।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।
(C)Image:ছবি |
--- " দাদুন ! কী হচ্ছে ? সবাই দেখছে তো ?"
পাপড়ির
কথা শুনে বিশ্বম্ভরবাবু একবার মুখ তুলে তাকালেন মাত্র ।তারপর মুচকি হেসে আবারো
একখানা বই এর পাতা
উল্টাতে উল্টাতে নাকের
কাছে নিয়ে গন্ধ শুকতে লাগলেন । এই বইপাড়াটা বিশ্বম্ভরবাবুর খুব প্রিয় জায়গা । সেই
ছাত্রজীবন থেকে এখানে যাতায়াত করছেন । চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে , তেমনি একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে এই পাড়ায় । এখানকার প্রতিটি গলি, প্রতিটি দোকান তার চেনা । চাকুরীতে থাকাকালীন কলকাতায় এলে সময় সুযোগ করে
একবার হলেও ছুটে
এসেছেন এখানে । দেখতে দেখতে বয়স ছিয়াশি পেরিয়ে গেছে । এখনও মন খারাপ হলে এখানে
আসার জন্য মন ছটফট করে তার । তবে এখন আর একা একা চলতে সাহস পান না বিশ্বম্ভরবাবু ।
তাছাড়া মন চাইলেও শরীর সবসময় সাথ দেয় না । যন্ত্রগুলোতে জংধরা । এটা ওটা লেগেই আছে
। সময় যে ফুরিয়ে আসছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । তাই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে
শুয়েই বিশ্বম্ভরবাবু সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন, যদি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন তবে যাবার পথে
শেষবারের মত হলেও একবার বইপাড়াটা ঘুরে যাবেন । অন্তত একটু সময়ের জন্য হলেও । সেই
মতো নাতনিকে পটিয়ে রাজিও করিয়েছেন। তিনি জানেন, অন্য কেউ এই
ঝুঁকি নেবে না । নাতনিটি ডাক্তার, বিশ্বম্ভরবাবুকে বোঝার
চেষ্টা করে । সেই নাতনিকে সঙ্গে নিয়েই আজ তিনি এখানে এসেছেন ।
---
"এই যে দাদু , কিছু চাই কি ?
" দোকানদারের প্রশ্নে বিশ্বম্ভরবাবু অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নেড়ে
না বললেন ।
---"
আপনার হাতে ঐ বইটা কালকূটের অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ।"
---"
জানি --"।
---
"নাম শুনেছেন কালকূটের? "
---
" জানি ---।"
---
" খুব ভালো বই--।"
বিশ্বম্ভরবাবু
আবারো বললেন --- " হ্যাঁ, জানি ---।"
---
" কী করে বুঝলেন ? গন্ধ শুঁকে ?"
আজকালকার ছেলে ছোকরারা ভাল করে কথা বলতে চায় না । কেমন যেন কাঠ কাঠ কথা । ওদেরকেও দোষ দেওয়া যায় না, যুগটাই
এমন হয়ে গেছে । ওরা যে খারাপ, তা নয়। অনেক কিছুই ওদের গর্ব
করার মত । শুধু বই পড়তেই যত অনীহা । দোকানির প্রশ্নে বিশ্বম্ভরবাবুর কপালের ভাঁজটি শুধু দীর্ঘায়িত হলো ।
নিঃশব্দে হাতের বইটা রেখে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। একটা সময়ে এই কাউন্টারে
দাঁড়িয়েই বই নিয়ে হয়েছে বিস্তর আলোচনা । ভাড়ের চা, চারমিনার
সিগারেট আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা । তখনকার দোকানদারদেরও বই নিয়ে খুব পড়াশোনা ছিল
। আজকালকার ছেলে ছোকরাদের মত এত ফাঁপা নয় । ভালো লাগতো কথা বলে ।
দুপা এগোতেই আনন্দ পাবলিশার্স । আহা কত ভালো ভালো বই এখান থেকে প্রকাশিত
হয়েছে, তার নাম বলে শেষ করা যাবে না । গুটি গুটি পায়ে
কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালেন, হাতে তুলে নিলেন ঘণাদা সমগ্র ।
অনেকবার পড়েছেন বইখানা, তবুও হাতে তুলে নিলেন বইখানা । পাশের
দোকান থেকে একটা ভদ্রলোক মুখটা চেনা চেনা লাগছে, চোখাচোখি হতেই
হেসে বললেন, " দাদা এদিকটাতে কি একবারও আসবেন না
।" বিশ্বম্ভরবাবু নামটা মনে করতে পারলেন না, তবু হেসে
ওখানটাতে চলে গেলেন । দোকানটাতে সব প্রকাশকদেরই বই সাজানো । বিশ্বম্ভরবাবুর মুখটা
উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । কী নেই এখানে? তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা, আজিজুল পারভেজের একাত্তরের গণহত্যা - রাজধানী থেকে বিয়ানীবাজার , স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হলদে গোলাপ, আলেক্স হেলির রুটস,
জয় গোস্বামীর ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা, যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল, সুকুমার সেনের ভারতীয় আর্য
সাহিত্যের ইতিহাস । বিশ্বম্ভরবাবু পাগলের মতো এই বই থেকে অন্য বই এ ছুটছেন,
যেন কোনটা ফেলে
কোনটা তুলে নেবেন । একটা আলাদা শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে। তিনি একটার পর আরেকটা বই
এর মলাট খুলে ধরছেন আর প্রাণ
ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন । বুকের ভেতরটা যেন অনেকদিনের পরে হালকা লাগছে । একটা অযাচিত
খুশিতে মনটা ভরে উঠলো । আপন মনে বিড়বিড় করে উঠলেন ---
অসতো
মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় , মৃত্যোর্মা
অমৃতং গময়।
---
" দাদুন ! আবার ?"
দোকানি ভদ্রলোক চুপচাপ দেখছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন । এবারে আর
পাপড়ির কথাতে রাগ করলেন না বিশ্বম্ভরবাবু । তিনি জানেন বইয়ের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, সেই গন্ধে আছে মাদকতা। একবার
যে এই নেশার পাল্লাতে পড়েছে, তার মুক্তি নেই । সবাই তার
স্বাদ জানে না , বোঝে না ; তারা অভাগা।
নাতনিটির জন্য তার করুণা হলো । ওরা জানতেই পারলে না কি বিশাল অমৃত কুম্ভে ওরা
দাঁড়িয়ে । পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে একটা গজেন্দ্র মিত্রের ট্রিলজি "
কলকাতার কাছেই, উপকণ্ঠে আর পৌষ ফাগুনের পালা " কিনে নাতনির হাতে দিয়ে বললেন,
"এইগুলো পড়েছিস ?"
---
" না: , বই পড়তে আমার ভালো লাগে না
।"
একটু হাসলেন বিশ্বম্ভরবাবু । বললেন," একবার আমার
জন্য পড়ে দ্যাখ, ভালো লাগবে।" তারপর আপন মনেই বললেন,
"আমি তোকে যেখানে নিয়ে এলাম, এখানে
লুকোনো আছে অমৃত কুম্ভ । যদি মন দিয়ে খুঁজতে পারিস দিদিভাই , একদিন তুই অমরত্ব লাভ করবি । আমি তোকে
কথা দিলাম ।"
তারপর চাদরের
খোটাতে চোখের কোণ মুছতে মুছতে বললেন, " চল, আর এখানে দেরি করা ঠিক হবে না । এবারে যাওয়া যাক ।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন