“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫

পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে





।। রজতকান্তি দাস।।

(C)Image:ছবি
   একবার এক খতরনাক বই পেয়েছিলাম। বইটি এখন আর হাতে নেই বটে তবে স্মৃতি থেকে দু’চারটে কথা বলতে চাই। প্রথমেই বলে রাখি যে বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি বেস্ট সেলার। লেখক নুরল ইসলাম এবং বইটির নাম ‘পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে’। এই বইটিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী নুরল ইসলাম বলছেন পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে বলে একটি অপপ্রচার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা ইসলামকে খতম করার জন্য পশ্চিমী দুনিয়ার একটি চাল। তিনি প্রমাণ করেছেন আসলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে।
কেউ যদি মনে করে থাকেন নুরল ইসলাম বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না তাহলে বলবো এটা অত্যন্ত ভুল। তিনি জেনেশুনে বিষ করেছেন পান। আর যেটা তিনি সব থেকে ভালো জানেন তা হলো মানুষকে বোকা বানানোর জন্য একটি বেস্ট সেলার বই কি করে লিখতে হয়। তিনি প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিজ্ঞানের অনেক খবরই রাখেন। ক্লডিয়াস টলেমি যেভাবে পৃথিবী স্থির প্রমাণ করেছিলেন যিশু খ্রিস্টেরও জন্মের বহু বছর আগে তা থেকে তথ্য নিয়ে নুরুল ইসলাম পৃথিবী স্থির প্রমাণ করেছেন তার বইয়ে। যেমন আকাশের দিকে কোনও জিনিসকে ছুড়ে দিলে তা আবার হাতেই এসে পড়ে, পৃথিবী চলমান হলে পাখিরা তাদের নীড় থেকে উড়ে গিয়ে আবার সেখানে ফিরতে পারতো না ইত্যাদি। তবে এখানে তিনি পাখির বদলে এরোপ্লেনের উল্লেখ করে নিজের স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। তবে কোপার্নিকাস ও গালিলিও বহু আগেই টলেমির তত্বকে খারিজ করে দিয়েছেন । এই নিয়ে আর আলোচনার কিছু নেই।
নুরল ইসলাম সাহেবের প্রতিভার পরিচয় পাই যখন দেখি মাইকেলসন-মোর্লে এক্সপেরিমেন্টকে পর্যন্ত তিনি পৃথিবী স্থির প্রমাণ করার কাজে ব্যবহার করেন। এই এক্সপেরিমেন্টের কথা তো আমরাও জানতাম। কিন্তু এটা যে পৃথিবী স্থির তত্বের প্রমাণ হতে পারে তা তো মাথায়ই আসে নি। তাই বলবো ধন্য নুরল ইসলাম, ধন্য বাংলাদেশের বিজ্ঞানী। এখানে আমি মাইকেলসন-মোর্লে এক্সপেরিমেন্টের কথা বলবো কারণ এই উত্তর-পূর্বের বহু ঘরেই হয়তো এখনও ‘পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে’ বইটি বিরাজমান। গুয়াহাটি গ্রন্থমেলায় স্বনাম ধন্য এই বিজ্ঞানীর বইটি বিক্রি হয়েছে ভালই। বিশেষত হাফলঙের একজন স্কুল শিক্ষকও যখন নুরল ইসলাম ও তার এই বিখ্যাত বই সম্পর্কে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হোন তখন কিছু বলাটা বাধ্যতামূলক বলেই মনে করি।
১৮৮৭ সালে মাইকেলসন ও মোর্লে নামে দু’জন বিজ্ঞানী বার্লিনের শহরতলি পটসডাম থেকে একটি পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ইথার তরঙ্গের উপর পৃথিবীর গতির প্রভাব নির্ণয় করা। এখানে একটা কথা বলে নিই যে ইথার বলে আসলে কিছু নেই তা এখন প্রমাণিত। ঐ সময়ে বিজ্ঞানীরা একটা বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন যে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে কি ভাবে বিস্তার লাভ করে চন্দ্রকে প্রভাবিত করে। এর কোনও ব্যাখ্যা দিতে না পেরে বিজ্ঞানীরা ধরে নেন যে সমগ্র মহাকাশব্যাপী এক ধরণের তরঙ্গ ছড়িয়ে আছে যার নাম দেওয়া হয়েছিল ইথার। এর মধ্য দিয়েই মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। যাই হোক পরবর্তীকালে আইনস্টাইন গ্রহগুলোর এই পরিক্রমণকে ব্যাখ্যা করেন যেখানে ইথারের কোনও ব্যাপার নেই। মাইকেলসন-মোর্লের এক্সপেরিমেন্ট সফল হওয়ার কোন কারণ নেই যেহেতু ইথার ব্যাপারটাই নেই। কিন্তু অন্য একটি কারণে এই এক্সপেরিমেন্ট বিখ্যাত হয়ে আছে এবং এটাই পৃথিবীর একমাত্র বিফল পরীক্ষা যা ডিজাইন জন্য মাইকেলসনকে ১৯০৭ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এই এক্সপেরিমেন্টে যাকে বলে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়েছিল।
মাইকেলসন-মোর্লে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম দু’দিকে আলোকরশ্মি ছেড়ে দেখতে চেয়েছিলেন কোন দিকে এর গতি কতটা। তা পরীক্ষায় দেখা গেল যে পৃথিবীর দু’দিকেই আলোর গতি সমান। এই বিজ্ঞানীরা যতই আরও ভাল করে তাদের পরীক্ষা চালান ততই দেখেন যে আলোর গতি দু’দিকেই সমান। শেষ পর্যন্ত তারা এই ফলাফল বিজ্ঞানী-মহলে প্রকাশ করেন।
এখন মনে করা যাক যে দুদিকে দুটো ট্রেন একই গতিতে ছুটে চলেছে আর আমি এর একটির পেছনে তীব্র গতিতে ছুটছি। এই অবস্থায় আমি যদি দুটো ট্রেনের গতিকে মাপতে যাই তাহলে দেখবো এর একটির গতি কম আর আরেকটির বেশি। তবে যদি আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ট্রেনগুলোর গতিকে মাপতে যাই তাহলে দেখবো দুটোর গতি সমান। তা পৃথিবীর একটা আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি আছে। তাই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পূর্ব-পশ্চিম দুদিকে আলোর গতি এক হওয়ার কথা নয়। তাই মাইকেলসন-মোর্লের এই এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল বিজ্ঞানী-মহলকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল। কারণ ঐ সময়ে বিজ্ঞানীদের পক্ষে নিউটনকে সম্বল করে আলোর গতির এই অদ্ভূত চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল না। বিজ্ঞানী নুরল ইসলাম এ সবই জানেন। তিনি জ্ঞানপাপী সমস্যাটা সেখানেই। সবচেয়ে বড় কথা হল তিনি কোনও ভুল তথ্য দেন নি। তবে এই তথ্যের ব্যাখ্যা করেছেন নিজের মতো করে মানুষকে বোকা বানানোর জন্য। অথবা তিনি একজন ধর্মীয় মৌলবাদী বিজ্ঞানী অর্থাৎ সোনার পাথর বাটি।
তবে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন যখন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ব পেশ করলেন তখনি এই রহস্যের উদঘাটন হয়। আইনস্টাইন তাঁর এই থিওরিতে অনেক কিছুই প্রমাণ করেন। এর মধ্যে একটি ছিল ‘আলোর গতি যে কোন নিরিক্ষণস্থল থেকেই সমান। আমি যদি স্থির অবস্থা থেকে আলোর গতিকে মাপতে যাই তা হলে দেখবো তা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। আবার যদি আলোর গতির সঙ্গে ছুটতে থাকি তাহলেও দেখবো যে ঐ একই গতি। যদি আলোর গতির বিপরীত দিকে ছুটতে থাকি তাহলে সেখান থেকেও দেখবো তা প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। অর্থাৎ যেকোনো নিরিক্ষণস্থল থেকেই আলোর গতি সব সময় সমান। এই আবিষ্কারই আইনস্টাইনের অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। যার জন্য আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্বের রিভিউতে লন্ডন টাইমস লিখেছিল ‘an affront to common sense’ অর্থাৎ আমাদের সাধারণ বুদ্ধির উপর আঘাত। আসলে আলোর গতি হলো একটি universal constant বা মহাজাগতিক ধ্রুবক এবং যা অনাপেক্ষিক। তাই আলোর গতিকে C অক্ষরটি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে আইনস্টাইনের প্রায় সমস্ত সমীকরণের মধ্যে C আছে। কারণ এই ধ্রুবক আবিষ্কার করেই তিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে এর ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন।
নূর শব্দের অর্থ হলো আলো। তবে নূরল ইসলামের কারবার হলো অন্ধকার নিয়ে। তাই ক্ষুদ্র স্বার্থে স্বজাতিকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যেতে তার কোনো আপত্তি নেই। যদিও তিনি হলেন মূলত একজন স্বজাতিশত্রু, অন্যদিকে তিনি আবার অজাতশত্রু। তাই চপার নিয়ে কেউ যে তার পেছনে ধাওয়া করবে না তিনি তা বিলক্ষণ জানেন। বরং তিনি যথেষ্ঠ সম্মান নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন বলেই আমার বিশ্বাস। তবে এই অন্ধকারের কারবারিকে জানাই আমার শতকোটি ধিক্কার।

কোন মন্তব্য নেই: