।। রজতকান্তি দাস।।
শিলঙে একজন ফিজিক্সের প্রফেসর আমাকে বললেন তিনি একবার খড়গপুর আইআইটিতে
গেছিলেন সেখানে ছাত্ররা তাকে অনুরোধ করেছে আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’
বুঝিয়ে দিতে। আমি ওনাকে কি বুঝিয়েছিলেন সেটা জিজ্ঞেস করাতে
তিনি বললেন ‘আমি ওদের বলেছি যে সবকিছু হচ্ছে রিলেটিভ’। আরেকদিন গুয়াহাটিতে একজন কেমিস্ট্রির প্রফেসরও
একই কথা বললেন যে আইনস্টাইন বলেছেন যে সবকিছু হচ্ছে রিলেটিভ। উনি যে গাম্ভীর্যের সঙ্গে তা বললেন তাতে মনে
হল যারা ওনার পাশে বসেছিলেন সবাই সেটা বিশ্বাস করেছেন। আমি আরও বহু জায়গায় অনেক শিক্ষিত লোককে এটা
বলতে শুনেছি আর দেখেছি যে লোকে তাদের কথা বিশ্বাসও করে।
তা সবকিছু যে আপেক্ষিক
এটা আমাদের সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায়। আর যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায় তাই আবিষ্কার করে আইনস্টাইন হয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য। যে জিনিস নিউটন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত
অনেকেই লিখে গেছেন তার জন্য ক্রেডিট দেওয়া হলো একা আইনস্টাইনকে, এতো ভারি অন্যায়। এখানে রবীন্দ্রনাথের কথা বললাম কারণ ১৯১৪
সালে তিনি ‘আমার জগত’ নামে একটি প্রবন্ধে
বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে উপনিষদীয় ভাবধারার এক অনাবিল সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। আমার মতে এই প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ
প্রবন্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবি এক অসাধারণ কাব্যিক ঢঙে বিজ্ঞানের এই
সমস্যাটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
যাই হোক, যে জিনিস আমাদের সাধারণ বুদ্ধির গোচর তা আবিষ্কার করে আইনস্টাইন
হলে গেলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, এটা ঠিক হজম হওয়ার মতো কথা নয় কিন্তু। মনে রাখতে হবে যে আইনস্টাইনের এই তত্ত্বটি
নিয়ে লন্ডন টাইমস পত্রিকায় যে রিভিউ বেরিয়েছিল তাতে এই থিওরিকে বলা হয়েছিল
‘an affront to common sense’ অর্থাৎ ‘সাধারণ বুদ্ধিতে আঘাত’।
আমি এখানে বিজ্ঞানের
এই জটিল তত্ত্বটি নিয়ে কিছু লিখতে বসি নি। সে ক্ষমতাও আমার নেই।
আমি শুধু এটুকুই বলতে
চাই যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদকে নিয়ে সাধারণভাবে এমনকি শিক্ষিত লোকেরাও যা বলেন
তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল।
এই ভুল পশ্চিমী দেশগুলোতেও
আছে। এ সম্পর্কে বিখ্যাত
রিলেটিভিস্ট নিগেল কেলডার তাঁর ‘Einstein’s Universe’ বইতে লিখেছেন “Einstein is often
said to have told that ‘all things are relative’. He did not. Relativity
is in fact a thoroughly bad name for the theory. Einstein considered calling it
in opposite, ‘invariance theory’. He discovered what was ‘absolute’ and
reliable despite the apparent confusions, illusions and contradictions produced
by relative motion or the action of gravity.” নিগেল কেলডারের লেখায় একটা কথা স্পষ্ট যে আইনস্টাইন এটা বলেননি
যে সবকিছু আপেক্ষিক।
বরং তিনি উল্টোটাই
বলেছেন। কিন্তু জনগণের মধ্যে
এই বিভ্রান্তি দেখা গেছে মূলত এর ভুল নামটির জন্য। এই ভুল নামটির জন্য আইনস্টাইনও মনে কষ্ট পেতেন।
‘আন্নালেন দার ফিজিক’
নামের জার্মান পত্রিকায়
১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের যে প্রবন্ধটি বেরিয়েছিল তার শীর্ষক ছিল ‘On the Law
of Electrodynamics’।
এখানেও রিলেটিভিটি
শব্দটি নেই। জনসাধারণের জন্য আইনস্টাইন
এর নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘Theory of Invariance’। কিন্তু কিছু সংখ্যক সাংবাদিকদের জন্য একটি
ভুল নাম এর ঘাড়ে চেপে গেছে এবং সেই সঙ্গে যারা নাম শুনেই কাজ বোঝে যান তাদের কল্যাণে
আইনস্টাইনের তত্ত্বটি নিয়ে জনমনে এক ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে বিজ্ঞানের ছাত্রদের যারা
শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য বিজ্ঞান পড়ে না, বরং প্রকৃতিকে ভাল
করে জানবার জন্যই বিজ্ঞান পড়ে।
শুরুতেই তাদের মনে
এক ভ্রান্ত ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ায় বিশ্বপ্রকৃতিকে ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছে না তারা।
‘বিশেষ আপেক্ষিকতত্ত্ব’,
এই নামকরণের একটি সার্থকতা
অবশ্য খুঁজে পেয়েছেন নিগেল কেলডার।
তাঁর মতে এই নামটি
আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গবেষণাকালে কোন বিষয়টি আইনস্টাইনকে সবচেয়ে ভাবিত করে তুলেছিল। কেলডার আরও বলেছেন যে “Einstein
gave the observer his proper status in modern science.”।
বিশেষত গতি বিজ্ঞানে আপেক্ষিকতার সমস্যা ছিল বহু শতাব্দী
ধরেই। দেখা যায় যে কোনো এক নিরীক্ষণস্থলকে বাদ দিলে কোনো বস্তুর নিজস্ব গতি বের
করা যায় না। আমি যে গাছটিকে দেখছি স্থির সেটিও আসলে গতিশীল কারণ পৃথিবী সঙ্গে তারও
একটা গতি আছে। পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখলে গাছটিকে গতিশীলই দেখাবে। তাছাড়া যদি একজন
ব্যক্তি একটি ট্রেনে বসে একটি ক্রিকেট বল ওপর দিকে ছুঁড়ে দেন তাহলে তা আবার তার
হাতেই এসে পড়বে। এই ব্যক্তিটি দেখলেন যে বলটি সোজা উপরে ওঠে নিচের দিকে নামল।
কিন্তু এই বলটির গতি যদি কেউ ট্রেনের বাইরে থেকে দেখেন তাহলে তিনি দেখবেন তা
ধনুরাকৃতি বা projectile।
এখন প্রশ্ন হলো যে
বলটির গতি আসলে কি রকম। দেখা যাচ্ছে যে যেহেতু বলটির গতি একেকজন দর্শকের কাছে একেক
রকম তাই বলতে হয় যে বলটির গতি দর্শক-নির্ভর এবং তার নিজস্ব কোনো গতি বা গতির ধরণ
নেই। এটা হলো নিউটনীয় আপেক্ষিকতাবাদ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আমার জগৎ’ প্রবন্ধে এই
আপেক্ষিকতার মায়াজাল থেকে সোজা উপনিষদীয় ভাব ধারায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন
এই আপেক্ষিকতার মায়াজাল থেকে বিজ্ঞানকে বের করে এনে এক অনাপেক্ষিক জগৎ-কে উপহার
দিয়েছেন আমাদের ধ্যান-ধারণায়। এই কাজটি তিনি করতে পেরেছিলেন স্পেস ও টাইমের যে
ধারণা আবহমান কাল ধরে চলে আসছিল এবং যে ধারণার উপর সমস্ত নিউটনীয় বলবিজ্ঞান
প্রতিষ্ঠিত তার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে লেখক রোনাল্ড ডব্লিউ ক্লার্ক
লিখেছেন ‘... this dissertation of some nine
thousand words overturned man’s accepted ideas of time and space … and
drastically altered the classical concepts of physics still held by the
overwhelming majority of scientists. In addition, it provided such an accurate
blueprint for the way in which the physical world was built that within a
generation man could no more ignore relativity in the teaching of physics than
they could ignore grammar in the teaching of language.(এই মৌলিক রচনার প্রায় নয় হাজার শব্দে ‘সময়’ ও ‘আকাশ’ সম্পর্কে মানুষের
স্বীকৃত ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া হলো এবং পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুপদী ধারণাকে
এমন জোরালো ভাবে পরিবর্তিত করে দিলো যে অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই অভিভূত হয়ে পড়লেন।
এছাড়াও এই তত্ত্ব পদার্থ-জগতের রচনা সম্পর্কে এমন এক নক্সা তৈরি করেছিল যে একই
প্রজন্মে মানুষের পক্ষে আপেক্ষিকতাকে বাদ দিয়ে পদার্থবিদ্যা শিক্ষা হয়ে পড়ল
ব্যাকরণ বাদ দিয়ে ভাষা শিক্ষার মতো।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন