“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের আন্দোলন ও চা-শিল্প


।। অরূপ বৈশ্য ।।

(রোমন্থনে প্রকাশিত)

ন্দোলনের প্রথম পর্যায় ঃ বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের কথা লিখতে গেলে তা শুরু করতে হয় ১৯২১-২২ সালে গোটা আসামে চা-শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় থেকে যখন করিমগঞ্জ জেলার চা-বাগানে ‘চরগোলা এক্সোডাস’ নামে খ্যাত শ্রমিক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। অমলেন্দু গুহ তাঁর ‘প্ল্যান্টারস রাজ টু স্বরাজ ঃ ফ্রিডম স্ট্রাগল এন্ড ইলেকটর‍্যাল পলিটিকস ইন আসাম, ১৮২৬-১৯৪৭’ গ্রন্থে লিখেছেন – “গুরুত্ত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে জানা থাকলেও ‘চরগোলা এক্সোডাস’ সামাজিক ঘটনা হিসেবে আরও ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করে আছে......। বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে শুরু হয়ে বাঁধা শ্রমের ব্যবস্থা থেকে দলবদ্ধ পলায়নের মাধ্যমে এক গণ রাজনৈতিক সংগ্রামী কর্মসূচীর রূপ পরিগ্রহ করে। এই গণ পলায়ন ছিল এক খোলাখুলি বিদ্রোহ, বৈধ দাসপ্রথার পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আদিম প্রত্যাহ্বান। এটা ছিল প্রবহমান শ্রেণি-জঙ্গিপনার সাথে গান্ধীয়ান প্রভাবের পরিণতি”।
বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পর্যায়ে চা-শিল্প যে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পরেছিল এব্যাপারে সবাই অবগত। কিন্তু যুদ্ধকালীন বাণিজ্যের সময়ে চা-শিল্প মালিকরা যে প্রভূত মুনাফা করেছিল তার ছিঁটেফোটা অংশও শ্রমিকদের ভাগ্যে জোটেনি। বরঞ্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার থেকে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি এবং মজুরি কাঠামোর সংশোধন না হওয়ার ফলে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি সাংঘাতিকভাবে নীচে নেমে যায়। ১৯০৬ সাল থেকে বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত এই দীর্ঘ পর্যায়ে শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোয় কোন সংশোধনী হয়নি। যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যের ফলে চা-শিল্পের প্রভূত মুনাফা হওয়ায় চা-শ্রমিকরা মজুরির বৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। উপরন্তু এক সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে স্থানীয় রেল শ্রমিকরা তাদের মজুরি বৃদ্ধি করে নেওয়ার ঘটনাও চা-শ্রমিকদের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। মজুরি বৃদ্ধি না হওয়া ও প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার ফলে সুরমা উপত্যকা সহ সমগ্র আসামের বিভিন্ন বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। সুরমা উপত্যকায় বিশেষত করিমগঞ্জ সাব-ডিভিসনের চা-বাগানগুলিতে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হতে থাকে। চরগোলা ও লঙাই ভ্যালি বাগানে এনিয়ে আন্দোলনও সংগঠিত হয়। সেই সময়ে কাছাড় জেলার খড়িল ও লক্ষিপুরের বিভিন্ন বাগানে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখনীয়।
            চরগোলা এক্সোডাসের প্রেক্ষাপট – যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে চা-শিল্প বছরে প্রায় এক লক্ষ পাউণ্ডের চায়ের রাশিয়াবাজার হারায়। ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশের বাজারে চায়ের চাহিদার পুনরুত্থান করা সম্ভব হয়নি। বাণিজ্য শুল্ক তুলে দেওয়ার জন্য বাগান-মালিকদের প্রচেষ্টা বিফল হয়। তবে যুদ্ধের সময়ে অভ্যন্তরিণ বাজারে চায়ের চাহিদার যে বৃদ্ধি ঘটেছিল তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। সেই ক্ষেত্রে যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে চা-শিল্পের যে সঙ্কটের কথা বলা হয়ে থাকে তা কতটা প্রকৃত এবং কতটা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রভূত মুনাফা আদায়ের সাথে তূলনামূলক বিচারে মালিকদের মনোগত বিষয় তা হিসেব করে দেখা উচিত। এই নিবন্ধের বিষয় যেহেতু সুরমা তথা বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের সংগ্রামের ইতিহাস যাচাই করা, তাই শ্রমিকরা কী পরিস্থিতিতে বিদ্রোহ করেছিল তা এখানে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব।
         চা-শিল্পে সংকটের অজুহাতে মালিকপক্ষ শ্রমিক ছাটাই এবং জীবনধারনের সমস্ত সুযোগ সুবিধা বাতিল করতে শুরু করে। সুরমা উপত্যকার চা-শ্রমিকদেরকে এক ঢিপি চাল ৩ টাকা দরে প্রদান করা হত, সেক্ষেত্রে যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা সেই পরিমাণ চাল ৬ টাকা দরে বাজার থেকে কিনতে বাধ্য হয়। ভেজা চা-পাতা তুললে আর্দ্রতার পরিমাণ হিসেবে মূল ওজন থেকে ২৫-৫০ শতাংশ কমিয়ে ধরা হত এবং ফলে প্রকৃত মজুরি কমে যেত অনেকখানি। মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে মালিকপক্ষের এই ধরনের পদক্ষেপের ফলে শ্রমিক অসন্তোষের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, সুরমা ও আসাম উপত্যকার বিভিন্ন বাগানে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও ম্যানেজমেন্টের উপর আক্রমণের ঘটনায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সিলেট জেলায় প্রধানত করিমগঞ্জ সাব-ডিভিসনে শ্রমিকরা বাগান ছেড়ে সদল বলে বেড়িয়ে যাওয়ার মত সবচাইতে কঠোর পদক্ষেপ নেয় এবং এভাবে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এক রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে।    
             সংগ্রামের রূপ ও সংগ্রামী চেতনার উল্লম্ফনের নির্দিষ্ট কারণসমূহ – শ্রমিক ধর্মঘট ও গণহারে বাগান ত্যাগের ঘটনা শুরু হয় ৫ মে, ১৯২১। ইণ্ডিয়ান টি এসোশিয়েসনের ভাষ্য অনুযায়ী, চরগোলা ভ্যালি বাগানের কিছু মহিলা শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে হঠাৎ করে ধর্মঘট করতে শুরু করে এবং তাদের সাথে সহমর্মিতা জানিয়ে পুরুষ শ্রমিকরাও যোগ দেয়। এই ধর্মঘট দ্রুত আশপাশের বাগান ও ভ্যালিতে ছড়িয়ে পড়ে। মালিকদের তরফ থেকে কোন অনুকূল সাড়া না পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই চরগোলা ভ্যালির প্রায় ৫০% পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক এবং তাদের সাথে লঙ্গাই ভ্যালির এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যা দলবদ্ধভাবে বাগান ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এই শ্রমিকদের মোট সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৭০০০ থেকে ১০০০০। শ্রমিকরা প্রায় ৪০ কিঃমিঃ পায়ে হেটে করিমগঞ্জে আসে এবং সেখান থেকে চান্দপুরের উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরে। চান্দপুর থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত নৌকা করে যায় এবং সেখান থেকে আসানসোল যাওয়ার পর কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে। আসানসোলে তাদেরকে বেঁচে থাকার কোন রসদ না দিয়ে বলপূর্বক আটকে দেওয়া হয় এবং বাগানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়, কিন্তু কেউ ফিরে আসতে রাজী হয়নি। বিপিন চন্দ্র পাল তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখার বিরোধিতা করেন ও সরকারের কাছে রিলিফের দাবি করেন। অনুরূপভাবে বালিছড়া ভ্যালি চা-বাগানে ২৯ মে ধর্মঘট ঘোষণা করে শ্রমিকরা শ্রীমঙ্গল স্টেশনে চলে আসে, কিন্তু তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। এর পরপরই শ্রমিকদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গল ও মৌলভি বাজারে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়ে যায়। চা-শ্রমিকদের এই ধর্মঘট ও বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনার সাথে সাথে ইউরোপীয়ান কর্মচারীদের গৃহ-পরিচারিকারাও কাজ ছেড়ে দেয় এবং স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয়ানদের কাছে নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করতে অস্বীকার করে। এদিকে চান্দপুর স্টেশনে বাগান ছেড়ে চলে আসা শ্রমিকদের ভিড় ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সেই সময়ে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে যে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব যাতে কোন সভা না করতে পারে তারজন্য চান্দপুরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, কারণ প্রশাসনের ধারনা ছিল যে অসহযোগ আন্দোলনের সংগঠকদের উস্কানিতে শ্রমিকরা এধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। চান্দপুর স্টেশন থেকে হাজার হাজার শ্রমিকদেরকে বলপূর্বক ফিরিয়ে আনতে গোর্খা সৈন্য লেলিয়ে দেওয়া হয় এবং তাতে মহিলা-শিশু সহ বহু শ্রমিক আহত হয়। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে অন্যান্য শ্রমিকরা হরতাল ঘোষণা করে এবং এই হরতাল পূর্ব বাংলার অন্য শহরগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। চা-শ্রমিকদের সমর্থনে ২৪ মে আসাম রেলওয়ে শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দেয় যার সাথে চিত্তরঞ্জন দাশ ওতপ্রতোভাব জড়িত ছিলেন এবং শীঘ্রই তাদের সাথে স্টিমশিপ কোম্পানীর শ্রমিকরাও ধর্মঘটে সামিল হয়।
                 ব্রিটিশ প্রশাসন ও চা-মালিকরা চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট ও গণহারে বাগান ত্যাগের ঘটনার পেছনে তাদের মজুরির প্রশ্নকে স্বীকার করতে চায়নি, তারা অসহযোগ আন্দোলনকারীদের উস্কানিকে মুখ্য কারণ হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। ১৯২১-এর ৬ জুন দুর্লভছড়া প্ল্যান্টার্স ক্লাবে মালিকপক্ষ ও সরকারি অফিসারদের সভায় মজুরি ৬ আনা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সহমত পোষণ করা হলেও বিভিন্ন বাগানে শ্রমিক ধর্মঘট ও বাগান থেকে শ্রমিকদের বহির্গমণ অব্যাহত থাকে। ১৯২১ থেকে ১৯২২-এর প্রথম দিক পর্যন্ত চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট অব্যাহত ছিল। পরবর্তীতে মজুরির গ্রহণযোগ্য বৃদ্ধির মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত তখনকার মত চা-শ্রমিক ধর্মঘটের অবসান ঘটে। আসাম লেবার এনকোয়্যারি কমিটিও মজুরির প্রশ্নকেই মুখ্য কারণ হিসেবে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল।
                 ১৯২১-২২-এর সময়কালে সমগ্র আসাম ও পূর্ব বাংলায় চা-শ্রমিকদের সংগ্রামের পর্যায় হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু এই সংগ্রামে করিমগঞ্জ জেলার চোরগোলা ভ্যালি ও পরবর্তীতে লঙ্গাই ভ্যালির শ্রমিকরা বাগান ছেড়ে গণহারে বেরিয়ে পড়ার মত কঠোর সংগ্রামী পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে কিছু নির্দ্দিষ্ট কারণ ছিল। প্রথমত, ঐ বাগানগুলিতে শ্রমিকদের এক বড় অংশ ছিল হিন্দীভাষী চামার সম্প্রদায়ভুক্ত। এই শ্রমিকদেরকে মাত্র চার-পাঁচ বছর আগে উত্তর-প্রদেশ থেকে আনা হয়েছিল এবং ফলে তাদের রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতা ছিল অন্যান্যদের চেয়ে তূলনামূলকভাবে অধিক এবং তারা অন্যান্য চা-শ্রমিকদের মত চা-বাগানের শোষণযন্ত্রের অধীনে দীর্ঘকাল কাটিয়ে সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকারের স্তরে উপনীত হয়নি। বাগান ত্যাগ করে চলে যাওয়া চরগোলা ভ্যালির অর্ধেকের বেশি শ্রমিক উত্তরপ্রদেশের বাস্তি ও গোরোখপুর এই দুই জেলায় ফিরে যায়। এই হিন্দীভাষী শ্রমিক ছাড়াও মুণ্ডাদের মধ্যে একাংশ খ্রীষ্টান মিশনারিদের প্রভাবে শিক্ষার সংস্পর্শে এসে সচেতন হয়ে উঠেছিল। সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে স্থানীয় রেল-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ঘটনা চা-শ্রমিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে, কারণ যুদ্ধকালীন চা-ব্যবসায়ের উর্ধগতির পর্যায় থেকেই শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধোত্তর পর্যায়ে প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও মালিকপক্ষের কঠোর শ্রমিক-বিরোধী নীতির ফলে শ্রমিকরা অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। এই সময়কালেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের  সভা-সমিতি তাদেরকে আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠতে ইন্ধন যোগায়। দেশীয় বাবু স্টাফদের একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থনও শ্রমিকদেরকে নৈতিক সাহস যোগায়। করিমগঞ্জ সাব-ডিভিশনে বিশেষ করে চরগোলা ভ্যালির চা-শ্রমিকদের অ্যান্দোলন বাগান ছেড়ে গণহারে বেরিয়ে পড়ার মত রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করার পেছনে অসহযোগ আন্দোলনের সংগঠকদের প্রচারের যে পরোক্ষ প্রভাব ছিল তা অনস্বীকার্য। একটি সূত্র মতে, ১৯২১-এর ১ ও ২ মে রাতাবাড়িতে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য যে জনসভা হয়েছিল তাতে চরগোলা সহ অন্যান্য বাগানের শ্রমিকরাও যোগ দিয়েছিল।
              শ্রমিক স্বার্থ ও কংগ্রেস নের্তৃত্ব ঃ কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব শ্রমিক স্বার্থের চেয়ে এই ডামাডোলের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দরকষাকষির ফায়দা তুলতেই বেশি আগ্রহী ছিল। ১৯২১-এর ৮ জুন গান্ধী লেখেন “শ্রমিকরা মালিকদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাকে নেতৃত্ব দিতে কেউ যদি আমার নাম নিয়ে থাকে তাহলে আমি দুঃখিত......। পুঁজি বা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোন অসহযোগিতা চলছে না। এক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা চলছে”। তবে তাঁর এই বক্তব্য যে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিতে নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে লড়াইকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয় সেটাও তিনি পরিষ্কার করেন। তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থকে ব্রিটিশ পুঁজির স্বার্থ থেকে আলাদা করে দেখার কংগ্রেসী রণনীতি এখানে স্পষ্ট। তথাপিও শ্রমিকদের মধ্যে গান্ধীকে ত্রাতা হিসেবে হাজির করার প্রচেষ্টা হয় এবং শ্রমিকরাও তাদের আদিম বিশ্বাসে গান্ধীজীর অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার উপর ভরসা করে। যারা বাগান ছেড়ে চলে যায় তাদের অতি নগণ্য অংশই বাগানে ফিরে আসে। বহু শ্রমিক কলেরা ও না খেতে পেয়ে যাত্রাপথেই মারা যায়, অনেকে কলকাতার মত শহরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং বহু শ্রমিক দীর্ঘ রেল-জল ও পায়ে হাঁটা পথ অতিক্রম করে তাদের নিজ গ্রামে ফিরে যায়। যারা বাগানে থেকে যায় বা ফিরে আসে তাদের জন্য মজুরি বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে বেঁচে থাকার লড়াইর সাথে আধুনিক চাহিদার সংশ্লেষে সংগঠিত শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এক আদিম রূপের বিদ্রোহে এবং এভাবেই তার আপাত সফল সমাপ্তি ঘটে। এই বিদ্রোহের ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমি হয়ে রইল করিমগঞ্জের মত এক প্রত্যন্ত পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের চরগোলা ও লঙ্গাই ভ্যালি চা-বাগান। ১৯২১-২২ সালে সারা আসামে যে চা-শ্রমিক আন্দোলন হয় তার রেশ ১৯২৮ পর্যন্ত চলতে থাকে। এই পর্যায়ে বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক ধর্মঘট হয় এবং কোন একটি বাগানের ধর্মঘটে আশপাশের বেশকিছু বাগানও সামিল হয়।
             ১৯২১-২২-এর পর চা-শ্রমিক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় ঃ চা-শ্রমিকদের সংগ্রামী মেজাজের দ্বিতীয় পর্যায় দেখা দেয় ১৯৩৯-৪০ সালে। কুড়ি শতিকার ত্রিশের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত আসামে চা-শ্রমিকদের মধ্যে কোন ইউনিয়ন ছিল না। মালিকপক্ষও কোন ইউনিয়ন গড়ে ওঠার বিরোধী ছিল, কারণ শ্রম-শোষনের এক প্রধান ভিত্তি ছিল বাইরের জীবনের সাথে বিচ্ছিন্ন বাগানের ঘেরাটোপে চা-শ্রমিকদের আবদ্ধ জীবন। সুতরাং ইউনিয়নের নামে বাইরের লোকদের বৈধ অবাধ আনাগোনা চা-মালিকরা পছন্দ করত না। চা-বাগান অঞ্চল ছিল ম্যানেজারদের ব্যক্তিগত জায়গিরের মত যেখানে বাইরের লোকের প্রবেশের ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি নিতে হত। জাতিয়তাবাদী নেতৃত্বও ১৯২১-২২-এর ঘটনাবহুল চরগোলা এক্সোডাসের আগে চা-শ্রমিকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখায়নি। তাছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার মূল দুই জনগোষ্ঠী অসমীয়া ও বাঙালিরা চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী থেকে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আলাদা ছিল। উপরন্তু শ্রমিক ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে অন্যতম বাধা ছিল এই যে ম্যানেজার, সর্দার, চৌকিদার ইত্যাদির সম্মিলিত প্রশাসনিক কাঠামোর তত্ত্বাবধানে বাগানের বাইরে শ্রমিকদের যাতায়াত অবরুদ্ধ করে রাখা হত। ১৯৩৭ সালে আসাম বিধানসভায় ‘আসাম টি গার্ডেন লেবারারস ফ্রিডম অব মুভমেন্ট বিল’ পেশ করতে গিয়ে অমিয় কুমার দাস চা-শিল্পে এই ব্যতিক্রমি ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। তবে জাতিয়তাবাদী নেতৃত্বের চাপে মালিকরা পিছু হঠে ও ত্রিশের দশকের শেষে চা-বাগান ইউনিয়ন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। ১৯৩৯ সালে আবারও ব্যাপক আকারে শ্রমিক ধর্মঘট দেখা দেয় এবং মালিকপক্ষ ১৯২১-২২-এর মতই মজুরির প্রশ্নকে অস্বীকার করে ও ধর্মঘটের কারণ হিসেবে বাইরের নেতৃত্বের উস্কানিকে দায়ি করে। এই পর্যায়ে বরাক উপত্যকার শ্রমিক ধর্মঘটের সবিশেষ তথ্য এই নিবন্ধ লেখার আগে পর্যন্ত সময়াভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, কোন উৎসাহি পাঠক এব্যাপারে অনুসন্ধান করতে পারেন। তবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাপক আকারে চা-শ্রমিক আন্দোলন যে গড়ে উঠেনি তার কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – (১) কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে চা-মালিকদের সম্পর্ক (২) শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের সাথে কংগ্রেস মতাদর্শের অমিল। (৩) অভিবাসী চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সাথে অসমীয়া ও বাঙালি মধ্যশ্রেণির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব। (৪) চা-বাগানে শ্রমিক নিয়োগনীতি ও গরিষ্ঠাংশ জনজাতীয় ও তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় শ্রমিকদের প্রতি হিন্দু বর্ণশ্রেষ্ঠতার মানসিকতা প্রসূত অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য। সামগ্রিক এই পরিবেশের জন্যই মহীতোষ পুরকায়স্থের মত ব্যতিক্রমী কংগ্রেস নেতা চা-শ্রমিকদের অধিকারের বিষয় নিয়ে কাজ করলেও চা-শ্রমিকদের ইউনিয়নের সাংগঠনিক কর্তৃত্বে কখনওই অসমীয়া বা বাঙালি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরঞ্চ স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে বাবু-কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃত্ব থাকল বাঙালি কংগ্রেসি নেতার হাতে ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব কংগ্রেসি প্রাক্তণ চা-শ্রমিক পরিবারের নেতাদের হাতে। কংগ্রেস উভয় শ্রমিকদের আনুগত্য আদায়ে সুকৌশলে এই ব্যবস্থাকে বহাল রাখার রণকৌশল অবলম্বন করে। তবে চা-শিল্পে শ্রেণি-সম্পর্কের ধারাবাহিক পরিবর্তনের পর্যায়কে অনুধাবন করতে হলে চা-শিল্প পত্তনের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা চর্চা করতে হয়।                              
            চা-শিল্প ও অভিবাসী শ্রমিক ঃ নীল চাষ ও বাংলার কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে যে পরিসরে ইতিহাস চর্চা হয়েছে, চা-শ্রমিকদের জীবন ও বিদ্রোহ বিদ্বৎ-সমাজের সেরকম দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। চা-শিল্প, কৃষি-সমাজ, নাগরিক সমাজ ও আসামের অর্থনীতির মধ্যে এক কাঠামোগত দূরত্বই তার প্রধান কারণ। চা-শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনকে এমন এক কাঠামোয় আবদ্ধ করে রাখা হত যাতে তারা গ্রামীণ ও নগর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। চা-শিল্পে ব্রিটিশ পুঁজি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হত যা আঞ্চলিক উন্নয়নে বিশেষ কোন অবদান রাখতে না পারে। তবে চা-পণ্য চলাচলের জন্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেল ও সড়ক নির্মাণে প্রভূত বৃদ্ধি আঞ্চলিক অর্থনীতিতে পরোক্ষ প্রভাব ফেলে।
১৮৪০সালে প্রথম আসামে ব্রিটিশ গ্রাহক বাজারের জন্য চা-উৎপাদন শুরু হয়। তার আগে পর্যন্ত চীন ছিল একমাত্র ব্রিটিশ বাজারে চায়ের যোগানদার। ওয়াকার নামে এক ব্যক্তি ভারতের গভর্নর জেনারেল বেন্টিং-কে স্মারকপত্র প্রদান করেন। এই স্মারকপত্রে উল্লিখিত ব্রিটশ ও চীনের মধ্যেকার বাণিজ্য সম্পর্কের অবনতির উপর গুরুত্ত্ব দিয়েই বেন্টিং ১৮৩৪ সালের জানুয়ারীতে হিমালয়ান অঞ্চলে চা-চাষের নীতি নেন এবং চা-উৎপাদনের জন্য কলকাতার আফিম ব্যবসায়ী গর্ডনকে সেক্রেটারী ও কয়েকজন ইংরেজ প্রতিনিধি ছাড়াও রাধাকান্ত দেব, রাম কমল সেনের মত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি চা-কমিটি গঠন করেন। ১৮৩৮ সালের অক্টোবর মাসে আসাম ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। চা-উৎপাদনই ব্রিটিশ পুঁজির মালিকানাধীন প্রথম ও সর্ববৃহৎ বাগান-শিল্প যার মাধ্যমে বিশ্ব-পুঁজির সাথে ভারতবর্ষ প্রথমিক–উৎপাদক হিসেবে যুক্ত হয়। ১৮৩৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী ৫ লক্ষ পাউণ্ড পুঁজি নিয়ে লণ্ডনে আসাম কোম্পানী গঠিত হয় এবং প্রায় একই সময়ে ১০ লক্ষ টাকা নিয়ে জয়েন্ট স্টক কোম্পানী হিসেবে বেঙ্গল টি এসোসিয়েশন গঠিত হয়। কোম্পানীর কলকাতা শাখার ২৮০টি শেয়ারের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ১০০ ও মতিলাল সিলের ১০০ শেয়ার ছিল। ১৮৬৬ সালে কলকাতা বোর্ড বন্ধ হয়ে যায় এবং পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় লণ্ডনে।
              ১৮৪০-এর প্রথমদিকে চীনা শ্রমিকদের আসামে চা-শ্রমিক হিসেবে লাগানো হয়, কিন্তু এদেরকে আনা ও শাসন করা দুরূহ ছিল। জঙ্গল সাফাইয়ের জন্য স্থানীয় জনজাতিদের ব্যবহার করা হত, কিন্তু এই জনজাতীয় শ্রমিকরা বাগানের ঘেরাটোপে বাস করতে ও কড়া তত্ত্বাবধানে কম মজুরিতে চা-উৎপাদনের কাজ করতে রাজি হত না এবং নাজিরাতে তারা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনাও করেছিল। ১৮৫৪ সালে চা-উৎপাদনে জমি প্রদানের নিয়ম শিথিল করে দেওয়ায় চা-উৎপাদনে বিরাট গতি আসে। ১৮৬১ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে যে শুধুমাত্র কাছাড়েই ৫৫৮,০৭৮ একর জমি চেয়ে আবেদনপত্র জমা পড়েছে। এই বৃদ্ধিরফলে শ্রমিক চাহিদারও বৃদ্ধি ঘটে। সস্তায় মজুর খাটানোর জন্য ছোট-নাগপুর, নিম্ন বাংলা, বিহার ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের দক্ষিনাঞ্চল থেকে শ্রমিক আমদানী করা হয়, যে অঞ্চলকে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডী সাংস্কৃতিক ভূখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বাংলা থেকে শ্রমিক আমদানীর ক্ষেত্রে সেসময়ে বাংলায় চালু মজুরির হার থেকে বেশি দিলেই শ্রমিকরা আকর্ষিত হবে – সরকারের এই মতের সাথে চা-মালিকরা সন্তুষ্ট হয়নি। তাই প্রথম দু’দশক অর্থাৎ ১৮৬০ অব্দি শ্রমিক আমদানীর ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল। যে সব শ্রমিকদের আনা হত তাদের অধিকাংশই পালিয়ে যেত। চা-মালিকরা এই সমস্যার সমাধান করে অমানুষিক অত্যাচার ও আইন-বহির্ভুত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। ১৮৬২ সালের হিসাব অনুযায়ী  (লি রিপোর্ট) আসামের মোট ১৬০টি চা-বাগান ৬০টি কোম্পানীর মালিকানাধীন ছিল। এই মালিকদের মধ্যে ৫টি জয়েন্ট স্টক কোম্পানী, ১৫টি ব্যক্তিগত কোম্পানী এবং বাকীগুলো ব্যক্তির অধীনে ছিল। সেসময়ে লণ্ডন ও কলকাতায় নতুন নতুন কোম্পানী রেজিস্ট্রেশন করতে আরম্ভ করে। ফাটকাবাজরা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে কোনভাবে চা-বাগান খুলে দিয়ে, এমনকি অস্তিত্বহীন চা-বাগানও চা-বাগান বিক্রির বাজারে লণ্ডনের মালিকদের কাছে বিক্রি করতে আরম্ভ করে। ১৮৬০ সাল থেকে চা-শিল্প বাণিজ্যে যে রমরমা দেখা দেয় তাতে বিনিয়োগকারী ও ফাটকাবাজরা জমি ও চা-কোম্পানির শেয়ারের উপর প্রভূত মুনাফা করে। ৩০-৪০ একরের ছোট বাগান ১৫০-২০০ একরের বাগান হিসাবে লণ্ডনের মালিকদের কাছে বিক্রি হয়। চা-কোম্পানীর শেয়ার মূল্যের এই উর্ধগতি ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত চলে এবং অনেকগুলো কোম্পানী বন্ধ হয়ে যায়। 
             চা-চাষের বাড়বাড়ন্তের পরিস্থিতে যাকে ‘টি-ম্যানিয়ার’ পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সেই পর্যায়ে আসামের বাইরে থেকে স্টিমার যোগে দলে দলে শ্রমিক নিয়ে আসা হয়। চুক্তিবদ্ধ এই শ্রমিকদের নিয়ে আসার সময় অকথ্য অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাহিনী আফ্রিকার দাস ব্যবসায় দাসদের উপর অত্যাচারকেও হার মানায়। ১৮৬১-৬২ সালে শ্রমিকদের যাত্রাপথেই কলেরা ও অন্যান্য রোগে মৃত্যুর হার ৪০-৫০ শতাংশ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনধরনের চিকিৎসা, শৌচালয়, থাকা-খাওয়ার সু-বন্দোবস্ত না থাকা স্টিমারে গাদাগাদি করে যতজন বোঝাই করা যায় ততজন শ্রমিককে উঠিয়ে দেওয়া হয় এবং পথমধ্যে যাতে এই শ্রমিকরা পালিয়ে যেতে না পারে তারজন্য ঘেরাবন্দি করে রাখা হত এবং তাদের মধ্যে বিদ্রোহীদের দমাতে বেত্রাঘাতের মত শারিরিক নির্যাতন করা হত। এই অমানবিক শ্রমিক-বাণিজ্যে রাশ টানতে বেঙ্গল ন্যাটিভ লেবার এক্ট (তিন) অব ১৮৬৩ আইন প্রণয়ন করা হয়। এই দুর্বল আইনের বিধানগুলিও যথেচ্ছভাবে অমান্য করা হয়। এব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিশনের এক রিপোর্টে জে. ডবলিউ.এডগার ১৮৭৩ সালে মন্তব্য করেন যে আসামের চা-শ্রমিকদের অভিবাসনের সময় মৃত্যুর কাহিনী সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু সেটা কত নির্মম ও ভয়াবহ ছিল তা খুব কম সংখ্যক লোকেই অনুধাবন করত পারবে। এই রিপোর্টে তিনি লিখেছেন যে ১৮৬৩-এর মে মাস থেকে ১৮৬৬-এর মে মাস পর্যন্ত ৮৪,৯২৫ জন শ্রমিককে আনা হয় তারমধ্যে মাত্র ৪৯,৭৫০ জন বাগানে এসে পৌঁছয়।
স্থানীয় নাগা ও কাছাড়ি শ্রমিকদর জঙ্গল সাফাইয়ের কাজে লাগালেও তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্য    চা-বাগানের শ্রমিক হিসেবে নেওয়া হত না। উপরন্তু পূর্ত বিভাগের কাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় শ্রমিকদের মজুরিও বৃদ্ধি পায়। ফলে চুক্তিবদ্ধ অভিবাসী শ্রমিকরাই ছিল সস্তা মজুরির গ্যারান্টি। উপরন্তু চা-বাগানের অত্যাচারী শাসনের ঘেরাটপে আবদ্ধ থাকায় বাইরের পরিবেশের প্রভাবও তাদের উপর পড়ার সুযোগ ছিল না। ১৮৮৬ ও ১৮৭৩ সালের সরকারি অনুসন্ধানেও দেখা যায় যে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত বিধিসম্মত ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হত না।
           শ্রম-লুণ্ঠনের কাঠামো ঃ চা-শিল্পে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমের উপর পুঁজির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একটি কাঠামো ১৮৭০ সালের মধ্যেই গড়ে উঠে। ১৮৭০ পরবর্তী সময়ে কলকাতা কার্যালয় ও লণ্ডনের মূখ্য কার্যালয়ের মাধ্যমে চা-শিল্প ব্রিটিশ পরিচালকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৩৯ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট চা-উৎপাদনের ৭৫% নিয়ন্ত্রণ  কলকাতায় অবস্থিত মাত্র ১৩টি আগসারির এজেন্সি হাউসের হাতে। ১৯৪৮ সালের হিসাব অনুযায়ী আসামের ৯২% ও বাংলার মোট আবাদ জমির ৭৮%-এর প্রতিনিধিত্ব করে মালিকদের সংস্থা ইণ্ডিয়ান টি এসোসিয়েশন। চা-শিল্পের কাঠামোয় একেবারে চূড়ায় এধরনের এক একচেটিয়া শক্তি ও তাদের প্রভাবাধীন উপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং তলায় বাগান এলাকায় শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণে ম্যানেজারদের ভূমিকা ছিল গুরুত্ত্বপূর্ণ। এক নতুন পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে অভিবাসী চা-শ্রমিকরা ম্যানেজারের উপর ছিল সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আসামে চা-এর স্বার্থ মূলতঃ এক শ্রেণি স্বার্থ। ব্রিটিশ একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রিত চা-শিল্পে তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি ইংরেজ ম্যানেজার ও নেটিভ সহকারী শ্রেণি বলপ্রয়োগ ও আইন-বহির্ভূত পদ্ধতিতেই শ্রম-প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। ম্যানেজার ও শ্রমিকের মধ্যে নির্দেশাত্মক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চা-শিল্পে একধরনের ম্যানেজারিয়্যাল ভাষাও গড়ে উঠে। সিভিল সার্ভেন্ট এডগার প্রথম বলপ্রয়োগের এই পদ্ধতির উপর আলোকপাত করেন। ১৮৬৩ সালে কাছাড় ভ্রমণের বিবরণে তিনি লিখেন যে রোজকার কাজের নিরিখ (Task) পূরণ করতে না পারলে শ্রমিকদের বেঁধে রেখে বেত্রাঘাতের মত ঘটনা সচরাচর ও সর্বত্র ঘটত। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অপরাধে গ্রেপ্তার করার আইনী অধিকার বাগান-মালিকদের প্রদান করে সরকার এবং এভাবে ম্যানেজার শ্রেণির আইন-বহির্ভূত ক্ষমতাকে বৈধতা প্রদান করা হয়। মহিলা শ্রমিকরাও যে শারীরিক নির্যাতন থেকে রেহাই পেত না তারও উল্লেখ পাওয়া যায় ডবলিউ. এস. ফ্রেজারের লেখা থেকে, যিনি নিজে ছিলেন একজন প্ল্যান্টার। অধ্যাপক রমা প্রসাদ বিশ্বাস তাঁর লেখায় ইছাবিল বাগানের মহিলা শ্রমিকদের উপর ম্যানেজার ডসন-এর বর্বর অত্যাচারের কাহিনী বর্ণণা করেছেন। এই ভয়ানক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহুবার স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক বিদ্রোহও সংগঠিত হয়েছে।
১৯০১ সালের আইন ৬ গৃহীত হওয়ার পর লাইসেন্স ছাড়া সব শ্রমিক-সরবরাহকারীদের বাতিল করা হয় এবং বাগানের ভেতরে শ্রমিক সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে এক সর্দার শ্রেণি তৈরি করা হয় যারা কোন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই শ্রমিক নিয়োগ করতে পারত। ১৯৩০-এর বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দা, বিশের দশক থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনও তীব্র হয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭-এর মধ্যে ঐ সর্দারদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা শ্রমিক ইউনিয়ন, বাগানের ম্যানেজার ও বাবু (কেরানী), মালিকদের সংস্থা ইণ্ডিয়ান টি এসোসিয়েশন ও তাদের প্রভাবাধীন সরকারি প্রশাসন যন্ত্র এই সবের মিলিত এক কাঠামোর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে শ্রমিকদের উপর পুঁজি-মালিকদের আধিপত্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বিভিন্ন সময়ে মজুরি বৃদ্ধি ও ন্যূনতম মজুরি প্রদানের দাবি চা-বাগান শিল্পে রূপায়িত হয়নি।
         চা-শ্রমিক আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায় সত্তরের দশকের ভারতীয় রাজনীতির অস্থিরতা, ইমার্জেন্সি জারি ও পরবর্তীতে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জনতা দলের উত্থানের পরিবেশ     চা-শ্রমিকদেরও খানিকটা প্রভাবিত করে। ঐ সময় কংগ্রেসী ইউনিয়নের বিক্ষুব্ধ নেতা ভজনলাল বারৈর নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হয়। ১৯৭৮ সালে ভজন লাল বারৈ’র নেতৃত্বে আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ডলু বাগানে সিপিআই(এম-এল) দলের রুক্মিণী বর্মণের নেতৃত্বে এবং এই দলের শিলচরের চন্দন সেনগুপ্তের সহযোগিতায় বোনাসের দাবিতে শ্রমিক-ধর্মঘট হয়। কিন্তু সিপিআই(এম-এল) দল তাদের সেই সময়ের রাজনৈতিক লাইন অনুসারে কোন ইউনিয়ন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়নি। পরবর্তীতে এই দল ঝাড়খণ্ডী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে চা ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের তপসিলি জাতি/জনজাতির স্বীকৃতি ও মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। এই দাবিগুলির পেছনে ভিন্ন এক ইতিহাস ও যুক্তি রয়েছে যা এই নিবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়। যাইহউক, ডলু বাগানের ঘটনা ছাড়া এই প্রচেষ্টায় কোন উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের অন্য কোন ঘটনার কথা বর্তমান লেখকের জানা নেই। তবে ভজন লাল বারৈ ও তাঁর সহযোগীদের নেতৃত্বে এই পর্যায়ের আন্দোলন প্রচেষ্টার বিশেষ কিছু তাৎপর্য রয়েছে। চা-বাগানে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ, ভূমিহার, রাজপুত প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোকও ভাগ্যের খোঁজে বরাক উপত্যকার চা-বাগানগুলোতে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু পরে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা বাগান ছেড়ে আশেপাশের জমি আবাদ করে আবার অতীত জীবনে (কৃষিকাজে) ফিরে যান। শ্রমিকদের সাথে তাদের যোগসূত্রকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে এই সম্প্রদায় থেকেই কংগ্রেসী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব গড়ে উঠে। সত্তরের দশকের মধ্যে চা-শ্রমিকদের অবিসি সম্প্রদায় থেকে বেশ কিছু পরিবার বাগানের বাইরে আর্থিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ত্ব নির্ভর করে চা-শ্রমিকদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উপর, যেখানে ব্রাহ্মণ-ভূমিহার-রাজপুতরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। ভজন লাল বারৈ ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগ আসলে এই টানাপোড়েনেরই পরিণতি এবং সম্ভবত এই দুই শিবিরের আপস রফার মধ্য দিয়েই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে যেখানে চা-শ্রমিকরা ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। তবে এই ডামাডোলের পরিস্থিতিতে হাতেগোনা কয়েকটি বাগানে সিটুর নেতৃত্বে বামপন্থী ইউনিয়ন গড়ে উঠে। এই ইউনিয়নগুলি এখন প্রায় অস্তিত্বহীন। বামপন্থী ইউনিয়নের এই পরিণতির জন্য বাস্তব পরিস্থিতি যতটা না দায়ি, তারচাইতে বেশি দায়ি তাদের শ্রেণি-সমঝোতার রাজনীতি ও দিশাহীনতা।
           সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলন ঃ স্বাধীনতা-উত্তর সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের দীর্ঘ পর্যায়, বিগত কয়েক বছর পূর্বে চা-বাগানের বসত অঞ্চলকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করার ফলে গ্রামাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি (যদিও নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নামক এক নিয়ম একে অনেকটাই পঙ্গু করে রেখেছে), অতি-ক্ষুদ্র হলেও একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠা ইত্যাদির প্রভাবে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ঘটে এবং অন্যদিকে নয়া-উদারবাদী নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে চা-বাগান শিল্পের প্রশাসনিক কাঠামোয় বদলের ফলে বাবু ও সর্দারদের দাপট ক্রমশঃ ক্ষীয়মাণ হয়ে শ্রমিকদের শিবিরে চলে আসার প্রবণতা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় চা-বাগান শিল্পে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক নতুন লড়াই আসন্ন। তাই বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বাগানে বিক্ষিপ্ত শ্রমিক বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দার্বি, অরুণাবন্দ, ভূবনডহর, জালালপুর, নর্সিংপুর ইত্যাদি বাগানে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং সবগুলিরই ম্যানেজম্যান্টের পক্ষে আপসের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে। এই সব আপসের ক্ষেত্রেই সর্ববৃহৎ দাপুটে আইএনটিএউসির চা-শ্রমিক ইউনিয়ন মালিকপক্ষের ত্রাতার ভূমিকায় অব্তীর্ণ হয়, তবে শ্রমিকের পক্ষে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন, কোরাস, স্বাভিমান, বরাক হিউম্যান রাইটসের মত ছোট ইউনিয়ন ও সামাজিক সংগঠনগুলির হস্তক্ষেপও এবার পরিলক্ষিত হয়। এরকম ঘটার মুখ্য কারণ এই যে মালিক, ইউনিয়ন, সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, রাজনৈতিক দল ইত্যাদির যে কূটিল চক্র শ্রমিকদের উপর আধিপত্য বিস্তারে শক্তিশালী কাঠামো হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে তা বর্তমানে অনেকখানি দুর্বল হলেও বৃত্তের কোন এক জ্যা খসে পড়ে শ্রমিকদের মুক্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সুযোগ তৈরি করে দেয়নি। তবে আধিপত্য বজায় রাখার এই বৃত্ত ভেঙে পরার পরিস্থিতি তৈরি হতে শুরু করেছে, শ্রমিকদের ন্যায্য প্রয়োজন তাদের মনোজগতে চাহিদায় রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে আইএনটিইউসি ইউনিয়নের কাছে আন্দোলনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, তাই তারা আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করেছে শ্রমিকদের উপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। এপর্যায়ে চা-বাগান শ্রমিকদের মধ্যে এনটিইউআই (নয়া দিল্লি) অনুমোদিত অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন নামে আরেকটি ইউনিয়নের কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অতীতের আন্দোলগুলির মত এবারের আন্দোলনেরও কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি। এই মজুরি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট এবার খানিকটা বিচার করে দেখা যাক।
            চা-শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্ন ঃ ১৯৪৩ সালে প্রথম এবং পরে ১৯৪৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় ত্রিপাক্ষিক লেবার কনফারেন্সের পরামর্শ অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি নির্ধারনের জন্য যথাক্রমে রেগে কমিটি ও দেশপাণ্ডে কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়েও অনেকবার এই প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে। কিন্তু শক্তিশালী চা-লবির চাপে কখনওই তা কার্যকর হয়নি। মজুরির বিতর্ক পুনরায় উত্থাপিত হয়েছে। চা-শ্রমিকদের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন হিসেবে আইএনটিইউসি’র চা-শ্রমিক শাখা মালিকপক্ষের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে মজুরি নির্ধারণ করে। বিগত চুক্তির সময় বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে রাজ্য শ্রম আয়ুক্তের পক্ষে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার জন্য গুয়াহাটিতে সভা আহ্বান করা হয়। এই সভায় চা-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন ও বরাক চা-শ্রমিক ইউনিয়ন যোগ দেয়। প্রথম পর্যায়ের আলোচনা অমিমাংসিত থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের কোন ত্রিপাক্ষিক সভা ডাকা হয় না। বরাক চা-শ্রমিক ইউনিয়ন বাগান মালিকদের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে মজুরি চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলে। সেই চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের মজুরি ৭৫ টাকা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শ্রমিকদের জন্য অনুরূপ আরেকটি চুক্তি অনুযায়ী মজুরি ৯৪ টাকা ধার্য হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে রাজ্য সরকার ২০১৩ সালে যে ন্যূনতম মজুরি সূচী (Minimum wage schedule) ঘোষণা করে তাতে চা-শিল্পেরও উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং শ্রম-আয়ুক্ত যে ছয় মাস অন্তর অন্তর পরিবর্তনশীল মাগগি ভাতা (VDA) হিসেব করে মজুরি সার্কুলার জারি করেন তা চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়ার কথা। ২০১৩ সালের সূচী অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের মজুরি হওয়ার কথা ১৬৯ টাকা। ন্যূনতম মজুরি আইনের অর্থই হচ্ছে এই যে সেই আইন অনুসারে মজুরি বোর্ডের পরামর্শ মত সরকার কর্তৃক ধার্য করা মজুরির নীচে যে কোন চুক্তি অবৈধ ও বাতিলযোগ্য। ন্যূনতম মজুরির বেশি মজুরি প্রদানের জন্য ইউনিয়ন আন্দোলন ও চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে, অন্যথায় তা বেআইনি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রীর আহ্বানে চা-শিল্পের প্রশ্ন নিয়ে গুয়াহাটিতে এক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির প্রশ্নটি উত্থাপন করে এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রাজ্য সরকারের ঘোষিত সূচী অনুযায়ী মজুরি প্রদানের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করেন। ন্যূনতম মজুরির প্রশ্ন ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জারি করা বিধান, যাতে ভারতবর্ষও স্বাক্ষরকারী, এবং পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের সংযোজিত বিধান অনুযায়ী জীবনধারনের মজুরি (Living Wage) হিসেব করেছেন। এই হিসাবের বিস্তৃত এখানে তুলে না ধরে শুধু এটুকু উল্লেখ করছি যে একটি হিসাব অনুযায়ী এই মজুরি হওয়া উচিত প্রায় ৪২০ টাকা। সে যাইহউক, চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রেশনের সাথে মজুরির প্রশ্নটি কীভাবে জড়িয়ে আছে সে বিষয়টি তলিয়ে দেখা যাক। কোন শ্রমিকের মজুরি তিনভাবে দেওয়া যেতে পারে – নগদ অর্থে, সামগ্রীর মাধ্যমে কিংবা দুয়ের এক সংমিশ্রণের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, কারুর মজুরি যদি ২০০ টাকা হয়, তাহলে তাকে ২০০ টাকা না দিয়ে নগদ ১৫০ টাকা ও এক বেলা আহার দেওয়া যেতে পারে, সেক্ষেত্রে একবেলা আহারের মূল্য হতে হবে ৫০ টাকা। বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে নগদ ৭৫ টাকা মজুরি দেওয়া হয় এবং রেশনের সামগ্রী হিসেবে মজুরি দেওয়া হয় ১৪.২০ টাকা। পিএফ সংক্রান্ত এক বিষয়ের উপর হাইকোর্টের এক রায়ে হাজিরা হিসেবে রেশনের নগদ মূল্য শ্রমিক প্রতি দৈনিক ১৪.২০টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এই হিসাব কষা হলো এবার তা দেখা যাক। মালিকপক্ষ সরকারি ভর্তুকি মূল্যে এফসিআই থেকে কেজি প্রতি ৮.৩৬ টাকা ও ৬.১০ টাকা মূল্যে আটা ও চাল কিনে নেয় এবং তা কেজি প্রতি ৫৪ পয়সা দরে শ্রমিকদেরকে প্রদান করে। নিয়ম অনুযায়ী একজন শ্রমিক সপ্তাহে অর্ধেক চাল ও অর্ধেক আটা মিলিয়ে ৩.২ কেজি পাওয়ার কথা। পুরুষ শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও দুইজন অপ্রাপ্তবয়স্ক সপ্তাহে পাওয়ার কথা যথাক্রমে ২.৪৪ কেজি ও ১.২২ কেজি, মহিলা শ্রমিক যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা পাবে শুধু দুইজন অপ্রাপ্তবয়স্কের বরাদ্দ। সেই ভিত্তিতে হিসাব অনুযায়ী ১৪.২০ টাকা রেশনের সামগ্রী হিসাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকদেরকে দৈনিক মজুরি দেয়।
             সম্প্রতি রাজ্য সরকার চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারনের জন্য মজুরি পরামর্শ বোর্ড গঠন করে এবং দীর্ঘ আলোচনার পর সরকার চা-শ্রমিকদের জন্য ১৭৭ টাকা মোট মজুরি এবং সামগ্রী ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা হিসাবে প্রদেয় মজুরির অর্থমূল্য বাদ দিয়ে নগদ দৈনিক মজুরি ১৪৩ টাকা ধার্য করে। এব্যাপারে কারুর আপত্তি থাকলে তা জানানোর জন্য দুই মাস সময় দেওয়া হয়। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় এক অন্তবর্তীকালীন চুক্তির মাধ্যমে ইতিমধ্যে মজুরি ১১৫ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু বরাক উপত্যকার মজুরি ৭৫ টাকায় রয়ে গেছে। একই রাজ্যের দুই উপত্যকায় চা-শ্রমিকদের সমান মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ বিভিন্ন ধরনের ওজর-আপত্তি হাজির করে যার কোনওটাই যুক্তিগ্রাহ্য নয়, অথচ আইএনটিইউসি ইউনিয়ন তা মেনে নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেয়। ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বদলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মজুরি নির্ধারনের সুবিধে হলো এই যে তাতে সরকারের কোন আইন ভঙ্গের দায়বদ্ধতা থাকে না। শ্রম-দপ্তর কোন অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখতে যে সময় লাগে তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগকারীর প্রচেষ্টা আর আব্যহত থাকে না। সুতরাং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির প্রক্রিয়াটিই বাতিল করা উচিত। এবারের চা-শ্রমিকদের আন্দোলন বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সমান মজুরি ও ন্যূনতম ১৪৩ টাকা নগদ মজুরি ও যে তারিখ থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শ্রমিকদের ১১৫ টাকা দেওয়া হচ্ছে সেই তারিখ থেকে বকেয়া এরিয়ার প্রদান ইত্যাদি দাবি আদায়ে সক্ষম হয় কিনা তা দেখার বাকি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে চা-শিল্প হচ্ছে একমাত্র শিল্প যেখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি দেওয়া হয় না। বরাক উপত্যকার চা-শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়ার সপক্ষে মালিকপক্ষের প্রধান যুক্তি হচ্ছে এই যে নিলাম বাজারে বরাকের চায়ের দাম কম, অথচ জমির খাজনা যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার তূলনায় বরাক উপত্যকায় অনেক কম একথাটি মালিকরা সযত্নে চেপে যায়। অন্যান্য রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে তূলনা করলে এই যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়ে যায়। তামিলনাড়ু, কেরালা ও কর্নাটকে চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি যথাক্রমে ২০৬.২২ টাকা, ২২২.৯৭ টাকা ও ২২৮.৩৫ টাকা। উৎপাদিত চায়ের পরিমাপের হিসাবে শ্রমিক-প্রতি উৎপাদনশীলতা আসামের ক্ষেত্রে ৭০৫ কেজি, অন্যদিকে তামিলনাড়ু ও কেরালায় যথাক্রমে ৬১৩ ও ৬৮৮ কেজি। ২০১২-১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী নিলাম বাজারে আসাম ও পশ্চিমবাংলার চায়ের মূল্য ১৪২ টাকা, অন্যদিকে উল্লিখিত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির চায়ের মূল্য ৯৩ টাকা। অর্থাৎ শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও নিলাম বাজারে চায়ের মূল্য দক্ষিণ ভারতের চা-শিল্প থেকে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানকার শ্রমিকরা অনেক কম মজুরি পায়। উপরন্তু সর্বভারতীয় গড় হিসেবে নিলাম বাজারে যায় মোট উৎপাদিত চায়ের মাত্র ৪৪% ও অন্যদিকে কোনও লেখা-জোখা না রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে যথেচ্ছ চা-এর যোগান দিয়ে এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক চতুরালির মাধ্যমে লাভের অঙ্ক রূপকথা অঙ্কে নিয়ে যায় চা-বানিয়ারা। সুতরাং শ্রমিকরা যাতে মালিকদের এই যুক্তিতে বিভ্রান্ত না হোন তারজন্য ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।  সবশেষে দুটি গুরুত্ত্বপুর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার খানিক চেষ্টা করে এই নিবন্ধ শেষ করব।
             শ্রম-প্রক্রিয়া ও পুঁজি বিনিয়োগ: চা-শিল্প পত্তনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় শ্রম প্রক্রিয়ায় কী কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি? ব্রিটশ জামানায় শ্রম-শোষণের বা মার্কসীয় ভাষায় উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য আহরণের ক্ষেত্রে পুঁজি বহুলাংশে নির্ভর করত বলপ্রয়োগ বা অর্থনীতি বহির্ভূত শোষণের উপর। উপরন্তু চা-বাগান গড়ে উঠেছিল মূলত প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় যেখানে শ্রমিকরা বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক খাদ্য অত্যন্ত কম পরিশ্রমে সংগ্রহ করার ফলে প্রয়োজনীয় শ্রমের মূল্যকে কমিয়ে রাখার সহায়ক ছিল। এই দ্বিবিধ কারণে চা-শিল্পে নিয়োজিত পুঁজির কাছে শ্রম শক্তির ব্যবহারিক মূল্য ও উদ্বৃত্ত মূল্য (মুনাফা) ছিল অত্যন্ত বেশি। স্বাধীনতা-উত্তর দীর্ঘ পর্যায়ে পারিপার্শ্বিক উন্নয়নের ফলে প্রাকৃতিক খাদ্য আহরণের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসায় চা-শিল্প থেকেই শ্রমিকদেরকে মজুরি হিসেবে পাওয়া প্রয়োজনীয় শ্রমের মূল্যের উপরই জীবনধারণ নির্ভরশীল। ব্রিটিশ আমলের প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগ বন্ধ হয়ে গেলেও অপ্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগের নানা প্রাতিষ্ঠানিক কূটচাল এখনও বজায় রয়েছে এবং শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা প্রসূত দক্ষতার বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ‘নিরিখ(task)’ বৃদ্ধিও অন্তিম সীমায় পৌঁছে গেছে। জাতিগত শোষণের অবশিষ্ট চরিত্র বজায় থাকায় চা-শ্রমিকরা এখনও সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত। কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের ফলে এভাবে ন্যূনতম মজুরি না দিয়ে আর বেশিদিন থাকা যাবে বলে মনে হয় না। শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা বৃদ্ধির জন্য পুঁজি-মালিকদের নতুন চারা-গাছ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু চা-শিল্পের মালিকরা এই বাড়তি বিনিয়োগের বদলে জোরজবরদস্তী ‘নিরিখ’ বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী। মালিকদের এই ভূমিকা শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষকে অদূর ভবিষ্যতে আরও তীব্র করে তুলবে।দ্বিতীয়ত, চা-শিল্পে পুঁজি বিনয়োগ ও স্থানীয় অর্থনীতি এবং বরাকের বাঙালি মধ্যশ্রেণির সাথে  চা-শ্রমিকদের আন্তঃসম্পর্ক কী?  চা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হওয়ায় শিলচর এলাকা শহর হিসাবে গড়ে উঠার ক্ষেত্রে গুরুত্ত্ব পায়, কিন্তু শহর হিসেবে বিকশিত হওয়ার ও শহরের বাঙালি মধ্যশ্রেণি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই শিল্প-পুঁজির বিশেষ কোন অবদান নেই। কারণ চা-শিল্প থেকে যে মুনাফা হয় তা পুঁজি হিসেবে আর স্থানীয়ভাবে পুনর্বিনয়োগ হয় না, এই পুঁজি চলে যায় এই এলাকার বাইরে। কলকাতা ও শিলচরের গুটিকয় বাঙালি চা-বাগান মালিক আছেন। কিন্তু চা-বাণিজ্যের সাপ্লাই চেইনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থেকে মুনাফার বড় অংশ শুষে নেয় দুটি বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানী - হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড ও টাটা গ্লোবাল বিভারেজ লিমিটেড। শিখরে এই দুটি কোম্পানী ও চা-ফ্যাক্টরির মাঝখানে যারা মুনাফার অংশীদার হয় তাদের মধ্যে বাঙালি মধ্যশ্রেণির অবস্থান খুবই নগণ্য, বরাক উপত্যকাতে তা প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমনকি চা-শিল্পের সদর-দপ্তর কলকাতায় অবস্থিত হওয়ায় এই শিল্পকে কেন্দ্র করে কোন চাকুরীর সুযোগ তৈরি হয়নি। সিলেট ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রাথমিকভাবে বাগানে বাবুর চাকরি করতে আসা লোকদের বাইরে আর কোন নিয়োগ হয়নি, বরঞ্চ বর্তমানে এদের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে গেছে এবং তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও অপ্রতুল। প্রথমদিকে তাদের বাবু মর্যাদা বজায় রাখতে শ্রমিকদের সাথে এক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেন এবং নিজেদেরকে ম্যানেজম্যান্টের লোক ভাবতেন। এদের একাংশের ভূমিকায় শ্রমিকদের মধ্যে বাবু-বিরোধিতার এক মানসিকতা ছিল যাকে রাজপুত-ভূমিহার-ব্রাহ্মণ শ্রমিক নেতারা ব্যবহার করতেন। কিন্তু দেখা গেছে শ্রমিকরা যখন কোন আন্দোলনে নেমেছে তখন এই বাবুরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যেমনটি হয়েছিল ১৯২১-২২ সালে। ক্লাসিক্যাল শ্রেণি চরিত্রের একেবারে জ্বলন্ত উদাহরণ। চা-শ্রমিক পরিবার থেকেও যারা পরবর্তীতে বাবু হয়েছেন এব্যাপারটি তাদের ক্ষেত্রেও অনেকখানি প্রযোজ্য। বরাক উপত্যকার দোকানদাররা          চা-পাতা বিক্রি করে কমিশন পান, এছাড়া চা-বাণিজ্য ও শিল্পে বিনিয়োজিত পুঁজির সাথে তাদের কোন সরাসরি অর্থনৈতিক যোগসূত্র নেই। বরঞ্চ তাদের যোগসূত্র রয়েছে শ্রমিকের আয়-বৃদ্ধির সাথে, কারণ শ্রমিকরা স্থানীয় বাজার থেকেই নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয় করে। সুতরাং শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সাথে বরাকের মধ্যশ্রেণির একাত্ম হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠেনি সামজিক-সাংস্কৃতিক দূরত্ব থেকে সৃষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজের অনীহার জন্য। এই অনীহার বাতাবরণ আরেকটি সত্যকে উন্মোচিত করে যে বরাক উপত্যকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্য খুবই দুর্বল। সুতরাং সামগ্রিক পরিস্থিতির আমূল গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্যও জোরদার এক শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠা খুবই জরুরি। পরিস্থিতি এই আন্দোলনের দিকেই ইঙ্গিত করছে, বাবুদের অবস্থাও এখন খুবই শোচনীয়, শ্রমিকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া তাদের আর কোন পথ খোলা নেই।
তথ্যসূত্র ঃ
Articles :
(1)   Coolie exodus from Assam’s Chorgola valley, 1921, by Kalyan K sarkar, EPW.
(2)   Form of labour protest in Assam Valley Tea Plantation, 1900-1930, by Rana P Behal, EPW.
(3)   Wages of tea plantation workers, Sharit K Bhowmik, EPW
Books :
(4)   Unfolding crisis in Assam’s tea plantations, Deepak K Mishra, Vandana Upadhay, Atul Sharma.
(5)   One hundred years of servitude, Rana P Behal.
(6)   বরাক উপত্যকায় চা-শ্রমিকদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, রমা প্রসাদ বিশ্বাস।
Others :
(7)   Brewing misery : Condition of working families in tea plantation in West Bengal and Kerala : Centre for workers’ management.
(8)   Field study of Chorus and Asom Mojuri Shramik Union.



      




কোন মন্তব্য নেই: