“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৯

মধ্যভাগ এফিডেভিট

।। অভীক কুমার দে  ।।
   
(C)Image:ছবি
   
রীরের জন্ম কেবলমাত্র জীবনের শুরুকেই দৃশ্যমান করে। এই শুরু যেকোনো জীবের জীবনের জন্য প্রযোজ্য,কিন্তু মানুষের জীবনে শুরু মানে কেবলমাত্র শরীরের জন্ম নয়। ভিন্ন সময় ভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার শুরু লক্ষ্য করা যায় এক জীবনে। মানুষ তার দক্ষতায় শুরু থেকে আবার শুরু করতে পারে। মানুষের কাছে এই পৃথিবী একটা একজিবিশন সেন্টার। মানুষ গবেষক, বাকি সবকিছুই গবেষণার সামগ্রী।
 
        মানুষ ছাড়া বাকি প্রাণীদের দলগত নাম রেখেছেন মানুষ নামক গবেষকরা। হতে পারে আলাদা জাতি, ভিন্ন গোত্র, তবুও দলগত নামই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গবেষণার বিশেষ সামগ্রী হলে, সেক্ষেত্রে আলাদা নাম রাখেন। একেকটি ভিন্ন শরীরের একেকটি নাম থাকে। প্রয়োজনে পদবীও। এই শুরু জীবনের শুরুর জন্য শুরু। একটি যন্ত্রের চালু হওয়া। তারপর সামগ্রী তৈরি হবে। তৈরি হওয়া সামগ্রীর আশানুরূপ গুণগত মান চিহ্নিত হলেই জীবনের শুরু বলা যায়। অর্জুনের দৃষ্টির মত স্থির লক্ষ্য ও নির্ভেজাল সিদ্ধান্ত অটুট হলে সেই নির্দিষ্ট বিষয় সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে এবং সেখান থেকেই শুরু করা যায়।
           আমার মধ্যভাগ নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। আমার এই শরীরের পারিবারিক ডাক নাম 'নিতু'। ছোটবেলা থেকে বেশ আপন হয়ে মনের নরম বিছানা দখল নিয়েছে। কিন্তু আমাকে যখন বাহ্যিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং বিদ্যালয় নামক একটা যান্ত্রিক জগতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে,তখন আরেকটা অপরিচিত নাম জুড়ে দেওয়া হল। সতিনের মতোই নরম বিছানায় ভাগ বসাতে থাকে। আমার ভেতরঘরে রোজ লেগে থাকা দ্বন্দ্ব পাগল করে তুলছিল।
         যে নামটি প্রথম পেয়েছি, যে নামটি পারিবারিক, সে নামের প্রতি খুব বেশি যত্নবান ছিলাম। সামাজিক পরিবেশের গোলকধাঁধায় পড়ে পরে পাওয়া নামের প্রতি উদাসীন ছিলাম। কখনো ঠিকঠাক খবরও রাখা হয়নি--- শারীরিকভাবে সুস্থ আছে কি নেই, সে নামের মনের বাউল কখন কী খোঁজে, এত বড় আকাশটাকে চেনে কিনা, পাখির মত ডানা মেলে নীলের গভীরতা খুঁজে দেখার ইচ্ছে কেমন। স্কুল জীবনের এতগুলো বছর আমার উদাসীন আচরণে একপ্রকার একঘেয়ে দিনযাপন করে চলছিল সামাজিক নাম 'অভীক কুমার দে'
 
         যতদিন উদাসীন ছিলাম, মধ্যে অবস্থানরত নির্ভেজাল 'কুমার' নিয়ে কোনও চিন্তা ছিল না। দুদিকেই বিস্তৃত সাম্রাজ্য। একদিকে গতি, গন্তব্য আর বিস্তার। এক লাগামহীন নির্ভীক দৌড়বাজ 'অভীক'। অন্যদিকে যুগের প্রতিফলন। শুষ্ক, রুক্ষ, দুঃসময়ের ছবি, কুশাসনের প্রতিফলন, প্রতীকী ক্ষুধার্ত 'দে''কুমার' আমার অনড় ছিল মাঝখানে।
      যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গুছিয়ে শুরুটা খুঁজছিলাম, তখন দেখি আমার নিতুর সতিন কষ্টে আছে। ওকে নিয়ে কানকথা হচ্ছে। কটূক্তি করছে সমাজ। দ্বিতীয় নামের ভেতর কুমারের অবস্থান দেখে ঠাট্টা করছে। একবার নিজের অজান্তে হলেও হাত বুলিয়ে শরীরটাকে বিবস্ত্র পেয়েছে পুনরায়। অনুশোচনায় বুকের উঠোনে শীত বাতাস বয়ে গেছে বারকয়েক। যদিও শরীর জানে, এই নাম সমাজ দিয়েছে। সমাজ তার প্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রে ছেঁকে লিখিত রূপ দিয়েছে। এই শরীরটা শুধু অনুগামী কেরানি ছিল তখন থেকেই।
       সময়কে চিনতে গিয়ে দেখেছি, সেই শুরু শুরুই ছিল না। নতুন করে শুরু করতে গেলে আরেকবার শুরুকে খুঁজতে হবে। তাই এই শরীর হাঁটতে শুরু করা প্রয়োজন। কেননা, প্রতিবার প্রতি মোড়ে ধাক্কা খায় শরীর। প্রতিটি মোড় বলে-- 'কুমার' নিষ্ক্রিয় নয়, অসহায় নয়, অভীকের সাথে জুড়ে থাকার কথা। 'কুমার' গন্তব্য জানে, গতি বোঝে, বিস্তারও জেনে যাবে একদিন। তারপর দুঃসময়ের ছবি মুছে দিতে কুশাসনের প্রতিফলনের মুখোমুখি হবে। ক্ষুধার প্রতীকী চিহ্নগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। চিৎকার করে বলতে কোনও ভয় পাবে না-- এই শুষ্কতা এমন রুক্ষতা পৃথিবীর নয়। শুরুতে এমন ছিল না কিছুই। নির্ভীকের অসীমান্ত দেশের মধ্যভাগ এফিডেভিট প্রয়োজন।


কোন মন্তব্য নেই: