“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৪ জুন, ২০১৯

সেইবেলা


আমার সেইবেলাটাই বেশ ছিল
পাশে আমার বাবা ছিলেন,
হাতখানা তার ধরা ছিল
পথে অনেক কাঁকড় ছিল
তবুও মনে সাহস ছিল,
বাবা আমার পাশে আছেন
এই একটা ভরসা ছিল
আমার সেইবেলাটাই বেশ ছিল।

মোড়ের মুখে স্কুল ছিল
স্কুলগুলোতে প্রাণ ছিল
দিদিমণির শাসন ছিল
ভীষণ রকম ভয় ছিল
একটানা এক টান ছিল,
আঁচল ভরা স্নেহ ছিল
শাসন শেষে বুকে টানা---
মায়ের গায়ের ঘ্রাণ ছিল।
দুদিন যদি যেতাম না কেউ
বাড়ি এসে খোঁজ নিতেন,
কি এমন সে কাজ ছিল ?
আমার সেই বেলাটাই বেশ ছিল।

আমার যারা বন্ধু ছিল
লালজামা আর নীল জামা-
ভীষণ মিষ্টি, পুতুল যেন
আমার সাথে ভাব ছিল
কথা যে খুব হতো তা নয়
তবুও ভীষণ ভাব ছিল।
টিফিন কৌটায় যা খুশী থাক
আমার তাতে ভাগ ছিল,
আমায় খাইয়ে তবেই তাদের
টিফিন খাওয়া স্টার্ট ছিল।
আমার সেইবেলাটাই বেশ ছিল।

মামার বাড়ি বাগান বাড়ি
শহর থেকে অনেক দুর,
ধানের গোলা, গোয়াল ঘর
ময়না টিয়ার মিষ্টি সুর।
গাড়ি ঘোড়ার চল ছিল না
পায়ে হাঁঁটাই মূল ছিল
পূজোর সময় নাচঘরেতে
যাত্রাগানেের চল ছিল।
অনেক অনেক আগের কথা
পূজোয় আমরা মামার বাড়ি
পাশের গায়ে যাত্রা দেখবো
তাই চেপেছি ঘোড়ার গাড়ি।
দাদু যাবেন দিদিমা আর
রাঙ্গামাসী, মিষ্টিমা
সহিসচাচা, বাবুর্চি ভাই
আমি বাবা সঙ্গে মা।
ছুটছে গাড়ি টগবগিয়ে
ঘোড়ার মাথায় টর্চ ছিল
ঝিঝি পোকা অন্ধকারে
ভয়ে ভয়েই ডাকছিল।
হঠাৎ গাড়ি থমকে দাঁড়ায়
আর এগুনো যাচ্ছে না,
সহিস বলে ফিসফিসিয়ে
সামনে দেখুন নড়ছে না।
কাঁপছে দাদু, কাঁপছে দিদা
কাঁঁপছে সহিস বাবুর্চি
আমার তখন বয়স কত
এই সবেতে চার ছুঁয়েছি।
বিশাল শরীর চকচকে গা
ভোরাকাটা দাগ ছিল
মায়ের কাছে শুনেছিলাম
রয়েল বেঙ্গল বাঘ ছিল।
দুপাশ ঘেরা চায়ের বাগান
জনবসতির চিহ্ন নাই
টুস করে যে পালিয়ে যাবো
কাঁপছে যে পা, শক্তি নাই।
দাদু বললেন সবাই চুপ
একটি আওয়াজ‌ও তুলবে না
একটুখানি কেউ নড়েছো
একটি লোক‌ও বাঁচবো না।
দাঁঁড়িয়ে আছি শক্ত কাঠ
নড়বো যে তার উপায় নেই
প্রাণ নিয়ে যে ফিরবো বাড়ি
সেই আশাতে ভরসা নেই।
সময়--পিঠে সময় চড়ে
সময় বুড়ি এগিয়ে যায়,
কাঁপছে সবাই থরথরিয়ে
এই বুঝি বাঘ হাড় চিবায়।
দাঁড়িয়ে আছি নড়ছি না
বাগবাবাজী সরছে না
হঠাৎ বাঘের দয়া হলো
পলক খুলেই দেখছি না।
দাদু বললেন জোর বেঁচেছি
এমন কম্ম আর হবে না
কিছু একটা ঘটে গেলে
মুখ দেখানো আর যাবে না।
সহিস বললে ওকথা নয়
মৃত্যুটাতো লিখাই ছিল
বরাত জোড়ে এই শিশুটি ---
শিশু যীশুই বাঁচিয়ে দিল।
ঘোড়ার গাড়ি, বাঘের ভয়
তবুও মনে সুখ ছিল
মন্দলোকে যে যাই বলুক
সেইবেলাটাই বেশ ছিল।

আমি যখন স্কুলে পড়ি
আমার বন্ধু তিনকড়ি
গরীব ছেলে ভীষণ শান্ত
পাশের পাড়ায় ঘর ছিল,
সাত চড়েতেও রা করে না,
এমনটি তার ভাব ছিল।
আমি বসতাম প্রথম সারি
ওটাই আমার পছন্দ খুব,
সে বসতো পেছন সারি
আমার ছিল তাতেই ক্ষোভ ।
কোনদিন সে পাশে বসেনি,
পড়াশুনায় খুব সাধারণ
কিছু বললে হাসতো শুধু
বলতো আমার হবেখন।
সেবার আমার অসুখ হলো,
ভীষণ জ্বর ,গায়ে ফোড়া
সবাই বললে সাবধান সব
ও কিছু নয়, মায়ের দয়া।
যত আমার বন্ধু ছিল
কোথায় যেন হারিয়ে গেল
তিনকড়িটাই স্কুল পালিয়ে
আমার পাশে বসেছিল।
সবার কত নিষেধ ছিল
মায়ের নিষেধ বাবার নিষেধ
ওদের বাড়ি রাগারাগি
তারপরেতেও তিন তিনটে দিন
আমার কাছেই এসেছিল।
চতুর্থ দিন খবর পেলাম
মায়ের দয়ায় সেও কাবু
বদ্যি, পথ্যি টুটকা--শক্তি
যম মানুষে লড়েছিল।
ভীষণভাবে কাবু হয়েও
এই যাত্রায় সে বেঁচেছিল।
যেদিন আমি সুস্থ হলাম
প্রথম ওদের বাড়ি গেলাম
আমায় পেয়ে সেকি খুশী
আনন্দেতে হাসছিল।
শুধু আমার চোখে জল‌ই জল
সে যে একটি চোখেই দেখছিল।
আমার সেই বেলাটাই..........।

২টি মন্তব্য:

Ratan Das বলেছেন...

ভীষণ ভালো লাগলো
মনটা ছুঁয়ে গেলো

Ratan Das বলেছেন...

ভীষণ ভালো লাগলো
মনটা ছুঁয়ে গেলো