দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা
এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার দ্বাবিংশ তথা ভাটি পর্বের শেষ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
জল বৈতলকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে । দেশের জল, বইয়াখাউরির জল, রইদপুয়ানির জল, লুলার বাড়ি হাকালুকির উত্তর পারে
খিত্তাগাও এর জল। মিঠাপানির দেশ পেরোতে বড় কষ্ট । দেহের কষ্ট একটানা ভোরা বাওয়ার, মনের অবস্থা তো খান খান । মা গেল, বাপ গেল, বন্ধুও গেল বেঘোরে । আনুষ্ঠানিক শোক উদ্যাপনের কোনও উপায়
নেই । ভোরা যখন কুশিয়ারায় পড়ে তখনও তরীর নিচে ঘোলা জল ।
জালুয়া বৈতল, মাইমল বৈতল জানে কোথায় নদী আর
কোথায় মিছাপানি । খেতখামার বাড়িঘর । মাটির রাস্তা । দুই একটা নারকেল সুপারি তাল
বটের মাথা দেখা না গেলে বোঝার উপায় নেই জলরাশির সীমানা । মালিকানা খুঁজে বের করা
অসম্ভব । ইন্ডিয়ার জলও ঘোলা, পাকিস্তানের পানিও গেরুয়া ।
সৃষ্টিধর ওঝাও চেনেন জল । বলেন,
--- পানির কুনু দেশ নাই বাবা ।
বৈতলের বাপও যে জলের জন্তু । বলে,
--- পানির কুনু তেভাগা নাই, লিগ নাই, কংগ্রেস নাই । পানি শুকাইলে মাটি
মাটি অইলেউ দেশ । দেশ দেশ করে, আর মরে মারামারি করিয়া ।
এপারে এসে বৈতল দেখে সব এক । মানুষের দুঃখ দুর্দশার শেষ নেই । ওদিক থেকে চলে
আসার আগে হিন্দুরা বলত ইন্ডিয়ায় বড় সুখ । ওদিকের মন্ত্রী যোগেন মণ্ডল বলে
হিন্দুদের বাঁচানোর দায়িত্ব তাঁর নয় । বলে, মাইমল চাঁড়াল কৈবর্ত পাটনি এরা তার মানুষ । এরা ছাড়া নাকি পাকিস্তান চলবে না ।
মাছ খাওয়াবে কে । মড়া পোড়াবে কে । পড়ানোর মতো মড়া ওদেশে থাকলে তো, মাইমল ছাড়া মাছুয়াও নেই । যোগেন মন্ত্রী নাকি
এবার দেশ ছাড়া হবে । ওপারে গণভোটে ময়নুল হক চৌধুরীর নাম শুনেছে লিগ নেতা । এপারে
এসেও তিনি নেতা কংগ্রেসের । হাইলাকান্দি রাতাবাড়ি পাথারকান্দি করিমগঞ্জেরমানুষ
সাতচল্লিশের পনেরো আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন পাকিস্তানের নাগরিক ।উঠিয়েছেন চাঁদ তারার
পতাকা, আঠারো তারিখে পালটে যায় তেরঙ্গায়
। মৌলভী বাজার শ্রীমঙ্গল বড়লেখা কুলাউড়া বিয়ানিবাজারও থেকে যায় পাকিস্তানে
।রইদপুয়ানি, বইয়াখাউরির স্বদেশ এখন আর বৈতলের
দেশ নয় । লিগের দেশ থেকে বৈতল এখন চরকার দেশে । নেহেরু গান্ধীর কংগ্রেস, জোয়াল কাঁধে জোড়াবলদ । এপারের নবগঠিত কাছাড়
জেলায় শুধু কংগ্রেস ছাড়া রাজনৈতিক দল নেই । স্বাধীনতা জোয়ারে শুধু
কংগ্রেসেরই ঘোলা জল । দু – একটা লম্বা গাছ আর ভেসে- থাকা বাড়ির মতো কম্যুনিস্ট পার্টির বীরেশ
মিশ্র অচিন্ত্য ভট্টাচার্য,পার্টি থেকে বেরিয়ে- যাওয়া তারাপদ ভট্টাচার্যর মতো নেতা আর
স্বতন্ত্র পার্টির জমিদার কিংবা হিন্দু মহাসভারও দম শেষ । ওদিকেও শুধু চাঁদ তারা, কয়েদে আজম । এপারে কয়েদে আজম উধাও হলেও কয়েদে
আজম ভক্ত আছে আছে, চাঁদ তারার পতাকাওয়ালা । যারা
বলে ‘সিলেট নিলাম ভোটের জোরে, কাছাড় নিমু লাঠির জোরে’ । কাছাড় নিয়ে নিলে ত্রিপুরাও চলে যাবে পাকিস্তানে । বেরোনোর
পথ নেই যে । গান্ধীকে এপারেও অনেক ‘ইগু’ বলে । দেশভাগের জন্য দায়ী করে । বৈতল তো জীবনে জল ছাড়া কিছুই
দেখেনি তেমন । সব কিছুর সঙ্গেই জলের তুলনা করে । দেশভাগও বৈতলের কাছে জলরাশি । যে – জল কারো কথায় চলে না, গান্ধীরও না, জিন্নারও না । দেশভাগ এমন এক সময়
যে- সময় মানুষ তৈরি করলেও রাশ থাকে না মানুষের হাতে । তখন কালের
গর্ভ থেকে উঠে আসে কালো জল । সে – জলের নিয়ন্তা সাধারণ মানুষের
ভগবান আর খোদা । লুলা যখন হিন্দু মেয়ের সর্বনাশ করে তখন তাকে সময়ের নির্দেশ
হিসেবেই মেনে নিতে হয় । আর প্রত্যক্ষ সত্যে ক্রোধ থাকে । ক্রোধের প্রতিফলে হিংসা, খুন । জিন্না গান্ধীকে ধরতে পারবে না জেনেই
দুরন্ত ক্রোধে বৈতল লুলাকেই নিশানা করে । একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে বৈতলকে রোখে
কার সাধ্য । এপারে এসেও বৈতল জলের সঙ্গে লড়াই করেছে । ওপারের বন্ধুজলের সঙ্গে এপারের
বিস্তর ফারাক । ওপারের জল বৈতলকে নিয়ত ডাকে,
--- আয় ।
বাপ ডাকে,
--- হেই বৈতল, পানিত লাম ।
নেমে যায় বৈতল বড় হাওরের গর্ভে, টেনে আনে আধমণি বোয়াল । এখানে
মানুষ বড় চালাক, ধুরন্দর । কেউ কাউকে চেনে না ।
এখানে বেজুড়া, তরফ, মিরাশি আর পণ্ডিতপাড়া নিয়ে কামড়াকামড়ি ! সবাই ওপারের জমিদারি ছেড়েএসেছে । সবার
জমিবাড়ি কেড়ে নিয়েছে মিয়ারা । বৈতল কাউকে বলে না তার ছেড়ে- আসা গ্রামের কথা, তার বিল আর হাওর কথা । বলে না মামার বাড়িমিরতিঙ্গার কথা, তার শৈশবের পাটপাথর আর তার সাম্রাজ্যকথা । ওপারের আল্লা হো আকবর এপারে হয়েছে বন্দেমাতরম ।
আল্লার নামে জিকির এপারেওহয় । হয় নারায়ে তকবির ! দাঙ্গাও হয়, দাঙ্গা থামে ।
এপার বরাক নদীর পারে শিলচর শহরে বেচুদার কশাইখানার কচি পাঠা খাশি খেয়ে তাগড়া হয় হিন্দুর রক্ত
। শিলং টেলার্স-এর ইন্দ্রিশ মিয়ার ডগকলার উল্টেই পুজো প্যান্ডেল মাত করে ডেকা গরুর পাল, নতুন যুবা কিশোরের দল । হিন্দু মহাজনের দাদন
দিয়ে ইদের কুর্তা তফন কেনে মুসলমান চাষী । স্বাধীনতার দুবছর পর বিজয়া ইদের
কোলাকুলি দেখে তো মনে হয় না কোনও গভীর দুঃখআছে দুই জাতির । পার্বণের সময় সব একাকার
হয়ে যায় । নতুন জলের দেশে সব মলিনতা ধুয়ে যায় নিমেষেই । আবার হয় । ধর্মকর্তারা
বিভিন্ন বীজতলিতে বিভেদের বীজ পুঁতে রাখেন । নইলে সিলেট কাছাড়ে কজন এসেছে আরব
মিথিলা থেকে । নাটকের প্রয়োজনে মাথা মুড়িয়ে গিরিমাটির তিলকে বৈষ্ণব, লম্বা দাড়ির রক্ত তিলকে শাক্ত, গোঁফহীন দাড়ির চাচাগিরির শেষে সাড়ে তিনহাত
জমিও উড়ে পুড়ে শুকিয়ে শূন্য হয় । নতুন দেশে বৈতলের তৎপরতা নেই । গিরিবাবার মতো কেউ
নেই বলে ডাকাতি করে নারায়ণ সেবা কর । কেউ নেউ ‘জলে লাম’ বলার । মা নেই মনে করিয়ে দেওয়ার, ভাঙা বাড়িটাও নেই বৈতলের । তাই বৈতল মানুষ দেখে আর মানুষের
কথা ভাবে । শিলচর শহরের হরিৎবরণ রিক্সা চালাতে চালাতে বৈতল নিজের অতীত বর্তমান
নতুন করে সাজায় । কিছু রিফ্যুজি মানুষ আর গরিব মুসলমান নিয়ে ইন্ডিয়ায় এখন তার নতুন
সমাজ । বন্ধুদের কাছে অতীতের মুখবন্ধ করে রাখে । বলে,
--- কুনুখানো কিচ্ছু আছিল না আমার । পানিত জন্মাইছি, পানিয়ে নিছে ।
--- কুনুখানো কিচ্ছু আছিল না আমার । পানিত জন্মাইছি, পানিয়ে নিছে ।
আবার নিব আবার দিব ।
< ভাটি পর্ব ২১ পড়ুন উজান পর্ব ১ পড়ুন >
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন