“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৯

অন্য মাতাল

।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।
(C)Image:ছবি

--- " দাদুন ! কী হচ্ছে ? সবাই দেখছে তো ?"
পাপড়ির কথা শুনে বিশ্বম্ভরবাবু একবার মুখ তুলে তাকালেন মাত্র  ।তারপর মুচকি হেসে আবারো একখানা বই এর  পাতা উল্টাতে উল্টাতে  নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকতে লাগলেন । এই বইপাড়াটা বিশ্বম্ভরবাবুর খুব প্রিয় জায়গা । সেই ছাত্রজীবন থেকে এখানে যাতায়াত করছেন । চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে , তেমনি একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে এই পাড়ায় । এখানকার  প্রতিটি গলি, প্রতিটি দোকান তার চেনা । চাকুরীতে থাকাকালীন কলকাতায় এলে সময় সুযোগ করে একবার হলেও  ছুটে এসেছেন এখানে । দেখতে দেখতে বয়স ছিয়াশি পেরিয়ে গেছে । এখনও মন খারাপ হলে এখানে আসার জন্য মন ছটফট করে তার । তবে এখন আর একা একা চলতে সাহস পান না বিশ্বম্ভরবাবু । তাছাড়া মন চাইলেও শরীর সবসময় সাথ দেয় না । যন্ত্রগুলোতে জংধরা । এটা ওটা লেগেই আছে । সময় যে ফুরিয়ে আসছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । তাই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই বিশ্বম্ভরবাবু  সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন তবে যাবার পথে শেষবারের মত হলেও একবার বইপাড়াটা ঘুরে যাবেন । অন্তত একটু সময়ের জন্য হলেও । সেই মতো নাতনিকে পটিয়ে রাজিও করিয়েছেন। তিনি জানেন, অন্য কেউ এই ঝুঁকি নেবে না । নাতনিটি ডাক্তার, বিশ্বম্ভরবাবুকে বোঝার চেষ্টা করে । সেই নাতনিকে সঙ্গে নিয়েই আজ তিনি এখানে এসেছেন ।
--- "এই যে দাদু , কিছু চাই কি ? " দোকানদারের প্রশ্নে বিশ্বম্ভরবাবু অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নেড়ে না বললেন ।
---" আপনার হাতে ঐ বইটা কালকূটের অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ।"
---" জানি --"।
--- "নাম শুনেছেন কালকূটের? "
--- " জানি ---।"
--- " খুব ভালো বই--।"
বিশ্বম্ভরবাবু আবারো বললেন --- " হ্যাঁ, জানি ---।" 
--- " কী করে বুঝলেন  ? গন্ধ শুঁকে  ?" 
আজকালকার ছেলে ছোকরারা ভাল করে কথা বলতে চায় না ।  কেমন যেন কাঠ কাঠ  কথা । ওদেরকেও দোষ দেওয়া যায় না, যুগটাই এমন হয়ে গেছে । ওরা যে খারাপ, তা নয়। অনেক কিছুই ওদের গর্ব করার মত । শুধু বই পড়তেই যত অনীহা । দোকানির প্রশ্নে বিশ্বম্ভরবাবুর কপালের ভাঁজটি  শুধু দীর্ঘায়িত হলো । নিঃশব্দে হাতের বইটা রেখে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। একটা সময়ে এই কাউন্টারে দাঁড়িয়েই বই নিয়ে হয়েছে বিস্তর আলোচনা । ভাড়ের চা, চারমিনার সিগারেট আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা । তখনকার দোকানদারদেরও বই নিয়ে খুব পড়াশোনা ছিল । আজকালকার ছেলে ছোকরাদের মত এত ফাঁপা নয় । ভালো লাগতো কথা বলে ।
দুপা এগোতেই আনন্দ পাবলিশার্স । আহা  কত ভালো ভালো বই এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে, তার নাম বলে শেষ করা যাবে না । গুটি গুটি পায়ে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালেন, হাতে তুলে নিলেন ঘণাদা সমগ্র । অনেকবার পড়েছেন বইখানা, তবুও হাতে তুলে নিলেন বইখানা । পাশের দোকান থেকে একটা ভদ্রলোক মুখটা  চেনা চেনা লাগছে, চোখাচোখি হতেই হেসে বললেন, " দাদা এদিকটাতে কি একবারও আসবেন না ।" বিশ্বম্ভরবাবু নামটা মনে করতে পারলেন না, তবু হেসে ওখানটাতে চলে গেলেন । দোকানটাতে সব প্রকাশকদেরই বই সাজানো । বিশ্বম্ভরবাবুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । কী নেই  এখানে?  তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা, আজিজুল পারভেজের একাত্তরের গণহত্যা - রাজধানী থেকে বিয়ানীবাজার , স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হলদে গোলাপ, আলেক্স হেলির রুটস, জয় গোস্বামীর ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা, যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল, সুকুমার সেনের ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস । বিশ্বম্ভরবাবু পাগলের মতো এই বই থেকে অন্য বই এ ছুটছেন, যেন কোনটা  ফেলে কোনটা তুলে নেবেন । একটা আলাদা শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে। তিনি একটার পর আরেকটা বই এর মলাট খুলে ধরছেন আর  প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন । বুকের ভেতরটা যেন অনেকদিনের পরে হালকা লাগছে । একটা অযাচিত খুশিতে মনটা ভরে উঠলো । আপন মনে বিড়বিড় করে উঠলেন ---
অসতো মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় , মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
--- " দাদুন  !  আবার  ?"
দোকানি ভদ্রলোক চুপচাপ দেখছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন । এবারে আর পাপড়ির কথাতে রাগ করলেন না বিশ্বম্ভরবাবু । তিনি জানেন বইয়ের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে,  সেই গন্ধে আছে মাদকতা। একবার যে এই নেশার পাল্লাতে পড়েছে, তার মুক্তি নেই । সবাই তার স্বাদ জানে না , বোঝে না ; তারা অভাগা। নাতনিটির জন্য তার করুণা হলো । ওরা জানতেই পারলে না কি বিশাল অমৃত কুম্ভে ওরা দাঁড়িয়ে । পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে  একটা গজেন্দ্র মিত্রের ট্রিলজি " কলকাতার কাছেই, উপকণ্ঠে আর পৌষ ফাগুনের পালা "  কিনে নাতনির হাতে দিয়ে বললেন, "এইগুলো পড়েছিস ?"
--- " না: , বই পড়তে আমার ভালো লাগে না ।"
একটু হাসলেন বিশ্বম্ভরবাবু । বললেন," একবার আমার জন্য পড়ে দ্যাখ, ভালো লাগবে।" তারপর আপন মনেই বললেন, "আমি তোকে যেখানে নিয়ে এলাম, এখানে লুকোনো আছে অমৃত কুম্ভ । যদি মন দিয়ে খুঁজতে পারিস দিদিভাই  , একদিন তুই  অমরত্ব লাভ করবি । আমি তোকে কথা দিলাম ।"
তারপর চাদরের খোটাতে চোখের কোণ মুছতে মুছতে বললেন, " চল, আর এখানে দেরি করা ঠিক হবে না । এবারে যাওয়া যাক ।"


কোন মন্তব্য নেই: