আরেকটা ঘটনার কথা বলছি। মাস কয়েক আগে একটা ইনোভা গাড়ি দিয়ে মিজোরাম বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে গাড়িচালকের কাছ থেকে শোনা। তবে ঘটনা যে মিথ্যা নয় তার প্রমাণ পরবর্তীকালে পেয়েছি। গাড়িচালক বলছিলেন, গাড়িটা নাকি খোয়া গেছিল, অনেকদিন এর হদিশ পাওয়া যায় নি, শেষ মেশ হায়দ্রাবাদের এক দামি হোটেলের বেইসমেন্ট ফ্লোর থেকে উদ্ধার হয়েছে। মিজোরাম যাওয়ার পথে গাড়িটা যিনি চালাচ্ছিলেন, তিনি গাড়ির মালিক। বলছিলেন, এর আগে গাড়িটা ড্রাইভারই চালাতো। শহরের এক ব্যবসায়ী (বরং সোজা-সাপটাই বলি, তক্ষক চোরাপাচারে লিপ্ত অবৈধ বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ী; শহরের কোন এলাকা, সেটা আপাতত: উহ্য থাকলো) শিলচর থেকে এই গাড়িটা করে সোজাসুজি হায়দ্রাবাদ পাড়ি দেন। ইনোভা গাড়িটা চুরি, পরবর্তীতে এর উদ্ধারের উপাখ্যান, এবং গাড়ী উদ্ধারে পুলিশের সহায়তা এই নিবন্ধের প্রাসঙ্গিকতার মধ্যে পড়ছে না, সেটা না হয় অন্য পরিসরে বলা যাবে) কিন্তু একটা ঘটনা তো স্ফটিকের মত পরিষ্কার, যে  চোরাই পথে বন্যপ্রাণী পাচারের ঘটনায় আমাদের বরাক উপত্যকা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই!
স্ফটিকের মত স্বচ্ছ আরেকটা ঘটনা আপনাদের স্মৃতির অতলে এখনও তলিয়ে যায় নি! বরাক উপত্যকার তিন জেলা নিয়ে যে বৃত্ত, তার চারপাশের পাঁচশো-হাজার কিলোমিটার দূরত্বে দেশীয় ভূখণ্ডের  কোথাও পোস্ত-চাষ হয় বলে জানা নেই!  (জানিনা আপনাদের জানা আছে কি না!) তাহলে দীপান্বিতার পর পরই শহরে পোস্তর গাড়ি এসেছিলো কোথা থেকে? যাচ্ছিলই বা কোথায়? না, কেউ জানলাম না! অনুসন্ধিৎসু মন উত্তরের অপেক্ষায় থেকেই গেলো! অদূর ভবিষ্যতে সাংবাদিক বন্ধুদের  কেউ হয়ত নিয়ে তদন্তমূলক প্রতিবেদন উপত্যকার কোনও খবরের কাগজে  প্রকাশ করবেন, সেই আশায়ই রয়েছি ! আচ্ছা, একটা কথা তো ঠিক, অবৈধ পোস্তর গাড়ি না আসলে বেঘোরে মেহেরপুরের দুটি মেয়ের প্রাণ যেত না! জানি না এর আগেপরে এক বা একাধিক পোস্তর গাড়ি সে পথ মাড়িয়েছে কি না! তবে মন্দের ভালো এই যে, সেগুলো ক্ষেত্রে  অন্য কোনও (সা/না) বালক - (সা/না) বালিকা কিম্বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রাণ হানি হয় নি!
ভাবছেন, ধান ভানতে শিবের গীত! কোথায় ধরিত্রী দিবস, আর কোথায় পোস্ত- উপাখ্যান! মিল আছে বৈ কি? যে শিরোনামে বলা আছে,  সোনার ধরিত্রী; একটু শ্লেষাত্মক ঠেকবে, তবুও বলতে ইচ্ছে করছে, সুবর্ণ জয়ন্তীতে, অর্থাৎ পঞ্চাশে, ধরিত্রীর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি! আর ধরিত্রীর এই পঞ্চত্ব প্রাপ্তিতে আমাদের আপনি বাঁচলে…’ গোছের শরণার্থীসুলভ জীবন-দর্শন, চোখ এবং উদরের অন্তহীন ক্ষুধা ইত্যাদি অনবরত: যোগান দিয়েই চলেছে! যতদিন পর্যন্ত ভাবের ঘরে এই চুরি’-খানা বজায় থাকবে, ততদিন ধরিত্রী বলুন, বা প্রকৃতি... সেটার রক্ষণাবেক্ষণে খামতি থেকেই যাবে! অবধারিত ভাবে যেটা প্রয়োজন, তা হচ্ছে, আমাদের মনন জগতের আমূল পরিবর্তনের।  সকলের সাথে, সবাইকে নিয়ে বাঁচার তাগিদে সেটা তো করতেই হবে। এবার একটু নির্জনে বসে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করুন দেখি, এই ত্রুটিপূর্ণ জীবন-দর্শন পাল্টানো কি সম্ভব?  দেশ কি ধরতিমাতা আপনাদের সেই উত্তরের অপেক্ষায়ই রয়েছেন। সামগ্রিকভাবে সেটা যদি করা সম্ভব হয়, তাহলেই হয়ত: বা ধরিত্রী মাতার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি আটকানো সম্ভব।
নতুবা...??


অধ্যাপক, বাস্তু পরিবেশ বিদ্যা বিভাগ, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর--৭৮৮০১১  
(মুঠোফোন +৯১-৯৪৩৫০৭৮২৯৬ )



কোন মন্তব্য নেই: