।। রজত কান্তি দাস।।
বিবর্তনবাদের রঙ্গমঞ্চে চার্লস ডারউইনের প্রবেশ
বিবর্তনবাদ ডারউইনের জীবনে কোন নতুন কিছু নয় কারণ তাঁর পিতামহ এরাসমাস
ডারউইন এ বিষয়ে প্রথম বই লিখে
খ্যাতি অর্জন করেন। চার্লসের বাবা রবার্ট ডারউইন ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ও মাতামহ ওয়েজউড চিনামাটির কারখানা করে
বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন।
রবার্ট ডারউইনের কনিষ্ঠ পুত্র চার্লস ডারউইনের আট বছর বয়সেই মাতৃবিয়োগ ঘটে। তা সত্ত্বেও দিদি, দাদা ও মামাবাড়ির ছত্রছায়ায় তাঁর ছোটবেলায় তিনি
স্বর্ণযুগ কাটিয়েছেন। উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বিলাসব্যসনের মধ্যে শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলি কাটালেও
চার্লসের প্রজাপতি,
কীটপতঙ্গ,
পাখির ডিম
ইত্যাদির নমুনা সংগ্রহের বাতিক ছিল। তবে প্রথাগত শিক্ষার প্রতি তাঁর অনাগ্রহ আমাদের রবীন্দ্রনাথের
কথাই মনে করিয়ে দেয়। চার্লসের এই
প্রাণীদেহ সংরক্ষণের বাতিক যে একদিন জীববিজ্ঞানে বিপ্লব এনে দেবে তা কেউ ভাবতে পারেন নি। তাই তাঁর স্কুলের
হেডমাস্টার যেমন এই কাজের জন্য তাঁকে
বকাবকি করতেন, তেমনি বাড়ির লোকেরাও বিরক্ত হতেন।
ডাক্তারি পড়ার জন্য চার্লস ডারউইন গিয়েছিলেন এডিনবারায়
কিন্তু হাসপাতালে শল্য চিকিৎসার
ধরণ দেখে দু’বছর পরই পালিয়ে আসেন। ডাক্তারি আর পড়া হয় নি। এ ব্যাপারে আমরা গ্যালিলিওর কথা স্মরণ করতে পারি কারণ তার
ক্ষেত্রেও ঠিক একই জিনিস হয়েছিল।
পুত্রের ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেওয়ায় চার্লসের বাবা দুঃখিত হন এবং উপায়ান্তর না পেয়ে তাঁকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের
অন্তর্গত খ্রাইস্ট চার্চ কলেজে
ভর্তি করিয়ে দেন ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য। উদ্দেশ্য ছেলেকে গির্জার
পাদ্রী বানানো। খ্রাইস্ট চার্চ কলেজের রেকর্ডসে চার্লস ডারউইন খুব সাধারণ মানের ছাত্র হলেও প্রথাগত এইসব শিক্ষার
সঙ্গে প্রথা বহির্ভূত
জ্ঞানলাভের একটি ধারাও তাঁর মধ্যে সদা জাগ্রত ছিল। মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। কারণ
যিনি পুরনো প্রথা ভেঙ্গে নতুন নিয়মের পরিচায়ক হবেন তিনি কলেজের সিলেবাসে আটকে থাকবেন এটা স্বাভাবিক নয়। তাই তিনি
কলেজের বাইরে নবলব্ধ এক
ভূতাত্ত্বিক ও দু’জন প্রাণীবিদ বন্ধুদের সঙ্গে অবসর সময়ে এডিনবারার আশেপাশে ক্ষেত্র সমীক্ষায় বেরিয়ে পড়তেন। বিভিন্ন
প্রাণীর নমুনা সংগ্রহের শখ তাঁর
চিরকালই ছিল। কলেজে পড়ার সময়েও প্রাণীসংগ্রহশালার অধিকর্তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেন নানা ধরণের প্রাণী সংগ্রহের
কাজে। বস্তুত এই প্রাণী সংগ্রহের
উপর ভিত্তি করেই তিনি তাঁর ক্রমবিকাশতত্ত্বের ব্যাখ্যা খুঁজে পান।
এডিনবারার পর কেমব্রিজে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়ার সময়ও হেন্সলোর মতো জীব
বিজ্ঞানীর সান্ধ্যভ্রমণের সময়েও ডারউইন ছিলেন তাঁর নিত্য সহচর। এই হেন্সলোর পরামর্শেই ডারউইন উত্তর ওয়েলসে
ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা শিখতে গিয়েছিলেন,
যদিও তাঁর বিষয়
ছিল ধর্মতত্ত্ব। তাই মনে হয় ধর্মতত্ত্ব বিষয়টি ডারউইনকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই প্রথা
বহির্ভূতভাবেই প্রাণিবিদ্যা ও ভূতত্ত্বের বিষয়ে তাঁর মন চলে গেছে বারবার। এই প্রথা
বহির্ভূত শিক্ষাই শেষ পর্যন্ত
তাঁকে খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। অন্যথায় হয়ত নিকোলাস স্টেনোর মত এক পাদ্রীর জীবনই কাটাতেন তিনি।
ডারউইনের সমুদ্রযাত্রার আমন্ত্রণ
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন
ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে তখন সারা
বিশ্বজুড়ে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও বাড়তে শুরু করে। তাই সাম্রাজ্য রক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তাগিদে গোটা পৃথিবী
জুড়ে জরিপের কাজ সম্পন্ন করা
জরুরি হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ অ্যাডমিরেলিটি আমেরিকা ও মহাসাগরীয়
দ্বীপগুলিতে ক্রোনোমিটার ঘড়ির সাহায্যে জরিপের কাজ শুরু করেছিল। তাই ১৮৩১ সালের
২৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ক্যাপ্টেন ফিজরয়ের নেতৃত্বে ‘এইচএমএস বিগল’ (HMS Beagle, HMS মানে হলো Her Majesty's service)
নামের জাহাজটি ইংল্যান্ড থেকে
যাত্রা শুরু করে। প্রায় পাঁচ বছরব্যাপী যাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে বেরোনো জাহাজটিতে লন্ডনের গ্রিনিচ মানমন্দিরের সঙ্গে
সময় মেলানো কতকগুলো ঘড়ি ছিল
কারণ জাহাজটি যে দ্বীপে যাবে সেখানের স্থানীয় সৌরসময়ের সঙ্গে ওই ঘড়িগুলোর সময়ের তফাৎ দেখে ঐ স্থানের দ্রাঘিমা গণনা
করা যাবে। এই কাজ সম্পন্ন হলে
অন্যান্য জাহাজের ক্যাপ্টেনরা মহাসাগরে পাড়ি দেবার সময় কম্পাসযন্ত্র ও ক্রোনোমিটারের সময়ের সঙ্গে নিজেদের ঘড়ি
মিলিয়ে তাদের অবস্থান বুঝতে
পারবেন।
এই জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিজরয় ছিলেন বাইবেলীয় বিজ্ঞানে
অত্যন্ত বিশ্বাসী ও সজ্ঞানে আধুনিক
বিজ্ঞান বিরোধী। ওই বছরেরই গোঁড়ার দিকে চার্লস লিয়েল ভূতত্ত্ব বিষয়ে বই লিখে মহাপ্লাবন, পৃথিবীর আয়ু ইত্যাদি বিষয়ে বাইবেল বিরোধী মনোভাব
নেওয়ায় ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং গির্জা আধিকারিকরা নানা ধরণের সভা-সমিতি করে লিয়েলের নিন্দায় মুখর হয়েছিলেন।
ফিজরয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত
ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি ভাবলেন যে তাঁর বিশ্বপরিক্রমায় তিনি যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে
লিয়েলের মুখে ঝামা ঘষে দেবেন। এই উদ্দেশ্যে তার এমন একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হয়েছিল যিনি তাকে বাইবেলীয় মত
প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবেন।
ফিজরয় তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনপন্থী উদ্ভিদ বিজ্ঞানী তথা ধর্মযাজক জন স্টিভেন হেন্সলোর শরণাপন্ন হন। এই
হেন্সলোর পরামর্শেই ফিজরয়
চার্লস ডারউইনকে তার সঙ্গী হিসেবে মনোনীত করেন। ডারউইনকে মনোনীত করার দুটো কারণ ছিল। একে তো তিনি অত্যন্ত
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সেই সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে গ্রাজুয়েট। তাছাড়া প্রকৃতি
বিজ্ঞানেও ডারউইনের আগ্রহ ও
ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় উৎসাহ দেখে ফিজরয় যে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এতে কোন সন্দেহ
নেই। তবে ফিজরয়ের এই নির্বাচন যে বুমেরাং হয়ে বাইবেলীয় বিজ্ঞানকেই ধরাশায়ী করেছিল তা আজ আর কারো জানতে বাকি নেই।
ফিজরয় তাঁকে মনোনীত করায় ডারউইন উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিলেন মূলত
অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। শিকারের নেশা তো
তাঁর ছিলই। প্রায়ই তিনি বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেন নেকড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। এই অভিযানে নেকড়ে শিকারের
পরিবর্তে নানা ধরণের উদ্ভট জীব
শিকারের নেশাও তাঁকে প্ররোচিত করছিল। অভিযানের প্রথম দু’বছর তিনি শিকারও করেছিলেন। পরে বন্দুকটি এক অনুচরের হাতে দিয়ে
পশুপাখিদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের কাজ
শুরু করে দেন। এই পর্যবেক্ষণই তাঁকে ক্রমবিকাশতত্ত্ব ও নতুন প্রজাতির উদ্ভবের কারণ আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন