।। রজত কান্তি দাস।।
(C)Image:ছবি |
দীর্ঘ অভিযানের
সমাপ্তি
১৮৩১ সালের ২৭
ডিসেম্বর বিগল জাহাজটি ইংল্যান্ডের প্লাই মাউথ বন্দর থেকে রওনা হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত
দীর্ঘ ৪ বছর ৯ মাস ৫ দিন পর ১৮৩৬
সালের ২ অক্টোবর এই অভিযাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে। এই দীর্ঘ অভিযাত্রায় ডারউইন তাঁর প্রাণী সংগ্রহের নমুনা ও
ভূতাত্ত্বিক ধারণার কথা চিঠি লিখে বন্ধু হেন্সলোকে পাঠাতেন। হেন্সলো ডারউইনের চিঠির
নির্বাচিত অংশগুলো নিয়মিত
লন্ডনের ভূতাত্ত্বিক সমিতি ও কেমব্রিজের
দর্শনশাস্ত্র সমিতির সভায় পড়ে শোনাতেন। তাই ডারউইন ফিরতে আসার আগেই বিশেষত লন্ডন ও কেমব্রিজে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে
পড়েছিল। তিনি ফিরে আসায় এ দুটো
জায়গাতেই তাঁকে ভূতাত্ত্বিক সমিতির সভ্য ও ১৮৩৯ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত করা হয়। দেশে ফেরার আগেই চার্লস
লিয়েলের সঙ্গে তাঁর মানসিক
যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই দুজনের মধ্যে প্রগাড় বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
বিজ্ঞানের মোড়
ঘুরিয়ে দিল সামান্য ফিঞ্চ পাখি
‘সবচেয়ে বড়কে
বুঝতে হলে সবচেয়ে ছোটকে বুঝতে হবে আগে’। কথাটি বলেছিলেন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর
আগে। তবে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের
প্রাক্ কালে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। লামার্ক ও তাঁর সহযোগীরা মনে করতেন সূক্ষ্ম গবেষণার প্রয়োজন নেই। কারণ
এতে জনগণের মনে রেখাপাত করে না।
তাই প্রয়োজন মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের মৌলিক সূত্র বের করা। তবে অন্য একদল বিজ্ঞানীরা
ছিলেন যারা মনে করতেন
সূক্ষ্ম গবেষণার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর পুরোভাগে ছিলেন আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের জনক ল্যাভোয়েসিয়ের।
আজ আমরা জানি যে পরমাণুকে বোঝতে
না পারলে গোটা ব্রহ্মাণ্ডকেই বোঝা যায় না। অথচ ফরাসী বিপ্লবের বিদ্রোহীরা এই ল্যাভয়েসিয়েরকেই মধ্যপন্থী হিসেবে
চিহ্নিত করে তাঁকে ধরে নিয়ে
গিয়ে গিলোটিনে চড়িয়ে হত্যা করেছিল। ফরাসী বিপ্লবের গৌরবময় ইতিহাসের এটা একটা কালো অধ্যায়।
যাই হোক, চার্লস ডারউইন
তাঁর অভিযানে প্রাণীদেহের
যে বিশাল নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন তার প্রায় সবটাই তিনি তুলে দেন কেমব্রিজ ও লন্ডনের বিশেষজ্ঞদের হাতে সঠিক
সনাক্তকরণের জন্য। ভেবেছিলেন যে
মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও গোষ্ঠী থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যখন জানতে পারলেন গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জ
থেকে তিনি যে ফিঞ্চ পাখির নমুনা
সংগ্রহ করেছিলেন তার মধ্যে তেরোটিই ভিন্ন প্রজাতির, তখন তিনি অবাক হয়ে যান। এছাড়াও গ্যালাপ্যাগোস থেকে সংগৃহীত মোকিং
বার্ডেরও ছিল তিনটি প্রজাতি ও
দৈতাকায় কচ্ছপগুলোর ছিল দুটি প্রজাতি। পরে গ্যালাপ্যাগোসের প্রায় হাজার কিলোমিটার উত্তরে কোকোস (Cocos) দ্বীপে ফিঞ্চ
পাখির আরো একটি প্রজাতির সন্ধান
পাওয়া যায়।
অভিযানের সময় এই
ফিঞ্চ পাখিগুলোকে নিয়ে ডারউইন বেশি
চিন্তাভাবনা করেন নি। তাঁর ডায়েরিতে তিনি এই পাখিগুলোর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। অথচ এই চড়ুই পাখির মতো ছোটখাটো
ফিঞ্চ পাখিই ডারউইনের
চিন্তাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলে শুরুতে একই ধরণের
ফিঞ্চ পাখি ধীরে ধীরে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে রূপ নিয়েছে। তাই নতুন প্রজাতি সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর মনে আর কোন সংশয় রইল
না। তবে নতুন প্রজাতি সৃষ্টির
মূল প্রক্রিয়া সম্পর্কে তখনও তিনি কোন ধারণা করতে পারেন নি।
চার্লস ডারউইনের
পূর্বসূরিরা
চার্লস ডারউইনই যে প্রথম
বিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন তা মোটেই সত্যি নয়। এর আগে অন্যরাও এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে চার্লস
ডারউইনের পিতামহ এরাসমাস ডারউইনও
ছিলেন। এছাড়াও ডিভ্যারো, লামার্ক, কুঁভিয়ে, জ্যোফে এঁরা তো ছিলেনই, এছাড়াও ছিলেন ডারউইনের বন্ধু চার্লস লিয়েল। কাজেই বিবর্তন
কিংবা ক্রমবিকাশ
ব্যাপারটি চার্লস ডারউইনের কাছে নতুন কিছু ছিল না। তথাপি আজ বিবর্তনবাদের সঙ্গে ‘ডারউইনিজম’ শব্দটি সমার্থক হয়ে গেছে মূলত যে কারণে
তা হলো তিনি
বিবর্তনের প্রক্রিয়াটি ধরতে পেরেছিলেন।
ডারউইনের
জীবদ্দশায় জনমনে লামার্কের
প্রভাবই ছিল বেশি। এমন কি বিংশ শতাব্দীর গোঁড়া পর্যন্ত লামার্ককেই বিবর্তনবাদের মূল প্রবক্তা হিসেবে ধরা হতো।
তাছাড়া বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ
পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্টরা লামার্কের তত্ত্বকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন মূলত রাজনৈতিক কারণে।
চার্লস ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনে’র তত্ত্ব কম্যুনিস্টদের মনঃপুত ছিল না
এবং সোভিয়েত রাশিয়ায় মস্তিষ্ক
গবেষণার সঙ্গে জেনেটিক্স বা জিন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণাকেও ব্যান করে দেওয়া হয়। গ্রেগর জোহান মেন্ডেল নামে এক বিজ্ঞানী
১৮৬৬ সালেই এই জিন তত্ত্বের
আবিষ্কার করেন এবং বিংশ শতাব্দীতে এই জিনতত্ত্ব নিয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী গবেষণা শুরু হলেও সোভিয়েত রাশিয়াতে এর চর্চা
বন্ধ রাখা হয় কারণ কম্যুনিস্টদের
পয়গম্বর বলে গেছেন ‘মানুষ হলো তার পারিপার্শ্বিকতায় সৃষ্ট’। বংশানুক্রমিক কোন গুণ মানুষের থাকে না। এ ব্যাপারে আমার
একটি বোকার মতো প্রশ্ন আছে যে
বংশগত গুণাবলি যদি না-ই থাকে তাহলে মানুষের পেটে মুরগির বাচ্চা জন্মায় না কেন। যাই হোক কম্যুনিস্ট সরকারের আমলে ওই
দেশে ডারউইনের পরিবর্তে
লামার্কের মতবাদকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই বলতে হয় যে ধার্মিকদের সঙ্গে কম্যুনিস্টদের যতই লড়াই থাকুক না কেন,
সত্যের প্রতি নিষ্ঠার ব্যাপারে
দু-দলেরই অবস্থানই এক। তাই সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞানীদের লড়াই এই দু’দলের সঙ্গেই ছিল।
স্বনামধন্য
লামার্কের পুরো নামটি ছিল জ্যাঁ ব্যাপতিস্ত দে লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯)। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের
জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাসের
প্রদর্শশালার অমেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগের অধিকর্তা। যদিও তিনি সর্বসাধারণের জন্য সর্বজনীন তত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথমে
চারটি বই লিখেছিলেন কিন্তু
বিজ্ঞানীমহল তাঁর এইসব বইয়ের মূল্য দিল না। কারণ বিজ্ঞানীরা ল্যাভোয়েসিয়েরের দেখানো পথকেই সঠিক পথ বলে গণ্য
করতেন। সর্বসাধারণের
জন্য বৈজ্ঞানিকতত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ ও হতাশ লামার্ক শেষ পর্যন্ত পর্যন্ত ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রাণিবিদ্যার দর্শন’ নামে যে বইটি লিখেছিলেন তাই
তাঁকে সাধারণ শিক্ষিত সমাজে স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল। যদিও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর বিষয়ে কতকগুলো বই তিনি লিখেছিলেন ১৮০১
থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত।
যে বছর চার্লস
ডারউইনের জন্ম সেই বছরই প্রকাশিত লামার্কের ‘প্রাণিবিদ্যার
দর্শন’ বইটি ছিল মূলত বিবর্তনবাদকে নিয়ে। চার্লস লিয়েল তখনও রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেননি তবে লামার্কের বইয়ে জেমস হাটনের
ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ
প্রাণিজগতের বিবর্তনকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ‘অসীম কালের মহাকন্দরে’ যা অবশ্যই বাইবেলবিরোধী। তাঁর মতে সময় প্রকৃতি বিজ্ঞানকে
কখনও বিপদে ফেলবে না
কারণ প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য সীমিত সময়ের ধারণাকে আঁকড়ে রাখার প্রয়োজন নেই। তাঁর কাছে ‘সময়’ একটি অসীম শক্তি। প্রাণীদেহের সংগঠনের ব্যাপারে
লামার্কের মন্তব্য ছিল দেহের বিভিন্ন আকৃতি ধারাবাহিকভাবে সারিবদ্ধ সিঁড়ির ধাপে সামান্য থেকে থেকে জটিল আকার নিয়ে
ক্রমশ উচ্চমানে পৌঁছেছে। তিনি
মনে করতেন কোন প্রত্যঙ্গের অধিক ব্যবহারে সেই প্রত্যঙ্গ উন্নত হবে এবং অব্যবহারে দুর্বল হবে। সেই সঙ্গে উন্নত ও
অবনত প্রত্যঙ্গ পরের প্রজন্মে
বর্তাবে। এভাবেই বহু প্রজন্মের ব্যবধানে কোন প্রত্যঙ্গের রূপ বদলে যাবে এবং বংশ পরম্পরায় অব্যবহৃত প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে
যাওয়ায় প্রত্যঙ্গটির
বিলুপ্তি ঘটবে। লামার্ক তাঁর মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিরাফের উদাহরণ দিয়েছিলেন। তাঁর মতে মগডালের পাতা খাওয়ার
দুর্নিবার ইচ্ছার কারণে বহু
প্রজন্মের বিবর্তনে জিরাফের গলা ও সামনের দুটো পা লম্বা হয়ে গেছে। তবে লামার্কের এই ব্যবহারের ফলে কোন প্রত্যঙ্গের
পরিবর্তন পরের প্রজন্মে
সঞ্চারিত হওয়ার তত্ত্বের পেছনে কোন গবেষণা ছিল না। এটা ছিল এক ধরণের অনুমান।
পরবর্তীকালে গ্রেগর মেন্ডেল ও লুই মরগ্যানের জিনতত্ত্ব বা প্রজননবিদ্যার মাধ্যমে লামার্কের তত্ত্ব খারিজ হয়ে যায়।
লামার্কের বিবর্তনবাদের
তত্ত্ব ডারউইনকে প্রভাবিত করেছিল নিশ্চয়ই। তবে মূলত চার্লস লিয়েলের বইয়ে জীবনের প্রগতি বনাম বদল নিয়ে যে বিস্তারিত
আলোচনা ছিল তাই ডারউইনের
দিগদর্শনের কাজ করেছিল বেশি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন