“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬

প্রজাতির উৎস সন্ধানে (অষ্টম পর্ব)


 ।। রজতকান্তি দাস।।
(C)Imageঃছবি

শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পেল ‘The Origin of Species’
চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিসবইটি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বর তারিখে প্রকাশিত হয় এবং সেই দিনই সমস্ত বই বিক্রি হয়ে যায়। বোঝা যায় যে বইটির চাহিদা কি হতে পারে প্রকাশক তা অনুমান করতে পারেন নি। এই বইটির পুরো নাম হলো ‘The Origin of Species by Means of Natural Selection, or The Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life’.এত জনপ্রিয় এই বইটি কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার কুড়ি বছর আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডারউইন তা প্রকাশ করতে আগ্রহবোধ করেন নি। তিনি সম্ভবত এ ব্যাপারে কোপার্নিকাসের পদাঙ্কই অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে ধর্মবিরোধী বই লিখে ইহলোক ত্যাগ করা। ডারউইন তাঁর বই নিয়ে যে সব বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে আলাপ করতেন তারা ছিলেন চার্লস লিয়েল, লুকার ও হাক্সলি। এই বন্ধুরা ডারউইনকে বইটি প্রকাশের জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। লিয়েলতো তাঁকে সাবধান করে বলেই দিয়েছিলেন যে তিনি যদি দেরি করেন তাহলে অন্য কেউ এই একই জিনিস প্রকাশ করে বিজ্ঞানজগতে নিজের স্থান করে নেবে। ডারউইনের তখন আর কিছুই করার থাকবে না। তাও কেন জানি বাইবেলবিরোধী বইটি প্রকাশ করতে ডারউইনের মন সরছিল না। তাছাড়া তাঁর পত্নীও ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক ও ধর্মবিশ্বাসী। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই কেপলারেরও একই সমস্যা ছিল। তিনিও বই লিখে ফেলে রেখে দিয়েছিলেন এবং তাঁর ধর্মভীরু মায়ের মৃত্যুর পরই নিজের বই প্রকাশ করেন।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত চার্লস লিয়েলের কথাই সত্যি হলো। ১৮৫৮ সালে এই বিষয়ে দাবিদারের আগমন ঘটে যায়। আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস নামে এক স্কুল শিক্ষক যিনি ক্রমবিকাশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং সময়-সুযোগ পেলে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অভিযানে বেরিয়ে পড়তেন, তিনি নতুন প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ওয়ালেস যখন ইন্দোনেশিয়ার টারনেট দ্বীপে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে বিবর্তনবাদ ও প্রজাতির উৎস নিয়ে ভাবছিলেন তখন তাঁর মাথায় ম্যালথাসের জনসংখ্যাতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকার লড়াই ও ক্রমবিকাশের যে ধারনা এসেছিল তার সঙ্গে ডারউইনের ধারণার বিস্ময়কর মিল। আশ্চর্যের বিষয় যে তিনি তাঁর ধারণার কথা লিখে জাহাজযোগে ডারউইনকেই পাঠালেন লেখাটি সংশোধন করে দেবার জন্য। এত লোক থাকতে তিনি ডারউইনকেই কেন পাঠালেন সে এক বিস্ময়।
             ওয়ালেসের এই প্রবন্ধটি ডারউইনের কাছে পৌঁছয় ৩ জুন, ১৮৫৮ সাল। ডারউইন এই সময়ে বিবিধ বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। সেসব লেখায় বিবর্তনবাদের প্রায় কিছুই ছিল না। তাই ওয়ালেসের প্রবন্ধটি পড়ে তাঁর মনের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, যাকে বলে জোরকা ঝটকা জোরসে লাগার অবস্থা। ডারউইন ভাবলেন এখন যদি নিজের কুড়ি বছর আগের লেখা বই প্রকাশ করেন তাহলে ওয়ালেস হয়ত ভাববেন তাঁর ধারণা চুরি করে তিনি নিজের নাম ফলাতে চাইছেন। এই সংকটের মধ্যে থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাঁর নিজের লেখার পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলবেন। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবরা তাতে বাঁধ সাধলেন। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের কথায় তিনি ওয়ালেসের সম্পূর্ণ প্রবন্ধসহ নিজের প্রস্তাবিত বিশাল বইটির সারাংশ পড়ে শোনান লিনিয়ান সোসাইটির সভায়। তারিখটা ছিল ১ জুলাই ১৮৫৮, তাই আসলে এই ১ জুলাই তারিখটিই ক্রমবিকাশতত্ত্বের আত্মপ্রকাশের দিন। যদিও ডারউইনের সম্পূর্ণ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল এর প্রায় ১ বছর ৪ মাস পর। ডারউইনের এই বইটি কিছুদিন আগেও ছিল বাইবেলের পর সর্বাধিক বিক্রিত বই। ইদানীংকালে অবশ্য স্টিফেন হকিঙের ‘A Brief History of Time’ বইটি এই রেকর্ডকে ভেঙেছে। ডারউইনের এই বইটি বিজ্ঞানজগতে যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল তার নজির খুব একটা দেখা যায় না।
 
‘The Origin of Species’ প্রকাশের পর
           ‘The Origin of Species’-এ মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে প্রায় কিছুই লিখেন নি ডারউইন। সম্ভবত তিনি কিছুটা অনুকূল পরিবেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। তবে এটুকু বলেছিলেন যে শিগগিরই মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে। এটুকু ইঙ্গিতই সম্ভবত যথেষ্ট ছিল। কারণ ধর্মবিশ্বাসী ও আভিজাত্যপ্রেমীরা ইতিমধ্যেই এক দুর্যোগের আশঙ্কা করেছিলেন এবং প্রতিবাদে ময়দানে নামতে শুরু করেন। বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রায় আভিজাত্যপ্রেমীদের মনের অবস্থা নিয়ে লেখা লর্ড টেনিসনের একটি কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি।
“A time to sicken and to swoon,
When science reaches forth her arms
To feel from world to world, and charms
Her secret from the latest moon?”
           যাই হোক, ডারউইনের পক্ষে তাঁর সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল ঠিকই, তবে তিনি যখন এই যাত্রা শুরু করেন তখন পরিস্থিতি অনেকটাই অনুকূলে এসে গিয়েছিল। তাই এই বন্ধুর যাত্রা পথে তাঁর বন্ধুর অভাব হয় নি কখনও। থমাস হাক্সলি, চার্লস লিয়েল প্রমুখ বন্ধুরা তাঁর হয়ে লড়াই করে গেছেন বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে। এই হাক্সলিই ১৮৬০ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ এসোসিয়েশন ফর দ্য এনভায়রনমেন্ট অব সায়েন্স দ্বারা আয়োজিত এক সভায় বিশপ উইলবারফোর্সকে তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। উইলবারফোর্স হাক্সলিকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি যে উল্লুকের বংশধর তা তিনি তাঁর পিতার সূত্রে হয়েছেন না মাতার সূত্রে । হাক্সলি জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে একজন গুণী ব্যক্তি যার সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে এবং তিনি নিজের প্রতিভাকে নিয়োগ করেন বিজ্ঞানের মতো সিরিয়াস বিষয়কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার কাজে, এই ধরণের এক ব্যক্তির বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় দেবার চাইতে তিনি বরং উল্লুকের বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে বেশি সম্মানিত বোধ করবেন।
             ডারউইনের বইটি আদ্যোপান্ত পড়ার পর ঈশ্বরবিশ্বাসী চার্লস লিয়েলের মনে যা কিছু ধন্দ ছিল তা দূর হয়ে যায় এবং ডারউইনের মতবাদকে তিনি সম্পূর্ণভাবে মেনে নেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে চার্লস লিয়েয়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে কিছুটা সমস্যা ছিল। তিনি বাইবেল নিয়ে সমালোচনা করলেও বাইবেল থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেন নি। না হলে লিয়েলই বিবর্তনবাদের আবিষ্কার করতেন। অন্তত বিশেষজ্ঞদের এটাই মত। অরিজিন অব স্পিসিসপ্রকাশ হয়ে যাবার পর লিয়েল নিজেও কিছুটা গবেষণা করে ১৮৬৩ সালেই প্রকাশ করলেন আরেকটি বই, নাম ‘The Geographical Evidence of the Antiquity of Man’ অর্থাৎ মানুষের প্রাচীনত্বের ভৌগোলিক প্রমাণ বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় বাইবেলবিরোধী ও ডারউইনের মতবাদের অনুকূলে। লিয়েল তাঁর বইয়ে শুধু যে ডারউইনের তত্ত্বকে মেনে নিয়েছিলেন তাই নয়, তিনি জোরালো যুক্তির প্রয়োগে ডারউইনের তত্ত্বকে আরো আকর্ষণীয় করে তুললেন। ১৮৬৫ সালে নিজের ভূবিদ্যার মূলতত্ত্ববইটির বড় রকমের সংশোধন করে প্রকাশ করলেন যা ডারউইনের মতবাদকে আরো জোরদার করেছিল।
             ‘দ্য অরিজিন অব স্পিসিসঅথবা প্রজাতির উৎসবইটি প্রকাশিত হওয়ার দুবছরের মধ্যেই আবিষ্কার হলো আরকিওপটেরিক্সের জীবাশ্ম। যে প্রাণীটি সরীসৃপ ও পাখির একটি মাঝামাঝি স্তর। এছাড়াও এক ফরাসী অভিযাত্রী আফ্রিকার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে সেখান থেকে নিয়ে এলেন এক গরিলার স্টাফড দেহ। এরকম প্রাণী ইউরোপের মানুষ আগে কখনও দেখেননি। ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে এমনিতেই জোরদার তর্ক-বিতর্ক চলছিল। এই পরিবেশে এমন এক প্রাণী যার সঙ্গে মানুষের যতটা সাদৃশ্য তার চাইতে কম সাদৃশ্য বানরের সঙ্গে। এর মধ্যে কিছু লোক এটাকে ডারউইনপন্থীদের চালবাজি বলে প্রচার চালাতে শুরু করে দেন। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন একটা প্রাণীর দেহ অথচ বিশ্বাস করতে পারছেন না এই প্রাণীটি আছে। তবে এই পরিবেশকে নিজেদের সপক্ষে নিয়ে আসার জন্য ১৮৬৩ সালেই ডারউইনের বন্ধু থমাস হাক্সলি লিখে ফেললেন একটি বই, নাম ‘Evidence as to Man’s Place in Nature’বইটির বক্তব্য গরিলা কিংবা শিম্পাঞ্জীর সঙ্গে মানুষের সাদৃশ্য। এছাড়াও ডারউইনের বই ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। তাই জার্মানি থেকে আর্নেস্ট হাকেল লিখলেন দুটি বই যার বক্তব্য ছিল বিবর্তনবাদের সপক্ষে। ১৮৬৬ ও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত এই বই দুটি ছিল যথাক্রমে ‘General Morphology’ ‘The Natural History of Creation’
           কাজেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কোপার্নিকাস বা গ্যালিলিওর সময়ে বিজ্ঞানীরা যেভাবে নিজমত প্রকাশে একাকীত্বের শিকার হয়েছিলেন, ডারউইনের সময়ে পরিস্থিতি ততটা বিরুদ্ধে ছিল না। তবে আজও বিশ্বের অনেক জায়গাতেই চিন্তাবিদদের নিজমত প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ নেই। এমন কি আমেরিকার মতো রাষ্ট্রেরও দুটি প্রভিন্সের স্কুলগুলিতে ডারউইনের মতবাদের পরিবর্তে বাইবেলীয় সৃষ্টিতত্ত্বের কথাই পড়ানো হয় মূলত ধর্মীয় কারণে। এমন কি ভারতেও মানুষের ধর্মীয় ভাবালুতা ও পশ্চাদপদতা কিছু লোকের অর্থ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক জীবনের উন্নতির সহায়ক। তারাও ডারউইনের তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু না জেনেই এর বিরুদ্ধে প্রচার চালান। তবে চার্লস ডারউইনের মতবাদ সমাজে যতটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, এক মার্ক্সবাদ ছাড়া আর কোন মতবাদ এতটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বলে মনে হয় না।
             ওই সময়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ডারউইনকে নিয়ে বেরোনো অনেক কার্টুনের মধ্যে দুটো কার্টুন এখানে তুলে দিলাম। তবে কার্টুনিস্টদের পৃথিবী মনে রাখেনি। মনে রেখেছে ডারউইনকে। এটাই সভ্যতার মার।

কোন মন্তব্য নেই: