“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৫

রাজনীতি হলো একধরণের necessary evil

(C)Image:ছবি


রাজনীতি কি? রাজনীতি ছাড়া কি সমাজ অচল? রাজনীতিবিদরা কি সমাজের শত্রু? এই ধরণের প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসে। এতদিন এই নিয়ে যা কিছু আপন মনে ভেবেছি তাই আজ এখানে খোলসা করবো। আপনারা পাগলের প্রলাপ ভেবে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারেন।  আমার শুধু প্রলাপ বকার স্বাধীনতা থাকলেই হলো। রাজনীতি নিয়ে এযাবৎ স্বনামধন্য ব্যক্তিরা বহু কিছু বলেছেন। সেসব শিরোধার্য। জর্জ বার্নার্ড শ' বলেছেন “Politics is the last resort of a scoundrel”। স্বামী বিবেকানন্দ রাজনীতি করাকে বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনীতিবিদদের চরিত্রহীন লম্পট হিসেবে দেখিয়েছেন। এই চরিত্রহননে রবীন্দ্রনাথ যদি বা কিছুটা কার্পণ্য করে থাকেন তাহলে এর ভরপাই করে ষোল আনা পূর্ণ করেছেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমায়। এখানে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনীতিককে প্রায় হিন্দি সিনেমার ‘প্রেম চোপড়া’ বানিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছেন তিনি। কাজেই দেখা যাছে যে কবি-সাহিত্যিক, ধর্ম প্রচারক, শিল্পী সকলে মিলে রাজনীতিবিদদের জুতো মারতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করেন নি। এর ফলে তাঁদের কপালে জনপ্রিয়তাও জুটেছে প্রচুর। এখন প্রশ্ন হলো রাজনীতি যদি এতোই খারাপ তাহলে এই জিনিসটা টিকে আছে কী করে? রাজনীতি ছাড়া কি আমাদের চলবে না? সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’ সিনেমায় যখন একজন রাজনীতিবিদকে গণ্ডমূর্খ হিসেবে দেখানো হলো তখন হলের মধ্যে প্রচুর হাততালি পড়তে শুনেছি। তবে আমি হাততালি দিতে পারি নি কারণ এর আগে এমন কিছু লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো যারা রাজনীতি করলেও ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও প্রতিভাবান। এরমধ্যে অচিন্ত্যকুমার ভট্টাচার্যের নাম করব সবার আগে। এই মার্ক্সবাদী নেতার সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। তবে শিলং-এর রণজিৎ দে-র সংস্পর্শে আসাটাও আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্টের মতই। এই সব অসামান্য প্রতিভাবান ও গুণী ব্যক্তিরাও তো রাজনীতি করতেন। তাহলে রাজনীতি এতটা খারাপ হবে কেনো? মহাত্মা গান্ধি, নেহরু, সুভাষচন্দ্র, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, সর্দার প্যাটেল, বালগঙ্গাধর তিলক, জর্জ ওয়াশিংটন, মার্টিন লুথার, লেনিন সহ আরও কত শত রাজনীতিবিদরা ছিলেন সারা বিশ্বজুড়ে যারা আজও নমস্য। তাই একটা কথা মানতেই হবে যে রাজনীতি শুধুমাত্র scoundrel-দের জন্যই নয়। এই ক্ষেত্রের অনেক মহাত্মারাই সমাজে পূজিত। রাজনীতি জিনিসটা কি, এই প্রশ্ন আমাকে কেউ করবে না জানি, তাও আগ বাড়িয়ে নিজের মতটাই এখানে ব্যক্ত করবো। আমার মতে রাজনীতি হলো এক ধরণের ‘necessary evil’। অর্থাৎ সমাজের এক অত্যন্ত ‘প্রয়োজনীয় খারাপ দিক’। গণতন্ত্র ও রাজনীতি দুটোই একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। গণতন্ত্র থাকলে রাজনীতিও থাকবে কারণ রাজনীতি ছাড়া গণতন্ত্র অচল। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের রাজনৈতিক সজাগতার প্রয়োজন কেনো? এর উত্তরে বলবো, কারণ যে বিষয় নিয়ে রাজনীতি হয় না সেই বিষয় সমাজে অবহেলিত হয়ে থাকে। উদাহরণ দিয়ে বলছি, যেহেতু এদেশে জনস্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতি হয় নি তাই সরকারের বাজেটে এ বাবদ মোট ঘরোয়া উৎপাদনের মাত্র ১.৪ শতাংশই বরাদ্দ করা হয়। যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলিতে তা গড়ে প্রায় ৭.৯ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে না দেখে বর্তমান সরকার সর্বশিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করা দিয়েছে। কারণ সর্ব-শিক্ষা কোনও রাজনৈতিক ইস্যু নয়। তাই যে বিষয় রাজনৈতিক ইস্যু হয় না সেই বিষয় সরকারিভাবে প্রাধান্য পায় না। আজ দুর্নীতি একটি রাজনৈতিক ইস্যু হওয়ার ফলে দেশে দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে। এর বিপরীতে রাম মন্দির যদি ইস্যু হয়ে যায় তাহলে তো দুর্নীতিবাজদের পোয়াবারো। তাই দেশের প্রতিজন নাগরিকের রাজনৈতিক সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান সরকার একদিকে যেমন সর্ব-শিক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করা দিয়েছে। তেমনি কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করারও প্রস্তাব রেখেছে। রাজনৈতিক সচেতনতা আরো বেশি থাকলে সরকার কি এতটা সাহস করতে পারত?



মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৫

উত্তর পূর্বভারত ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রদর্শনী তথা সম্মিলনী, ২০১৫

গুয়াহাটির পরে, বছর তিনেক পরে,   উত্তর পূর্বভারত ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রদর্শনী তথা সম্মিলন  আবার হচ্ছে আগামী ১, ২ ও৩ মে, ২০১৫! যথাক্রমে শুক্র, শনি এবং রবিবারে। আয়োজক শিলঙের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। পূর্বোত্তরের সমস্ত বাংলা প্রকাশনার সহযোগী, সহকর্মী, সহমর্মী ঈশানের পুঞ্জমেঘ। ছোট কাগজেরতো বটেই। উত্তর বাংলা সহ গোটা পূর্বোত্তর ভারতের ছোট কাগজের যে সম্পাদকই আন্তর্জালে আছেন, অধিকাংশই ঈশানেও আছেন। তাই, ঈশানের এটা দায় যে সম্মেলনকে সফল করতে নিজের ভূমকা টুকু পালন করে। সম্মেলনের আয়োজকদের হয়ে লেখক লেখিকা, সম্পাদক সবাইকে তাই আমন্ত্রণ রইল।
সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান সূচী এরকমঃ


১-৫-২০১৫ (শুক্রবার)

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানঃ
সকাল ১১-০০ ঃ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন / মঞ্চ উৎসর্গীকরণ
সকাল ১১-৩০ ঃ প্রদর্শণী উদ্বোধন তথা পত্রিকা উন্মোচন
সকাল ১১-৩০ – বিকাল ৬-৩০ ঃ বাংলা ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রদর্শনী
দুপুর ২-৩০ - বিকাল ৫-০০ ঃ আলোচনা সভা
বিকাল ৫-৩০ - সন্ধ্যা ৭-৩০ ঃ বাংলা কবিতা পাঠের আসর।

২-৫-২০১৫ (শনিবার)
সকাল ১০-০০ ঃ মঞ্চ উৎসর্গীকরণ
সকাল ১০-৩০ – বিকাল ৬-৩০ ঃ বাংলা ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রদর্শনী
সকাল ১১-০০ ঃ দুইজন পরিষদ সদস্যকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন
সকাল ১১-৩০ দুপুর ১-০০ ঃ আলোচনা সভা
দুপুর ৩-০০ - বিকাল ৫-০০ ঃ বহুভাষিক কবি সম্মেলন
বিকাল ৫-৩০ - সন্ধ্যা ৭-০০ ঃ আলোচনাচক্র

৩-৫-২০১৫ (রবিবার)
সকাল ১০-০০ ঃ মঞ্চ উৎসর্গীকরণ
সকাল ১০-৩০ – বিকাল ৬-৩০ ঃ বাংলা ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রদর্শনী
সকাল ১১-৩০ দুপুর ১-৩০ ঃ আলোচনা সভা
দুপুর ৩-০০ - বিকাল ৬-০০ ঃ সমাপ্তি সভা

(প্রয়োজনে অনুষ্ঠানসূচী পরিবর্তন সাপেক্ষ)


দরকারে এই নম্বরে রজত কান্তি দাসের সঙ্গে কথা বলুনঃ ০৯৭০৬১৯৪৩০৪
অথবা সংযুক্তা দাস পুরকায়স্থের সঙ্গে কথা বলুন এই নম্বরেঃ০৮৯৭৪০০৬৭৫২

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

গছ তলর বিহু - এক স্বর্ণালী অভিজ্ঞতা

।। আশু পাল।।
কৃষি-প্রধান ভারতে অধিকাংশ সামাজিক উৎসবই কৃষি, ফসল, উর্বরতা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। আসামের জাতীয় উৎসব বিহুও এর থেকে পৃথক নয়। কার্তিক সংক্রান্তিতে কঙালি বিহু’, পৌষ সংক্রান্তিতে ভোগালি বিহুআর চৈত্র সংক্রান্তিতে রঙালি বিহু’ – সবগুলোই কৃষিকর্মের প্রেক্ষাপট সঞ্জাত। সুদূর অতীতে নাকি ভোগালি বিহু ছিল সবচেয়ে ব্যাপক, কিন্তু পরবর্তীতে রঙালি বিহু অসমীয়া সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চৈত্রের শেষ দিনে নামঘরএ ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানিয়ে বিহুর সূত্রপাত করা হয়, আর সমাপন অনুষ্ঠান হয় ১২ বা ১৩ বৈশাখ। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয় হুচরি। দলে দলে যুবক যুবতীরা নাচ ও গানের দল তৈরি করে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচে-গেয়ে বিহুর আগমনী বার্তা পৌছে দেয়। ওটাই হুচরি। রাত দুটোয়ও যদি হুচরির দল কোন বাড়ির সামনে গিয়ে ঢোল বাজায়, গৃহস্বামী তার পরিবার সহ ঘুম থেকে উঠে হুচরি দলকে স্বাগত জানান, আপ্যায়ন করে আনেন, সাধ্যানুযায়ী চাল ডাল ও টাকা পয়সা দিয়ে তাদের খুশি করেন। হুচরির ঢোল বাজানো শুনেও যদি কোন গৃহস্থ ঘুমিয়ে থাকেন, উঠে তাদের আপ্যায়ন না করেন, তবে সমূহ অমঙ্গল এটাই প্রচলিত বিশ্বাস। 
       বৈশাখের দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ দিনে চার-পাঁচটা গ্রামের মানুষ মিলে, নিজেদের সুবিধামত কোন একটা খোলা মাঠে, কোনও একটা গাছতলায়, সমবেত হয়ে নাচ-গান করেন। তার আগে সেই গাছের গোড়ায় মাঙ্গলিক গামোছাজড়িয়ে কৃষি ও গ্রামীণ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রতীকী উপস্থাপনা করে পুজো করেন। তার পরেই শুরু হয়গছ তলর বিহুউদযাপন। অবিবাহিত যুবতীরা এক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিহুনাচ নাচে। অবিবাহিত যুবকেরা ঢোল বাজায়, নাচে আলাদা ভাবে। মাঝবয়সী ও প্রবীণ পুরুষেরা আরেক জায়গায়। বিবাহিতা মহিলারা অন্য জায়গায়। একই মাঠের বিভিন্ন জায়গায় একই সাথে চলতে থাকে এই নাচ গান। ঢুলিয়ার ঢোলের বোল শুনে প্রবীণা মহিলারাও অন্তত দু-চার পাক না নেচে থাকতে পারেন না। শহুরে মঞ্চে বিহু নাচ অনেক দেখেছি। একই ধরণের কাপড়ে সুসজ্জিতা, সুবেশা, সুন্দরী মেয়েরা বেশ কিছুদিন রিহার্সালের পর অপূর্ব দক্ষতায় মনোহারিণী নাচ পরিবেশন করে। দেখলেই বোঝা যায়, যৌবনের জয়গান চলছে। কিন্তু গছ তলর বিহু-র চরিত্র ভিন্ন। ধনী-দরিদ্র, যার যেমন কাপড় আছে বাড়িতে, দক্ষ বা অদক্ষ - যে যেমন নাচতে পারে, নতুন বা পুরোনো যার যেমন ঢোল আছে, সবাই নিঃসঙ্কোচে মিলিত হবে গাছের তলায়। নাচবে গাইবে বাজাবে প্রাণের টানে। সাত থেকে সাতাত্তর বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। 
             অতীতে এই গছ তলর বিহুথেকেই নাকি যুবক-যুবতীদের অনেকে জীবন-সাথী বেছে নিয়ে পালিয়ে যেতো। অভিভাবকেরাও সেটা মেনে নিতেন খুশি মনে। দু-চার-পাঁচ-সাতদিন পর ওই যুবক-যুবতীকে ডেকে এনে সামাজিক বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। কেউ কেউ বলেন, সেই ধারা এখনও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। অবিবাহিতাদের নাচ যখন চলছে, বাঁশের ঘেরা দেওয়া নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে থেকে দু-চারটে যুবকের মন্তব্য শুনেছি, “এই যে, চশমা লাগিয়েছ বলে একবার কি আমার দিকে প্রেমের চোখে তাকানো যায় না ?” আজানুলম্বিত কেশদামের অধিকারিণীকে উদ্দেশ্য করে কেউ বলছে ওই কোমর ছাড়ানো ঘন কালো চুলের রাশি কি আমার জন্য নয় ?” কাজল নয়না কোন হরিণীকে উদ্দেশ্য করে কেউ বলছে, “ ওই কাজল কালো চোখের গভীরে ডুবে মরেছি, এবার টেনে তোলো। লাল টিপ পরা যুবতীর উদ্দেশ্যে মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, “ আর কত টিপ পরবে, এবার সিঁদুর দিতে চাই। সরস মন্তব্যের জেরে যদি কোন নাচনী মুচকি হেসে ফেলল, সাথে সাথে হৈ হৈ করে উঠলো যুবকের দল, “হয়েছে, হয়েছে, তোর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে রে বিড়াল। অভিভাবকদের  অনেকেই শুনতে পাচ্ছেন মন্তব্য গুলো, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছেন না, ধমকও দিচ্ছেন না।


      
   ৩০ চৈত্র থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ভদ্রতার সীমারেখার মধ্যে এসব চলতেই পারে, আগামীকাল এমন হলে কিন্তু কান মুলে দেওয়া হবে।  এমন একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতার সুযোগ কি ছাড়া যায় ? গতকাল (১২ বৈশাখ, ১৪২২, রবিবার) আমরা কয়েকজন মিলে চলে গেলাম তিনসুকিয়ার পানিতোলার পাশে বরুয়াহোলা গ্রামে। নীলাভ নয়ন বরদলৈ আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সংস্কৃতিকর্মী আমাদের গাইড। আন্তরিক আতিথেয়তায় আমাদের স্বাগত জানালেন গ্রামের মানুষ। ফটো এবং ভিডিও রেকর্ডিং করার সুযোগ করে দিলেন। বিকেলে রোদের তেজ যখন একটু স্তিমিত হয়ে এলো, একের পর এক মোট ছয়টি গ্রামের মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হলেন পূর্ব-নির্দিষ্ট গাছের তলায়। নেচে গেয়ে ঢোল বাজিয়ে ওই সাংস্কৃতিক মিছিল দেখেই আমি উদ্বেলিত হয়ে ওঠলাম। আয়োজকেরা মাইকে ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু করলেন অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে নাচুনী, গাইয়ে, বাজনদার সহ উপস্থিত সবাইকে দেওয়া হল নুন-আদাকুচি সহযোগে ভিজিয়ে রাখা কাঁচা ছোলা আর মুগ। আপ্যায়নের এই ধারাই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ঘুরে ঘুরে কিছু ছবি তুললাম। ঢোলের তালে একবার নাচার ইচ্ছা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু অতিথিদের নাচ অভিপ্রেত নয়, তাই ইচ্ছাকে চাপা দিতে হল। ফেরার পথে বাইকের পিছনে বসে নীলাভ আমাকে বলল, “ আশুদা, দেখলেন তো, আমরা যে বলি, ‘বিহুঅসমীয়া জাতির রক্তের সঙ্গে, প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে তা আসলে শহুরে বাবু সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে নয়, বিহু বেঁচে আছে গ্রামের সহজ সরল সাধারণ গরীব মানুষের মধ্যে। বাইক চালাতে চালাতে কথাটা যেন মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করলাম।

রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৫

আইনস্টাইনের থিওরি নিয়ে ভুলভাল প্রচার




।।  রজতকান্তি দাস।।
শিলঙে একজন ফিজিক্সের প্রফেসর আমাকে বললেন তিনি একবার খড়গপুর আইআইটিতে গেছিলেন সেখানে ছাত্ররা তাকে অনুরোধ করেছে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটিবুঝিয়ে দিতেআমি ওনাকে কি বুঝিয়েছিলেন সেটা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন আমি ওদের বলেছি যে সবকিছু হচ্ছে রিলেটিভআরেকদিন গুয়াহাটিতে একজন কেমিস্ট্রির প্রফেসরও একই কথা বললেন যে আইনস্টাইন বলেছেন যে সবকিছু হচ্ছে রিলেটিভউনি যে গাম্ভীর্যের সঙ্গে তা বললেন তাতে মনে হল যারা ওনার পাশে বসেছিলেন সবাই সেটা বিশ্বাস করেছেনআমি আরও বহু জায়গায় অনেক শিক্ষিত লোককে এটা বলতে শুনেছি আর দেখেছি যে লোকে তাদের কথা বিশ্বাসও করে
            তা সবকিছু যে আপেক্ষিক এটা আমাদের সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায়আর যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায় তাই আবিষ্কার করে আইনস্টাইন হয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাতএটা কি বিশ্বাসযোগ্যযে জিনিস নিউটন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই লিখে গেছেন তার জন্য ক্রেডিট দেওয়া হলো একা আইনস্টাইনকে, এতো ভারি অন্যায়এখানে রবীন্দ্রনাথের কথা বললাম কারণ ১৯১৪ সালে তিনি আমার জগত নামে একটি প্রবন্ধে বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে উপনিষদীয় ভাবধারার এক অনাবিল সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেনআমার মতে এই প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ  প্রবন্ধগুলোর মধ্যে অন্যতমকবি এক অসাধারণ কাব্যিক ঢঙে বিজ্ঞানের এই সমস্যাটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন
           যাই হোক, যে জিনিস আমাদের সাধারণ বুদ্ধির গোচর তা আবিষ্কার করে আইনস্টাইন হলে গেলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, এটা ঠিক হজম হওয়ার মতো কথা নয় কিন্তুমনে রাখতে হবে যে আইনস্টাইনের এই তত্ত্বটি নিয়ে লন্ডন টাইমস পত্রিকায় যে রিভিউ বেরিয়েছিল তাতে এই থিওরিকে বলা হয়েছিল ‘an affront to common sense’ অর্থাৎ সাধারণ বুদ্ধিতে আঘাত
           আমি এখানে বিজ্ঞানের এই জটিল তত্ত্বটি নিয়ে কিছু লিখতে বসি নিসে ক্ষমতাও আমার নেইআমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদকে নিয়ে সাধারণভাবে এমনকি শিক্ষিত লোকেরাও যা বলেন তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুলএই ভুল পশ্চিমী দেশগুলোতেও আছেএ সম্পর্কে বিখ্যাত রিলেটিভিস্ট নিগেল কেলডার তাঁর ‘Einstein’s Universe’ বইতে লিখেছেন “Einstein is often said to have told that ‘all things are relative’. He did not.  Relativity is in fact a thoroughly bad name for the theory. Einstein considered calling it in opposite, ‘invariance theory’. He discovered what was ‘absolute’ and reliable despite the apparent confusions, illusions and contradictions produced by relative motion or the action of gravity.” নিগেল কেলডারের লেখায় একটা কথা স্পষ্ট যে আইনস্টাইন এটা বলেননি যে সবকিছু আপেক্ষিকবরং তিনি উল্টোটাই বলেছেনকিন্তু জনগণের মধ্যে এই বিভ্রান্তি দেখা গেছে মূলত এর ভুল নামটির জন্যএই ভুল নামটির জন্য আইনস্টাইনও মনে কষ্ট পেতেন
              ‘আন্নালেন দার ফিজিকনামের জার্মান পত্রিকায় ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের যে প্রবন্ধটি বেরিয়েছিল তার শীর্ষক ছিল ‘On the Law of Electrodynamics’এখানেও রিলেটিভিটি শব্দটি নেইজনসাধারণের জন্য আইনস্টাইন এর নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘Theory of Invariance’কিন্তু কিছু সংখ্যক সাংবাদিকদের জন্য একটি ভুল নাম এর ঘাড়ে চেপে গেছে এবং সেই সঙ্গে যারা নাম শুনেই কাজ বোঝে যান তাদের কল্যাণে আইনস্টাইনের তত্ত্বটি নিয়ে জনমনে এক ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছেএতে ক্ষতি হচ্ছে বিজ্ঞানের ছাত্রদের যারা শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য বিজ্ঞান পড়ে না, বরং প্রকৃতিকে ভাল করে জানবার জন্যই বিজ্ঞান পড়েশুরুতেই তাদের মনে এক ভ্রান্ত ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ায় বিশ্বপ্রকৃতিকে ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছে না তারা
              ‘বিশেষ আপেক্ষিকতত্ত্ব’, এই নামকরণের একটি সার্থকতা অবশ্য খুঁজে পেয়েছেন নিগেল কেলডারতাঁর মতে এই নামটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গবেষণাকালে কোন বিষয়টি আইনস্টাইনকে সবচেয়ে ভাবিত করে তুলেছিলকেলডার আরও বলেছেন যে “Einstein gave the observer his proper status in modern science.”
           বিশেষত গতি বিজ্ঞানে আপেক্ষিকতার সমস্যা ছিল বহু শতাব্দী ধরেই। দেখা যায় যে কোনো এক নিরীক্ষণস্থলকে বাদ দিলে কোনো বস্তুর নিজস্ব গতি বের করা যায় না। আমি যে গাছটিকে দেখছি স্থির সেটিও আসলে গতিশীল কারণ পৃথিবী সঙ্গে তারও একটা গতি আছে। পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখলে গাছটিকে গতিশীলই দেখাবে। তাছাড়া যদি একজন ব্যক্তি একটি ট্রেনে বসে একটি ক্রিকেট বল ওপর দিকে ছুঁড়ে দেন তাহলে তা আবার তার হাতেই এসে পড়বে। এই ব্যক্তিটি দেখলেন যে বলটি সোজা উপরে ওঠে নিচের দিকে নামল। কিন্তু এই বলটির গতি যদি কেউ ট্রেনের বাইরে থেকে দেখেন তাহলে তিনি দেখবেন তা ধনুরাকৃতি বা projectileএখন প্রশ্ন হলো যে বলটির গতি আসলে কি রকম। দেখা যাচ্ছে যে যেহেতু বলটির গতি একেকজন দর্শকের কাছে একেক রকম তাই বলতে হয় যে বলটির গতি দর্শক-নির্ভর এবং তার নিজস্ব কোনো গতি বা গতির ধরণ নেই। এটা হলো নিউটনীয় আপেক্ষিকতাবাদ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আমার জগৎপ্রবন্ধে এই আপেক্ষিকতার মায়াজাল থেকে সোজা উপনিষদীয় ভাব ধারায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন এই আপেক্ষিকতার মায়াজাল থেকে বিজ্ঞানকে বের করে এনে এক অনাপেক্ষিক জগৎ-কে উপহার দিয়েছেন আমাদের ধ্যান-ধারণায়। এই কাজটি তিনি করতে পেরেছিলেন স্পেস ও টাইমের যে ধারণা আবহমান কাল ধরে চলে আসছিল এবং যে ধারণার উপর সমস্ত নিউটনীয় বলবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত তার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে লেখক রোনাল্ড ডব্লিউ ক্লার্ক লিখেছেন ‘... this dissertation of some nine thousand words overturned man’s accepted ideas of time and space … and drastically altered the classical concepts of physics still held by the overwhelming majority of scientists. In addition, it provided such an accurate blueprint for the way in which the physical world was built that within a generation man could no more ignore relativity in the teaching of physics than they could ignore grammar in the teaching of language.(এই মৌলিক রচনার প্রায় নয় হাজার শব্দে সময়আকাশসম্পর্কে মানুষের স্বীকৃত ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া হলো এবং পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুপদী ধারণাকে এমন জোরালো ভাবে পরিবর্তিত করে দিলো যে অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই অভিভূত হয়ে পড়লেন। এছাড়াও এই তত্ত্ব পদার্থ-জগতের রচনা সম্পর্কে এমন এক নক্সা তৈরি করেছিল যে একই প্রজন্মে মানুষের পক্ষে আপেক্ষিকতাকে বাদ দিয়ে পদার্থবিদ্যা শিক্ষা হয়ে পড়ল ব্যাকরণ বাদ দিয়ে ভাষা শিক্ষার মতো।)