“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

চাকরি থেকে অবসর নিলো অমূল্য - আমার বন্ধু


    
(C)Image:ছবি--সম্পাদিত
    কৃ
ষ্ণনগর এম ই স্কুলের শিক্ষকেরা আজ খুব খুশি। তাদেরই ছাত্র অমূল্য এ বছর স্কুল শিক্ষান্ত পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। কৃষ্ণনগর স্কুলের এটাই সর্বোচ্চ কৃতিত্ব। হোজাই শহর থেকে মাইলদুয়েক উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কৃষ্ণনগরকে শহরতলি বলাই যায়। কৃষিজমিকে গ্রাস করে করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন গলি, একের পর এক বসতবাড়ি। অধিকাংশ-ই নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের
গরীব কৃষক আর ওইসব নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সন্তানেরাই এই স্কুলের ছাত্র। এখান থেকে পাশ করে  হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া ছেলের সংখ্যা দশ শতাংশের বেশি হবে না, মেয়েদের সংখ্যা আরও কম। বছর ছয়েক আগে চাল ব্যবসায়ী পরেশ নাগের ছেলে এম ই পরীক্ষায় নবম হয়েছিল। এ যাবত ওটাই ছিল কৃষ্ণনগর স্কুলের সেরা ফলাফল। পড়াশোনায় মনোযোগী অমূল্যও যে বেশ ভালই রেজাল্ট করবে, তা সবাই আশা করেছিলেন। কিন্তু একেবারে প্রথম স্থান দখল করে নেবে – এটা প্রত্যাশার বাইরে ছিল। খুশির মাত্রা তাই একটু বেশিই। কিন্তু খুশি নয় অমূল্য নিজে। দিন কতক আগে বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছে, বাবা আর পড়াতে পারবেন না।
            জীবনের পঞ্চম দশকে পা রাখা চন্দ্রমোহন দেবনাথ বিপত্নীক। ছ’ বছর আগে তৃতীয় ছেলের জন্মের কিছুদিন পরেই সূতিকায় ভুগে ভুগে মারা যান তার স্ত্রী। উজানে ডিমাপুর থেকে ভাটিতে রহা পর্যন্ত বাজার গুলিতে ঘুরে ঘুরে তাঁতের কাপড় বোনার সুতো বিক্রি করাই তাঁর পেশা। বাধ্য হয়ে ছোট ছেলেটিকে সম্পর্কিত এক শ্যালিকার কাছে রেখেছিলেনপাশেই বাড়ি, সকাল বিকেল দেখে আসতেন। বছর খানেক হল নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। অমূল্য – তাঁর বড় ছেলে। শান্ত, ধীর, স্থির, পড়াশোনায় মনোযোগী। এখন রান্নার একটা বড় অংশই সে সামলে নেয়ভাইদের দেখে রাখে। রোদে শুকিয়ে, রং মিলিয়ে সুতোর গাঁট তৈরি করে প্যাকিং করার কজেও বাবার সহায়তা করে। কোনদিন ফিরতে দেরি হলে নিজেই আলুসেদ্ধ ভাত রেঁধে ভাইদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের আর ভাইদের পড়াশোনাটাও চালিয়ে যায়। চন্দ্রমোহনের আর্থিক অবস্থা অজানা নয় বলে, স্কুলের শিক্ষকেরাও বই খাতা দিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য করেন, ছুটির পরও এক-দেড় ঘণ্টা সময় পড়ান। এখন মেজ আর ছোট ছেলেটি যদিও মোটামুটি বড় হয়েছে, কিন্তু ছেলেকে আরও পড়াশোনা করানোর মত আর্থিক সঙ্গতি তার নেই।
               মণিপুরের জিরিবামে থাকেন অমূল্যর ছোটমাসি। সম্পন্ন পরিবার। বাবার সাথে আলোচনা করে ছোট মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রাতের ট্রেনে চাপল অমূল্য। পরদিন সকালবেলা শিলচরে নেমে বাস ধরল। খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেল মাসির বাড়ি। খুবই আদর যত্ন করলেন সবাই। দিন পাঁচেক থাকল সেখানে। একদিন মনের কথা খুলে বলল। এম ই স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে সে। আরও পড়তে চায়। কিন্তু বাবার পক্ষে আর সম্ভব নয়। মাসি কি দয়া করে তাকে নিজের কাছে রেখে মেট্রিক পর্যন্ত পড়াতে পারবেন। তক্ষুণি কোন জবাব দিলেন না মাসি কিংবা মেসো। পরদিন খুব যত্ন সহকারে বোঝালেন, পাঁচ ভাইয়ের যৌথ পরিবারে এ রকম একটি ছেলেকে বাড়িতে রেখে পড়ানোর দায়িত্ব নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মন ভেঙে গেলআরও দুদিন পর বাড়ি ফিরে চলল অমূল্য। শিলচর থেকে রাত আটটায় গৌহাটির ট্রেন ছাড়ে। জিরিবাম থেকে বাসে শিলচর যেতে বড়জোর দেড় ঘণ্টা লাগবে। তাই বেলা দুটোর বাসে তুলে দিলেন মেসো। যতটা আশা নিয়ে এসেছিলো, তারচেয়ে দ্বিগুণ হতাশা নিয়ে সে বসে রইলো চলন্ত গাড়ির জানালার বাইরে চেয়েগাড়িতে যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য একঘণ্টা সময় নষ্ট হল।  প্রায় পৌনে পাঁচটায় বাস থামল। হাতে পয়সা বেশি নেই, তাই রিক্সা নিল না। হেঁটেই রেল স্টেশনে চলে যাবে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, ইন্ডিয়া ক্লাব থেকে ডানদিকে সোজা রাস্তায় গেলেই স্টেশন। আনমনা হয়ে হাঁটতে লাগল সে। তা হলে পড়াশোনা আর হবেই না তার জীবনে ! হোজাইতে কোন দোকানে টোকানে কাজে লেগে গেলে কেমন হয় । মালিককে বলে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারলে হয়তো কিছুটা পড়াশোনা করা যাবে। বাবার সাথে সুতোর ব্যবসায় লেগে গেলে সে সম্ভাবনাটাও আর থাকবে না। স্যারদের বলে যদি প্রাইভেট পড়ার একটা সুযোগ করা যায়। ছোট্ট মাথায় কোন কূল কিনারাই পাচ্ছেনা সে। যে জায়গা থেকে ডানদিকে এক মিনিট গেলেই স্টেশন, সেই জায়গাটা পেরিয়ে চলে গেল প্রায় তিন কিলোমিটারঅন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাত খেয়াল হল, এদিকটা তো শহরের বাইরে মনে হচ্ছে। সামনে একটা দোকান। একজন লোক দোকানের বাইরে একটা বিস্কুটের টিনের উপর বসে দোকানীর সাথে গল্প করছে। “কাকু, স্টেশনটা কি আরও আগে ?” ভুরূ কুঁচকে ভদ্রলোক পালটা প্রশ্ন করলেন, কোত্থেকে আসছো তুমি ? যাবেই বা কোথায় ? অমূল্যর জবাব শুনে বললেন, জিরিবাম বাস স্ট্যান্ড থেকে স্টেশন তো দশ-পনেরো মিনিটের রাস্তা। তুমি তো অনেক দূর চলে এসেছো। যেদিক থেকে এসেছ, সেদিকেই আবার ফিরে যেতে হবে। কিন্তু এখন তো অন্ধকার হয়ে গেছে, যাবে কি করে ? আমার সাইকেলটাও পাংচার হয়ে আছে, নইলে হয়তো দিয়ে আসতাম। দোকানী বললেন, দাঁড়াও, একটা বিস্কুট আর জল খাও। বাচ্চা ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল ভদ্রলোকের। তিনি চেঁচিয়ে কা’কে যেন ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তাদের সাইকেল টা বাড়িতে আছে কি না । নেই। একা একা কেন এসেছিলে বাপ্‌ ! প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল অমূল্য। ভদ্রলোক অভয় দিলেন। চিন্তা করোনা, কিছু ব্যবস্থা না হলে রাতটা আমার বাড়িতেই থাকবে। কাল সকালে আমি যখন স্কুলে যাবো, তোমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যাবো। শেষ পর্যন্ত তাই হল।
          ভদ্রলোকের নাম প্রদ্যুম্ন দাস। শিলচর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী। রাতে খেতে বসে কথায় কথায় জানতে পারলেন, সে পড়াশোনা করতে চায়। বাবার সামর্থ্য নেই বলে মাসির বাড়ি এসেছিল। কিন্তু তারাও অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। প্রদ্যুম্ন বাবুর চট করে মনে পড়ে গেল, স্কুলের এক প্রৌঢ় শিক্ষিকা কয়েকদিন আগে ঠিক এরকমই একটা ছেলের খোঁজ করছিলেন। বললেন, তুমি যদি টুকটাক বাড়ির কাজ-কর্ম করে পারো, তো আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। রাজী হয়ে গেল অমূল্য। পরদিন সকাল সকাল সাইকেলটা মেরামত করিয়ে অমূল্যকে নিয়ে স্কুলে গেলেন প্রদ্যুম্নস্কুলের পাশেই ঊষা দিদির বাড়ি। ঊষা ধর চৌধুরী। শিক্ষিতা বিধবা মহিলা, বয়স পঞ্চান্নর কাছাকাছি। বনেদী বাড়ির বধূ ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর বিত্তবান কাকার বাড়িতে থেকে চাকরি করছেন। একমাত্র ছেলে ইংরাজিতে এম এ পাশ করে চিত্তরঞ্জনে ভাল চাকরি করে। তিনি এখানে একাই থাকেন কাকার বিশাল বাড়ির এক অংশে। বাজার করা, জল তোলা, উনুনের জন্য খড়ি আনা ইত্যাদি করতে কষ্ট হয়। তিনিও চাইছিলেন, কোন গরীব বাড়ির ছেলে যদি এই কাজ গুলো করে দেয়, তা হলে তার ভরণপোষণ আর পড়াশোনার দায়িত্বটা তিনি নিতে রাজী আছেন। অমূল্যর সাথে কথা বলে তিনি খুশিই হলেন। সে থেকে গেল তাঁর কাছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল নরসিং হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে, ক্লাশ সেভেনে।
              চৌধুরী বাড়ির পাশেই চা বাগানের মালিক শ্যাম পরিবারের দোতলা বাড়ি। সামনে বেশ বড় খোলা উঠোন। এক সময় ফুলের বাগান থাকলেও এখন সব খা খা। আমাদের বৈকালিক ফুটবলে পা চালানোর জায়গা। খেলার চেয়ে হুল্লোড় বেশি। খেলোয়াড়েরাও অসমবয়সী। পঁচিশ বছরের নানক দা, বত্রিশের শেখর দা, তেইশের গণেশ দা, এগারোর আমি, আট বছরের বড়কা, দশ বছরের রবি, আবার ছুটির দিনে পঁয়ত্রিশের স্বপন দাও এসে যোগ দেন মাঝে মাঝে। এতো হৈ-হল্লার মধ্যেও একটা নতুন ছেলে বারান্দায় বসে বসে বই পড়ে। খেলতে খেলতে হয়রান হয়ে একদিন তার পাশে গিয়ে বসলাম, আলাপ করলাম। সেই শুরু। ছ’মাসের মধ্যেই অমূল্য আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলো। একই স্কুলে সে সেভেনে আর আমি সিক্সে। একসাথে স্কুলে যাই, একসাথে ফিরি। প্রথম বছরেই পরীক্ষায় বেশ ভাল ফল করল সে। চোখে পড়ে গেল সকলের। আমি পড়লাম বিপদেবাড়িতে অভিভাবকেরা, স্কুলে শিক্ষকেরা বলতে লাগলেন, খুব তো গলায় গলায় বন্ধু, তার মত পড়াশোনা করোনা কেন ? সবাই তো আর এক হয়না, আমিও অমূল্য হতে পারলাম না।
           দিন যায়। মেট্রিক পাশ করলাম আমি, সে হায়ার সেকেন্ডারি। ঊষা দিদি রিটায়ার করেছেন। এবার চিত্তরঞ্জনে ছেলের কাছে চলে গেলেন। অমূল্যর মাথার উপর থেকে ছাতা আবার সরে গেল। ঊষা দিদির কাকার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দু বেলা পেটে খাবার তো দিতে হবে। সাপ্লাই অফিসে স্কেলম্যানের অস্থায়ী চাকরি একটা জুটেছে। পড়াশোনায় ইতি টানতেই হল। সন্ধ্যার পর একটা সেন্টার থেকে শর্টহ্যান্ড শিখে নিল। আমি পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে চাকরি পেয়ে চলে গেলাম মিজোরামে। একদিন সন্ধ্যায় সাব ডিভিশনাল অফিসার দ্বিজব্রত পুরকায়স্থ আমায় ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার জানাশোনা কোন মহিলা আছেন, যিনি শর্টহ্যান্ড জানেন ? এলেই চাকরি দিয়ে দেবো।“ একটু চিন্তা করার অভিনয় করে জবাব দিলাম, “মহিলা তো নেই স্যার, তবে আমার এক বন্ধু আছে, ভাল শর্টহ্যান্ড জানে।“ গ্র্যাজুয়েট ? বললাম, না, হায়ার সেকেন্ডারি। একটুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন, চলে আসতে বলুন। খুশিতে ডগমগ হয়ে ঘরে ফিরলাম। সাতাত্তরে মোবাইল যুগ ত দূর অস্ত, মিজোরামের ওই অভ্যন্তরে টেলিফোন ব্যবস্থাই চালু হয়নি। চিঠি দিলাম। দ্বিতীয় চিন্তা না করেই সে গাড়ি ধরল। যেদিন পৌছাল, সেদিন থেকেই চাকরি শুরু। পদোন্নতি হয়ে হয়ে স্বশাসিত চাকমা জেলা পরিষদের ডেপুটি সেক্রেটারি পদে উন্নীত হয়েছে অমূল্য। আমি মিজোরাম ছেড়ে চলে এসেছি, অমূল্য আসেনি।
            বিয়ে করেছে, বাবাকে আমৃত্যু দু হাতে আগলে রেখেছে, ভাইদের আর দুই মেয়েকে মানুষ করেছে, শিলচরে জায়গা কিনে চারতলা বাড়ি করেছে, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, ছোট মেয়েকে গিন্নির সাথে কলকাতায় রেখে পড়াচ্ছে। পরিবর্তন হয়েছে একটাই, যে চুল আর চুলের স্টাইল নিয়ে যুবক অমূল্য খুব সচেতন ছিল, আজ তারা সদলবলে বিদায় নিয়েছে। আমার বন্ধু অমূল্য, স্বশাসিত চাকমা জেলা পরিষদের ডেপুটি সেক্রেটারি অমূল্য চন্দ্র দেবনাথ গত ৩১ মার্চ চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। অফিস থেকে শেষবারের মত বেরিয়ে এসেই আমাকে ফোন করেছে। আশু, এইমাত্র চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলাম। আজ সারাদিন তোকে খুব মনে পড়ছে রে।

কোন মন্তব্য নেই: