“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৯ মে, ২০১৬

কাকচরিত্র


।। শিবানী দে।।
(C)Image:ছবি
প্রচণ্ড গরম পড়েছে । পাখিগুলো দুপুরের তাতে কার্নিশে বসে ঠোঁট হাঁ করে হাঁপায় । দেখে মনে হয় খুব তেষ্টা পেয়েছে । আগে তো অনেক জলা, পুকুর ছিল,গরমে তারা প্রাণভরে জল খেতে পেত, ঝুপঝাপ অল্পস্বল্প স্নান ও করত। গাছপালা ঝোপঝাড় ছিল, সেখানে বিশ্রাম করত, বাসা বাঁধত । এখন সে সুযোগ নেই---জনসাধারণএর স্বার্থে পুকুর ডোবা সব বুজিয়ে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট হচ্ছে। জনসাধারণের মধ্যে পশুপাখি আসে না । তাদের জনপ্রতিনিধি নেই ।
তা জনসাধারণএর মধ্যে আমিও পড়ি, পশুপাখিদের দলে তো ভিড়তে পারি না । শুধু পাখিদের (মানে, যারা আমাদের আশেপাশে থাকে, চড়ুই, কাক, শালিক, পায়রা ---- এইরকম মানুষ-ঘেঁষা পাখি; বাকি যারা আগে জলাজঙ্গলে থাকত তাদের দায় আমি নেব না ) মধ্যে যারা আমার কার্নিশে বসে, তাদের জন্য একমুঠো ভাত আর এককাপ জল জানালার ধারে হাত বাড়িয়ে রেখে দিই, তারা আসে, ভাত খুঁটে খুঁটে খায়, জল খায়, উড়ে যায় । কাপ খালি হলে  আবার ভরে  দিই । আমার ও মনে বেশ তৃপ্তি হয়, বেশ ভাল কাজ করছি, পরিবেশ রক্ষায় কাঠবেড়ালি-সম হলেও কাজ করছি । 
একদিন বিকেলে দেখলাম  জলের কাপটা নেই । একটা ডাঁটিভাঙ্গা কাপ, বেশ ভারি (ফ্রি পাওয়া কিনা), বেশ বড়, এটা কোথায় যেতে পারে ? কোনো হিংসুটে প্রতিবেশী কিংবা কাজের লোক ফেলে দেয় নি তো ? মনে নেই, অনেক আগেই এক লেখক বলে গিয়েছিলেন, ‘বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন । বঙ্গে কেবল প্রতিবেশীরাই দুরাত্মা ।’ ? কাপটাতে তার প্রয়োজন নেই, শুধু আমাকে পাখিদের জল খাওয়ানোর তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত করবার সুখে ? উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলাম, কাপটা নিচের তলার কার্নিশে । কিভাবে গেল ? কে ফেলল ? ভাগ্যিস কাপটা গড়িয়ে যায়নি, ভাঙ্গেওনি মনে হচ্ছে, হয়তো ভারি বলেই ।  লম্বা কাঠি দিয়ে ঠেলে নিচে ঘাসে ফেললাম, তুলে এনে আবার জল ভরে যথাস্থানে রাখলাম  
পরদিনও বিকেলে সেটা জায়গায়  নেই । উঁকি মেরে দেখলাম সেটা কার্নিশে পড়ে আছে, এবারে টুকরো টুকরো হয়ে । কি আর করা । তবে আমার ঘরে ভাঙ্গা কাপের অভাব নেই । দু তিনটে এখনো আছে, কিজানি কি কাজে লাগে বলে রেখে দিয়েছি, মধবিত্ত মানসিকতা বলে খোঁটা দেবেন না । সব বাঙ্গালি বাড়িতেই এরকম করে সেদিন ফেসবুকে টুথব্রাশের ব্যবহার নিয়ে পোস্ট দেখলাম, ভারতীয় বাড়িতে টুথব্রাশটা প্রথমে দাঁত মাজার কাজে, তারপর চুল রঙ করার কাজে, তারপর ছোটোখাটো ঝাড়নের কাজে, সবশেষে ব্রিস্‌ল্‌গুলো ক্ষয়ে গেলে পাজামার দড়ি ভরার কাজে ব্যবহৃত হয় ।
যাহোক, ভাঙ্গা টুকরোগুলো তো আর কাজে লাগবে না, এগুলো ফেভিকলের ও সাধ্যের অতীত হয়ে গেছে, আমি আরেকটা ডাঁটিভাঙ্গা কাপে পরদিন জল দিলাম । মাঝে মাঝে দেখি, কাপটা যথাস্থানে আছে । একদিন গেল । দ্বিতীয় দিন বিকেল বেলা দেখি, সেটা প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় কার্নিশের প্রান্তে । পড়বে পড়বে করছে ভেতরদিকে টেনে আনলাম । না, আর নয় । বিকেলেই যখন ঘটনাটা হচ্ছে, তখন বিকেলের দিকেই একটু নজর রাখতে হবে । পরদিন বিকেলের দিকে তক্কে তক্কে রইলাম, দেখি জল খেতে এসেছে একটা কাক । জল খেল, তারপর ঠোঁট দিয়ে ধাক্কা মেরে সেটাকে সরাল । তারপর কাপটার কিনারায় কামড়ে ধরে আরো একটু । সেটা যখন প্রায় কার্নিশের প্রান্তে নিয়ে যাবার উপক্রম, তখন আমি দেখা দিলাম । কিন্তু ততক্ষণে কাপ ফেলেই দিয়ে উড়ে পালাল ।
আমি তো আসামি খুঁজে পেলাম । কিন্তু ভাবলাম, কাকটার মনস্তত্ত্ব কি ? নিত্য নতুন পাত্র চাই ? সে কি বিলাসী ? না কি নিজের খাওয়া হয়ে গেলেই শেষ, পরের জন্য ভাববার দরকার নেই ? এখন তো অন্যের সুযোগ নষ্ট করি, পরে যা হবার হবে ? মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে দেখেছি, কোত্থেকে কিছু একটা খাবার, হয়তো সেটা একটা মাংসের হাড়, হয়তো এক টুকরো পাউরুটি, নিয়ে এসে কাকটা (সে অন্য কাক ও হতে পারে, কাকেদের চেহারার পার্থক্য আমি বুঝতে পারিনা ) সেটাকে কাপের মধ্যেই সাবধানে রাখে, জল খাওয়া হয়ে গেলে খাবারটা ঠোঁটে নিয়ে চলে যায় । মানে হল, নিজের জিনিষটা সুরক্ষিত রেখে উপরিটুকু নিয়ে নেওয়া ।
আগে আরেকদিন আরেকটা ঘটনা দেখেছিলাম এই কাকসংক্রান্তই । চৈত্রমাসের দিন, কাকেদের বাসা বানানোর সময় । যেখান থেকে পারে ওরা কুটোকাটা সংগ্রহ করে । আমার ঘরের জানালার কাছে ফুট-চারেক দূরত্বে দুটো খুঁটি, কোনো এক সময়কার বেড়ার অবশেষ । সেই খুঁটিদুটোতে দুটো কাক বসে আছে, নিচে একটা কুটো, মানে গাছের ডালের ছোট একটা টুকরো । দুটো কাকই কুটোটার দিকে তাকাচ্ছে । একজন যেই সেটা তুলতে যাবে,অন্যজন এসে সেটাতে ছোঁ মারল । প্রথমটা তার দখল ছাড়বে কেন ? সে কা কা করে কুটোটা ছেড়ে দ্বিতীয়টাকে মারতে গেল । দ্বিতীয় কাকটা সেটা ছেড়ে দিয়ে খুঁটির উপর বসল । প্রথমটাও কুটোটা ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় অন্য খুঁটির উপর বসল । খানিকক্ষণ পরে আবার দ্বিতীয়টা, অর্থাৎ প্রথমবারের জবরদখলকারী কুটোটা তুলতে ডাইভ মারল । কিন্তু প্রথম দাবিদারও নিজের অধিকার ছাড়বে কেন ? সে এবার ও কা কা করে তেড়ে গেল, প্রতিদ্বন্দ্বী কুটোটা ছেড়ে নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসল । সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কাকটাও নিজের খুঁটিতে এসে বসল । আরো দুবার একই নাটকের পুনরাবৃত্তির পর দুজন দুজনের দিকে পেছন ফিরে বসল, ভাবখানা এমন যেন কুটোটার উপর দুজনের মধ্যে কারো লোভ নেই । একটু পর  দ্বিতীয় কাকটা আরেকবার সেই একই চেষ্টা করল, প্রথমটার ও পেছনে নজর আছে, তাই আরো একবার বিফল । দুজনেই খানিক পর জায়গা ছেড়ে উড়ে গেল । আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম নাটকটা আরো গড়ায় কিনা দেখতে, কিন্তু ওরা আর এলো না । কুটোটা ওখানেই পড়ে রইল ।
তাহলে উপসংহার কি দাঁড়াল ? আমি যদি নেব না, তুমিও তা নিতে পারবে না । তোমাকে নিতে দেব না । বস্তুটা লোভনীয় হোক বা তুচ্ছ, আমার চান্স না থাকলে তোমাকেও চান্স নিতে দেওয়া যাবে না । 
চরিত্রগুলো চেনা চেনা লাগছে না ? মানুষের সঙ্গে বাস করতে করতে ওরা মানুষের চরিত্র শিখে ফেলল ? না আমরা ওদের কাছ থেকে শিখলাম ? আমার মনে হয় প্রথম আন্দাজটাই ঠিক । দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে আমরা অবশ্যই অনুকরণীয় ! 

কোন মন্তব্য নেই: