“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬

প্রজাতির উৎস সন্ধানে (সপ্তম পর্ব)

 ।। রজতকান্তি দাস ।।

ডারউইনিজমের উদ্ভাবনে ব্লাইথ ও ম্যালথাসের অবদান
      
(C)Image:ছবি
      ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পত্রিকা
ম্যাগাজিন অব ন্যাচারেল হিস্ট্রি’ –তে এডওয়ার্ড ব্লাইথ নামে জনৈক ব্যক্তির একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ডারউইনের বিখ্যাত নোট বইটিতে দেখা যায় তিনি এই লেখাটি পড়েছিলেন। তিনি পত্রিকার নাম উল্লেখ করে লিখেছেন যে এই জাতীয় ছোট পত্রিকায় ভাল প্রবন্ধ থাকে যা অনেক বিদেশী পত্রিকাতেও থাকে না। যারা লিটল ম্যাগাজিন চালান তাদের জন্য এটি একটি সুখবর বটে।
             ব্লাইথের মতে মানুষ যদি বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীকে তাদের বাসস্থান থেকে সরিয়ে এনে তাদের স্বভাব ও শারীরিক গঠনকে পাল্টে দিতে পারে তাহলে এই একই কাজ প্রকৃতি কেন করতে পারবে না। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন যে এখন যেভাবে আমরা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি দেখতে পাচ্ছি তা কি অতীতের কোন এক বিশেষ প্রজাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যা অভিযোজনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে রূপ নিয়েছে। ব্লাইথের মতে প্রাণীসমূহের মধ্যে যারা তাদের ক্ষিপ্রতা, শক্তি অথবা কোন ইন্দ্রিয়ের সূক্ষ্মতার সাহায্যে খাদ্য আহরণ করে তাদের মধ্যে যে সর্বাধিক সংগঠিত, সে নিশ্চয়ই অন্যদের চাইতে বেশি খাদ্য আহরণ করতে পারবে এবং শারীরিকভাবে শক্তিমান হয়ে প্রতিপক্ষদের পরাজিত করবে, সেই সঙ্গে নিজেদের উচ্চতর গুণগুলি সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করবে। তবে ব্লাইথ এ ব্যাপারে বেশি দূর এগোতে পারেন নি। শক্তিমানের জেতা ঈশ্বর নির্দিষ্ট বলেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন।
           চার্লস ডারউইনের প্রজাতির উৎস সন্ধানে এডওয়ার্ড ব্লাইথের প্রবন্ধ তাঁকে কতটা সহায়তা করেছিল তা নিয়ে সংশয় থাকলেও আরেক চিন্তাবিদ থমাস রবার্ট ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৮) যে বইটি লিখেছিলেন তা ডারউইনের বিবর্তনবাদ আবিষ্কারে যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তা স্বয়ং ডারউইনই অকপটে স্বীকার করে গেছেন।
              ম্যালথাস ছিলেন ইউরোপের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, রয়্যাল সোসাইটির সদস্য, লন্ডনের স্ট্যাটিস্টিক্যাল সমিতির সহ-প্রবর্তক এবং তাঁরই উদ্যোগে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিভাগ খোলা হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনস্থ কলেজে। ১৭৯৮ সালে ম্যালথাসের যে চটি বইটি বেরিয়েছিল, তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী তার দীর্ঘ শিরনামটি ছিল An Essay on the Principles of Population as it Affects The Future Improvement of Society, with Remarks on the Speculation of M. Godwin, M. Condorcet and other Writers, সংক্ষেপে ‘Priciples of Population’ অর্থাৎ জনসংখ্যার মূলতত্ত্বপরে এই চটি বইটির একটি বর্ধিত সংস্করণও বেরিয়েছিল।
             ম্যালথাসের পিতার বয়েসি অনেক দার্শনিকরাই তখন নতুন সহস্রাব্দের সুখকর চিন্তায় বিভোর ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন নতুন সহস্রাব্দের মানুষ যুক্তিবাদী হবে ও মিলেমিশে দুঃখহীন পৃথিবীতে বাস করবে। কিন্তু তাঁদের এই ভাবনায় যেন কিছুটা ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল ম্যালথাসের জনসংখ্যার মূলতত্ত্ব। তিনি দেখালেন যে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে কিন্তু খাদ্যের জোগান বাড়ে গাণিতিক হারে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি ১, , , , ১৬, ৩২, ৬৪ ... এইভাবে হয় তাহলে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্যোৎপাদন বাড়তে পারে এইভাবে, যেমন ১, , , , , , , ... কাজেই জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের জোগান পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি না হওয়ায় জনসংখ্যার দ্রুতহারে হ্রাস অবশ্যম্ভাবী। তাই যুদ্ধ বিগ্রহ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির মাধ্যমে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার খাদ্যোৎপাদনের বৃদ্ধির হারের সঙ্গে মানিয়ে নেবে।
            এটা ঠিক যে ম্যালথাসের এই তত্ত্বের মধ্যে কিছুটা অতিসরলীকরণ ছিল। বর্তমান পপুলেশন থিওরি আরো অনেক জটিল। আর সত্য সব সময়ই জটিল। আসলে ম্যালথাস তাঁর সমসাময়িক যুগের ছন্নছাড়া ইউরোপীয় সমাজ, উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর গরিবি ইত্যাদি দেখেই অভ্যস্ত ছিলেন। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি, জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং পুঁজিবাদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবেন নি।
             ডারউইন দেখলেন যে ম্যালথাস মানব সমাজ নিয়ে যা লিখেছেন তা পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর জন্যই প্রযোজ্য। তাই প্রতিটি প্রজন্মে অস্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং খাদ্য ও বাসস্থানের জোগানের তারতম্যই তাঁকে ‘Struggle for Existence’ অর্থাৎ বেঁচে থাকার সংগ্রামের নির্দেশ করেছিল। এই বেঁচে থাকার সংগ্রামের কারণেই যে বিবর্তন ঘটে তা তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় নি। কেউ একজন মন্তব্য করেছিলেন বিবর্তন যদি হয় মেশিন তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনহলো তার ইঞ্জিন এবং খাদ্যের জন্য ক্রমাগত লড়াই হলো তার জ্বালানি। তাই ডারউইন বিবর্তনবাদ আবিষ্কারের জন্য ম্যালথাসের জনসংখ্যার মূলতত্ত্বের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করে গেছেন।

চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ
            ডারউইনের বিবর্তনবাদ আবিষ্কারে সময় লেগেছে অনেক। সামাজিক স্তরে দেখতে গেলে প্রায় দুহাজার বছরের ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে মানব সমাজকে এগিয়ে যেতে হয়েছে অনেক দূর। ছহাজার বছরের সীমিত সময়ের ধারণা, বাইবেলের বিপর্যয়বাদ থেকে মুক্তি এবং এক অবিচল তথা ধীর পরিবর্তনশীল পৃথিবীর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতেই বহু বছর পার হয়ে গেছে। এছাড়াও বিবর্তনের মূল কারণ ও প্রক্রিয়াকে উদ্ধার করতেও ডারউইনকে থাকতে হয়েছে কোন দিশারীর প্রতীক্ষায়। সমকালীন সমস্ত তথ্য ও উন্নতমানের চিন্তাভাবনাকে মূলধন করে শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত ডারউইন বিবর্তনের যে বিশেষ প্রক্রিয়াকে আবিষ্কার করলেন তা হলো প্রাকৃতিক নির্বাচনবা ‘Natural Selection’ এই প্রাকৃতিক নির্বাচন হলো সেই ইঞ্জিন যা প্রাণিদেহের মধ্যে অভিযোজন ঘটিয়ে অবশেষে নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। এই বিশ্বে মানব প্রজাতি শুরু থেকেই ছিল না। এই বিবর্তনের ধারায় মানব প্রজাতিরও উদ্ভব ঘটেছে। তবে এই প্রসঙ্গে আমি পরে আসব। প্রথমে আমাদের দেখতে হবে এই প্রাকৃতিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াটি কি।
ডারউইন লক্ষ্য করেছিলেন প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে কিছু না কিছু শারীরিক তফাৎ থাকে। এমন কি ছোট ছোট একই প্রকার প্রাণিগুলির মধ্যেও কিছু না কিছু তফাৎ থাকেই এবং কোন দুটো প্রাণী সম্পূর্ণ সাদৃশ্য হয় না। বিশেষত যৌন প্রজননজাত প্রাণীগুলির মধ্যে বেশি পরিমাণে বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিটি প্রাণীই এত বেশি সন্তানের জন্ম দেয় যে সব সন্তানের জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের সংকুলান করা প্রকৃতির পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতি যোগ্যতমকে টিকিয়ে রাখার জন্য নির্বাচিত করে অন্যদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটায়। প্রকৃতির এই অমানবিক দিকটির কথা ডারউইনের বই প্রকাশিত হওয়ার আগেই আঁচ করতে পেরেছিলে ইংরেজ কবি টেনিসন। তিনি লিখেছেন প্রকৃতি প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কত সাবধান কিন্তু ব্যক্তির প্রতি ততটাই উদাসীন। তাই মানব সভ্যতার সঙ্গে এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরোধ নিয়ে আমি লিখব আমার উপসংহারে। তবে বিজ্ঞানের কাজ হলো সত্যকে প্রকাশ করা তাই ডারউইন একজন বিজ্ঞানী হয়ে নিজের কাজটি তিনি নির্লিপ্ত ভাবেই করে গেছেন। কারণ বৈজ্ঞানিক সত্য আমাদের পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা করে না।
             ডারউইন ভেবেছিলেন যেহেতু প্রত্যেক প্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের সংকুলান নেই তাই যেসব প্রাণীর দেহজ গঠন অধিক খাদ্য সংগ্রহ করার অনুকূল সেই সব প্রাণীগুলি বেশি পরিমাণে খাদ্য সংগ্রহ করে বেশি সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হবে। এই শারীরিক গঠন যেহেতু জন্মসূত্রে পাওয়া তাই এই গঠনই তাদের সন্তানের মধ্যে বেশি পরিমাণে সঞ্চারিত হবে। তাই পরের প্রজন্মে ওই প্রজাতির মধ্যে অনুকূল গঠনের সদস্যই বেশি পরিমাণে হবে। সেখানেও থাকবে একই ধরণের প্রতিযোগিতা। এভাবেই একটি একটি করে বহু সফল প্রজন্মের মধ্য দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশি পরিমাণে অনুকূল গঠন সম্পন্ন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হবে এবং একই সঙ্গে কিছু কিছু প্রতিকূল গঠন সম্পন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে।
             ডারউইন ভাবলেন যে ফিঞ্চ পাখিরা গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপে এসেছিল বাইরে থেকে। কিন্তু আসার পর দেখল এখানে খাদ্যের জন্য কোন প্রতিযোগিতা নেই। তাই মনের আনন্দে এখানে রয়ে গেল। কিন্তু বংশ পরম্পরায় যখন ফিঞ্চ পাখিদের সংখ্যা বাড়তে লাগল তখনই শুরু হলো প্রতিযোগিতা। এই পরিবেশে যে ফিঞ্চ পাখিগুলোর জন্মসূত্রে ঠোঁট কিছুটা বড় তারা বড় আকারের পোকা ধরতে সক্ষম ছিল। বড় পোকার আমিষ অংশ যেহেতু বেশি তাই এই পাখিগুলোরই স্বাস্থ্য ভাল হওয়ায় বেশি পরিমাণে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে ঠোঁট ছোট পাখিগুলির ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে উল্টোভাবে। এই ভাবেই বহু প্রজন্মের ব্যবধানে এতটাই পরিবর্তন ঘটে যায় যে একই প্রজাতি থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জন্ম হয়।
              খাদ্য ও বাসস্থানের লড়াইকে ডারউইন মোট তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, নিজের প্রজাতির মধ্যে লড়াই, অন্যান্য শত্রুভাবাপন্ন প্রজাতির মধ্যে লড়াই ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য লড়াই। গ্যালাপ্যাগোসে তিনি মূলত শেষোক্ত লড়াইকেই বেশি করে দেখেছিলেন। কারণ এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপগুলির মধ্যে পরিবেশগত পার্থক্য ছিল। যেমন কোনটা আর্দ্র আবার কোনটা শুকনো। কোনটাতে ঘাস আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে, আবার কোনটাতে অপর্যাপ্ত। কোথাও ঝোপঝাড় বেশি, কোথাও বা কম ইত্যাদি। এই বিভিন্ন পরিবেশে খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একই প্রজাতির শারীরিক গঠনের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে বিশাল সময়ের ব্যবধানে। এসবই তিনি লক্ষ্য করেছিলেন তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে। তবে তাঁর সঙ্গী ফিজরয়ের এসব কিছুই নজরে আসেনি কারণ বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
              বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের অপ্রতুল সম্ভারের জন্য লড়াইয়ে শুধুমাত্র যোগ্যতমের সংরক্ষণই হলো প্রাকৃতিক নির্বাচনযা ডারউইনের সময়ে কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি। ওই সময়ে এটা কল্পনা করা খুব সহজ ছিল না তা বুঝা যায় যখন দেখি ডারউইনের মৃত্যুর ষাট বছর পরও অনেকেই তা বুঝতে পারেন নি। তবে পরবর্তীকালে জিনতত্ত্ব, ভ্রূণবিজ্ঞান, শরীরবিজ্ঞান, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার অগ্রগতির ফলে এটা মোটের উপর এটা প্রমাণিত যে ডারউইন ছিলেন অভ্রান্ত। তবে ডারউইনের সমালোচকরা বলেন যে তিনি বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে পরস্পর নির্ভরতা নিয়ে কিছুই বলেনি। এই ধরণের সমালোচনা ডারউইনের মতবাদের অসম্পূর্ণতা নির্দেশ করে ঠিকই কিন্তু তা খারিজ করে দেয় না।

কোন মন্তব্য নেই: