ভূমিকা
(লেখাটি সাময়িক প্রসঙ্গে প্রকাশিত) |
ভিত্তিবর্ষ
প্রসঙ্গ
আসু-র নেতৃত্বে
নাগরিকপঞ্জি নবীকরণের প্রশ্নে ১৯৫১ সালকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার দাবি জানানো
হচ্ছে। কিন্তু কেন ? অন্য সব বিষয় বাদ দিলেও এটা তো অনস্বীকার্য যে ১৯৫১র দাবি
আন্দোলনের শুরুতে যদিওবা ছিল রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে সমঝোতা করে ১৯৭১ সালের ২৪
মার্চকে মেনে নিয়েই আসু ‘অসম চুক্তি’ স্বাক্ষর
করেছিল, তা থেকে
এখন হঠাৎ সরে আসার অর্থ কী? তাছাড়া সরে আসতেই যদি হয় তো নৈতিক বিচারে তার
আগে চুক্তিটি বাতিল বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। অথচ বিগত কুড়ি বছর যাবৎ আসু মূলত অসম
চুক্তি রূপায়ণের কথাই বলে এসেছে। তাহলে এই
আচমকা ডিগবাজি কেন ? এটা সংশয়হীন ভাবে স্পষ্ট যে অসমের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষিক গোষ্ঠীর অর্থাৎ
বাংলাভাষীর সংখ্যা যাতে এনআরসি-তে হ্রাস পায় সেটা নিশ্চিত করাই এই দাবির নিহিত
উদ্দেশ্য। একজনও বৈধ নাগরিকের নাম যাতে বাদ না পড়ে সেটা সুনিশ্চিত করা যেখানে
প্রাথমিক শর্ত হওয়া উচিত ছিল, (যে কোন সভ্য সমাজে সেটাই
বাঞ্ছনীয়) সেখানে এ বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করছে না। যার দরুণ অহেতুক
অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে যা আদৌ কাম্য নয়। মনে রাখা দরকার যে সর্বোচ্চ
আদালতের নির্দেশেই এই নবীকরণ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে, সরকারি সদিচ্ছার ফলে
কিংবা আঞ্চলিক সংগঠন সমূহের দাবির ভিত্তিতে নয়। তাছাড়া ১৮৭২ সালেও যে রাজ্যের
রাজ্যভাষা বাংলা ছিল সে রাজ্যে ‘বাঙালি মানেই বহিরাগত’ মানসিকতা গড়ে তোলার
অপপ্রয়াস কোন মহৎ উদ্দেশ্যে ? কাদের স্বার্থে ?
প্রশাসনিক
দিক থেকেও যদি দেখি তাহলেও ভিন্ন কিছু সমস্যা দেখা দেবে। যেমন ১৯৫১ সালের
নাগরিকপঞ্জি অসম্পূর্ণ এমন কথা অনেকেই বলছেন। ’৫১তে যাদের নাম ওঠেনি
পরবর্তীতে তাদের অধিকার সম্পর্কিত দাবিদাওয়া/আপত্তি খতিয়ে দেখার জন্য
কোনও পদক্ষেপ এমনকি অসম চুক্তি সম্পাদনের পরেও কেন নেওয়া হয়নি সে প্রশ্নের জবাব কে
দেবে ? শোনা যাচ্ছে
অনেক জেলাতেই ১৯৫১ থেকে ১৯৬৬র মধ্যবর্তী প্রতিটি ভোটার তালিকা
সহজলভ্য নয়। ১৯৭১এর পূর্বের জমির দলিল ইত্যাদিও সংশ্লিষ্ট
সরকারি বিভাগে নেই, অথচ এগুলো প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি
করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব পুরনো জরুরি কাগজপত্র সরকারি বিভাগ সমূহের
পক্ষেই যেখানে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি সেখানে আম নাগরিকের পক্ষে তা
সংরক্ষণ সব ক্ষেত্রে সম্ভব কি ? বিশেষত শিক্ষার হার ও দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস
করা মানুষের হার যদি মাথায় রাখা যায় তাহলে! ১৯৫১ সালের অসম বিভক্ত হয়ে আজকের অবস্থায়
পৌঁছেছে পর্যায়ক্রমে। পুনর্বিভাজনের সম্ভাবনা একেবারেই অন্তর্হিত হয়েছে তা বলা যায়
না, বরং আগামীতে
সে সম্ভাবনা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে যে কোন হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে। ধরা যাক
অবিভক্ত অসমের বাসিন্দা একজন অসমিয়া(ভাষী) নাগরিক ১৯৭১ সালের পরে মেঘালয় রাজ্য থেকে
পুনরায় অসমে এসে বসবাস শুরু করেছেন এবং তার নাম ১৯৫১র এনআরসি কিংবা ১৯৬৬র ভোটার
তালিকাতে নেই, সেক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং কীসের ভিত্তিতে ? এক্ষেত্রে
যদি ছাড় দেবার বন্দোবস্ত করা যায় তাহলে বাংলাভাষীদের বেলায় নয় কেন? তাছাড়া ’৭১ এর পরে
যারা এসেছেন এনআরসি নবীকরণের পর তাদের কী ব্যবস্থা করা হবে সেসব নিয়েও চিন্তা-ভাবনা জরুরি
নয় কি ? বহিষ্কার
করা হবে হুমকি দেওয়া হলেও বিগত সাড়ে চার দশকে দু দফায় আঞ্চলিক দল সরকার গঠন করা
সত্ত্বেও তা যে সম্ভব হয়নি সে বাস্তবতা থেকে মুখ লুকিয়ে সমস্যার সমাধান যারা
চাইছেন তারা আসলে কী চাইছেন? বিদেশি ট্রাইব্যুনালের কর্মধারা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কিত
অভিজ্ঞতা কী নির্দেশ করে ? ’৫১ সালের নাগরিপঞ্জিতেও এখন ‘ডি’ চিহ্ন আবিষ্কৃত হচ্ছে ? এসব কীসের
ইঙ্গিত বহন করে ? রোগ সারানোর উপায় জানা নেই বলে মৃত্যু ত্বরান্বিত করার
অমানবীয় নিদান হাজির করতে হবে ? পৃথিবীর সব সভ্য
রাষ্ট্রেই জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের পরে নাগরিকত্বের জন্য
আবেদনের আইনি বন্দোবস্ত রয়েছে, একমাত্র অসমেই এক ‘একুশে আইন’ প্রণয়নের
প্রস্তাব গৃহীত হতে যাচ্ছে।
অসমিয়ার সংজ্ঞা
অসমিয়ার সংজ্ঞা নির্ধারণ নামক আরেক ‘গুগলি’ ছোঁড়াও আরম্ভ হয়েছে। এনআরসি নবীকরণের সাথে এর সম্পর্ক কোথায়? আদৌ আছে কি ? এ নিয়ে নানা মুনি
নানা মত দিচ্ছেন। মতামত সমূহের যৌক্তিকতা বিচারেরও আগে বুঝতে হবে এই প্রশ্ন উঠছে
কেন! অসমের নাগরিক মানেই
তো ‘অসমিয়া’(ভাষী) নয়, আবার অসমের নাগরিক মানেই কি ‘অসমিয়া’ নয়? অসমের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষিক গোষ্ঠী বাংলাভাষীদের কথা বাদ দিলেও তো অসম একটি
বহুভাষিক রাজ্য। অসমিয়াভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেন, কিন্তু তাতে অন্যান্য ভাষাভাষীদের ন্যায্য অধিকার খর্ব করার অধিকার জন্মায়
না নিশ্চয়! একজন বড়ো অথবা কার্বি ভাষাভাষী এবং বলা বাহুল্য বাংলাভাষী মানুষ অসমে বসবাস
করেন বলেই আত্মপরিচয় অস্বীকার করে ‘অসমিয়া’ হিসেবে পরিচয় দেবেন কেন? সংখ্যাগরিষ্ঠ অসমিয়াদের একটা অংশ চাইছে বলেই কি আমরা ‘অসমবাসী বাঙালি’ না হয়ে ‘বাংলাভাষী অসমিয়া’ হয়ে যাবো ! কিংবা কার্বিভাষী অসমিয়া! এজাতীয় প্রস্তাবনার আড়ালে যে ছদ্মবেশী ভাষিক সম্প্রসারণবাদ সক্রিয় তা বোঝা
কি এতোই শক্ত! আপত্তিটা এখানেই । অসম সাহিত্য সভার সভাপতির প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষা ইত্যাদি প্রস্তাবের ‘উদারমনস্কতা’ সত্ত্বেও তা আপত্তিজনক। কারণ আমরা অনুগ্রহ নয়, অধিকার দাবি করছি, করব। তাছাড়া নাগরিকপঞ্জি প্রসঙ্গে ‘অসমিয়া-অনসমিয়া’ বিচার অবান্তর বিষয়। দ্বিচারিতার ব্যাপারটা লক্ষ্য করুন, অসম চুক্তির হাত
ধরেই একদিকে সংজ্ঞা নির্ণয়ের বিষয়টিকে হাজির করা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ১৯৫১র দাবি তোলা হচ্ছে। সংখ্যা গরিষ্ঠতার প্রয়োজনে একদিন
যে মুসলমান বাঙালিকে ‘ন-অসমীয়া’ সম্বোধনের দরকার পড়েছিল, নেলী-পরবর্তী পর্যায়ে তাদের আজ ‘বাংলাদেশি’ সাজানোর নক্সা তৈরি করা হচ্ছে।
অসম
চুক্তিতে ভাষিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট সুরক্ষিত করার প্রশ্নে people of Assam এর স্থলে Assamese
people কথাটা
ব্যবহৃত হয়েছে। এই অছিলায় অসমিয়া
বুদ্ধিজীবীরা যদি তথাকথিত ‘বৃহত্তর অসমীয়া জাতি গঠন-প্রক্রিয়া’ পুনর্বার
শুরু করতে উদ্যোগী হন তাহলে পূর্বে উল্লেখ করা বিভাজনের
সম্ভাবনা প্রবলতর হবে নিঃসন্দেহে। ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আইনি রক্ষাকবচ কতদূর
কার্যকর সে তর্ক মুলতুবি রেখেও একথা অনায়াসে বলা যায় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে
প্রতিটি ভাষিক সংখ্যালঘুর ভাষিক-সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে
অপারগ হলে ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে গঠনমূলক কোনও
পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব ও অবাস্তব হয়ে পড়ে। অসমিয়া বৌদ্ধিক মহলের বড় অংশ এই
গণতান্ত্রিক চিন্তা-পদ্ধতিকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন দিয়েই সামাজিক দায়িত্ব পালনের
বিভ্রমণে মগ্ন। একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। ডিমাপুরের জঘন্য ঘটনার ‘নিন্দা না
করলে মান থাকবেনা’ উপলব্ধি করার পর পত্রপত্রিকায়-বৈদ্যুতিন মাধ্যমে
নিন্দা প্রস্তাব সমূহে ‘অসমিয়া যুবক’ হিসেবে নিহতের উল্লেখ থাকল, কোথাও ‘বাঙালি’ এমনকি
বাংলাভাষী শব্দটিও উচ্চারিত হল না। একই ভাবে ‘দিল্লিতে অসমিয়া যুবক
আক্রান্ত’ যেভাবে উচ্চারিত হতে দেখা যায়, সেভাবে ‘অরুণাচলের-মনিপুরের
যুবক-যুবতী’ উচ্চারিত না
হয়ে ‘উত্তরপূর্বাঞ্চলের
যুবক-যুবতী’ হয়ে পড়ে। এ
এক শর্তাধীন পরাবর্ত যেন। অসমিয়া সাহিত্যি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে
বাঙালির অবদানের স্বীকৃতির প্রশ্নেও এই মানসিকতা কমবেশি বর্তমান। দোহাই, কেউ যেন
ভেবে না বসেন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে কথাগুলো বলা হচ্ছে, চোখ কান খোলা থাকলে এই
বাস্তবতার সপক্ষে দৃষ্টান্তের অভাব ঘটবে না।
বরাক
উপত্যকা প্রসঙ্গ
ভিত্তিবর্ষ
বলুন, আর অসমিয়ার
সংজ্ঞা নিরূপণের প্রশ্নই বলুন বরাক উপত্যকার মানুষের সুনির্দিষ্ট মতামত গ্রহণের
কথা ছেড়েই দিলাম, জানার দায় পর্যন্ত স্বীকার করতে কুন্ঠিত সব পক্ষ। ‘কাছাড়
আসামের ক্যান্সার’ মার্কা ধারণা থেকে এখনো খুব বেশি দূরে সরে আসতে পারেনি
অসমের বৌদ্ধিক মহল। এটা আমাদের জন্য তো বটেই, অসমিয়া জাতির পক্ষেও
দুর্ভাগ্যের বলে ইতিহাসে সাব্যস্ত হবে ভবিষ্যতে। আসু-র আন্দোলনের কাল থেকে
হালের এনআরসি নবীকরণের সাম্প্রতিক সময়েও এ উপত্যকাকে হিসেবের বাইরে রেখেছে আঞ্চলিক
দল থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সহ সকলেই। আর এ কারণেই আসু-র আন্দোলন
অক্লেশে ‘অসম আন্দোলন’ হয়ে পড়ে, এমনকি ইতিহাস চর্চায়ও! অথচ এর বিপরীতে, মুদ্রার
উল্টো পিঠে রয়েছে আরেক ইতিহাস –আন্দোলনের, আত্মোৎসর্গের। ১৯৬১ সালে
ভাষার অধিকারের দাবিতে স্বাধীন ভারতবর্ষে ১১জনকে শহিদ হতে হয়েছে, গোটা বিশ্বে যা
নজিরবিহীন। সে ইতিহাস অস্বীকার করার ভুলিয়ে দেবার প্রয়াসে ক্ষান্তি নেই, কিন্তু তা
কি ভোলার! অসমিয়া বুদ্ধিজীবীশ্রেণী যতদিন না এই ইতিহাস স্বীকার করে
নিজেদের অবস্থান পাল্টাবে ততদিন বরাকের মানুষের আস্থা লাভ অসম্ভব। এই বাস্তবতা অস্বীকার
করে ভবিষ্যতের ‘সোনার অসমের’ স্বপ্ন-দেখা নির্বোধ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব
নয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার যারা সময় বিশেষে দুই উপত্যকার সমন্বয়ের সূত্র আওড়ান তারা
নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার দায় বহন করুন এবার!
এমন নয় যে
উপরের কথাগুলো ভাষা কিংবা জাতিবিদ্বেষ ছড়ানোর লক্ষ্যে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কারণ
বাস্তবে বিভেদ বর্তমান রয়েছে এবং তা কাটিয়ে ওঠার স্বার্থেই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া
জরুরি। এই অবিশ্বাসের বাতাবরণ টিকে থাকার পশ্চাতে বরাকবাসীর দায়ও কম নয়। স্বাধীনোত্তর ছয় দশকে এক পরবাসী মানসিকতা আশ্রয় করেই কাটিয়ে
দিয়েছে এ উপত্যকার শিক্ষিত বাঙালির বড় অংশ। হারানো
স্বদেশের গল্পগাঁথা শুনিয়ে আর দিসপুরের বঞ্চনার কাঁদুনি গেয়ে কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে
দীর্ঘ সময়। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়, রাজনীতিতে, সামাজিক
আদান-প্রদানে, আলাপনে গঠনমূলক
ভূমিকা নিতে অসমর্থ হয়েছে বাঙালির ‘তৃতীয় ভুবনের’ বৌদ্ধিক মহল। কাঁটাতারে-রুদ্ধ পথের
দিকে তাকিয়ে হাহুঁতাশ করার পরিবর্তে
বিকল্প পাহাড়ি পথে চলার অভ্যাস রপ্ত করার মানসিকতা অর্জন যে জরুরি হয়ে
পড়েছে সেকথা বুঝতে হবে বইকি। আশার কথা বর্তমান প্রজন্ম তা বুঝতে শিখেছে। এও
বুঝতে হবে যে বর্তমান অস্থির সময়ে যে কোন মূল্যেই নিরঙ্কুশ ভাষিক ঐক্য বজায় রাখতে
হবে। বলা বাহুল্য, একদিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান মার্কা রাজনীতি আর অপর দিকে বিদেশি-বাংলাদেশি-বাঙালি
সমীকরণের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সে ঐক্যের বোধ এবং ভিত। এনআরসি যদি শেষ অবধি তৈরিও
হয় তাতে যে সুরাহা হবে খুব, মীমাংসা হবে সব সমস্যার তেমন ভাবার যুক্তিসঙ্গত
কারণ নেই। ‘খিলঞ্জিয়া’র ছদ্মবেশে অচিরেই তা ফিরে আসবে নিশ্চিত।
লক্ষ্মণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। অসমবাসী বাঙালি হিসেবে নিজেদের অধিকার
আদায় করার সময় এসে গেছে, কাজেই ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে হবে। বঙ্গসাহিত্য দাবি তুলেছে, কিন্তু
সেটুকুই যথেষ্ট নয়। কেবল ভাষিক আগ্রাসন কিংবা অন্যতর বঞ্চনার আশঙ্কা দেখা দিলেই নয়, অন্য সময়েও
বাঙালি যে অসমের স্থায়ী বাসিন্দা এবং নিজস্ব স্বকীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়েই এক
অপরিহার্য অংশ তা সাব্যস্ত করতেই হবে। কেন আমাদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র পকেটে
নিয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকতে হবে সে প্রশ্ন তুলতে হবে। ঝাড়খণ্ডে যা সম্ভব হয়েছে, অসমে তা হবে
না কেন? তবে তার
জন্য আত্মসমালোচনার বন্ধুর পথে হাঁটতেও হবে। কাজটা শুরু করার এখনি যথার্থ
সময়, সচেতন
বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসা উচিত। অসমের মাটিতে নিজস্ব শেকড় দৃঢ় ভাবে প্রোথিত করেই বাঙালি
তার কন্ঠস্বর সংখ্যাগরিষ্ঠ অসমিয়া বৌদ্ধিক সমাজকে শুনতে বাধ্য করতে পারে। অবসান ঘটাতে পারে এনআরসি নিয়ে শুরু হওয়া নষ্ট রাজনীতি-চর্চার। বরাক
উপত্যকার বৃহত্তর ঐক্যমঞ্চ থেকেই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে গোটা অসমের বাঙালির
সপক্ষে জোর আওয়াজ তুলতে হবে।
উপসংহার
অসমিয়া কে বা কারা ? এ প্রশ্নে ঘোর সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বিদ্রোহের সুর শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন কোণ
থেকে। কাজটা বোধহয় সহজতর হয় যদি ‘কারা অসমিয়া নয়’তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ফেলা যায়। 'আসু' সহ অন্যান্য
জাতীয়তাবাদী দল সমূহ সেটাই নাহয় সাব্যস্ত করুক ! 'দুধ কে দুধ, পানীকে পানী'আলাদা করার এটাই বোধহয় সব চেয়ে ভালো উপায়! অসমিয়ার সংজ্ঞা নিরূপণ যে সম্ভব হবে না তা
ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ‘অসমিয়া নই’ বলার সাহস দেখাচ্ছেন অসমেরই জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ।
অতএব, এরপর শুরু
হবে ‘খিলঞ্জিয়া’ রাজনীতি। সন-তারিখের
হিসেবে তাও যে নির্ধারণযোগ্য নয়, কোন কোন মহল থেকে সে অভিমত ব্যক্তও হচ্ছে। ছদ্ম-উদারতার
দৃষ্টান্ত হাজির করে কেউ কেউ বলছেন যে ‘অসমের কলা- সং’স্কৃতির সঙ্গে যারাই
একাত্ম’ তাদের সকলেই
‘অসমিয়া’। চোখ ঠারা কাকে বলে আর! নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি
বিসর্জন দিয়ে অসমিয়াভাষীদের এক বৃহৎ অংশ যে আজ বিশ্বায়নের মায়াবি হাতছানিতে
দিকশূন্যপুরের দিকে ছুটছে, অন্যান্য ভাষার মতো অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতিও যে বিশ্বায়নের
ছোবলে পর্যুদস্ত তা তাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! এই সঙ্কুচিত দৃষ্টির
দোষেই অসম বারবার বিভাজিত হয়েছে। সাংবিধানিক রক্ষাকবচ যারা খুঁজছেন তাদের বোঝা
উচিত যে জাতি-ধর্ম-ভাষার ভিত্তিতে বিভাজনের পরিবর্তে পারস্পরিক
শ্রদ্ধার ভিত্তিতে, জনসংখ্যার নিরিখে সংরক্ষণের ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিটি
জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। এ ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থানের এই নীতিতে আস্থাবান হতে সম্মত না হলে অসমের ভবিষ্যত তমসাবৃত থেকে যাবে
আরো বহুকাল। ’৭১ সালের ২৪ মার্চ, মধ্য রাত্রির পর যারা এসেছেন তারাও
প্রায় অর্ধশতক অতিবাহিত করেছেন এদেশে, কাজেই এদের নাগরিকত্ব প্রদানে অসম্মত হলেও সভ্য
মানসিকতার পরিচয় প্রদর্শন করে অন্তত শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া উচিত। নতুবা এক
মধ্যরাত্রি যেমন দেশকে দু টুকরো করেছে, তেমনি আরেক মাধ্যরাত্রির অসম চুক্তি বর্তমান
অসমকে হয়ত আরো একবার টুকরো করবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন