।। চিরশ্রী দেবনাথ ।।
শ্রাবণ এক ঝরঝর অনুভব, আমার কাছে রবির সঙ্গে। কবি তাঁর দীর্ঘ জীবনের সবকটি
গ্রন্থি যেন
শ্রাবণের ধারার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন জলজ আনন্দে। বর্ষা রবিজীবনের নিরবিচ্ছিন্ন ঋতু।
শুধুমাত্র বর্ষাকে অবলম্বন করে , আষাঢ়
ও শ্রাবণ মাসকে কেন্দ্র
করে কবি একশো পনেরটি গান রচনা করেছেন, যা
তার প্রকৃতি বিষয়ক গানের দুই পঞ্চমাংশ। এই বর্ষা ঋতুর গান গুলোর দুটো পর্যায়, একটি প্রাকশান্তিনিকেতন পর্ব এবং অপরটি
শান্তিনেকতন বাস শুরু হওয়ার পর। শিলাইদহ অঞ্চলে প্রায় একযুগ থাকার সময়, সেখানকার বর্ষার বিচিত্র রূপ তাকে মুগ্ধ করেছিল। এই সময়
পর্যন্ত কবির রচিত ঋতুসংগীতের সংখ্যা ছিল বারো, যার মধ্যে আটটি বর্ষার। তেরশো তের বঙ্গাব্দের পাঁচ ফাল্গুন
শান্তিনিকেতনে শ্রীপঞ্চমীর
দিন ঋতু উৎসবের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্র শমীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে কবির রচিত
"একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ "গানখানি দিয়ে। এর আগে বা পরে ঋতু বিষয়ক গান লিখলেও
শান্তিনিকেতনে পূর্ণ মাত্রায় ঋতু উৎসব শুরু হয় তেরশো আঠাশ বঙ্গাব্দ থেকে। তেরশো আঠাশ থেকে রবি জীবনের
শেষ কুড়ি বছরের
আরম্ভ। এ জেনো তার সারা জীবনের সাধনার সার্থক পরিনতির হীরক সময়। এখন থেকে তিনি অন্যান্য ঋতু বিশেষ করে যাদের
প্রতি তার কিঞ্চিৎ অবহেলা ছিল, শীত,
হেমন্ত তাদের নিয়েও গান রচনা করতে
লাগলেন। তবে কবি বিরানব্বইটি বর্ষার গান লিখেছেন এই ষাট থেকে আশি বছর বয়সের মধ্যে।
তেরশো উনত্রিশ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ কবি
শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল উৎসব পালন করলেন। সেদিন পূর্নিমা তিথির দিনে সকাল থেকেই ছিল
অবিশ্রান্ত বারিপাত। কবি লিখলেন
'আজ আকাশের মনের কথা ঝরঝর বাজে ',সেদিনের অনুষ্ঠানে তিনি নিজকণ্ঠে গানটি গেয়েছিলেন,
আবৃত্তি করেছিলেন 'ঝুলন, বর্ষামঙ্গল, নিরুপমা
'এই তিনটি বর্ষার কবিতা। এইভাবে প্রতিবছর
শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল উৎসবকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গান রচনা করে
গেছেন, ধারাবাহিকভাবে।
সেইসঙ্গে বর্ষামঙ্গল
অনুষ্ঠান হতো জোঁড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও। সেই উপলক্ষেও রচিত হতো বিশেষ সম্ভার। তেরশো
উনচল্লিশ সালে কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের জন্য তিনি বাউলসুরে
লিখেছিলেন "আমি তখন ছিলেম মগন "কলকাতায় রচিত বলে এই গানটিকে তিনি বলতেন কলকাতার বাউল আর "আমার
প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি "গানটিকে তিনি বলতেন "শান্তিনিকেতনের বাউল’ ।তেরশো ছিচল্লিশ সালের বর্ষা মঙ্গলের জন্য কবি লিখেছিলেন 'বাদল দিনেরও প্রথম কদমফুল ' গানটি। আমার সবচাইতে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গুলোর প্রায় সবকটিই বর্ষার।
আরেকটি গান, ষোল
শ্রাবণ, তেরশো ছিচল্লিশ সালে
রচিত, ‘এসো
গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি/বিজনঘরের
কোণে, এসো গো /নামিল
শ্রাবণসন্ধ্যা, কালো ছায়া ঘনায় বনে
বনে।’ কবির বহু গানে এই "এসো "কথার
ব্যবহার, কাকে বার বার তিনি
আসতে বলেন, এই একটি মাত্র শব্দে গানগুলো
আমাদের প্রত্যেকের নিজের হয়ে ওঠে, আমরাও
যে কাউকে না কাউকে
আসতেই বলি, সবসময়।
শান্তিনিকেতনের অপূর্ব
বর্ষার প্রতিটি বিন্দুকে রবীন্দ্রনাথ সার্থকতম বাণীরূপ দিয়েছেন, এক একটি বিদ্যুতচমক
তাকে নতুন সুর দিয়েছে, বর্ষার
মেঘের রূপকে
সর্বশ্রেষ্ঠ বঙ্গানুবাদ তিনিই করেছিলেন।
রবিমানসী কাদম্বরী দেবীর কবিজীবনে
আবির্ভাবও হয়েছিল এমনি বর্ষায়। তিনি ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন বারোশো পঁচাত্তর অব্দের তেইশে
আষাঢ়।আর তিনি আত্মহত্যা
করেন আট বৈশাখ, বারশো একানব্বই। কবির
সারাজীবনের সৃষ্টির গ্রন্থিটুকু
তাই যেন গ্রীষ্ম আর বর্ষার প্রেক্ষিতেই। তিনি মনে করতেন তাঁর
নিতান্তই একঘেয়ে ছ্যাৎলাপড়া জীবনে
কাদম্বরী দেবী ছিলেন আষাঢ়ের সজলধারা। এই প্রেম এবং তাঁর চলে যাওয়ায় অমূল্য যে
শোকটি কবি পেয়েছিলেন, এমন অসামান্য বিরহসুখ খুব কম
সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনেই প্রাপ্ত হয়।
আহা মাঝে মাঝে মনে হয় আমিও যদি এমন একটি বিরহ লালন করিতে
পারিতাম।
প্রতিভাবান মানুষরা তাদের প্রতিভার একটি তীব্র সনসন বাতাস নিজের মধ্যে
অনুভব করেন, তিনিও করেছিলেন,
আর ঠিক তখনি পেয়েছিলেন এই নারীকে, যার
সান্নিধ্য, বিরহ, মৃত্যু তাঁর ঝুলিতে সোনার ফসল তুলে দিয়ে
গেছে।
অল্পবয়সে চন্দননগরে তেলেনিপাড়ার বাঁড়ুজ্যেদের বাগানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
এবং কাদম্বরী দেবীর
সঙ্গে কবি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। বৈষ্ণব কবিতার ভাব ও পদাবলীর সুর রবিকে তখন আচ্ছন্ন
করে রেখেছিল। পরিনত জীবনে তিনি যখন "ছেলেবেলা "লিখেন তখন সেই সময়ের
স্মৃতিচারণ করেছেন, তখন তিনি বিদ্যাপতির
অনেক গানে সুর দিয়েছিলেন,
"এ ভরা বাদর মাহ বাদর শূন্য মন্দির মোর’ এই গানটিতে সুর দিয়ে প্রথম শোনান তার নূতন
বৌঠানকে, রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার আগে সেই সব নরম বর্ষামেদুর ব্যক্তিগত সময় কাটানোর
মূহূর্তগুলো সম্বন্ধে তার নিজের ভাষায় ‘গঙ্গার ধারে সেই সুর দিয়ে মিনে করা এই
বাদল দিন আজও রয়ে গেছে আমার বর্ষাগানের সিন্ধুকটাতে,
‘আমার একটি ভীষণ প্রিয় গান "গহন কুসুম
কুঞ্জ মাঝে।" তখন
কবির বয়স পনের থেকে কুড়ির ভেতর। কবি
বলেছেন, “একদিন
মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে,
সেই মেঘলা দিনে ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে
বাড়ির ভিতর খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা স্লেট লইয়া লিখিলাম, ‘গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে’।” কবির বয়স যখন পঁচাত্তর বছর,তেরশো বিয়াল্লিশ সনের জৈষ্ঠ্যের প্রচন্ড দাবদাহে এই প্রথমবারের মতো তাকে
শান্তিনিকেতনের গ্রীষ্ম ক্লান্ত করে দিয়েছিল, তিনি ফিরে এলেন সেই চন্দননগরের বাগানবাড়িতে, উনিশে আষাঢ় পর্যন্ত সেখানে থাকলেন, কবি রিলকে বিশ্বাস করতেন, ....যে অকালমৃত্যু প্রেমিকারা নাকি পন্থহীনতার দিশারী হতে পারেন,
বিশেষ করে তারাই যারা প্রিয়বিহনে ভালোবাসার সাধনা
করেছেন। রবীন্দ্রনাথও
তাই মনে করেছিলেন, আট বৈশাখ বারশো একানব্বই সনে নতুন
বউঠানের মৃত্যু, তার পরের সময়খানি
কবিকে দীর্ঘদিন পর আবার
যেন ফিরিয়ে দিল। তখনের লেখা
কাব্যফসল গুলো সংকলিত হয়েছে বীথিকা কাব্যগ্রন্থে। তারপর
শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন, লিখেন
বেশ কয়েকটি বর্ষার গান,
যার মধ্যে একুশে শ্রাবণ থেকে আঠাশে
শ্রাবণের মধ্যে লেখা, আমার আরেকটি প্রিয় গান, ‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণরাতি, স্মৃতি বেদনার মালা একেলা গাঁথি। ’
শান্তিনিকেতনে কেমিষ্ট্রী পড়াতে এসেছিলেন শৈলজারঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ তাকে বললেন, কেমিষ্ট্রী রাখো তুমি সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ হও। শৈলজারঞ্জন বললেন, তাহলে আমার ডেজিগনেশন কী হবে? রসিক রবি বললেন,
মিউজিকেল কেমিষ্ট্রী। আসলে দীনুবাবুর পর তিনি
গানের ধারক খুঁজছিলেন, কারণ
রবীন্দ্রনাথ সুর দিয়েই ভুলে যেতেন। তেরশো ছিচল্লিশ সালের বর্ষামঙ্গলে এই শৈলজারঞ্জনের
বিভিন্ন আবদারে, অনেকগুলো বর্ষাসঙ্গীত
রবি লিখেছিলেন। তবে
এখানে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। তা হলো, এদিন
যখন বর্ষামঙ্গল শুরু হয়, রবীন্দ্রনাথ
ভীষণ অসুস্থ বোধ করেন, এবং অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে
যান, শৈলজারঞ্জন অনুষ্ঠানটি তখন বন্ধ করে দেন। এই অসমাপ্ত বর্ষামঙ্গল
রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে আবার উত্তরায়নে উদয়ন বাড়ির সামনে হলো। নাম দেওয়া হলো "বাসি বর্ষামঙ্গল’। এই অনুষ্ঠানের দিন
রবীন্দ্রনাথ শৈলজারঞ্জনকে বললেন,
এখনই যদি তোমাকে শিখিয়ে দেই একটি নতুন গান, তুমি সন্ধ্যার মধ্যে ছেলেমেয়েদের দিয়ে
গাওয়াতে পারবে কি ? তাহলে
ষোলকলা পূর্ণ
হয়, অর্থাৎ ষোলোটি গান হয়। কারণ, স্নেহের শৈলজারঞ্জনের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ সেবার
বর্ষায় বিভিন্ন রাগরাগিণীতে পনেরটি বর্ষাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। শৈলজারঞ্জন সানন্দে রাজি। রবীন্দ্রনাথ তখন
"যবে রিমিকি ঝিমিকি বাজে ঝরে ভাদরের ধারা’
তাকে শিখিয়েই শান্তিনিকেতনের প্রেসে পাঠালেন। তখন গীতবিতান ছাপা হচ্ছিল, তার পরিশিষ্টে গানটি সংযোজিত হলো।
রবি জীবনের প্রাপ্তি, হতাশা, মৃত্যু, প্রেম,
প্রায় সবটাই গ্রীষ্ম ও বর্ষার প্রতীকি
ব্যঞ্জনায় রূপকায়িত। তেরশো একত্রিশে রচিত হয়
রক্তকরবী, অবশ্যই সকলের মতো
আমারো প্রিয় নাটক, নাটকটির কোনো নামই কবির ভালো লাগছিল না, বলেছেন আমার ঘরের কাছে লোহালক্কড় জাতীয় আবর্জনার স্তুপের কাছে একটি
রক্তকরবী গাছ চাপা পড়া ছিল, গ্রীষ্মাবসানে
বর্ষার আগমনে, সেই জঞ্জাল ভেদ করে
একটি সুকুমার করবী শাখা উঠল লাল একটি ফুল
বুকে নিয়ে, যেন বলতে চাইল মারতে
চেয়েছিলে পারলে কই, তখন কবি মনে দারুণ এক ব্যথার অনুুভব হলো,
যক্ষপুরী, বন্দিনী সব নাম মন থেকে সরিয়ে নাম দিলেন "রক্তকরবী "।
আমার কাছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান, বর্ণনাত্মক, ব্যালাডধর্মী, সুরে
কীর্তন এবং কথকতার ফিউশন, কালো
রঙকে এতো অদ্ভুত ভাবে আর কেউ চিত্রায়িত করেছেন
বা করতে
পারবেন কিনা জানি না, গানটি
শিলাইদহে থাকার সময় লেখা,দিনটি
ছিল চার আষাঢ়, তেরশো সাত । প্রথমে কবিতা, তারপর গান, এবং
সেই গানটি অবশ্যই একমোদ্বিতীয়ম্
সুচিত্রা মিত্রের গলায় হতে হবে, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি........শ্রাবণ রজনীতে যে হঠাৎ খুশি
ঘনিয়ে আনে চিতে’, এখানে এই
"হঠাৎ" উচ্চারণটি,
এ যেনো হঠাৎ বর্ষার নেমে আসা, আমার কাছে।
আরেকটি গান, সেটিও আমি শুধু সুচিত্রা মিত্রের গলায়
শুনতেই ভালোবাসি এবং অত্যন্ত ভালোলাগার বলে পরপর দু তিনবার শুনে নেই ...
‘এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে
সেই আগুনের কালোরূপ যে আমার চোখের পরে
নাচে "
একটি কথা এই আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক, তবুও, "অনেকান্ত রবীন্দ্রনাথ "লিখেছেন আমার অত্যন্ত
প্রিয় লেখক, সুধীর চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথের গানের অন্যতম একজন গবেষক,রবি বিশেষজ্ঞ , এই
বইটিতে তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের
গান একই সঙ্গে
বাংলা গানের সর্বস্ব এবং সর্বনাশ। কারণ, তারপর
যেন আর কিছু করার নেই। এই বিশাল দানবিক সৃষ্টির পর রবীন্দ্রনাথকে আর কেউ কলিগ ভেবে
লিখতে পারলেন না, তাকে সর্বোচ্চ আসন দিয়ে, তাকেই অনুসরণ করা প্রতিদিন।
রবির জন্ম ১৮৬১, দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৬৩, রজনীকান্ত
১৮৬৫, অতুলপ্রসাদ ১৮৭১, দিলীপকুমার রায় ১৮৯৭, নজরুল
১৮৯৯, এই যদি গানের বৃত্ত ধরা হয়, তবে এই জরোয়ার নেকলেসে রবীন্দ্রনাথ নীলকান্ত
মণি, তাঁর গানের মতো
পরিব্যপ্তি, তখনো কারো ছিল না, আজো নেই।
অ্যান্ড্রিয়ান বাঁকে, যিনি লন্ডন থেকে শান্তিনিকেতনে এসে রবিগান শিখেছিলেন, দীনুবাবুর কাছে, তিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে ভীষণ সুন্দর একটি সনাক্তিকরণ দিয়েছিলেন, বলেছেন যে ভারতীয় গানের বৈশিষ্ট্য হলো
"ইম্প্রোভাইজেশন "Improvisation’।গানটি
সৃষ্টি হওয়ার পর শিল্পী তাকে নিয়ে সুরবিহার করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণ,এটা হলো রবীন্দ্রনাথের গানের ইউরোপিয়ান এ্যাটিচিউড, গানটি সৃষ্টির হওয়ামাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাই তিনি বার বার বলেছেন, তোমরা আমার গানে স্টীম রোলার চালিও না, যদি পারো অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে দরদ দিয়ে
গাও, প্রাণ দিয়ে গাও,
দিলীপকুমার রায় বা জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ চৌধুরী মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথকে বলতেন আপনার গানে একটু তান বা
অলঙ্করণ করি, বড্ড ন্যাড়া ন্যাড়া
লাগে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু
বলেছিলেন
একদম না, আমি তো কোথাও কোন
ফাঁক রাখিনি, এতোটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন
তিনি নিজের সৃষ্টি সম্বন্ধে।
মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার জন্যও কবি যেন বর্ষার
অপেক্ষায় ছিলেন, কবি পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী লিখেছেন
"আষাঢ় মাস পড়তেই বাবামশায় খোলা আকাশে বর্ষার রূপ দেখবার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন, তখন তাকে উত্তরায়নের দোতলার ঘরে নিয়ে
আসা হলো। "কিন্তু চিকিৎসায় কোন
কাজ হচ্ছিল না, তাই তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া অনিবার্য হলো। বর্ষার শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়া, কবি
হৃদয় বুঝেছিল এবারই শেষ।
সময় এসেছে সুন্দরের কাছে চলে যাওয়ার।
তেরশো আটচল্লিশ সালের, বাইশে শ্রাবণ, বারোটা দশ মিনিটে, শ্রাবণী
পূর্ণিমা রাতে কবি অবশেষে প্রিয় দুইটি চোখে মিলিয়ে গেলেন
"কশ্চিৎ কান্তা বিরহ গুরুণা স্বাধিকার
প্রমত্ত :
শাপেনাস্তং গবিমত মহিমা বর্ষ ভোগ্যেণ ভর্তুকি :
বিরহী যক্ষের এই অনুভবই রবীন্দ্র গানে,
অসংখ্যবার,কালিদাসের সৃষ্টিকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন পূর্ণভাবে। আমার আরেকটি প্রিয় শ্রাবণের গান. ..., এ দিয়েই শেষ করছি, তেরশো
চৌচাল্লিশ বঙ্গাব্দে
বর্ষামঙ্গল উৎসবে গানটি গাওয়া হয়েছিল। গানখানি কবির ছিয়াত্তর বছরের রচনা।
আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
মম জল ছলো ছলো আঁখি মেঘে মেঘে
বিরহ দিগন্ত পারায়ে
সারারাতি অনিমেষে আছে জেগে।
যে গিয়েছে দেখার বাহিরে
আছে তারি উদ্দেশ্যে চাহি রে,
স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি
পূরবী পবন বেগে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন