“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

নারায়ণ চন্দ্র পাল - এক সংগ্রামী জীবনের কথা


  
(C)Image:ছবি
          আ
দি বাড়ি ময়মনসিংহের নিজ শান্তিপুর গ্রামে, সিলেট জেলার এক্কেবারে লাগোয়া। পঞ্চাশের দাঙ্গায় ঘর বাড়ি গোয়াল পুড়ে ছাই। সন্ধ্যার আঁধার নামার অনেক পর ওরা এসেছিল দল বেঁধে। হাতে ছিল লাঠি, সড়কি, টাঙন, রাম দা আর মশাল। প্রাণ নিয়ে কে যে কোন পথ দিয়ে কোথায় পালিয়েছিল, কেউ জানেনা। অন্ধকারের সাহায্য নিয়ে মাঠ ঘাট খাল বিল পেরিয়ে ভোর বেলা সে পৌঁছেছিল ছাতক রেল স্টেশনে। চড়ে বসেছিল প্রথম ট্রেনে। গাড়িটি কোথায় যাবে, সে জানেনা। শুধু জানে, এখান থেকে চলে যেতে হবে এতোটাই দূরে, যেখানে লোকে তাকে চেনেনা – হিন্দু না মুসলমান। টিকিট চেকারের হাতে ধরা পড়ে কেঁদে ফেলেছিল ছেলেটি। টিকিট কাটার মত একটা পয়সাও যে নেই তার। অভুক্ত ক্লান্ত শুকনো কান্না ভেজা মুখ দেখে মায়া হল চাটগাঁয়ের বাসিন্দা ওই টিকিট কালেক্টারের। তিনি ছেলেটিকে নামিয়ে দিলেন ট্রেন থেকে কুলাউড়া জংশনে। একটা টাকা চুপিচুপি হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, সোজা পূবদিকে চলে যা। ও পারে কৈলাশহর, ইণ্ডিয়া। এদিকে আর ফিরে আসিস না।

            স্টেশনের বাইরে একটা দোকান থেকে এক আনার গুড়-মুড়ি কিনে খেয়ে আবার হাঁটা দিল ছেলেটি। সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে গেল বর্ডারে। রাতে চুপিচুপি সীমানা পেরিয়ে ঢুকে গেল ইণ্ডিয়ায়, কৈলাশহরে। ত্রিপুরার এক ছোট্ট সীমান্ত শহর। পরদিন কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাস স্ট্যান্ডের পাশে একটা চায়ের দোকানে কাজ নিলো। তার কাজ, কাপ প্লেট ধোয়া, চা মিষ্টি বাসযাত্রীদের অর্ডার অনুযায়ী প্লেটে এনে দেওয়া সহ সব কিছুই। সকালবেলা মালিক যখন নিজে খাজা, গজা, খুরমা, সুজির হালুয়া পোরা লুচি বানায়, তখন তার ফাই ফরমাশও খাটতে হয় তাকে। ঢাউস চুলোয় খড়ি দেওয়া, গাঁজলার টিন মাথায় নিয়ে মনু নদীর ঢালে ফেলে আসা, বাস এলে যাত্রীদের ডেকে ডেকে নিয়ে আসা, সবই করতে হয় তাকে। বিনিময়ে মেলে দুবেলা খাবার আর রাতে ঘুমোনোর জন্য একটা নিশ্চিন্ত ঠিকানা। সে বুঝে গেছে, এটা ইণ্ডিয়া, এখানে কেউ তাকে মারতে আসবে না। শুধু গরম চায়ের কাপ হাতে করে নিয়ে আসার সময় আঙুলের পাতলা চামড়া গুলো ভীষণ তেতে ওঠে, আর রাতে ঘুম আসার আগে অব্দি মশার কামড়ে বড় কষ্ট হয়। সে ভাবে, বড় সুখেই দিন কাটছে তার।

             দিন যায়, মাস যায়, বছরও গড়িয়ে গেল। মালিক এখন তাকে দু টাকা বেতন দেন। বিনিময়ে অবশ্য দায়িত্ব বেড়েছে। দেখে দেখে মিষ্টির অনেক গুলো আইটেম বানানো তার শেখা হয়ে গেছে – ও সব করতে হয়। কাস্টমারেরা সরাসরিই দোকান মালিককে বলে, “ ও দ্বিজেন দা, তোমার মিঠাই গুলো বড় স্বাদ বানাচ্ছো যে আজকাল”। দ্বিজেন দাস, মনে মনে খুশি হন। একটা নতুন মশারি বরাদ্দ হয়েছে তার জন্য। বাড়ি থেকে খেয়ে আসার সময় মালিক নিজেই এখন টিফিন ক্যারিয়ারে করে তার জন্য খাবার নিয়ে আসেন। রাতের খাবার মালিকের বাড়িতে খায় একসাথে। কখনো কখনো মালিক গিন্নিও একটা অতিরিক্ত পুঁটি মাছ তুলে দেন তার পাতে। এখন মশায় কামড়ায় না। শুধু মনের ভিতরটা কামড়ায়, মা বাবা, ভাই বোনদের জন্য। কোথায় আছে তারা ? কেমন আছে ? আদৌ কি আছে, নাকি সেই ভয়াবহ রাতে আরও অনেকের সাথে তারাও শেষ হয়ে গেছে ? কপাল যার মন্দ, তার ভাগ্যে সুখ বেশিদিন টেঁকে না। হঠাৎ এক অজানা জ্বরে দু দিনেই চোখ বুজলেন দ্বিজেন দাস। শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ শেষ হয়ে যাবার পর মালিকের ছেলে জানালো, দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। আগরতলায় চাকরি করে দোকান চালানো যাবে না। চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সে নতুন করে ভাগ্যের অন্বেষণে সে চলে আসে দক্ষিণ আসামের সবচেয়ে বড় শহর শিলচরে।
              আবার একটা অচেনা জায়গা। এটা কৈলাশহর নয়, শিলচর – বড় শহর। অথচ একটাও পরিচিত লোক নেই ডাইনে কিংবা বাঁয়ে। শহরের একটা বড় দোকানের নাম মেসার্স এস এম এন্দ। ফিলিপ্স রেডিও-র এজেন্সি। ছেলেটি কাজের খোঁজে দেখা করল সেই দোকানের মালিক সুনীল মোহন এন্দ-র সাথে। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা সুনীল বাবু সংস্কৃতি-মনস্ক মানুষ, বামপন্থী আন্দোলনেও জড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, রান্না করতে পারবে, প্রায় কুড়ি বাইশ জনের রান্না ? রাজী হয়ে গেল ছেলেটি। শুরু হল নতুন জীবন। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ানোয় পরিচিতি বাড়লো। বহু চেষ্টায় অবশেষে খবর পেলো, মা বাবা ভাই বোনেরা বেঁচে আছে। রয়েছে লালমণির হাটের উত্তরে কোচবিহার জেলার এক গ্রামে। সুনীল বাবুকে বলে একবার গিয়ে তাদের দেখেও এলো। তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ, কিন্তু তার নিজের অবস্থাও যে তথৈবচ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার এসে তাদের শিলচরে নিয়ে আসবে, জানিয়ে চলে এলো। কেটে গেল আরও দু’বছর।  স্বল্পভাষী নম্র স্বভাবের জন্য সবাই ভালবাসে ছেলেটিকে। কিন্তু পারিবারিক কারণে এন্দ পরিবার ভাগ হয়ে গেল। কাজ গেল ছেলেটির। অনন্যোপায় হয়ে আইসক্রিম বিক্রি শুরু করল, সন্ধ্যায় দুর্গা-বাড়ির সামনে তেলেভাজার দোকান। মালুগ্রামের মনিপুরী পাড়ায় একটা বারান্দা ভাড়া করে রাত কাটায়। ধীরে ধীরে একটা জল জমা হয়ে থাকা গর্ত মত জায়গা কিনে নিলো এক সুযোগে। মাটি ভরাট করে ঘর বানালো একটা। কোচবিহার থেকে মা বাবকে নিয়ে এল ওই ঘরে। বরাক সেতুর এপ্রোচের পাশে অনেকেই অস্থায়ী দোকান দিচ্ছে। সেও একটা চা মিষ্টির দোকান খুলে বসল। ছোটবেলায় কৈলাশহরের অভিজ্ঞতা এবার কাজে লাগল। বাবা আর ছোটভাইও সহায়তা করে দোকানে। ভাগ্যলক্ষ্মী বোধ হয় মুখ তুলে চাইলেন ! বিক্রি বাট্টা ভালই। বাবা এবার নিজে পছন্দ করে বৌ আনলেন ঘরে। সচ্ছলতা উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু না, ভবিতব্য অলক্ষ্যে হাসলো। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারির এক গভীর রাতে আগুন লেগে এপ্রোচ রোডের সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল লোকটি। প্রশাসন আর এখানে দোকান বসাতেও দিচ্ছেনা। পুরসভায় ধরাধরি, অনুনয় বিনয়, কাকুতি মিনতি করছে সবাই। এই বিপদের সময় সহায়তা করলেন সুনীল মোহন এন্দ। তার চেষ্টায় অবশেষে একটা ব্যবস্থা হল। জেলা কোর্ট আর চার্চের মাঝখান দিয়ে যে নতুন রাস্তাটি গড়ে উঠেছে, তার পাশ ঘেঁষে দোকান দেবে শুধু তারাই, যাদের দোকান আগুনে পুড়েছে। তাই হল। সেখানে বানানো হল নতুন অস্থায়ী দোকান। দোকান খোলার আগের দিন প্রথমেই হল ব্রহ্মা পূজা। পরদিন থেকে দোকান শুরু এবং শুরু জীবনেরও.....................।
............গেল বছর শিলচরের রোটারি ক্লাব, ৭৫ বছরের ওই প্রবীণ ব্যক্তিটিকে “কর্মযোগী” উপাধিতে ভূষিত করেছে। ৯৬টি রুম সম্বলিত শিলচরের সবচেয়ে বড় হোটেলটির নাম “হোটেল কল্পতরু”। ম্যানেজার, রিসেপশনিস্ট, ওয়েটার, দারোয়ান, নাইট গার্ড, কুক, ওয়ার্ড সুপারভাইজার, ক্যাশিয়ার, একাউন্ট্যান্ট, লন্ড্রি ও সাফাই কর্মী ইত্যাদি মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা দেড়শ’ ছাড়িয়ে। সেই হোটেলের ক্যাশিয়ার যখন কর্মীদের মাসের বেতনের টাকা ওঠাতে ব্যাঙ্কের চেক লিখে মালিকের স্বাক্ষর আনতে যান, কাঁপা কাঁপা হাতে সেই অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষটি আস্তে আস্তে সই করে দেন...............শ্রী নারায়ণ চন্দ্র পাল।


কোন মন্তব্য নেই: