(C)Image:ছবি (ব্রাদার টমের ছবি নয়) |
জনা কয় সঙ্গী নিয়ে যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রাম হয়ে
তিনি রাঙ্গামাটি পৌঁছালেন।
সেখান থেকে নৌকায় কর্ণফুলী নদীর উজান বেয়ে দেমাগিরি। দুইরাত সেখানে
কাটিয়ে একজন দোভাষী নিয়ে খচ্চরের পিঠে চেপে তারা এগিয়ে চললেন লুংলের পথে, পাহাড়ি ‘মিউল ট্র্যাক’ ধরে।
যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তারা এগোচ্ছেন, তারই চূড়ায় একটা জনজাতি গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আর দুটো বাঁক ঘুরলেই তিনি গ্রামে পৌঁছে যাবেন। এমন সময়
ক্ষুব্ধ পাহাড়িরা চূড়া থেকে বড় বড় পাথরের চাঁই গড়িয়ে ছাড়তে লাগল তাঁর এবং তাঁর
সঙ্গীদের তাক্ করে, একের পর এক। পাঁচ
দশটা নয়, শ’ খানিক হবে। খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে বড় গাছের আড়ালে, পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে তারা প্রাণরক্ষা করলেন ঠিকই, কিন্তু রক্তাক্ত আহত হলেন কমবেশি সবাই। মাথায় পাথরের আঘাত
পেয়ে একটা খচ্চর মারা গেল। দমে গেলেন না তারা, দোভাষীকে আগে পাঠিয়ে অতি কষ্টে সাক্ষাৎ করার অনুমতি নিলেন গাঁওবুড়ার কাছ থেকে।
যিশুকে স্মরণ করে অসীম সাহসে তারা উপস্থিত হলেন গ্রামবাসীদের মধ্যে। ঘণ্টা দুয়েক
দোভাষীর মাধ্যমে আলোচনা করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করলেন। পরদিন থেকেই লেগে গেলেন
পীড়িত আহত গ্রামবাসীদের চিকিৎসায়। সঙ্গে ওষুধপত্র যা এনেছিলেন, তাই সম্বল।
সেই সঙ্গে রয়েছে মানুষের প্রতি অসীম ভালবাসা, অটল ধৈর্য আর সফলতা প্রাপ্তির দৃঢ় প্রত্যয়। মাস দুয়েকের মধ্যেই শিখে নিলেন
তাদের ভাষা। লুংলে যাবার বাসনা ছেড়ে তিনি ওই গ্রামেই থেকে গেলেন দেড় বছর। গ্রামের
মানুষের কাছে তিনি এখন দেবদূত। তাদের নিজেদের
মধ্যে ঝগড়া বিবাদের নিষ্পত্তিতেও তাঁর বিচার সবাই খুশি মনে মেনে নেয়। আদিতে
গ্রামটির কি নাম ছিল, আজ আর জানা নেই, কিন্তু তার প্রতি শ্রদ্ধায়, এবং প্রথমে তাঁকে ভুল বোঝার ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখতে গ্রামবাসীরাই এর নাম
রাখল, লুংসেন। লুং মানে
পাথর, আর সেন মানে লাল – লাল পাথর। তাদের ছোঁড়া পাথর গুলো মানুষ ও খচ্চরের রক্তে লাল
হয়ে গিয়েছিল বলেই ওই নাম।
এখন আর শুধু লুংসেন নয়, আশপাশের দশ বারোটা গ্রামেই অবাধে যাতায়াত করেন টম্। পাহাড়ি গ্রামবাসী
যুবকেরাই এখন তাঁর স্বেচ্ছাসেবী দেহরক্ষী। সাতটা গ্রামে স্কুল খুলেছেন। শিক্ষক
আনিয়েছেন চট্টগ্রামের মিশনারি স্কুল থেকে। কিন্তু তার আগে তিনি যা করেছেন, তার জন্য সমগ্র মিজোরাম চিরদিন তাঁকে মনে রাখবে। শুধুমাত্র
দক্ষিণ মিজোরামেই আছে অন্তত ছ’টি জনজাতি
সম্প্রদায়। তাদের আছে আলাদা ভাষা, কিন্তু সে ভাষা
ছিল শুধু মুখেই। কোনও লেখ্য অক্ষর ছিলনা তাদের। সব গুলি উপভাষার
শব্দ, বাক্য, প্রয়োগবিধি ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার পর তিনি ইংরাজি
২৬টি অক্ষরের মধ্যে অদল বদল ঘটিয়ে, জোড়া লাগিয়ে মোট
২৫টি অক্ষরের বর্ণমালা তৈরি করে দিলেন তাদের জন্য। আজও সেই বর্ণমালাতেই মনের ভাব
লিখে প্রকাশ করছেন লুসাই, লাখের, হ্মার, বম, পাং, পই, ত্লাংলাও প্রভৃতি প্রায় পনেরোটি মিজো সম্প্রদায়।
স্কুলগুলিতে লেখাপড়া চলছে টম্ লুইনের হাত ধরে পাওয়া সেই ২৫ অক্ষরে।
পরবর্তী দশ-বারো বছরে গোটা মিজোরাম (তখন পরিচিতি ছিল লুসাই
পাহাড়) জুড়ে ঘুরে বেড়ালেন টম্। সম্প্রদায় গুলোর নিজেদের মধ্যেও তখন লেগে থাকত কলহ
বিবাদ। এমন কি রক্তাক্ত প্রাণঘাতী আক্রমণও ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। টম্ তাদের
ঐক্যবদ্ধ করলেন। প্রভু যিশুর অমৃতবাণী ছড়িয়ে দিলেন তাদের মধ্যে। গোটা পঁচিশেক
প্রাইমারি স্কুল, তিনটে পোস্ট অফিস
স্থাপন করালেন সরকারকে চিঠি লিখে। একটা হাসপাতালও গড়ে তুলেছিলেন দেমাগিরিতে, কিন্তু সেটি আজ অস্তিত্বহীন। পাহাড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থেকে গ্রামগুলোর মধ্যে নদী পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। পায়ে হাঁটা
সড়ক তৈরি করালেন। চট্টগ্রাম ও ব্যান্ডেলের চার্চের মাধ্যমে তাঁর কাজকর্মের সমস্ত
খবর আর্চবিশপ হয়ে পৌঁছে গেল ভ্যাটিকানে। তারই স্বীকৃতি হিসেবে এখন তিনি ফাদার টম্
লুইন। মোট সাতাশ বছর পেরিয়ে গেল এভাবেই। এখন বয়স হয়েছে, শরীর আর তেমন ধকল সইতে পারেনা, মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে যান। কেরালায় তাঁর এক ছোট বোন থাকেন, এক চার্চে। তিনি খবর পাঠালেন, “ দাদা, আমিই বুড়ো হয়ে
গেছি, তুমিতো নিশ্চয় আরও
বেশি। আর পারছি না, শরীর জবাব দিচ্ছে, চলো এবার বাড়ি যাই।“ প্রথম দুবার মনের জোরে বোনের প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন।
কিন্তু তার সহকর্মীরাও তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বারংবার অনুরোধ করতে লাগলেন, তাই তৃতীয়বার আর বোনের আবদার নাকচ করতে পারলেন না। বাড়ি ফিরে যাবার
জন্য বৃদ্ধ টম্ যেদিন দেমাগিরিতে কর্ণফুলির বুকে নৌকায় চেপে বসলেন, আক্ষরিক অর্থেই তখন নদীর ঘাটে কান্নার রোল উঠলো। শত শত
পাহাড়ি নর-নারী-শিশুর বুক ফাটা কান্না দেখে বিস্ময়ে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল কর্ণফুলির
টলটলে জলধারা। পক্ককেশ এক বৃদ্ধ তখন নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত দেখার
চেষ্টা করছিলেন সবুজ অরণ্যে ঘেরা তাঁর যৌবনের এই উপবনকে। কিন্তু না, কিছুই দেখতে পেলেন না, বারংবারই ঝাপসা হয়ে আসছিল তার দু চোখের পাতা। ক্রমশ ছোট হতে হতে সেই পরিচিত
মুখগুলো একসময় নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ব্রিস্টলের বাড়িতে ঘুম আসেনা তাঁর। ছোটভাইয়ের ছেলে-বউরা খুব
যত্ন-আত্তি করে। রয়েছেন কেরালা ফেরত ছোটবোনও। নিয়মিত ডাক্তার, চেক আপ্, ওষুধ, পথ্য, গির্জাঘর সবই
হচ্ছে। কিন্তু তবু মনে শান্তি পান না। সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এক বছর পর তিনি আবার
চেপে বসলেন চট্টগ্রামগামী জাহাজে। মাস দেড়েক পর পৌঁছে গেলেন দেমাগিরিতে। সবাই মিলে
তার জন্য একটা ঘর বানিয়ে দেওয়া হল বাজারের উত্তর দিকে এক টিলার মাথায়। অসুস্থ টম্কে
দেখাশোনার জন্য জনজাতি সর্দারেরাই নিজেদের লোককে দায়িত্ব দিল। শরীর ক্রমেই ভাঙছিল, তবু অভ্যাস মত খুব ভোরে উঠে কাঠের পাটাতন দেওয়া বারান্দায়
বসে সূর্যোদয় দেখতেন আর প্রভুর অপার মহিমায় আপ্লুত হতেন । এভাবেই আরও প্রায় চার
বছর তিনি বেঁচেছিলেন। এক সেপ্টেম্বরের ভোরে সূর্যোদয়ের আগে তাঁকে ধরে ধরে এনে
বারান্দায় বসিয়ে তার জন্য চা বানাতে গেল দায়িত্বপ্রাপ্ত ছেলেটি। কিছুক্ষণ পর চায়ের
কাপ হাতে ফিরে এসে দেখে, আরাম কেদারায় ঠিকই বসে আছেন টম্, কিন্তু তাঁর ঘাড়টি কাত হয়ে ঝুঁকে আছে ডান দিকে, নিঃশ্বাস আর পড়ছে না।
পরিতাপের কথা, বিপুল আয়োজনে কবরস্থ
করা হলেও পরবর্তী কালের স্থানীয় মানুষের ঔদাসীন্যে তাঁর কবরটি সংরক্ষিত হয়নি। এমন
কি, ঠিক কোথায় তাঁকে
কবর দেওয়া হয়েছিল, সেই জায়গাটিও
নির্দিষ্ট করে বলার মত কোন তথ্য কারো হাতে নেই। এখন সেই টিলায় গড়ে উঠেছে মিজোরাম
পি ডব্লিউ ডি-র সুদৃশ্য গেস্ট হাউস। গেস্ট হাউসের প্রবেশ মুখে একটা সুন্দর স্মৃতি
ফলকে লেখা আছে “Somewhere here lies the eternal body of Father Tom
Leween, once who gave us our language, our voice. Rest in Peace, Father Tom. We
will never forget you”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন