।। রজতকান্তি দাস।।
আমার বাবা ছিলেন
একজন সরকারি অফিসার, তবে অন্য সময়ে ওনার কাজ ছিল হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস। এর জন্য তিনি
কারোর কাছ থেকে কোনও অর্থ নিতেন না, এমন কি ঔষধও দিতেন নিজের খরচে। এটা ছিল তাঁর সমাজ সেবার
একটি অঙ্গ। তাই হোমিওপ্যাথি নিয়ে বাবার কাছে অনেক কথাই শুনেছি। এছাড়া বাড়িতে
এ বিষয়ের উপর বই ছিল একগাদা। এর মধ্যে ‘হোমিওপ্যাথির দর্শন’ বইটি আমি
পড়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি এই বইটি পড়তে ভালই লাগে।
বাবার দৌলতে
অনেককেই সুস্থ হতে দেখেছি হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে। যেমন একজন মহিলা প্রায় মুমূর্ষু
অবস্থায় ছিলেন। বাবা তাকে দিলেন কড়া ডোজের ‘অ্যাকনাইট’। মহিলার অবস্থা কিছুক্ষণের
পাল্টাতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থও হলেন। বাবা বললেন মহিলার মৃত্যু ভয়
দেখে তিনি এই অ্যাকনাইট দিয়েছিলেন কারণ বইয়ে আছে ‘মৃত্যু ভয়ে অ্যাকনাইট’। এছাড়া আমার অল্প
বয়সের এক খুড়তুতো ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাবা
তার হোমিওপ্যাথিক গুরুর শরণাপন্ন হলেন। তিনি দেখলেন বাড়িতে রং করা
হয়েছে তাই লেড পয়জনিং অনুমান করে তিনি দিলেন ‘প্লাম্বাম’। সে সুস্থ হলো। আমি
বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম লেড মানে তো সিসা। আর ল্যাটিন ভাষায় প্লাম্বাম মানেও
সিসা। তাই কেমিস্ট্রিতে লেডের সিম্বল হলো ‘Pb’। বাবা বললেন ‘হোমিওপ্যাথির দর্শন’ বইটি পড়িস তখন
বুঝতে পারবি। এর পরই আমি এই বইটি পড়েছিলাম।
হোমিওপ্যাথির
দর্শনে যা পেলাম তা হলো ‘similia similibus curantur’। এটি একটি ল্যাটিন প্রবাদ যার অর্থ হলো like
cures like। সংস্কৃত ভাষায়ও এরকম একটি প্রচলিত বাক্য আছে যা স্মৃতি থেকে আর লিখলাম না কারণ ভুল হতে পারে। তা ইউরোপ কিংবা ভারতে এই বিশ্বাস ছিলো যে যা রোগের কারণ তাই ঐ রোগের ঔষধ। এই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা।
ইংরেজি homo
শব্দের বাংলা হলো ‘সম’। এখানে সাহেবরাও ‘স’ কে ‘হ’ বলছে। যত দোষ শুধু আমাদের মতো বাঙালদের। তাই homeopathy মানে হলো সমধর্মী চিকিৎসা। অর্থাৎ রোগের যা কারণ তাই তার নিরাময়ের উপায়। এখন প্রশ্ন হলো হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান কি না। এর উত্তরে বলব এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানে যতগুলো মূল নিয়মের আবিষ্কার হয়েছে তা দিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পদ্ধতিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় তা বলছি।
রসায়ন শাস্ত্রের
আমি বিশেষ কিছু জানি না ঠিকই তবে এটা জানি যে ঐ শাস্ত্রে একটি
প্রতিষ্ঠিত নিয়ম আছে যেটিকে বলা হয় ‘Law of mass action’। এই নিয়মটি প্রতিষ্ঠিত এবং আজ অব্দি এমন
কোনও ঘটনা ঘটে নি যা এই নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। হোমিওপ্যাথি
চিকিৎসা এই নিয়মটিকে তো মানেই না বরং এর উল্টোটা মানে। যেমন law of mass
action –এ বলা হয়েছে যদি কোনও বস্তুর পরিমাণ বেশি হয় তা হলে তা হলে তার রাসায়নিক প্রক্রিয়া বেশি হবে। যেমন base দিয়ে অ্যাসিডের ক্ষমতা কমানো যায়। তা base – এর ক্ষমতা নির্ভর করে তার
ঘনত্ব ও পরিমাণের উপর। রসায়ন কিংবা জড় বিজ্ঞানে এতে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু
হোমিওপ্যাথিতে এর বিপরীত পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। তাই হোমিওপ্যাথি
চিকিৎসাকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
হোমিওপ্যাথিতে
ঔষধের শক্তি বাড়ে তার তারল্যের উপর। অর্থাৎ ঔষধের পরিমাণ যত কমবে ততই তার
শক্তি বাড়তে থাকবে। যেমন ৩০ ফোটা দ্রবণের মধ্যে ১ ফোটা ঔষধ দিলে তার শক্তি
হবে ৩০। আবার ২০০ ফোটা দ্রবণের মধ্যে ১ ফোটা ঔষধ দিলে তার শক্তি হবে ২০০।
এভাবে তরলীকরণের মাধ্যমে ঔষধের শক্তি বাড়ানো হয়। এই ভাবে তরলীকরণ করতে করতে
এমন দশা হয় যে সবচেয়ে বেশি শক্তির ঔষধের মধ্যে মূল ঔষধের পরিমাণ এমনই
দাঁড়ায় যার তারল্য হবে প্রায় ৮০০০ গ্যালন জলের মধ্যে এক অণু ঔষধ। প্রশ্ন হলো
একটি অণুর সাইজ কত। এটা এমনিতে বোঝানো যাবে না। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে
একটি আলপিনের ডগায় প্রায় এক লক্ষ অণুর জায়গা করে নেওয়া যাবে। তাই এক
ফোঁটা দ্রব্য জলে মিশিয়ে ঐ শক্তির ঔষধ তৈরি করতে হলে যতটা জলের প্রয়োজন ততটা
জল এই পৃথিবীতে নেই। অর্থাৎ উচ্চ শক্তি সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি
পুরিয়াতে ঔষধের পরিমাণ নেই বললেই চলে। হোমিওপ্যাথিতে এটাকে বলা হয় সুক্ষ্মমাত্রা। এই সুক্ষ্মমাত্রা কখনো এমনও হয় যে এলাহাবাদের গঙ্গায় এক ফোঁটা ঔষধ ঢেলে কলকাতার গঙ্গা থেকে এক ফোঁটা জল খেয়ে নিলে অসুখ সেরে যাবে। এই হলো হোমিওপ্যাথির সুক্ষ্মমাত্রা।
তবে আমার
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় হোমিওপ্যাথি ঔষধে কাজ হতে দেখেছি। এমন কি নিজেও সুস্থ
হয়েছি। তাই যদি সত্য কথা বলতে হয় তাহলে বলবো যে আমি বিশ্বাস ও সংশয়ের দোলাচলে
আছি।
হোমিওপ্যাথির এই dilution নিয়ে গবেষণা চলছে। ১৯৮৮ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় একটি বিতর্কিত লেখাও ছাপা
হয়েছিল যা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহল। এই বিতর্ক নিয়ে
এখন আর কিছু লিখব না। ১৯৮৯ সালে দেশ পত্রিকায় সমরজিত কর নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এই বিতর্কিত প্রবন্ধটি নিয়ে
'হোমিওপ্যাথির
সপক্ষে' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এছাড়া হোমিওপ্যাথির গবেষণায় water memory বলেও একটা ব্যাপার
আছে। তবে এ সবই এখনও অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে। যদি কোনদিন এর বৈজ্ঞানিক কারণ
আবিষ্কার হয় তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। আমি খোলা মন
নিয়েই আমার লেখাটি লিখেছি। হোমিওপ্যাথিকে অব্যবহার্য বলে
দাবি করার আমার ইচ্ছে নেই আবার অবৈজ্ঞানিক কোনও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করাটাও
উচিৎ নয় বলে মনে করি। মনে হয় বিজ্ঞান আরও বহুদূর যাত্রা করার পরই এই রহস্যের
সমাধান হবে। মানুষের অনুসন্ধিৎসা একদিন তাকে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে
পৌঁছে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন