“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫

রাতের হারিয়ে যাওয়া তারারা


।।রজতকান্তি দাস।।


শিলং শহরে আমাদের বাড়ি ছিল পাহাড়ের উপর। আমাদের ছোটবেলায় রাতের আকাশে ঝলমল করতো তারারা। মনে আছে লক্ষ লক্ষ তারার আলোয় ভরে থাকত আমাদের রাতের সমস্ত আনন্দ। এর বেশির ভাগ তারাই উজ্জ্বল সাদা রঙের আবার এর মধ্যে কতকগুলো ছিল লাল। এই লাল তারারা হলো রেড জায়েন্ট। এগুলো যে আয়তনে বিশাল হয় তখন জানতাম না। নক্ষত্রগুলোর পারমানবিক জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে গেলে রেড জায়েন্টের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সপ্তর্ষি মণ্ডল, কালপুরুষ কিংবা ছায়াপথকে কেউ কখনো চিনিয়ে দেয়নি ঠিকই তবে নিজে নিজেই চিনেছি। মনে আছে আমার এক কাকা আমাকে লুব্ধক নামের তারাটিকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। মোটের উপর নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ যা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল তা যে গায়েব হয়ে গেছে এ নিয়ে কারুর মনে কোন ধরণের আক্ষেপওতো নেই। তাই ভাবি যে সব কবিরা রাতের উজ্জ্বল তারকাখচিত আকাশ নিয়ে কবিতা লেখেন তারা কি আদৌ জানেন যে শহরাঞ্চল থেকে এই আকাশ এখন আর দেখা যায় না। মনে হয় রাতের আকাশের দিকে তারা তাকান না কারণ তাকালে জানতেন যে তারাগুলো সব গায়েব হয়ে গেছেলক্ষ লক্ষ তারার মধ্যে এই গুয়াহাটি থেকে কয়েকটা মাত্র এখনো দেখা যায়। দশ বছর পর তাও দেখা যাবে না। এদিক থেকে গ্রামের লোকেরা অবশ্যই বেশি ভাগ্যবান। তবে তারকাদর্শনের উপর আগ্রাসন সেখানেও ধীরে ধীরে হবে।
            প্রশ্ন হলো যে একেকটা নক্ষত্রতো আকাশে হাজার কোটি বছর ধরে জ্বলতে থাকে, তা হলে মাত্র ৩০-৪০ বছরের মধ্যেই সব গায়েব হয়ে গেল কি করে। কারণটা হলো স্কাই-গ্লো। আমরা জল প্রদূষণ, বায়ু প্রদূষণ, শব্দ প্রদূষণ শুনেছি ঠিকই কিন্তু আলোক প্রদূষণও যে এক ধরণের প্রদূষণ তা নিয়ে আসলে আমরা ভাবি না। শহরাঞ্চলে এই আলো প্রদূষণের জন্যই দেখা দেয় এই স্কাই-গ্লো। রাতের বেলা রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট, দোকানের গ্লো-সাইন, শ্বপিং মল ইত্যাদি ছাড়াও আমাদের বাড়িতে যে সব বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার হয় তারও অনেকটা বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই তৈরি হয় এই স্কাই-গ্লো
            রাতের বেলা শহরাঞ্চলের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোক রশ্মি বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণা ও জলকণার সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ে। এই আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণের ফলে শহরের আকাশে তৈরি হয় এক আলোর আস্তরণ। কখনও দেখতে অনেকটা পাতলা মেঘের মতোও মনে হয়। রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো এই আলোর পর্দায় ঢাকা পড়ে যায়। কয়েক বছর আগে শিলচর গিয়েছিলাম নাইট সুপারে। মাঝরাতে রাস্তায় গাড়িটা দাঁড় করানো হলো কিছু যাত্রীর অনুরোধে, কারণটা অবশ্যই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া। তা ঐ একই উদ্দেশ্যে আমিও নামলাম বাস থেকেহঠাৎ মনে পড়লো এখানে তো স্কাই-গ্লো নেই আর সময়টাও শীতকাল অর্থাৎ মেঘহীন আকাশ।  শীতের দিনে বাতাশে জলকণাও বেশি থাকে না। তাছাড়া জায়গাটা জঙ্গলের ভেতর তাই এখানে ধূলিকণাও বিশেষ নেই। তাই আকাশের দিকে তাকাতেই যা দেখলাম তা বহুদিন পর দেখলাম। এক ঝলমলে তারা ভরা নিকস কালো আকাশ। উজ্জ্বল, অতি উজ্জ্বল। অসংখ্য, অগুনতি। দেখে দেখে যেন আর আশ মেটে না। মনটা ভরে উঠলো ঠিকই তবে সেই সঙ্গে দুঃখও হলো। কারণ এ জিনিস আবার কবে যে দেখব তা তো জানি না। আমাদের এই গুয়াহাটি মহানগরীতে অনেক কিছুই পাওয়া যায় তবে এটা পাওয়া যায় না।
            রাতের এই যে আলোক প্রদূষণ এতে পাখিদের দেহমনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এছাড়া অন্যান্য জীবজন্তু সহ মানুষের দেহমনেও এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে স্কাই-গ্লোর কারণে অবশ্য নাসার (NASA) বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বাধা সৃষ্টি হয় না কারণ তারা তো হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। এই টেলিস্কোপ থাকে বায়ুমণ্ডল থেকে বহুদূর মহাকাশে যেখানে বায়ুমণ্ডলের বিরূপ প্রভাব পড়ে না। তবে বিপদে পড়েছেন শৌখিন ও পেশাদার আকাশ পর্যবেক্ষকরা। এছাড়া কিছু প্রকৃতিপ্রেমীও এই স্কাই-গ্লো নিয়ে চিন্তিত। ১৯৮৮ সালে এরা মিলে এক সংস্থার জন্ম দিয়েছেন যার নাম ইন্টারনেশনেল ডার্কস্কাই এসোসিয়েশন (IDA)এই সংস্থার মূল কাজ হলো শক্তি সংরক্ষণ ও রাতের বেলায় বাইরের আলো কমানো। বর্তমানে IDA এর তরফ থেকে বেশ কিছু ডার্কস্কাই পার্ক তৈরি করা হয়েছে যেখান থেকে রাতের আকাশ পরিষ্কার দেখা যায়। আমেরিকা সহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে শহরাঞ্চল থেকে বহুদূরে নির্জন এলাকায় তৈরি করা হয়েছে এই পার্কগুলো। এছাড়া মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেও আশ্রয় নিয়েছেন অনেক আকাশ পর্যবেক্ষক। এই আকাশপ্রেমীরা আলোকদূষণ নিয়ে এতোটাই চিন্তিত যে তারা ঘরের ভেতরেও খুব কম আলো ব্যবহার করেন এবং সেই আলো যাতে ঘরের বাইরে না যায় সে সম্পর্কে সাবধান থাকেন। বাইরের সব কাজ দিনের বেলাতেই সেরে নেন যাতে রাতের অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে কোথাও যেতে না হয়। আশা করি এই লেখার পাঠকরা এরপর যখনই রাতের বেলা শহর থেকে দূরে যাবেন তখন রাতের আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাতে ভুলবেন না।




কোন মন্তব্য নেই: