“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

একটি পত্র

 মধুমিতা নাথ
মেইল বক্স থেকে
----------------------

ম্যাম ,

প্রণাম তুমি নিতে চাওনা , জানি। কিভাবে যে শুরু করি ! তুমি ভালো আছো ? জানি বলবে ---" বিন্দাস!"। আমি ভালো নেই। এবার তুমি আমায় একচোট বকুনি দেবে। "উল্লুক" , "মুরগি চোর" , "ন্যাকা চৈতন্য" ...। কতদিন হলো তোমার মিষ্টি বকুনিগুলো খুব মিস করি।

তুমি বলতে --- "সবসময় বলতে হয় ভালো আছি। ভালো থাকাটা একটু কঠিন ঠিকই। সবাই পারে না। আর সবাই যা পারেনা সেটা করতে পারাটাই তো আনন্দের " ।

          কি অসম্ভব মনের জোর গো তোমার ! সবসময় হাসিমুখে থাকো কি করে ? তোমার কি কোনো সমস্যাই নেই ! কোন অসুখ বিসুখ ! তোমাকে আমরা বলতাম "IRON LADY" । কি সুন্দর পড়াতে তুমি ! তোমার প্রিয় চরিত্র শরৎ চন্দ্রের 'ইন্দ্রনাথ'। বলতে --- "ইন্দ্রনাথ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে সৃষ্ট এক অদ্ভুত সৃষ্টি"। কি সুন্দর লাইন। এখনো কানে বাজে।কত বলবো আর !

          আমাদের নিয়ে ভলিবল খেলতে। টুয়েলভ ক্লাসে পড়ার সময় স্কুলে সে বছর প্রথম আমরা মেয়েরা ভলিবল চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম টিচারদের হারিয়ে দিয়ে। কি দারুণ ভালো লাগা। সেতো তোমার প্রেরণায় , তোমার চেষ্টায়! ! তারপর "ডাকঘর" নাটক ! "চণ্ডালিকা" তে আমাকেই তুমি প্রধান চরিত্রে সিলেক্ট করেছিলে। নাচ শেখালে , গান শেখালে , হাসতে শেখালে , বাঁচতে শেখালে।

            যে কারণে তোমায় লিখতে ইচ্ছে হলো। বাঁচতে ভুলে যাচ্ছি। বাবার গলায় টিউমার অপারেশন হয়েছে। বিছানায় শয্যাশায়ী। মা নার্সারী স্কুলের ছোট্ট চাকরীটা এখনও করছেন। দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে সারা গায়ে মার খাওয়ার চিহ্ন নিয়ে। আর যাবে না। আমি অনার্স গ্র্যাজুয়েশন নিয়েছি দু'বছর হলো। এম এ করা আর হলো না। ছোট্ট একটা প্রাইভেট এজেন্সিতে ঢুকেছি। দশটা- পাঁচটা। মাস ফুরোলে সাড়ে নয় হাজার। শহরে একটা মেয়ে একলা থাকার মতো ভাড়াবাড়ি পেতে কতটা কষ্ট  তা জানো। এক হাজার তো বাড়ি ভাড়াই দিতে হয়। নিজের খরচ চালিয়ে বাকিটা মা'কে পাঠাই। একটা ভালো চাকরীর আমার ভীষণ দরকার। একটার পর একটা চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছি। কিচ্ছু হচ্ছে না। সবখানে tough কম্পিটিশন। আমার মতো মধ্য-মেধার ছেলেমেয়েদের যে কি দুরবস্থা জানো ! বাবা বিয়ের কথা ভাবছে। মা রেগে যায়। বলে ---"এক মেয়ে বিয়ে দিয়ে আক্কেল হয় নি ! বহ্নি'র বিয়ে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ওকেই ভাবতে দিও"।

        ম্যাম , আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা একটা ভালো চাকরী ছাড়া। morality তো তুমিই বানিয়ে দিয়েছো এমন।  বাবার ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু শরীর , মায়ের কর্মক্লান্ত সংসার , দিদির ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ---- ওসব দেখতে হয় বলে বাড়ীতে খুব কম যাই । জয়দীপেরও কোন চাকরী হচ্ছে না। তাছাড়া ওরও তো ফ্যামিলি বার্ডেন আছে । সেদিন তুমি আমায় সিরিয়াসলি খুব বকলে। না , ওই মিষ্টি বকুনি নয়। আমি বলেছিলাম শুধু যে ----''মাঝে মাঝে মনে হয় এই দেশটাই আমার নয়। রিজার্ভেশন এর পর আমরা যারা বেশির ভাগ আছি তাদের কথা এই দেশটা কবে ভাববে ? মনে হয় বিদেশে পালাই। গিয়ে রেস্তোরাঁয় কাজ করি। কিংবা পেট্রোল পাম্পে। টাকা তো আসবে ! আমার যেকোন মূল্যে টাকা চাই !"

            তুমি আমায় "স্বার্থপর" বললে। "এঁচোরে পাকা" বললে। "ESCAPIST"  বললে।  আরও বললে দেশকে ভালবাসতে শিখিনি। কেন ? কি অন্যায় কথা বলেছি আমি ? কোন কবি যখন বলেন --" এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয় । এ জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ নয় ..." তখন তুমি তা আবৃত্তি করে শোনাও। আবেগে তোমার চোখে জল চিকচিক করে। আর আমার কথায় তোমার আমাকে স্বার্থপর মনে হলো ? কেন ? আমি কবিতা লিখতে পারি না বলে ? পারি না তো ! আমি সোজাসাপ্টা বলি। "পাথরকে পাথর , গাছকে গাছ"।

            আমায় ক্ষমা করে দিও। এই প্রথম তোমাকে আমি অভিযুক্ত করলাম। তুমি আসলে আমাকে অভিনয় করে যেতে শিখিয়েছিলে। হাসি না পেলেও হাসবে। ভালো না থাকলেও বলতে হবে ভালো আছি -- "বিন্দাস" । কেন মিথ্যে বলতে শেখালে। তোমার মতো আয়রন হতে পারিনি। আমি দুর্বল। ভাঙছি। রোজ একটু একটু করে।

ভেঙে যেতে যেতেও তোমায় মনে পড়ে। তাই লিখছি। আবার স্কুলের দিনগুলোতে ফিরতে ইচ্ছে করে। যেখানে তোমার হাসিটাকেই সত্যি মনে হতো। তুমি সাহস জোগাতে। "বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা / বিপদে আমি না যেন করি ভয় ..."

তুমি রাগ করো না। মাথার ঠিক নেই। আবোল তাবোল অনেক বললাম। জানি , তুমিই ঠিক। বুঝতে পারছি , কতটা আঘাত সহ্য করলে তোমার মতো সবসময় হাসতে পারা যায়। বাঁচতে পারা যায়। তোমার হাতটা আরেকবার আমার মাথায় রাখো। আমি ভাঙতে চাই না। তোমার মতো "আয়রন" হতে চাই। পাশে থেকো , যেমন এতদিন ছিলে।

                     ইতি ------
                    তোমার একসময়ের সেরা ছাত্রী ,
                               
                                        বহ্নি
03/02/2017

              -------------------//-----------------

কোন মন্তব্য নেই: