।। শিবানী ভট্টাচার্য দে।।
শ্রী অশোক
দেবের ‘সদাপুরাণ’ পড়লাম। বইটার কিছু ট্রেলার ফেসবুকে পড়েছিলাম এবং তখনই
মনে দাগ কেটেছিল। তবে কিনতে গিয়ে বইটির ব্ল্যাক
ট্র্যাজেডি সুলভ কালোপ্রধান জ্যাকেট দেখে দমে গিয়েছিলাম। ১২০ পাতার ছোট উপন্যাসে
মৃত্যুর মিছিল---- তিনটি আত্মহত্যা, একটি হত্যা, একটি দুর্ঘটনা, যদিও
সেটাকেও আত্মহত্যাই বলা যায়, এছাড়া আরো কয়েকটি দুঃখজনক ঘটনা আছে।
তবুও উপন্যাসটি শুধু মৃত্যুর কথাই বলেনা । ত্রিপুরার পটভূমিতে লেখা বইটিতে
অনেকগুলো স্তর, আছে কিছু অভিনব চরিত্র, ছোট ছোট কবিতাত্মক বাক্য, চিত্রকল্পময় বর্ণনা সারা উপন্যাসটিতে মণিমুক্তোর দ্যুতি ছড়িয়েছে। মৃত্যুকে ছাপিয়ে তার অন্তর্নিহিত অর্থের সন্ধান আখ্যানকে মৃত্যুবর্ণনার ঊর্ধ্বে, অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে, যে মাত্রায় নিরানন্দ থাকে না, থাকে এক চিরন্তন দর্শন ।
পাঁচ সফল দিদির তুলনামূলকভাবে
অসফল, বাধ্যতামূলক
ভাবে বাধ্য, ফলত হীনমন্যতায় ভোগা সদানন্দ এই উপন্যাসের
প্রধান চরিত্র। পরিবারের অবহেলার, প্রতিবেশীর বিদ্রূপের,
স্কুলের হেডমাস্টারের তাকে দিয়ে স্কুল প্রশাসনের কাজ করানোর,
এমন কি তার ঘরে বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়লেও বাড়িওয়ালির--- কারো বিরুদ্ধে
কিছু বলতে পারে না, মনে মনে শুধু এক অসহায় রাগে জ্বলতে থাকে। নিষ্প্রেম জীবনে নিজের বাড়িতে ছাদের উপর নিজেরই
করানো কাচের ঘরে বসে সে মদ্যপান করে, গান শোনে, আর চিঠি লেখে এক কাল্পনিক প্রেমিকাকে ‘স’ সম্বোধন
করে, যে আসলে তারই অন্য সত্তা। সেই চিঠিগুলোতেই প্রকাশ
করে তার চেপে রাখা ক্ষোভ, কষ্ট, দ্বন্দ্ব, নিরীহ চেহারার নিচে অন্তর্দৃষ্টি যা দিয়ে সে জগতকে দেখে।
সদানন্দ তার নিষ্প্রেম জীবনের অর্থহীনতাকে কিছুতেই কাটাতে পারেনা, আত্মহত্যা করে। তার অন্যদিকে আছেন ‘গপিস্ট’ রহিম মিয়াঁ যিনি নিজেকে ‘ফাজিল’ বলে পরিচয় দেন, লোকের কাছে ‘গপ’ অর্থাৎ বানানো গল্প করে জীবনকে উপভোগ করেন তাঁর মত করে। আবার মানুষের মধ্যে থেকেও একা হয়ে, তথাকথিত ন্যায় অন্যায়, ধর্ম অধর্মের সরল নিয়মে বদ্ধ না থেকে, তিনিও জীবনের দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। তিনি ‘যামুগা’ বললেও স্বাভাবিকভাবে যেতে পারেন না, নৌকাডুবির রাস্তা ধরে তাঁকে যেতে হয়। লালুমজিদই একমাত্র চরিত্র যে ‘ছয় কাঠির আঠা’য় আবদ্ধ থাকেনা, নিজের কুকুরকে নিজের নাম দেয়, কুকুর সহ সকলকে সম্মান করে কথা বলে। রহিম মিয়াঁর বাড়িতে আসা সব যুবকেরা রহস্যময়ী সুন্দরী জরিনার প্রতি আকৃষ্ট হয় আগুনের প্রতি পতঙ্গের মত। জরিনা যেন মূর্তিমতী বাসনা, যার আকর্ষণে মানুষ হিতাহিত হারায়, কিন্তু সে নিজে থাকে নির্বিকার। সে শেষ পর্যন্ত লালুমজিদের সঙ্গেই যায়, কারণ সে-ই একমাত্র বাসনাকে জয় করতে পেরেছে।
সদানন্দের মৃত্যুর তদন্ত করতে করতে
শেষপর্যন্ত নন্দ দারোগা নিজে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘ঘুঙুর’ (অনেকটা সাংসারিকতার
ঊর্ধ্বে ওঠা বিবাগী) হয়ে যেতে চান। আমার মনে হয় এই বৈরাগ্য, ‘ছয় কাঠির ফাঁদ’ থেকে মুক্তির যাত্রাই উপন্যাসটির মূল সুর, মৃত্যু নয়। এই যাত্রায়
সদানন্দ বা ‘গপিস্ট’এর মত বেরোয় অনেকেই,
কিন্তু বেশির ভাগই ‘ছয় কাঠির ফাঁদে’র আঠায় ধরা পড়ে তিলে তিলে মরে, যেমন সদানন্দ উদ্ধৃতি দিয়েছিল নিজের ডায়েরির পাতায়, we live bit by bit….. by killing others…..bit by bit । উত্তরণ ঘটে খুব কম। তবুও এই
মুক্তিই তো জীবনের সাধনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন