“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

১৯৮৩র অসম: নিপীড়িত বাঙালি হিন্দু-৩




মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
                        
       ( শিলচর থেকে প্রকাশিত "অরুণোদয়' কাগজে বেরুচ্ছে ধারাবাহিক। ক্লিক করুন প্রথম অংশ এবং দ্বিতীয় অংশ পড়তে)




নদী পাড়ের ঝোপেঝাড়ে শকুন উড়েছিল
(অরুণোদয়, মার্চ ২০১৬)
বৃহত্তর আর্নে চরঅঞ্চলের অন্তর্গত টেঙানি-নলবাড়ি গ্রামে অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের খবরে নিমেষে কাছের গ্রামগুলোতেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। ভোর রাতে যখন তারা টেঙানি-নলবাড়িতে    আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছিলেন তখনই সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পানবাড়ি, শিবনগর, আর্নে, কাকোবাড়ি, মুক্তিয়ার, মাণিকপুর, আর্নে তিরাশি ইত্যাদি গ্রামের মানুষ ভাবতেই পারেন নি যে অচিরেই তারাও আক্রমণের মুখোমুখি হবেন।
            পানবাড়ি শিবনগর গ্রামের তিনকুড়ি বছরের বয়স্ক ব্যক্তি লালমোহন দেবনাথ বললেন, “ তিরাশি সনে পানবাড়ি শিবনগর গ্রামে প্রায় ৫০টার মতো পরিবার বাস করতো। ফেব্রুয়ারি মাসের সেই আক্রমণে এই সমস্ত পরিবার তাদের বাড়িঘর সব হারালো। প্রথমে আমরা গ্রামের মানুষ আক্রমণকারীদের বাধা দিতে গেছিলাম। কিন্তু বাধা দিতে গিয়েই বুঝতে পারলাম এতো হাজার হাজার মানুষকে বাধা দেবো কী করে? শেষে পিছিয়ে এলেন আমাদের গ্রামের লোকেরা। যদিও ওরা গ্রামের বহু মানুষকে হত্যা করেছিল, অনেকেই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের দিকে পালালেন। কেউ কেউ নৌকা করে নদী পার করে ডিব্রুগড় গিয়ে পৌঁছুলেনবাকিরা ব্রহ্মপুত্রের কাছেই ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করলেন। ”
কালীদাসী মালোদাস
            গ্রামের সবাই প্রাণ বাঁচাতে কি পারলেন? ---আমাদের এই প্রশ্ন শুনে লালমোহন কিছু সময় চুপ করে রইলেন। তিনি যখন বলছিলেন পানবাড়ি শিবনগরের   আরো কিছু মানুষ সেখানে ছিলেন। কিন্তু লালমোহন দেবনাথের কথার উপরে কেউ কথা বলছিলেন না। লালমোহনের নীরবতা পুরো পরিবেশটাকেই নীরব করে ফেলল। (আমরা তাঁর বাড়ির উঠোনে বসেই কথা বলছিলাম।)  নীরবতা ভেঙ্গে লালমোহন দেবনাথ আবার বললেন, “ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের জঙ্গলে লুকিয়েও আমাদের বহু মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পারেন নিহাজার হাজার লোকে ঘেরাও করে সেই জঙ্গলের ভেতরেই বহু মানুষকে মেরে ফেলল। প্রাণ বাঁচাতে কেউ কেউ সেখান থেকেও দৌড়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। ঘিরে ফেলে কুপিয়ে কুপিয়ে , নইলে তির ছুঁড়ে মেরে ফেলল।  পরদিন আমাদের এলাকা পুরো যখন ঘুরে দেখেছিলাম নদীর কাছে বেশ কিছু মৃতদেহ। একজন ছিলেন বনমালী শর্মা, তাঁর মৃতদেহ দেখেছি বাঁধের উপরে।  আর তিনটা মৃতদেহ নদীর কাছে পেয়েছিলাম , তিনজনকেই টুকরো টুকরো করে কেটেছিল। দিন কয় আমরা সবাই দেখেছি  ঐ ঝাড়ের উপরে ঝাঁক বেঁধে শকুন উড়তে দেখেছি।  কাক উড়ছিল শয়ে শয়ে। জঙ্গলের ভেতরে শেয়াল-কুকুরের হাঁক শুনেছি।   সেসব শুনে দেখে আমরা গ্রামের সব মানুষই নিশ্চিত সেখানে প্রচুর মৃত দেহ ছিল। আজ অব্দি আমাদের গ্রামের বহু মানুষ নিরুদ্দেশ।    যারা ঘর-বাড়ি হারিয়েছিলেন তারা বহুদিন কাছের ভৈরবপুরের আশ্রয় শিবিরে ছিলেন।   আমরাও ছিলাম। কিন্তু শিবিরের অবস্থাও এতোই জঘন্য ছিল যে সেখানেও চিকিৎসার অভাবে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। আমার মনে আছে,  তাদের মধ্যে একজন ছিলেন দশরথ দেব।    
            লালমোহন দেবনাথকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনাদের উপরে আক্রমণ কারা , কেন করেছিল---আপনি কিছু জানতে পেরেছিলেন?
            “ হ্যাঁ, ঘটনার পরে জেনেছি।” তিনি আবার বললেন, “আর্নে চরআঞ্চল এলাকার বা পানবাড়ি এলাকার মানুষকে ‘বিদেশী’ বলে আক্রমণ করেছিল। বাঙালি দেখে দেখে আক্রমণ করেছিল। আমাদের গ্রামের কাছেই একই এলাকার মিসিং , হাজং ইত্যাদি আর যেসব জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন তাদের উপরে করে নি। বেছে বেছে বাঙালি সম্প্রদায়কেই আক্রমণ করেছিল। অসমের বিদেশী বিতাড়নের আন্দোলনকারীরা স্থানীয় কিছু মানুষকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছিল। আমাদের বাঙালিরাও কোথাও কোথাও প্রত্যাক্রমণ করেন, তাতে তাদের অনেকেও মারা গেছিলেন বা আহত হয়েছিলেন। তাতেই প্রমাণ---আক্রমণকারী ছিল কারা। ...”
            “এখানে আপনার কখন থেকে বাস করছেন?”
            “ ১৯৬৬তে এখানে এসেছি। এর আগে আমার বাবা থাকতেন ত্রিপুরার আগরতলাতে। এখানে যখন আসি    তখন আমি ছোট ছেলে।” আক্ষেপের স্বরে তিনি বললেন, “ তখন থেকেই এখানে বাস করছি। এই মাটিগুলো ব্রহ্মপুত্রের চরের মাটি। খুব ভালো খেত কৃষি হয়। আমরা যখন এসেছি, তখন থেকেই পাশের মিসিং আর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করছিলাম। বানের সময় যেমন সবাই মিলে বাঁধে বা অন্যান্য উঁচু জায়গাতে আশ্রয় নিই , হাটে বাজারেও একই সঙ্গে যাই আসি, কাজ কর্ম করি। কিন্তু ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারিতে যেন কেন আমাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিল। শ’য়ে শ’য়ে বাঙালি মারা গেলেন, হাজারে হাজারে  পঙ্গু হলেন।  ...” 
            লালমোহন দেবনাথের মতো ২নং আর্নে চরাঞ্চলের  বছর ষাটেকের দুর্য রায়ও ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনাগুলো সাক্ষী।
            সেই দুর্য রায় এখনো আছেন ২নং আর্নে চাপরিতে। দুর্য রায়ের বড়ভাই মণ্টু রায় ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি এলাকার সব মানুষের সুখ দুঃখের সংবাদ রাখতেন। রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারিতে উগ্রজাতীয়তাবাদী স্থানীয় অসমিয়া মানুষের আক্রমণে তিনি আহত হন। ঘটনার পরে সরকারী তদন্ত আয়োগের (তেওয়ারি আয়োগ) সামনে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। পরে সেই মণ্টু রায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর ভাই দুর্য রায় বললেন, “সেদিনের আক্রমণে ২নং আর্নে বহু মানুষ মারা গেছিলেন। মারা যাওয়া মানুষের অধিকাংশই ছিলেন বৃদ্ধ –বৃদ্ধা, শিশু আর মহিলা। আমি যেটুকু জানি ২নং আর্নে চরাঞ্চলের প্রাণ কুমার সরকার (৭০), মাদারী মণ্ডল( ৫০), সুবল সরকার (৭০), কাঞ্চন সরকার (৬০), রতন বর্মণ (  ১০), যোগেশ রাজবংশী ( ৭০), হেমন্ত সরকার  ( ৭০), রায়মোহন বিশ্বাস ( ৭৫) এমন বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়। আহত মানুষের তো কোনো হিসেবই নেই।”
            তেমনি আর্নে পানবাড়ি গ্রামের বহু পরিবার সেই আক্রমণের পরে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন। প্রায় ১১০টি পরিবার শিলাপাথার শহরের কাছে  থিতু হলেন। শিলাপাথারের সেই নতুন নিবাসীর একজন অঞ্জলি ভৌমিক বললেন, “ সকালে প্রায় সাতটাতে  আমাদের পানবাড়ি গ্রামটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে। যারা দৌড়ে পালাচ্ছিলেন তাদের ধনুকে তির ছুঁড়ে মারা হয়। হাতের কাছে যাদেরকেই পেয়েছে তাদের কুপিয়ে হত্যা করে। আমার চোখের সামনে আমার স্বামী সুনীল ভৌমিককে কুপিয়ে হত্যা করে। তখন সুনীলের বয়স ছিল ৩৫ বছর। আমাদের বিয়ের তখন ৪ বছর মাত্র হয়েছিল। ছেলে জগন্নাথের বয়স তখন মাত্র ৪ বছর হয়েছিল। আমি ওকে কোলে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচাই। সুনীলও দৌড়োচ্ছিল, তাতেই হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল। আর উঠতে পারল না। আমি কিছু দূর থেকে দেখছিলাম ওকে কিছু মানুষ কোপাচ্ছে। ...”
            কথাগুলো বলে অঞ্জলি হু হু করে কেঁদে ফেললেন। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে আমরা কোনো ভাষা খোঁজে পাচ্ছিলাম না। কিছু পরে অঞ্জলি বললেন, “ পুরো জীবনটাই পিতৃহারা সন্তানটিকে নিয়ে, বাড়ি ঘর হারিয়ে চরম যন্ত্রণাতে জীবন অতিবাহিত করেছি। যে দুর্যোগপূর্ণ সময় আমাদের জীবনে নেমে এসেছিল সে আর কারো জীবনে না নামুক। কিন্তু আজ অব্দি বুঝতে পারিনি আমাদের অপরাধ কী ছিল? শিকারিরা যেমন জীবজন্তুকে তাড়া করে সেভাবে  তাড়িয়ে তাড়িয়ে আমাদের মানুষকে কেন আক্রমণ করল? কোনোদিনই আমরা ন্যায় পেলাম না।”।
            উল্লেখযোগ্য যে সেই পানাবাড়িতে যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস (৪০) , সাধুচরণ সাহা (৭০), ধীরেন শিকদার (৩৫), উমা শর্মা (৭), বনমালী শর্মা (৬০), সরস্বতী দেবী (৫০) , দশরথ দেবনাথ (১৭) এমন অনেক মানুষকেই অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীরা হত্যা করেছিল।
            সেরকম কাকোবাড়ি গ্রামেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রমণ কারীদের হাতে ৬২ বছরের নরেন ঘোষ, ৩৫ বছরের নরেশ ঘোষ এবং নরেশের বৃদ্ধা মা আশি বছরের ফালো মণ্ডলের মৃত্যু হয়েছিল। বৃদ্ধা ফালো মণ্ডল ঘরের থেকে নড়াচড়া করতে পারতেন না।  সেই অসহায় বৃদ্ধা মহিলাকে হত্যা করেছিল অসমিয়া জাতির অস্তিত্ব রক্ষার নামে। এদিকে কাকোবাড়ি গ্রামে আক্রমণ করতে এসে আন্দোলনকারীরাও বাঙালি প্রত্যাক্রমণকারীদের হাতে অনেকে প্রাণ দিয়েছে। এই সম্পর্কে  কাকোবাড়ি অঞ্চলের পরমা মণ্ডল বলেছিলেন, “ আমাদের গ্রামে আক্রমণ হবে বলে আমরা আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলাম। একাংশ মানুষ আমাদের খবর দিয়েছিলেন যে আন্দোলনকারীরা আন্দোলনকারীরা বাঙালিদের গ্রামগুলোকে আক্রমণ করবার পরিকল্পনা করছে। অনেকে অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করছেন। আক্রমণ করতে লখিমপুর জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আন্দোলনের সমর্থক এসে শিলাপাথারে সমবেত হয়েছে। ফলে আমরাও আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। বন্দুক –বারুদ কই পাই, তাই বর্শা-বল্লম, দা –লাঠি সেসবই ছিল। কিন্তু ঐ হাজার হাজার মানুষকে আমরা বাধা দিই কী করে? তবুও আমি, সুচল মণ্ডল এমন অনেকে মিলে লড়ে গেছি। আমরা লড়াইটা করেছিলাম বলেই গ্রামের অনেকেই বিশেষ করে মহিলারা, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যেতে সুবিধে পেল। আমাদের প্রত্যাক্রমণে যদি কারো মৃত্যু হয়েছিল জানি না। কিন্তু অনেক মিসিং সম্প্রদায়ের মানুষকে আক্রমণকারীদের দলে দেখেছিলাম। সেদিন আমার পা ওরা কুপিয়ে ভেঙ্গেছিল। যে আমাকে আঘাত করেছিল সে মিসিং সম্প্রদায়ের ছিল। আমাদেরই কিছু মানুষের প্রত্যাক্রমণে সেই মানুষটির মৃত্যু হয়েছিল। ...”
এমনি ভাবে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী তথা আক্রমণকারী এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ও হয়েছিল। মোট কথা আর্নে চরাঞ্চলের বালিতে সেদিন বয়ে গেছিল রক্তের নদী, আকাশে উড়েছিল ধোঁয়া ছাই। একদিন পরেই আরেকটি নৃশংস কাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল চিমেনচাপরিতে।   


চিমেনচাপরির বিষাদ গাঁথা
আসু গণ-সংগ্রাম পরিষদের নৃশংসতার জীবন্ত সাক্ষী মাতা-পুত্র
পরমার সামনে হাজির হতে আজো কেন সৎ সাহস হলো না জাতীয়তাবাদী নেতাদের?

        
(পরমার ছিন্ন হাতখানা)
    আর্নে বালিচরে বাঙালি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে  অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের কিছু পরেই অন্য এক নৃশংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল চিমেন চাপরিতে। বিশেষ করে চিমেন চাপরির খেরনি বস্তিতে অসমের ‘অস্তিত্বরক্ষা’র আন্দোলনকারীরা পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করেছিল। খেরনি বস্তি অঞ্চলে আক্রান্ত বহু পরিবার পরে চিমেন চাপরি ছেড়ে  এসে মাজরবাড়ি চিমেনমুখ অঞ্চলে বাস করতে শুরু করেন। বাড়ি ঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত ভুক্তভোগীরা এখনো আছেন মাজরবাড়ি অঞ্চলে--- উগ্রঅসমীয়াদের আক্রমণের সাক্ষী হয়ে। ...
            চিমেনচাপরির ভুক্তভোগী জনতা শুধু আন্দোলনকারীদের আক্রমণেরই সাক্ষী নয়, বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলনের নামে অসমের বিভিন্ন প্রান্তে ফ্যাসিবাদের যে জোয়ার উঠেছিল তারও প্রমাণ। শিলাপাথারের কাছের বৃহত্তর আর্নে চরে বা চিমেন চাপরিতে উগ্র অসমিয়াদের আক্রমণ কেমন নৃশংস ছিল আর সেই আক্রমণের ফলে এক একজন ব্যক্তি বা এক একটা পরিবারকে ঘটনার পরবর্তী কালে কীভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছিল---তার নজির পরমা মালোদাস নামের তরুণের জীবন পরিক্রমা।...
            ধেমাজি জেলার অন্যতম শহর শিলাপাথারের থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাজরবাড়ি বাজার। চিমেনমুখ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মাজরবাড়ি এলাকার প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ এই বাজারটিতে যখন আমরা গিয়ে হাজির হৈ তখন আমদের সঙ্গী সমাজকর্মী ধনঞ্জয় নাথ বলল, ‘ঐ ছেলেটিকে দেখুন।’
            এক তরুণকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, আমরা যে চায়ের দোকানে বসে আছি সেদিকে এগিয়ে আসছেন ঐ তরুণটি।
            সেই তরুণের সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিল ধনঞ্জয়। আমরা নমস্কার জানালাম। প্রত্যুত্তরে সেই তরুণ এক হাত তোলে সম্ভাষণ জানালেন। আমরা একটু অবাক হলাম। দু হাত তোলে সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর দেবার  জন্যে তাঁর অন্য হাতটি নেই। ঠিক কব্জির নিচেই হাতটি ছিন্ন। ...
            এই তরুণই পরমা মালোদাস। আর তাঁর এই ছিন্ন হাত হচ্ছে ‘অসম আন্দোলনে’র ফ্যাসিস্ট বাহিনীর জঘন্যতম কার্যকলাপের জ্বলন্ত উদাহরণ। ১৯৮৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় ভাগে ‘অসমিয়া’ মানুষের পরিকল্পিত আক্রমণের সাক্ষী পরমা মালোদাস। আর সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, অসম গণ সংগ্রাম পরিষদ ইত্যাদির নেতৃত্ব তথা প্রফুল্ল মোহন্ত, ভৃগু কুমার ফুকন, ভরত চন্দ্র নরহ প্রমুখ নেতার নির্দেশে পরিচালিত বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলনের গণসংহার কর্মসূচীর অন্যতম প্রমাণ। ...
            বাঙালিদের উপরে যে কী নির্দয়ভাবে অসমের ভূমিপুত্রেরা অত্যাচার –উৎপীড়ন চালিয়েছিলেন , মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিশ্ব কাঁপিয়েছিলেন তারই সাক্ষী হয়ে রয়েছেন পরমা মালোদাস।   উল্লেখযোগ্য যে আন্দোলনকারীরা চিমেন চাপরির বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাতে আক্রমণ চালাতে গিয়ে এই পরমার এক হাত দায়ে কেটে দুই টুকরো করে ফেলেছিল... আর সেই সময় পরমা ছিলেন এক কিশোর মাত্র। সেই পরমার ছিন্ন হাতটি অসম আন্দোলনের বর্বর চরিত্রের প্রতীক।
            মাজরবাড়ি বাজারে দেখা হলে সেই সব ভয়াবহ দিনটির কথা পরমা বলেছিলেন এইভাবে, “ সেদিন আবহাওয়া মেঘলা ছিল। দিনের প্রায় দশটা এগারটার সময় বাড়ির কাছেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলাম। কিন্তু হঠাৎই টের পেলাম গ্রামের মানুষ দৌড়োদৌড়ি করছেন। চীৎকার চেঁচামেচি করে পালাচ্ছেন। দৌড়ে বাড়ি যেতে গিয়ে দেখি আমাদের বাড়ির দিকেই প্রচুর মানুষ হাতে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছেন। চেঁচামেচি শোনে বেশ ভয় করছিল। দূরে গ্রামের আর মাথাতে আগুনের শিখা চোখে পড়ল। তখন আমার ঠাকুমাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি হাঁটতে পারেন না। তবুও লাঠি একটাতে ভর করে বেরিয়ে এলেন। অন্যেরা ইতিমধ্যে পালাতে শুরু করেছে। আমি ঠাকুমার হাতে ধরে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলাম। হাঁটবার শক্তি ছিল না, তবু ঠাকুমা হেলে দুলে প্রাণ বাঁচাতে এগুচ্ছিলেন। কিছুদূর এগোবার পরে প্রচুর লোকে আমাদের ঘিরে ফেলল। ওদের হাতে দা-তলোয়ার –লাঠি-মশাল এমন কত কী!  ওদের দেখে ভয়ে প্রায় মূর্ছা যাই আর কি। কী করবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। তখনি ওরা আমাদের ঘিরে ফেলল আর আমার সামনেই ঠাকুমাকে কুপিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলল। আমার মনে হলো মাথা ঘোরাচ্ছে, সে অবস্থাতেই ক’জন আমাকে ঘপ করে ধরে টেনে নিয়ে গেল। দা দিয়ে মারলো আমাকে। আমি চীৎকার করলাম। কেউ একজন আমার বাঁহাতে ঘা বসালো আর হাতখানা দু’টুকরো হয়ে একটুকরো দূরে ছিটকে পড়লো। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম।”
            কথাগুলো বলে বহু সময় মৌন হয়ে রইলেন পরমা। পরমার কথা শোনে আমরাও নির্বাক। কিছুক্ষণ নীরব থাকবার পরে দেখি ডানহাতে বাঁহাতের ছিন্ন অংশে স্পর্শ করলেন পরমা। “এই দেখুন!” ---পরমা ছিন্ন হাতখানা আমাদের দিকে তুলে ধরলেন---অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের একটি কিশোরের উপরে চালানো ‘দানবীয় নিপীড়নের প্রতীক’ সেই খণ্ডিত হাতখানা কিছুক্ষণ আমাদের চোখের সামনে স্থির হয়ে রইল।
            কোনো প্রশ্ন নাই, কোনো উত্তর নেই ---আমাদের থেকে।
            মৌনতা ভেঙ্গে পরামাই বললেন, “ গলাতে, পিঠেও আছে আক্রমণকারী আন্দোলনকারীদের দায়ের ঘায়ের চিহ্ন।” এবারে পরমা গায়ের জামা তোলে শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখালেন। তারপরে আবার বললেন, “আমাকে ওরা মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে গেছিল। পরে রাতে বাবা এসে আমাকে তোলে নিয়ে যান। ঠাকুমা প্রিয়বালা মালোদাসের মৃতদেহ সেখানেই পড়ে রইল। পরে গ্রামের মানুষ সৎকার করেন। এদিকে আমার মা কালীদাসী মালোদাসের ঠিক চোখের নিচে দায়ের ঘা পড়েছিল। নাকটি কাটা গেছিল। মা আর আমাকে দু’দিন পরে আশ্রয় শিবিরে আসা ডাক্তার চিকিৎসা করেন। পরে অরুণাচলের পাশিঘাট হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা হয়। আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল।”
            এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পরমা থমকে রইলেন। কথাগুলো শোনে ধনঞ্জয় বলল, “ পরমার জীবন কথা আমরা ভালো করেই জানি। পরমা সেই ঘটনার পরে এক হাতেই বইএর বোঝা  নিয়ে বহু দূরের স্কুলে যাওয়া আসা করেছিল। আমাদের সঙ্গে লেখাপড়া করেছিলবিশ কিলোমিটার দূরে সাইকেল চালিয়ে শিলাপাথারে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই পরমা এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে ধরে বাড়ি বাড়ি মুড়ি বিক্রি করে পরিবার চালিয়েছে। কিন্তু এই পরমাকে সাহায্য করতে বা ন্যায় দিয়ে কেউ এগিয়ে এলো না। পরমার দোষ কী ছিল? আসলে পরমার মতো যুবকের সামনে দাঁড়াবার সাহস আজ অসম আন্দোলনের নেতৃত্বের নেই। তারা নির্যাতিত  লোকেদের ক্ষতিপূরণ বা ন্যায় প্রদানতো দূর , এই সব নিপীড়িতদের  কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করবারও সৎ সাহস ওদের নেই হয়ে গেছে। ...”
           
          
সূর্য এবং কালীদাসী মালোদাস
মাজরবাড়ির একটি ভগ্নপ্রায় কুড়ে ঘরে আমাদের দেখা হয় পরমার বাবা সূর্য মালোদাসের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, “চিমেন চাপরির খেরনি বস্তিতে থাকবার সময় আমার ছিল ১২ বিঘা খেতের জমি। এখন আছে শুধু এই ভিটাটাই। তিরাশি সনের ঘটনা আমাদের সব শেষ করেছে। আমার বড় ছেলে পরমার একটা হাত কেটে ফেলল। আমার স্ত্রীর মুখেই কোপিয়েছে। আমার মাথাতে দায়ের আঘাতের চিহ্ন এখনো আছে। বহু মানুষ এসে আমাদের আক্রমণ করেছে, ঘরে আগুন দিয়েছে, তাড়া করেছে। কিন্তু বহু অসমিয়া মানুষ আমাদের আশ্রয়ও দিয়েছেন। আমার স্ত্রী কালীদাসীকে বড়োরাই উদ্ধার করে পরে আমাকে সমঝে দেন। অন্যদিকে মিসিং জনগোষ্ঠীর একাংশ আমাদের গ্রামে আক্রমণ করেছিল, অন্য মিসিঙেরা আবার আশ্রয়ও দিয়েছিলেন, প্রাণও বাঁচিয়েছিলেন। সে যাই হোক, আমার স্ত্রীর মুখের সেই ক্ষতচিহ্ন আর পরমার কাটা হাত দেখলে আজও এলাকার মানুষের মনে পড়ে সেই ভয়াবহ দিনটির কথা। মৃত্যু না হওয়া অব্দি আমরা সেই আক্রমণের কথা ভুলতেই পারবো না। সেই আঘাত শুধু আমাদের দেহেই স্থায়ী হয় নি, মনেও স্থায়ী হয়ে রইল।...”
            চিমেন চাপরির আক্রমণের আগে অঘটন ঘটবে বলে খবরটা দিয়েছিলেন এক অসমিয়া মানুষই। অনেকে গৃহহারাদের আশ্রয়ও দিয়েছিলেন। চিমেন চাপরির খেরনি বস্তির একজন ভুক্তভোগী মহিলা হিমানী দাস। মহিলা সেই দিনটির কথা বললেন এইভাবে, “ আমাদের গ্রামের কাছেই এক অসমিয়া গ্রাম ছিল। গ্রামটির নাম ছিল বরুয়াপাম। সেদিন বরুয়াপামে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। একজন অসমিয়া মানুষ, তাঁর উপাধি বরদলৈ। বরদলৈ সেদিন খুব ভোরে আমাদের গ্রামে গিয়ে খবর দিয়েছিলেন যে আজ গণ্ডগোল একটা হবে। আমাদের সাবধানে থাকতে বলে গেলেন। সকাল নটা বাজতেই আক্রমণ নামলো। গ্রামের উত্তর দিক থেকে আগুন দিল। ঘরে আগুন দিল, বহু মানুষকে মারলো। আমাদের সম্পর্কিত  একজন ছিলেন হেমন্ত দাস, তাঁকে পরিচিত অসমিয়া লোকেই ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আগুন দিল। এভাবে আক্রমণ নামলে আমরা যখন রাস্তা দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে পালিয়ে আসছি তখন আবার কিছু মিসিং আর বডো পরিবারের লোকজন আমাদের আশ্রয় দিলেন। পরে আমরা দৌড়ে দৌড় এসে তেলেম রেল স্টেশনে উঠলাম। সেখানে রাত কাটালাম। কয়েক হাজার মানুষ ভিড়েছিল স্টেশনে। কিন্তু রাতে অরুণাচল থেকে কিছু আদি জনগোষ্ঠীর যুবক এসে আমাদের লোকজনের ভিড় থেকে জোর জুলুম করে বেশ কিছু মেয়েদের তোলে নিয়ে গেল।        সেই মেয়েরা আর ঘুরে এলো না। এর পরে আমরা শিলাপাথারে এসে আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিলাম। প্রায় এক মাস থাকলাম। তারপরে আমরা মাজরবাড়িতে ফিরে আসি। ...”
কথাগুলো বলে মহিলা কেঁদে ফেললেন। কিছু পরে বললেন, “ আমাদের বাঙালিদের কী দোষ ছিল?”
হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু চিমেন চাপরির ঘটনা স্পষ্ট করে একাংশ অসমিয়া বিদেশীর নামে বাঙালিদের হত্যা করতে, বাড়ি ঘর, জমি জমা দখল করতে গিয়েছিল। সেভাবে আরেক অংশ নির্যাতিত  আর্ত মানুষজনকে আশ্রয় দিয়ে মানবতা বোধের নিদর্শনও তোলে ধরেছিলেন। 



কোন মন্তব্য নেই: