“শুধু
তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো”
সেই কোন সুদূর বালিকাবেলায় এই মানুষটির হাত ধরে
পথ চলা শুরু হয়েছিল।স্মৃতির সরণি বেয়ে পেছন ফিরে তাকালে অস্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিনও
ছিল শরতকালের পূজো-গন্ধ মাখা সকাল।নীল আকাশে হয়তো ভেসেছিল সাদা মেঘের ভেলা, হয়তো
বা সোনাঝরা রোদে উজ্জ্বল ছিল দশদিক,হয়তো সবুজ ঘাসের চাদরে শিশির মাখা শেফালিরা এঁকেছিল
শারদীয় আলিম্পন, কোন জলজ ভূমির পাশে হয়তো চামর দুলিয়েছিল কাশের গুচ্ছ। কিন্তু
ফুল-ছাপ জামা পরা,দু-বিনুনি বাঁধা,ফু্লকো-লুচি গাল ছোট্ট মেয়েটির সেদিকে কোন
দৃষ্টি ছিল না। তার তখন ভারি মন খারাপ। বাড়ীর পাশের মাঠে দুগ্গা প্রতিমায়
রং-তুলির টান পড়ে গেছে; অথচ তার পূজোর জামা-জুতো কিছুই এখনও পাওয়া হলনা। সকাল থেকে
তাই মায়ের শাড়ীর আঁচল কচি হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘ্যান্ঘ্যান,প্যান্প্যান....
একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধূ মা তখন স্বামী-দেবর-ভাসুর-শ্বশুরের দৈনন্দিন
পরিচর্যায় ব্যস্ত।মেয়ের মুখ দেখে কষ্ট হলেও করার কিছু নেই।কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন
মেয়ের মন ভোলানোর।মেয়েও নাছোড়।তার পূজোর জামা চাই-ই চাই।তক্ষুনি তক্ষুনি।
অতঃপর মা মেয়েকে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের একান্ত
ঘরটিতে। বিছানার তোষক তুলে বের করে আনলেন ঈষৎ বিবর্ণ, হল্দেটে হয়ে যাওয়া “সহজ
পাঠ”... “মামন,তুমি এখন এই বইটা পড় দেখি বসে বসে;কত সুন্দর ছবি-ছড়া আছে...বিকেলে
বাবা অফিস থেকে ফিরলে তোমার পূজোর জামার কথা বলব এখন”...
মা চলে যান রান্নাঘরে স্বস্থানে।নিরুপায় মেয়ে
চোখের জল মুছে আন্মনে উল্টোয় বইয়ের পাতা।আর তারপরেই ভোজবাজি। পাতায় পাতায় অদ্ভুত
সুন্দর ছড়া –ছবির দৃশ্য জাদু-মাখানো চাবিকাঠির মত এক মায়াময় জগতের দুয়ার খুলে
দেয়..... “দিনে হই একমতো,রাতে হই আর,রাতে যে স্বপন দেখি মানে কিবা তার”, কিংবা
“নদীর ঘাটের কাছে, নৌকো বাঁধা আছে,নাইতে
যখন যাই দেখি সে জলের ঢেউয়ে নাচে”, অথবা “কাল ছিল ডাল খালি,আজ ফুলে যায় ভরে, বল্
দেখি তুই মালী, হয় সে কেমন করে?” বা সেই যে “কুমোরপাড়ার গোরুর গাড়ি,বোঝাই করা কল্সী
হাঁড়ি..” ইত্যাদি ইত্যাদি চিত্রকল্প কোথায় কিভাবে ধুয়ে মুছে দিয়ে যায় তুচ্ছ পুজোর
জামার বায়না, তা টেরই পায় না সেই বোকা মেয়ে।
সেই শুরু।‘সহজ পাঠে’র সহজ সুরে সুরে তাঁকে চিনে
নেওয়া।তারপর ‘শিশু ভোলানাথ’ কে সঙ্গী করে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর বেলা...মৃদু সমীরণ
পরশেই তখন ‘গায়ে আমার পুলক জাগে,চোখে ঘনায় ঘোর..’। কত সাধ, কত ভাব। কিছু আভাস,কিছু
কল্পনা। কিছু অনুমান,কিছু ঘটনা। সবেতেই তিনি অবলম্বন।এই যে নিতান্তই সাধারণ এক
মেয়ের জীবনকে অসাধারণ করে তুলে তার গভীর গোপন অস্তিত্বের অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে
যাওয়া, এ শুধু রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব। তাঁর অসম্ভব মানবিক চেতনা ও নিগূঢ়
সংবেদনশীল মানসিকতা নিরন্তর ছুঁয়ে যেতে পারে যে কোনও মানবমনের নিভৃত
ভাবনাকে,প্রকাশের বাণী দিয়ে যেতে পারে প্রতিটি অপ্রকাশিত অনুভূতিকে।তাই তো তিনি
‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’।
ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে ছিল তাঁর এক
নিবিড় আত্মিক যোগ।ফুল, পাখি,গাছ,পশুর মত মানুষও এই প্রকৃতিরই এক অঙ্গ,তার চাইতে
বেশি কিছু নয়,সে কথা বার বার বলেছেন তাঁর গানে, কবিতায়, রচনায়।প্রকৃতি ও পরিবেশের
সঠিক সংরক্ষণ যে কেবলমাত্র মানব ও জীব-জগতের অস্তিত্বকেই আরও সুরক্ষিত করে,সেই
বৈজ্ঞানিক সত্যটির ইঙ্গিত তিনি বহুভাবেই দিয়েছেন। ‘বনমহোৎসব’, ‘বৃক্ষরোপণ’ ইত্যাদি
তাঁর বাৎসরিক অনুষ্ঠান –সূচীর নিয়মিত অনুষ্ঠান ছিল।আজকের প্রদূষণ যুক্ত সমাজ ও
পরিবেশ সংশোধনে তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসৃত হলে অনেক ক্ষেত্রেই সুফল পাওয়া সম্ভব
বলেই মনে হয়।
কবিহৃদয় স্বভাবতঃই আবেগপ্রবণ,অনুভুতিপ্রবণ
হয়।তিনিও হয়তো ব্যতিক্রম ছিলেন না।কিন্তু রবীন্দ্ররচনার মননশীল অধ্যয়ন এই ইঙ্গিতই
দেয় যে তাঁর যাবতীয় আবেগ-অনুভূতি এক উজ্জ্বল বৈজ্ঞানিক চেতনা ও যুক্তিবাদী ধীশক্তির আধারেই ধরা ছিল।তাই
মানুষের অস্তিত্বের প্রকৃত সমস্যা, তার জীবনের বাস্তব সংগ্রাম তাঁকে চিন্তিত ও
ব্যথিত করে তুলত প্রতিমুহূর্তে।মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষিত করার বহু আন্তরিক
প্রয়াস তিনি করেছিলেন,যার চিহ্ণ ছড়িয়ে রয়েছে শান্তিনিকেতন শ্রীনিকেতন জুড়ে।অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের
সুনিশ্চিত ব্যবস্থাই যে মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগৃত করতে পারে,তাঁর অনুভবী মন খুব
সহজেই তা বুঝেছিল। তাই তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক
স্বনির্ভরতায় ।কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্রশিল্পের উন্নতিকরণের মাধ্যমে খুলে দিতে
চেয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির এক অতি বিশ্বাসযোগ্য পথ এবং নিজের
জীবনের সর্বস্ব দিয়ে তা বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন।শ্রীনিকেতনের ‘আমার কুটির’
আজকের দিনেও তাঁর সেই আন্তরিক প্রয়াসের এক উজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে চলেছে।
রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীর বিশেষত্ব হল তার
বহুমাত্রিকতা।জীব ও জড়জগতের এমন কোন ক্ষেত্র, এমন কোন পর্যায়,এমন কোন পরিপ্রেক্ষিত
খুঁজে পাওয়া শক্ত যেখানে তার সৃষ্টির পরশ লাগেনি।মানুষকে ভালবেসেছিলেন,তাই
ভালবেসেছিলেন মানুষের দেশকেও।স্বদেশ ও স্বাদেশিকতার এক প্রবল চেতনা সবসময় তাঁর
অন্তর্লোকে অনুরণিত হত।তাই তো গাইলেন... “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই
মাথা..”। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ তাঁকে কখনও গ্রাস করতে পারেনি।অন্যায়ের বিরূদ্ধে
প্রতিবাদ করার তাঁর এক নিজস্ব মত,পথ ও ভঙ্গী ছিল।বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়ালেন রাখীবন্ধনের গান নিয়ে .. “.. বাঙালির
প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে
যত ভাই বোন—এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান..”।আবার জালিয়ানয়ালা বাগের নির্মম
কাণ্ডের পর নির্দ্বিধায় ত্যাগ করলেন ‘নাইটহুড’।তাঁর রচিত স্বদেশ পর্যায়ের গানের
বাণী-সুর-ধ্বনি অত্যন্ত সফলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতাকামী ও
স্বাধীনতাসংগ্রামী বহু তরুণ প্রাণকে।
তাঁর অধ্যাত্মবাদও ছিল এক অদ্ভুত সুন্দর দর্শন। কখনও তিনি আপন আত্মার উত্তরণ
ঘটিয়েছেন পরমাত্মার মিলনপিয়াসী হয়ে, কখনও ঈশ্বরকে সপ্রেমে নামিয়ে এনেছেন আপন
অন্তরের অন্তঃস্থলটিতে।গেয়েছেন...
‘তাই তোমার
আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে–
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে॥’
তুমি তাই এসেছ নীচে–
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে॥’
তাঁর পূজা ও প্রেম বারে বারে এক হয়ে মিলে গেছে।ভাবতে
অবাক লাগে,যে মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে বহু বিচ্ছেদ যাতনা, বহু প্রিয়জনের মৃত্যু -
অভিঘাত সহ্য করেছেন, কি অটল আস্থায়, কি গভীর ঈশ্বর বিশ্বাসে তিনি আজীবন ও আমৃত্যু
ব্যপ্ত ছিলেন!প্রিয়জনের নশ্বর দেহকে চিরবিদায় জানাবার পরমুহূর্তে কি স্থির আশ্বাসে
লিখেছন..
‘ আছে দু:খ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন
লাগে।
তবুও শান্তি , তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥’
তবুও শান্তি , তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥’
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতার্থেই এক অবিচ্ছিন্ন,অবিরত ও অনন্ত যাত্রাপথ।সে পথের আদিতে
তিনি,মধ্যভাগেও তিনি আর প্রান্তসীমায় সেই তিনিই। তাঁর অসীম সৃষ্টিকে আশ্রয় করেই চলে
যাওয়া যায় জীবন থেকে জীবনান্তরে।তাঁর অসম্ভব সুন্দর জীবনবোধ ও জীবনব্যাখ্যা
শুধুমাত্র জীবনকেই ভালবাসতে শেখায় না, মৃত্যুকেও পীড়াহীন ও সীমাহীন ভালবাসায় জড়িয়ে
ধরতে শেখায়; শেখায় মৃত্যুভয়কে অবলীলায় অতিক্রম করে জীবনকে সঠিকার্থে অর্থপূর্ণ করে
তুলতে... ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ।’
আজ যখন সমস্ত পৃথিবী জুড়ে চলছে মানুষ ও প্রাণের অস্তিত্বের এক ভয়াবহ সংকট, যখন
এক বিষণ্ণ আঁধার কেবলই গ্রাস করে নিতে চায় সভ্যতার
সততাকে,যখন শুধুমাত্র বস্তুবাদী ও ভোগসর্বস্ব জীবনচর্যা মানুষের জীবনে লিখে চলেছে
লক্ষ্যহীন নৈরাশ্যের কাহিনী, যখন মানুষ তার ‘মান-হুঁশ’ হারিয়ে ক্রমশঃ অবনমিত হয়ে
চলেছে মনুষ্যেতর প্রাণীতে, তখন বড় বেশী করে বোধ হয় সেই মানুষটির অভাব। মনে হয়,
তিনি আরও একবার আসুন আমাদের মাঝে- ‘প্রাণ ভরিয়ে,তৃষা হরিয়ে’ আরও আরও প্রাণের উৎসবে
মাতিয়ে দিন আমাদেরকে..
‘আজ যখন
পশ্চিমদিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস
,
যখন গুপ্তগহ্বর থেকে পশুরা
বেরিয়ে এল ,
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল
,
এসো যুগান্তের কবি ,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে
,
বলো ‘ ক্ষমা করো ' —
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী
।’
....আর....
সেই বেণী দোলানো ছোট্ট মেয়েটি যখন বড় থেকে আরও বড় হয়ে ওঠে, আরও আরও বড়....যখন
জীবনপথে চলতে গিয়ে সমাজ – সংসারের ঘাতে-অভিঘাতে-সংঘাতে ক্রমশঃ ক্রন্দসী হয় তার
হৃদয়, নিবিড় বেদনায় আকুল আতুর হয় তার প্রাণ, তখন, সেই গভীর সংকটকালে প্রতিবার সেই
বিপন্ন ও অভিমানী মানবী আত্মার সামনে এসে
দাঁড়ান তিনি .......রাজরূপে, ঈশ্বররূপে এবং...এক চিরন্তন প্রেমিকরূপে....
‘হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো, দাও
গো আমার হাতে–
ধরব তারে,
ভরব তারে, রাখব তারে সাথে,
একলা পথে
চলা আমার করব রমণীয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো॥’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন