।। শিবানী দে।।
প্রাচীন কাল থেকেই
মানুষ একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করেছে, সঙ্গে গেছে
তার ভাষা, সংস্কৃতি ।
সেই নতুন স্থানের
ভূমিবৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া, আদি বাসিন্দা
ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকতে থাকতে তার পুরোনো সংস্কৃতি পালটে গড়ে উঠেছে
নতুন সংস্কৃতি । যেহেতু আগে যোগাযোগ-ব্যবস্থা উন্নত ছিল না, একবার জনপদ
গড়ে উঠলে মানুষ নিতান্ত বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ইত্যাদি দৈব, অথবা
রাষ্ট্রবিপ্লবের মত মনুষ্য-কৃত দুর্বিপাকে নাচার না হলে সহজে গ্রাম ত্যাগ করত না ।
বিশেষত কৃষিভিত্তিক সমাজে একই স্থানে যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে মানুষ বাস করত। ফলত
এক বড় জনপদের অধিবাসী একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও সেই জনপদের বিভিন্ন
জায়গায় অনেক উপভাষা গড়ে উঠত, সেইসঙ্গে সংস্কৃতিতেও ফারাক দেখা দিত। উপভাষাভাষী
গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও কিছুদূর অন্তর অন্তর বাচিক ও শাব্দিক পরিবর্তন আসত । ভাষাবিদদের মতে, প্রতি দশ মাইল
অন্তর ভাষার অল্পবিস্তর রূপান্তর দেখা যায় ।
এইধরণের রূপান্তর চলতে থাকলেই একএকটি
ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকগুলো উপভাষার উদ্ভব হয়, আর তার মধ্যে বেশি সংখ্যক ও
বেশি প্রভাবশালী লোকের ভাষা প্রধান ভাষা বলে পরিগণিত হয় । সাধারণত সেটাই হয়ে ওঠে লিঙ্গুয়া
ফ্রাঙ্কা বা যোগাযোগের ভাষা । কালক্রমে উক্ত ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সেটাই মান ভাষার
মর্যাদা পায়, কারণ অনেক
লোকে ব্যবহার করার ফলে সেই ভাষাতেই
সাহিত্য সংস্কৃতি,
ব্যবসাবাণিজ্য, শাসন কার্য ও
আইনের ভাষা হয়ে ওঠে । তাই ভাষাটি ধীরে ধীরে মিশ্র ভাষা হয়ে ওঠে । মিশ্র ভাষা মানে
আমি বোঝাতে চাইছি, সেই ভাষাটি
মান ভাষার রূপে কোনো জনপদের বিশেষ
স্থানের আদি ভাষা হয়ে আর থাকে না, তার মধ্যে সেই জনপদের অন্যান্য স্থানের ভাষারও
উপাদান-অবদান মিশে যায় । এবং সেই ভাষা
সাধারণত বড়শহর বা রাজধানী ভিত্তিক । বড় শহরে বা রাজধানীতে জনপদের সমস্ত কোণ থেকে
লোকে নানা প্রয়োজনে আসে, বসতি করে ।
স্থানীয় ভাষার সঙ্গে নবাগতদের মেলামেশায় যে ভাষা গড়ে ওঠে তারই পরিশীলিত রূপ শাসন
কার্যে, রাজসভায়, ব্যবহার হয়, এবং
সাহিত্যিকরা সেই ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন, ভাষাটি সমৃদ্ধ হয় । ভারতের
রাষ্ট্রভাষা হিন্দি, বা পাকিস্তানের
উর্দু দুটো ভাষাই কোনো বিশেষ অঞ্চলের ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠেনি, এই ভাষাদুটো
অনেক ভাষা উপভাষার মিশ্রণ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেবার পর ভাষাগুলোকে
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করা হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবে তাতে নানা
বইপত্র রচিত হয়ে সেগুলো সমৃদ্ধ হয়েছে, এবং ধীরে ধীরে শহরাঞ্চলে লোকে
নিজেদের আদি অনুন্নততর ভাষা ছেড়ে এই ভাষাগুলোকে নিজেদের মুখের ভাষা করেছে ।
আমাদের চলতি
বাংলাও তেমনি মিশ্র
ভাষা । জেলা ভেদে
(পশ্চিমবঙ্গীয়, পূর্ববঙ্গীয়, বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরা
মিলিয়ে) বাংলার অনেক
উপভাষা যার মধ্যে সিলেটি অন্যতম। যদিও
গঙ্গাতীরবর্তী নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলের ভাষা ও উচ্চারণ আদর্শ বলে ধরা হয়, শহর কলকাতায়
ওই রকম উচ্চারণ বড় একটা শোনা যায় না । একসময়ের দেশের রাজধানী, বাণিজ্যকেন্দ্র, হওয়াতে
সারাদেশের মানুষজন এখানে এসেছে, বাংলার প্রতিকোণের কিছু না কিছু মানুষ এসে স্থায়ীভাবে
থেকেছে । সকলের ভাষার ছাপ অল্পবিস্তর
নিয়েই আধুনিক বাংলাভাষা গড়ে উঠেছে । বড়বড় সাহিত্যিকেরা মান ভাষা
তৈরির কাজ করেছেন, যত যুগ
এগিয়েছে, পুরোনো রূপ পাল্টেছে ।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট আধুনিক বাংলার সঙ্গে কল্লোলযুগের, কল্লোলযুগের
সঙ্গে হাংরি জেনারেশনের, তাদের সঙ্গে
আবার একবিংশ শতকের ভাষার কতো তফাত!
পশ্চিমবঙ্গের
বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন উচ্চারণের, বিভিন্ন ক্রিয়াবিভক্তির বাংলা চলে, পূর্ববঙ্গ, বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরার
বিভিন্ন অঞ্চলে আরো কত ধরণের । পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়াতে যেখানে বলে, ‘হবেক নাই’ কলকাতায় বলে ‘হবে না’ ঢাকায় বলে ‘হইব না’, সিলেটে বলে ‘অ(হ)ইত নায়’। ‘গেলুম’ ‘খেলুম’ ধরণের
ক্রিয়াপদ মান বাংলায় ব্যবহার হয় না, হয় সর্বজন গ্রাহ্য ‘গেলাম’ ‘খেলাম’ । শব্দ তো
অনেকটা সুবিধামতই আমদানি হয় । মধ্যযুগে হত আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার
। রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্রের
কাব্য এবং পরবর্তীকালে কাজি নজরুলের কবিতা তার উজ্জ্বল উদাহরণ । বৃটিশ
যুগে ইংরাজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় শব্দ ব্যবহার শুরু হল । স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে
ইংরাজির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা হিন্দির শব্দ ইচ্ছেমত নেওয়া হচ্ছে। এই ফেসবুক
হোয়াট্স্ অ্যাপ যুগে বাংলা কোনো শব্দ জানা না থাকলেই হিন্দি বা ইংরাজি ভাষা থেকে
বসিয়ে দেওয়া----আজকাল তো এটা ফ্যাশন । এ ছাড়াও ঢুকছে স্থানীয়
জনজাতীয় শব্দ। এই একই বাংলা
বাংলাদেশের ও প্রধান ভাষা , ওখানকার
মানুষ নিজেদের সংস্কৃতির স্বার্থে ওখানকার নতুন শব্দ ঢোকাচ্ছেন। বরাক উপত্যকার
পত্রপত্রিকা ঘাঁটলেও দেখা
যাচ্ছে যে এখানেও লিখার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষার প্রকাশভঙ্গি চলছে । যেমন, লিখা হচ্ছে ‘স্থানীয় লোকজন
চোরকে পুলিসের হাতে সমঝে দিয়েছেন’, কলকাতায় কিন্তু লেখা হবে, ‘স্থানীয় লোকজন
চোরকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছেন’ । অনেকটা এই ব্যাপার অনেক আগে আমরা সৈয়দ মুজতবা আলিরলেখাতে পেয়েছি, তিনি অনেক
সিলেটি শব্দ তাঁর লেখায় নিয়েছেন । তাঁর রম্যরচনাগুলোতে যে রস, সেটা একেবারেই
সিলেটি বৈঠকি । অন্যদিকে, মান্য চলতি
ভাষার পরিকাঠামো নির্মাণ করে তার মধ্যে আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় চরিত্রদের কথোপকথন দ্বারা
চরিত্র এবং তার পারিপার্শ্বিককে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার টেকনিক অনেকেই নিয়েছেন, যেমন
বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পগুলো বা রণবীর পুরকায়স্থের ‘সুরমা গাঙ্গর
পানি’ উপন্যাস ।
এভাবেই মান্য ভাষার পরিকাঠামোর মধ্যে থেকেও নিজস্ব কথ্য ভাষাকে তুলে ধরা যায়, তার অস্তিত্বের
জানান দেওয়া যায় গর্বের সাথে । এই ব্যাপারগুলোকে নাক সিঁটকে দূরে না রেখে এগিয়ে
নিয়ে গেলে বরাক উপত্যকায় নিজস্ব ভাষা তৈরি হতে পারে । ভাষাও সমৃদ্ধ হয় ।
একটা উদাহরণ
দেওয়া যেতে পারে । ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবং
অস্ট্রেলিয়া তিন মহাদেশের তিনটি দেশে ইংরাজি চলে । কিন্তু আমেরিকীয় ইংরাজি এবং
অস্ট্রেলীয় ইংরাজি ব্রিটিশ ইংরাজি থেকে আলাদা । অনেক শব্দের বানান পর্যন্ত
আমেরিকানরা আলাদা করে নিয়েছে । সবটাই মান্যতা পেয়ে গেছে । একসময় রানির ইংরাজির
আভিজাত্যে নাক সিঁটকানো ইংরেজ পণ্ডিত আমেরিকীয় ইংরাজিকে কৌলীন্যের দরজা দিতেন না ।
এখন ভূমিকা পালটে গেছে । সমৃদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আমেরিকান ইংরাজি আজ
সুপ্রতিষ্ঠিত । এমন কি ভারতীয় স্বাদ গন্ধ নিয়ে ভারতীয় ইংরাজিও তার সম্মানের জায়গা
করে নিয়েছে ইংরাজি ভাষাবৃত্তে । তাহলে
বাংলাভাষার রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক স্বাদগন্ধে ভাষাকে
সমৃদ্ধ করতে বাধা কোথায় ? কলকাতার বাংলা, বাংলাদেশের
বাংলা, ত্রিপুরার
বাংলা, বরাক উপত্যকার
বাংলা সব নিজ নিজ স্থানীয় পুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠুক না ।
লিপিপ্রসঙ্গে
আসি । লিপি একটা কৃত্রিম জিনিষ, ভাষা গঠন হবার অনেক পরে আসে । ভাষা স্মরণাতীত কাল
থেকে, মানুষের
পৃথিবীতে আসার সময় থেকেই বলতে গেলে, আছে, তা দুচারটে কথার
বুলিই হোক না কেন। যত অভিজ্ঞতা বেড়েছে, শব্দসম্ভার বেড়েছে, নতুন কথা
প্রকাশ করার তাগিদ বেড়েছে। সাহিত্য হয়েছে পদ্যচ্ছন্দে, যাতে মুখস্থ
রাখা যায় । ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দুচারজনকে মুখে বলা যায়, কিন্তু
মানুষের স্মৃতি তো বিশ্বাসঘাতকতা করতেই পারে । যে কথা বলবার থাকে, তা মুখেমুখে
একজন আরেকজনকে বলাতে দিনদিন পরিবর্তিত হতে পারে । তখনই আসে লিপির প্রয়োজনীয়তা, ভাষার শব্দ
প্রকাশের কিছু সঙ্কেতচিহ্ন । একবার লিপিবদ্ধ হলে লিখিত বিষয়বস্তুর আর সহজে পরিবর্তন
হয়না । প্রথম প্রথম রাজারাই লিপির ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের চালু করা নিয়মনীতির
বিষয়ে প্রজাদের অবহিত করার জন্য । তাই রাজাদেশ সাধারণত
প্রস্তরলিপিতে উৎকীর্ণ হত । এইভাবে আমরা আজো ব্যবিলনীয় রাজা হামুরাবির আইনগুলো
স্তম্ভে উৎকীর্ণ দেখি । সম্রাট অশোকের ধর্মোপদেশ শিলালিপিতে বা স্তম্ভের গায়ে
খোদাই করা আছে । পাথরের পর তালপাতা, ভূর্জপাত, বা চামড়া লিখার পট
হিসেবে ব্যবহার হতে লাগল । এতদিনের মুখস্থ সাহিত্য ও লিখে রাখা শুরু হয়ে
স্থায়িত্ব প্রাপ্ত হল । কাগজ ও ছাপাখানা লেখাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেল ।
ভাষার সঙ্গে
সঙ্গে লিপিও যুগে যুগে পাল্টেছে । অনেক দেশেই দেখা যায় প্রাচীন যুগ থেকেই উন্নত
সভ্যতা সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সেখানে যুগ যুগ ধরে একই লিপি ব্যবহার হয়
নি । অনেক সময় শাসকের ভাষার লিপি ব্যবহার হয়েছে, নিজেদের পুরোনো লিপি থাকা
সত্ত্বেও । যেমন উর্দু
ভাষাতে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষা হলেও আরবি লিপি ব্যবহার হয়েছে , কারণ তখনকার
শাসকের ভাষা ছিল ফারসি, আর ফারসির
লিপি হল আরবিভিত্তিক । আবার ধর্মীয়
কারণে লিপি পাল্টানোর উদাহরণ হল সেই ফারসি, প্রাচীন যুগে যার নিজস্ব সমৃদ্ধ
লিপি ছিল, এবং সেই লিপি
এখন পার্সিদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার হয় না । ইসলামের
প্রসারের পর ফারসিতে আরবি লিপি আমদানি হল। বৃহত্তর ও উন্নততর সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ
প্রতিষ্ঠা করার জন্য ও লিপি পালটানো হয়েছে, যেমন বিংশ শতকের প্রথম দিকে
তুর্কি আরবি লিপি ছেড়ে রোমান লিপিকে আপন করেছে । এই উদাহরণ আমাদের নিজেদের
আশেপাশেও দেখতে পাই, বোড়ো ভাষা
অসমীয়া লিপি ছেড়ে রোমান লিপি নিয়েছে, খাসি, গারো, মিজো, নাগা ---- এই
সব ভাষাই রোমান লিপিতে লিখা হচ্ছে । কাজেই দেখা যাচ্ছে যে লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে
মূলত সুবিধাবাদ কাজ করছে, সেটা রাজনৈতিক, বা ধর্মীয়, বা সাংস্কৃতিক
যা-ই হোক না কেন ।
আমি সিলেটি
নাগরির অস্তিত্ব মাত্র বছর কয়েক হল শুনছি । শোনা যাচ্ছে যে এই লিপি বেশ প্রাচীন, সুফি সন্ত শাহ্জালালের সঙ্গে এই অঞ্চলে আগত
এবং বিহারের কাইথি লিপির অন্তর্ভুক্ত ।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে এটা একটা বহিরাগত লিপি । সিলেটকাছাড় অঞ্চলের
একদিকে অসমিয়া ও বাকি সব দিকে
বাংলালিপি প্রচলিত । লাগোয়া ওড়িশাতেও যে লিপি, তার মাত্রাটুকু বাদ দিলে বাংলার
সঙ্গে মিল প্রকট । তাই মাঝখান থেকে
কাইথি লিপি কি করে এ অঞ্চলের নিজস্ব লিপি হতে পারে তা বোঝা যাচ্ছেনা । সম্ভবত
বহিরাগত হবার কারণেই এই লিপি যাদের
সঙ্গে এসেছিল, তাদের এবং
তাদের বংশধর বা সম্পর্কান্বিতদের মধ্যেই থেকে
গেছে, বহুলপ্রচারিত
হয় নি । তাই মনে হয় একে সিলেটি লিপি
বলা ঠিক হবে না ।
তাই এই তথাকথিত সিলেটি নাগরি লিপিতে লেখা
সংখ্যায় যে সামান্য কিছু পুঁথি
রয়েছে, বেশির ভাগ সিলেটি বাঙালি
এই বিষয়ে অবহিত নন ।
বাংলাভাষার
প্রথম যুগ থেকে বাংলা হরফেই বেশির ভাগ সিলেটিরা সাহিত্য রচনা করেছেন, এটা অস্বীকার
করার কোনো উপায় নেই । বাংলায় অনেক উপভাষা থাকা সত্ত্বেও মেদিনীপুর পুরুলিয়া থেকে
সিলেট চট্টগ্রাম, কুচবিহার
থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত হরফ প্রায় সকলেরই বাংলা ছিল, মধ্যযুগেও একটা মান্য সাধুভাষা ছিল, সেই ভাষাতেই
গান, কাব্য রচিত হত
। অল্পস্বল্প শব্দ বা ক্রিয়াপদের আঞ্চলিক ভাষাভেদে পার্থক্য ছিল । কিন্তু বুঝতে
সকলেই পারত । সেই ভাষাই ছিল
সিলেটি সাহিত্যিকদেরও ভাষা। তখন জাতীয়তার অত বোধ ছিল না, জাতীয়তাবোধ
আধুনিক ব্যাপার যা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে জাগ্রত হয় । দেশবিভাগের পর এই
জাতীয়তাবোধ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে, আবার বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত
হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় । এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা তো
বটেই, এদেশের বাঙালি
আমজনতাকেকেও উদবুদ্ধ করেছিল । আমার মনে আছে, বাংলাদেশ যুদ্ধের
সময়, যখন আমি
স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি, তখনকার
করিমগঞ্জের গ্রামের গরিব অশিক্ষিত
চাষাকেও নিজেকে বাঙালি বলে গর্বিত পরিচয় দিতে শুনেছি, যেটা আগে কখনো
শুনিনি । আমরা সিলেটি হলেও বাঙালি, বাঙালি হলেও সিলেটি, এভাবেই
নিজেদের জানতাম । কিন্তু লিখিত প্রকাশের হরফ ছিল বাংলা, তাতে কোনো
অসুবিধা হয় নি । আমাদের স্বল্পশিক্ষিত ঠাকুমা-দিদিমারা চিঠিপত্র বাংলা অক্ষরে
সিলেটি উপভাষায় লিখতেন।
সিলেটি
সংস্কৃতি ছিল আমাদের আচারে ব্যবহারে, মননে, কথ্যভাষায় ।
কিন্তু বাংলার বিশাল সাহিত্য, সংস্কৃতি, মনীষা আমাদেরও, এই ভেবে মন
গর্বে ভরে উঠত। এই সাহিত্যে সংস্কৃতিতে আমাদেরও অবদান আছে, এই ভেবে
রবীন্দ্রনাথ নজরুল বিভূতি তারাশঙ্করের পাশে সৈয়দ মুজতবা আলি সমগ্র বইয়ের তাকে
রেখেছি । পুলকিত বোধ করেছি দেখে আমাদের হাছন রাজাকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা
গোটা কবিতা লিখেছেন, যা হাছন রাজার
দর্শন বিধৃত করার প্রয়াস। নির্মলেন্দু চৌধুরী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান, শরৎচন্দ্র
চৌধুরী, অশোকবিজয় রাহা, শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী, আরো অনেক
সিলেটি কবির কাব্য, বিপিন পালের
বক্তৃতা প্রবন্ধ, সুজিত
চৌধুরির ইতিহাস গবেষণা, সুন্দরীমোহন
দাসের চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই, আরো কত
শ্রীহট্টীয় মনীষীর কত বিষয়ে অবদান বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে । আমাদেরই সিলেটি
মূলের লোক শ্রীচৈতন্য সারা দেশ মাতিয়েছিলেন প্রেমের ধর্মে, কীর্তনে, যার ফল হল
বাংলার সমৃদ্ধ বৈষ্ণব সাহিত্য । শুধুমাত্র সিলেটি হয়ে এইসব উত্তরাধিকার কি আমরা ছেড়ে
দিতে পারি ?
হ্যাঁ, অবশ্যই
নাগরিতে লেখা পুঁথিগুলোও আমাদের উত্তরাধিকার । আমরা এতদিন এগুলোর বিষয়ে জানতাম না, এখন যদি
জেনেছি, সেগুলোকে
প্রকাশ করতে হবে, বহুজনের
সুবিধার্থে বাংলায় লিপ্যন্তর করে । মনন, দর্শন, চিন্তন, যা কিছু কোনো
সিলেটি করে গেছেন, সেগুলো তাঁর
দেশবাসীকে অবশ্যই জানতে দিতে হবে । বাংলা ভূখণ্ডে একসময় সংস্কৃত ও বাংলা হরফে লিখা
হত । আজকালকার
ছেলেমেয়েরা রোমান হরফে বাংলা লেখে ফেসবুক হোয়াট্স্ অ্যাপে, বাংলা লেখার
কষ্টটা করতে চায়না । ভাল অভ্যাস নয় । তবুও বলছি, যে লিপি অনেক যুগের পরিচিত, যে লিপিতে
অজস্র সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের বই
লিখিত হয়েছে, যার সঙ্গে এত
বছরের ওতপ্রোত সম্পর্ক, তা ছেদ করে
মুষ্টিমেয় কয়েকটা পুঁথির লিপিতে ভাষাকে ফেরানোর ভাবনা সভ্যতার উল্টোপথে যাত্রা
করার শামিল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন