।। জয়শ্রী ভূষণ।।
(C) |
কেন জানি না ভাতের সাথে ছোটবেলায়
একদমই ভাব ছিল না, খুব আড়ি ছিল আমার...ভাত খেতে কখনোই ভালবাসতাম
না আমি...এখনো মনে আছে সন্ধেবেলা প্রায়ই
একটি মাঝারে সাইজের বাটি টুবুটুবু ভর্তি করে ভুজিয়া খেতাম..আর রাতে খিদে পেলে বিস্কুট...
বালিশের নীচে, জামার পকেটে থাকতো বিস্কিট, অবশ্যই মাকে লুকিয়ে...রাতে এমন ভাবে ঘুমুতে ঘুমুতে বিস্কুট খেতাম যাতে
কুড়মুড় শব্দে মার ঘুম না ভেঙ্গে যায়....আসলে নিঝুম রাতে নিজের বিস্কুটের কামড়ের
শব্দ আমার কানেই বেশি বাজতো মনে হয়। আমার জন্য
একটা সাদা ঘিয়ের রঙের ডিশ ছিল....মা কত কিছু রান্না করতো...একান্নবর্তী পরিবারে বড়
হয়েছি, তখন অত ফ্রিজ টিজ ছিল না, বাপি
প্রায়ই মাছের মুড়ো, বড় ছোট রকমারি মাছ, মাংস, অনেক শাকসবজি বাজার করে আনত। আমার মা খুব
টিপটপ আর পরিপাটি ছিলেন। মাকে দেখেছি ঘরেও খুব কমদামী প্রিন্টের শাড়ি পরতেন কিন্তু
সব সময় ভাতের মাড় দিয়ে কলপ দিয়ে পরতেন। অনেক উঁচুতে তার বাঁধা থাকতো। ভেজা শাড়িটা
এক ঢিলে উঁচু তারে উড়িয়ে মারতেন ওপরে, তারপর
লম্বা শাড়ি টানটান করে টেনে দিতেন। শুকিয়ে গেলে সুন্দর ভাঁজ করে বালিশের নীচে
রাখলেই ইস্ত্রি শাড়ি তৈরি। তো আমার টিপটপ পরিপাটি পাটভাঙা শাড়ি
পরনে ভীষণ সুন্দরী মা আবার খুব কাজও করতেন, সবার জন্য রান্নাবান্না,
যে যখন বাড়িতে আসছে চা তার সাথে টা এসব লেগেই থাকতো....কতদিন মাকে
দেখেছি দুপুরে খেতে বসেছেন...কেউ বেড়াতে এসেছে তাকে বাটি ভরে তরকারি খেতে দিতেন।
কোন সময়ে অতিথিরা ভাতও খেয়ে যেতেন। আগে অত কে কার বাড়িতে কখন যাবে আসবে তার সময়
গময় ছিল না। বাড়ির বাবা কাকা পিসিরা খুব চা খেতেন সবাই, তাই
মা কাকিমারা সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। তাছাড়াও
আচার বানানো, ঘর গোছানো, আমাদের দেখভাল
করা, আজ ওর জন্মদিন লুচি বানানো, কাল
পৌষ সংক্রান্তিতে সবাই মিলে মা কাকিমারা পিঠেপুলি, পরশু পয়লা
বৈশাখে নানা রান্নাবান্না ইত্যাদি লেগেই থাকতো। বাড়িতে সবসময় আত্মীয় স্বজনরা
বিভিন্ন জায়গা থেকে বেড়াতে আসা যাওয়া করতেন,তাই এসবের মধ্যে
আমাদের পেছনে অত সময় দিতে পারতেন না। তো আমি ছিলাম ডিস্টার্বিং এলিমেণ্ট। মানে
খেতাম না ভাত এক্কেবারেই। আমাকে বলা হতো আমি নাকি পাখির মত
খেতাম।এখনো মনে আছে মা ভাত বেড়ে দিলে অপেক্ষা করতাম কখন মা
রান্নাঘরে যাবে। তখন আবার রান্নাঘর স্নানঘর আমাদের বাড়িতে অত গায়ে গায়ে ছিল না।
বাড়ির মাঝে মস্ত উঠান তার ওপারে একটু গিয়ে রান্নাঘর তার পাশে পুকুর
এবং সেই পুকুর থেকে ডান দিকে ছিল স্নানঘর। তো এত সব করে আমাদের মা এত খেয়াল করতে
পারতেন না আর তার মধ্যে আমি একটু বেয়ারা ছিলুম, তা যেই মা
একটু চলে যেতেন প্রায়ই জানালা দিয়ে ফেলে দিতাম
মাছের টুকরো, গ্লাস ভর্তি দুধ, ভাত ডিসের সাইডে ফেলে দিতাম এমন ভাবে যেন পড়ে গেছে । কোনমতে ভাতের থেকে নিষ্কৃতি
পাওয়ার ব্যবস্থা আর কি। কারণ না খেলে আবার মায়ের উত্তম মধ্যম খেতে হবে, তাই সটান ফেলে দেওয়াটাই সেইফ আর নির্ভেজাল ছিল আমার জন্য। তবে একদম যে
খেতাম না তা নয়, একমাত্র আলু সেদ্ধ বাটার দিয়ে দিলে গপাগপ
সেটা খেয়ে নিতাম। আমি খুব লিকপিকে কাঠির মত ছিলাম দেখতে । তার কারণ
ভাত জাতীয় খাদ্যে আমার তেমন রুচি ছিল না,হাবিজাবিই
ভাজাভুজি প্রিয় ছিল । না খেলেই আমি ভাল থাকতাম
যেন, বিশেষ করে ভাত । আসলে বেশি পেলে যা হয় তাই বোধহয়।
এখনো যখন মুড়িঘণ্ট, চিংড়ি মাছ, মাংস হরেক রকম মিষ্টি, দই এগুলোর কথা মনে পড়ে,
মনে হয় ইসস যদি এখন পেতাম,ভেবেই জিভে জল আসে।
কোন কাপড় জামাই আমার গায়ে ফিট হতো না। এমনও হয়েছে বাপির সাথে কোথাও গেছি, কেউ হয়তো মজা করে বলেছে কি রে তোকে তোর বাবা খেতে দেয় না, শুনেই আমি চটে লাল, একে আমায় সবাই রোগা বললেই আমার মাথা
খারাপ হত, তার ওপর আমার বাপিকে বলে কিনা খেতে দেয় না,
খুব তেড়েমেরে বলে উঠতাম কে বলেছে তোমায় খেতে দেয় না, জানো আমার জন্য আমার বাপি বোর্ণভিটা আনে তাই দিয়ে দুধ খাই আমি। এইকথা শুনে
সে কি হাসাহাসি হল সেদিনও আমায় নিয়ে । প্রায়ই রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম,সারাদিন এত দৌরাত্মপনা আর কত সেই লিকপিকে
শরীরে সইবে। আমার বাপি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন রাতে টেনে হিঁচড়ে তুলে বলতেন মা মা
এরকম করে না মা, রাতে না খেলে এক চড়া রক্ত কমে যাবে শরীর থেকে
তাই এক গরাস হলেও খেতেই হবে। এখানে চড়া বলতে একটা চড়াই পাখির শরীরের রক্তের কথা
বোঝাতেন আর গরাস মানে এক গ্রাস ভাত। এই কথাগুলো আবার আমায় বাপি বুঝিয়ে বলতেন কারণ
আমিও প্রশ্ন করতাম চড়া কি গরাস কি। আমার এইসব দুরন্তপনার দরুন যেহেতু মা নানা কাজে
ব্যস্ত থাকতেন তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে মা আমার খেয়াল সেভাবে কোনদিনই রাখতে পারেননি,
আর তাই আমার খাবার ফেলে দেওয়া সংক্রান্ত এই কাণ্ডকারখানাগুলি কখনোই
টের পাননি।না হলে ওগুলোর জন্য এডিশন্যাল গরুপেটা করতেন। ..... কাজেই বোঝাই যাচ্ছে
সমস্ত দুষ্টুমি ও দুরন্তপনার সাক্ষী ও সাথী ছিলেন আমার বাবা....সেই বাপির সাথেই
আমি বেশি লেপ্টে থাকতাম। বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, রথের মেলা, দুর্গা পুজো, মিশন,
কালীবাড়ি, দশমীতে মূর্তি বিসর্জন, স্কুল, খেলাঘর, মেলা, নাচ গানের অনুষ্ঠান, সব কিছুর সাথী ছিলেন
বাপি...এরকমই বাপির সাথে একটা দিন...সেদিনটা কোন এক
দশমী বা রথের মেলা এমন কিছু একটা উৎসব ছিল ভালো করে মনে পড়ছে না ।
খুউউব ভিড় ছিল সেদিনও। বাপি আমাদের দুজনকে মানে আমার
ভাই ও আমাকে নিয়ে কালীবাড়ির সামনে নরনারায়ণ ট্রেডিং কোং এর বারান্দায় নিয়ে উঠিয়ে
দিয়ে গেলেন। দশমীর দিন সমস্ত দুর্গা প্রতিমাগুলি
নিরঞ্জনের জন্য কুশিয়ারা নদীর ঘাটে নিয়ে আসা হত। হ্যাঁ সেদিন মনে হয় দশমীই ছিল। তো
সেই দিনও একের পর এক প্রতিমা শম্ভু সাগরের পার্কের রাস্তা ঘেঁষে
বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। নারায়ণ ট্রেডিং কোং এর এই
বারান্দাটায় বেঞ্চ পাতা থাকে....তাতে সবাই বসা অনেক মানুষ দাঁড়ানো আসছে যাচ্ছে
গিজগিজ তারই মাঝে ছোটখাটো মেলা মতন সবাই যার যার পসরা নিয়ে বসেছে..আর এর সামনে
দিয়ে কালীবাড়ি পেরিয়ে এই রাস্তা গিয়েই তো সামনেই কুশিয়ারা নদীর ঘাট....…..তবে আমার ওসবে অত মন ছিল না, না বসার ইচ্ছে ছিল,
বাপি নারায়ণ ট্রেডিং কোং দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলেন...আমি এদিক উদিক ঘুরঘুর
করছিলাম আর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলাম। এত্ত ভিড়ের মাঝেই বারান্দায় একদম একটা কোনায়
দেখতে পেলাম আমার বয়সের দুটো বাচ্চা একটু উবু হয়ে
বসে আছে...ওদের সামনে একটা ছোট্ট মাটির উনুন জ্বলছে...উনুনে একটা এনামেলের ডেগচি
বসানো মাটি দিয়ে লেপা তাই কালো কুচকুচে ডেকচির বাইরেটা... একটা বাঁশ দিয়ে ডেকচির
ভেতরে নাড়াচ্ছিল একটু পরপর একজন ময়লা সাদা কাপড় পরিহিত মধ্য বয়সের এক মহিলা।
বাচ্চাদুটি জ্বলজ্বল চোখে বারবার উঁকি দিয়ে দেখছিল। কৌতূহলে সেদিনের সেই ফর্সা
বাদামী চুলওয়ালা ফিনফিনে বাচ্চা মেয়েটি গুটিগুটি ওদের পাশে গিয়ে উঁকি মারলো। একটা
কুপিতে আলো জ্বলছিল সেই আলোতে ওদের তিন জনের চেহারা আর সেই সাথে ডেগের ভেতরে সাদা
ভাতের টগবগ করে ফেনা শুকিয়ে ভাতের ধোঁয়া এখনো চোখে
ভাসছে... আজও স্টিল ফোটোর মত স্মৃতিতে ফ্রিজ হয়ে আছে যেন....খুব আশ্চর্য হয়েছিল
সেই বাচ্চা মেয়েটি..সেই মেয়েটি উবু হয়ে প্রশ্ন করছে তোমরা খালি
ভাত খাবে...উত্তর এসেছিল... না না কাঁচালঙ্কা আর তেল আছে তো... সেই সাথে বাচ্চাটির
মুখের পরিতৃপ্তির হাসি,
সাদা দাঁত, ধুলোয় মাখা হাত কাটা গেঞ্জি সেই
চাউনি.... আর সেই বাচ্চা মেয়েটির জানার পিপাসা, অবাক
হওয়া...ভাতের এই অন্য রূপ, সেদিনের ভিড়ের মাঝে মগ্ন হয়ে ওদের
ভাত-প্রীতি যদিও আশ্চর্য
করেছিল সেই ছোট্ট দুষ্টু মেয়েটিকে........
দুরন্ত লিকপিকে ছোট্ট মেয়েটির সেই ছোট্ট অবুঝ বেলায় আশ্চর্য
ঘটনার জট যেন এতদিনে খুললো... সেই সন্ধ্যার
ওই অদ্ভুত ঘটনার দৃশ্যটি
হঠাৎ হঠাৎ অবচেতনে যেন তাড়া করে...যদিও সব কিছু
আবছা হয়ে গেছে তবুও আজকাল বিশেষ করে এই করোনা ভাইরাসের প্রকোপের দৌরাত্ম্যের চোটে
কোভিড -১৯ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য এই লকডাউন এবং তার পরবর্তী সময়ে পরিযায়ী
শ্রমিক, খাদ্যাভাব, খিদে, এবং শুধুমাত্র ক্ষইদের জন্য মৃত্যুগুলো সেইদিনের দৃশ্যটা চোখের সামনে
জীবন্ত করে তোলে যেন। তেলেঙ্গানা থেকে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ১২
বছরের সেই কিশোরী, লকডাউনের প্রথম বলি ১১ বছরের সেই ছেলেটি,
ছোট বাচ্চাগুলো যারা শুধু দুমুঠো অন্নের জন্য এই পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য
হচ্ছে...সবকিছুরই এতদিনে কোথায় যেন সেই ছেলেবেলার ছবিটির সাথে আজকের
সাদৃশ্য খুঁজে পাই।
(C) |