।। রজতকান্তি দাস।।
(C)Image:ছবি |
হয়ত
একটা সময়ে ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের একটা যোগসাজশ ছিল। যেমন বাইবেলে গ্রহের
গতিপ্রকৃতির বর্ণনায় টলেমিকে আশ্রয় করা হয়েছিল। কিন্তু মধ্যযুগে এসে বিজ্ঞান ও
ধর্মের মধ্যে অহিনকুল সম্পর্ক তৈরি হয়। বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সমন্বয়ের পথে
সবচাইতে বড় অন্তরায় ছিল ধর্মীয় যাজকশ্রেণির মানসিকতা। কারণ ধর্মের প্রতি তাদের
যতটা নিষ্ঠা ছিল সত্যের প্রতি ততটা ছিল না। আসলে ধর্মনিষ্ঠা ও সত্যনিষ্ঠা যে এক নয়
মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে।
ধর্মীয় মৌলবাদ
ছাড়াও কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক মৌলবাদ অথবা ‘ব্যক্তিবাদ’
আছে যেখানে ঐ সমস্ত ‘বাদী’দের বিশ্বাস করতে হয় যে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিরা সর্বাবস্থাতেই নির্ভুল। নিজ
নিজ মতবাদে ধর্মীয় মৌলবাদী ও ব্যক্তিবাদীদের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক থাকলেও
বিজ্ঞান অথবা বিজ্ঞানীদের প্রতি তাদের আচরণে কোনো তফাৎ নেই। রোম অথবা ইতালিতে
ধর্মীয় যাজকশ্রেণি ব্রুনো অথবা গ্যালিলিওর প্রতি যে আচরণ করেছিলেন কিছু কিছু
ক্ষেত্রে রাশিয়ার স্তালিন সরকারের আচরণও অনুরূপ ছিল। ধর্মীয় যাজকশ্রেণির শ্রেণির
তুলনায় তাদের আচরণ কম নিষ্ঠুর হলেও সত্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা আশানুরূপ ছিল না।
১৯২৬ সালে
সোভিয়েত রাশিয়ায় লেলিনের সংরক্ষিত মরদেহ থেকে মস্তিষ্ক বের করে তাঁর প্রতিভার উৎস
নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিশিষ্ট স্নায়ু বিশেষজ্ঞ অস্কার ভোক্ট ও তাঁর ফরাসি স্ত্রী
সিসিল ভোক্টকে জার্মানি থেকে নিয়ে আসা হয়। তাদের কাজ শেষ হয়ে যাবার পর ১৯৩০ সালে
এই দম্পতিকে রাশিয়া থেকে বিতাড়িত করে মস্কোয় প্রতিষ্ঠিত মস্তিষ্ক গবেষণা
কেন্দ্রটিকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ স্তালিন মনে করেন যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার
ফলাফল মার্ক্সবাদে বর্ণিত ‘মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতায় সৃষ্ট’
তত্ত্বের বিরুদ্ধে যেতে পারে। অতএব বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ বন্ধ। স্তালিনের
মৃত্যুর পর যদিও এই প্রতিষ্ঠানকে আবার চালু করা হয় তবে বিজ্ঞানীদের মাথার উপর
মার্ক্সবাদী খাড়া ঝুলে ছিল কিনা তা জানা যায় নি। তবে বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে দল-তান্ত্রিক
তত্ত্বের সংঘাত হলে বিজ্ঞানীরা কতটুকু নিরাপদে থাকতেন সে সম্পর্কে সংশয় আছে।
বিজ্ঞানের জন্য মুক্তাঙ্গন হলো
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীদেরও নিজমত
প্রকাশের প্রধান অন্তরায়গুলো দূরীভূত হয়। তাই ইউরোপে বুর্জোয়াশ্রেণির উদ্ভবের ফলে
যে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে এরপর মাত্র কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই বিজ্ঞানজগৎ অভাবনীয়
উন্নতিলাভে সমর্থ হয়।
বিজ্ঞান সত্য
ব্যতীত আর কোনো কিছুর সঙ্গেই টিকি বাঁধা নয়। বিজ্ঞানীরা কোনো এক সত্যকে আবিষ্কার
করার পরও সেই সত্যের নিরিখে আরও গভীরতর সত্যের সন্ধানে রত হন। কোনো বিশেষ সত্যের
কণ্ঠি পরে নিয়ে সেই সত্যের জয়গাঁথা কীর্তন করার চাইতে নিরলস-ভাবে আরও গভীরতর
সত্যের অনুসন্ধান করাই বিজ্ঞানীদের ধর্ম। এই যাত্রাপথে আধুনিক বিজ্ঞান ব্যক্তিপুজো
ও ভক্তিবাদকে তার সূচনালগ্ন থেকেই সম্পূর্ণ বর্জন করেছে। গ্যালিলিও ও নিউটনের মতো
মহান বিজ্ঞানীদেরও কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণাকে বর্জন করা হয়েছে অতি অবলীলায়। কারণ
বিজ্ঞানীরা ব্যক্তিপূজকদের মতো প্রণামে বিশ্বাস না করে প্রমাণে বিশ্বাস করেন।
তাছাড়া ভক্তিবাদীদের ভক্তিশেলের আঘাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
মানবচিত্ত পরিত্যক্ত জলাশয়ের মতো আবদ্ধ থাকায় তাতে শ্যাওলা জমে। দেখা যায় যে এই
ভক্তিশেলের আঘাত সুদূরপ্রসারী এবং সময়-বিশেষে তা শক্তিশেলের চাইতেও ভয়ঙ্কর।
ভক্তিবাদে মানুষ যতটা সহজে আকৃষ্ট হয় যুক্তিবাদে ততটা হয় না। কারণ রোগ সংক্রামক
হলেও স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়। বিজ্ঞান তাই সবধরনের ‘মৌলবাদ’
এবং ‘ভক্তিবাদ’কে বর্জন
করে শুধুমাত্র সত্যবাদকে আশ্রয় করেছে। এটাই তার সুস্বাস্থ্যের পরিচায়ক।
প্রকৃতির রহস্য
বড়ই জটিল। তাই বিজ্ঞানের ঊষালগ্নেই কোনো এক বিজ্ঞানীর পক্ষে এক পরম সত্যকে
আবিষ্কার করা হয়তোবা সম্ভব, কিন্তু সবক্ষেত্রেই চরম সত্যকে
উপলব্ধি করা তাঁর পক্ষে বাস্তবিক কারণেই অসম্ভব। সেক্ষেত্রে মনুষ্যজনিত সীমাবদ্ধতা
অতিক্রম করে তাঁকে দেবত্ব প্রাপ্ত হতে হয়। বিজ্ঞান-সমাজে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির ঘটনা
অবিরল হলেও দেবত্বপ্রাপ্তির ঘটনার উল্লেখ নেই। বিজ্ঞানজগৎ তাই দেবত্ব-বর্জিত
প্রতিভাবান মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, অসাধারণ মেধা ও
সত্যানুরাগের ফসলে পরিপুষ্ট। দেবত্বমহিমাবর্জিত হয়েও বিজ্ঞান আজ স্ব-মহিমায়
সমুজ্জ্বল। তাই যে বিজ্ঞানকে ‘ধর্মসম্মত’ করার জন্য যাজকশ্রেণি এক সনয় বলপ্রয়োগ করেছিলেন, আজ
সভ্য সমাজে কল্কে পেতে গিয়ে তাদেরকেই বলতে হচ্ছে যে ধর্ম ‘বিজ্ঞানসম্মত’
অর্থাৎ ধর্মকে প্রণাম ও বিজ্ঞানকে স্যালুট। বিলম্বিত হলেও সত্য-সাধনার
এটাই সুফল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন