(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা
এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে
করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার একবিংশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
একুশ
সেই বন্ধুও বদলে যায় । পাকিস্তান হওয়ার পর ধীরে ধীরে পাল্টে যায় লুলা । হয়তো
দেশের জন্য ধর্মের জন্য কোনও কাজ পেয়ে যায় । লুলাও হয়তো ভাবে এক ধর্মরাজ্য গড়তে
হবে । সব বাধা দূর করতে হবে । দলে দলে যারা দেশ ছেড়ে যায় তারা তো যায় । যারা, মাটি আঁকড়ে থাকতে চায়, তাদের কথা ভাবে লুলা । ওদেরও তাড়াতে হবে । কিংবা
ধর্মান্তরিত করতে হবে । এই ভাবনায় লুলার মানবিক চরিত্রে কোনও তারতম্য হয় না । সে
বৈতলের বন্ধুই থাকে । শুধু রাতের জন্য ওৎ পেতে থাকে, পরিচয় পাল্টায় । গরিব যারা, যারা ভাবছে ওপারে গিয়ে কী হবে, কী কাজ কী খাওয়া নতুন দেশে, ওরাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে । বয়সের ধর্মের বিপরীতে যাওয়া হয় না
লুলার, রুল আমিন বেজ –এর । বৈতলের প্রতিবেশীরা অভিযোগ জানায় । বলে,
--- বৈতল, তুই কিন্তু দারাইশ সাপর লগে ঘর করবে !
--- কেনে, কিতা অইছে ।
--- কিতা অইছে জিগাছ নি, তোর হিগুয়ে, লুলায়, হে বুলে দিলবাহার বাঙাল কবি । তোর বন্ধু ।
--- কিতা অইছে কও, ইতা জানি ।
--- তুই জানছ না, হে যে হিন্দুর বৌ বেটি হক্কলর ইজ্জত লুটের ।
--- তুই দেখছ নি । লুলা বরমচারি মানুষ, ইতা মাতিও না ।
সংখ্যাগুরু অপরাধীর বিরুদ্ধে কেউ
প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে না । বৈতলও বিভ্রান্ত, ভাবে মিথ্যা । আবার ভাবে, হলেও হতে পারে, বয়সের দোষ, দুদিনেই কেটে যাবে । একদিন বলে,
--- তুই জিনচছ কম নায় । মাইনষে যেতা মাতের
একেবারে মিছা নায় ।
--- হাচা মিচা দিয়া তুইন কিতা করতে । তুইন তো বাগদাদর হারুণ রসিদ ! পাচ বেগমর হারেমওয়ালা বাদশা ! আমারে কেনে দিলে না একটা, অখন কেনে চউখ টাটার ।
বৈতল জানে সেও ধোয়া তুলসী পাতা নয় ।
গুরু সৃষ্টিধরের মেয়ের সঙ্গে শুকনো সম্পর্কের কথা সব জানে লুলা । তাই বৈতলের
দুর্বল জায়গায় আঘাত করে । বৈতল লুলার বদলে যাওয়া নিয়ে ভাবে না । হিন্দু – বিদ্বেষের কিছু কেন কোথাও খুঁজে পায় না ।
লুলা তো আর বাবুর বাড়ির ছেলে নয় যে নিয়মনীতি মেনে ভালবাসার বাড়ি খুঁজবে । আর পাটনি
মাইমলের মেলামেশারও এত বাধা নেই । লুলা হিন্দুকে শত্রু ভাবলে বৈতলকেও ছেড়ে যেত ।
তাই বন্ধুর প্রশ্নের সুত্রে লুলার অভিমানও আবার সক্রিয় হয় । বলে,
--- তুইও বদলি যাইরে বৈতল । তুই কিতা ভাগি যাওয়ার
কথা ভাবরে নি ।
--- ভাবিয়ার তো । তোর মতো বদমাইশর লগে কে থাকত ।
--- তুইন আমারে ছাড়িয়া ইন্ডিয়াত যাইছ না রেবা ।
বৈতলের রাগ জল হয় । বলে,
--- ধুর, ইন্ডিয়াত আমার কিগু আছে যে যাইতাম । বইয়াখাউরিত অউ মরতাম । তুই আমার মুখো আগুন
দিবে ।
--- আইচ্ছা । তুইও আমার কয়বরো মাটি দিছ একদলা ।
--- দিমু । কিন্তু তুই আর ইতা করিছ না । তুই তো
ইলাখান আছলে না । ই কি লাখান পাকিস্তান অইলে রে ।
--- হুন । কয়েদে আজমে কইছইন...
--- ছাড় তোর কয়েদে আজম । আমরার মাঝে কয়েদে আজম কে
রে ।
গান্ধীর নামের আগে অসম্মানের ‘ইগু’ আর মহম্মদ আলি জিন্নাকে সসম্মানে
কয়েদে আজম বলার শুরু গণভোটের সময় থেকে । যে কোন অন্যায় চলে কয়েদে আজমের নামে । যেন, ‘কয়েদে আজমে কইছইন’ বললেই বেছে বেছে হিন্দু রমণীর সর্বনাশ করা যায় । হিন্দুর
ভিটে দখল করা যায় । কয়েদে আজম তো বলেছেন ‘পাকিস্তান
কোনও ধর্মের দেশ হবে না । পাকিস্তানে মুসলমান হিন্দু শিখ পার্শি খৃষ্টান সব ভাই
ভাই হয়ে থাকবে ।’ এই কি নমুনা ।
দেশভাগ মানুষের কোনও ক্ষতি করেনি । সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের
তার ইচ্ছেমতো বেঁচে থাকার অধিকার আছে । সংখ্যালঘুও যেন মাৎস্যন্যায়ের শিকার না হয়
সে – অধিকার নিশ্চিত করতে হয়
গুরুজনদের । এর অসাম্য হলেই হয় রায়ট । রায়ট মানুষের ক্ষতি করে । রায়ট হলেই মানুষ
পাল্টে যায় । রায়ট হলে বৈতল পাল্টে যায়, রামদা তুলে নেয় হাতে । হাঁক দেয় বোম বোম বম্বালে ।
রায়ট যেন এক দেশ । আলাদা আলাদা জাতি । কেউ কারো ভাষা বোঝে না । রায়ট লুলাকেও
বদলে দিয়েছে । লুলা মায়ের উপর অভিমানে বদলে যায় । জন্মের পরই কেন মরে যায় লুলার মা
। তাই তো মায়ের আদরে জড়িয়ে গেল বৈতলের সঙ্গে । আর তার বাপ তাকে নানার কাছে ছেড়ে
দিয়ে চলে যায় অন্য রমণীর সঙ্গে । লুলার নতুন মা হিন্দু রমণী । তাই হয়তো রাগ জমে
ছিল মনের ভিতর । রায়টের সময় মনের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেরোয় । রায়ট মানুষকে খণ্ড
খণ্ড করে দেয়। বন্যা হলে এক করে ।
জলস্রোতের ধর্মে যেমন মালীর ভিটায় জড়ো হয় হিন্দু মুসলমান । একসঙ্গে, এক পাতে একই হাঁড়ির রান্না খায় সকলে মিলে ।
বৈতলের লুঠ করা চাল ডাল সবজি দিয়ে রান্না করে এক চণ্ডালিনী যুবতী, নাম দুর্গাবতী । পাকিস্তান হওয়ার বছর খানেক
আগে রাজরোগে মরে যায় ভুরুৎ আচার্য । অগ্রদানী ব্রাহ্মণ । গ্রামের মানুষ বলে কটার
বাবন, অগ্রদানী না হলে স্বর্গের দ্বার
খোলে না, তবু এ ব্রাহ্মণের সম্মান নেই
সমাজে । বলে, মড়িপুড়ি ব্রাহ্মণ । এই
ব্রাহ্মণের সংখ্যাও খুব কম । পিয়াইন পারের শ্মশানে কোনও দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ পাওয়া
যায় নি । ভুরুৎ আচার্য মরার পর তার যুবতি কন্যা দুর্গাবতী বলে সে তিলকাঞ্চন করবে । সমাজ মানেনি । নদীর পারের ঘরে
একা যুবতিকেও কেউ উঠে যেতে বলেনি । দুর্গাবতী নদীর পারে থাকলেও মালির ভিটা
কালীবাড়িতেই সময় কাটে গিরিবাবার কন্যা- স্নেহে । সেই দুর্গাবতী নিয়েই বন্যার জলে ভাসে বৈতল । সুরমার উজান বেয়ে ছোটে
কলাগাছের ভোরায় । গিরিবাবার অনুনয় যে ঠেলতে পারে নি বৈতল । বাবাজি বৈতলের দুহাত
ধরে বলেছেন,
--- বাবা, ই পুড়ি ইগুরে বাচাও । তোমার বন্ধু ইগুয়ে খুব জ্বালার ।
পিয়াইন আর সুরমার জলে তখন উথালি পাথালি ।
বছরকার বন্যার প্রলয়ঙ্করী রুপ । প্রবল স্রোত আর কুড়ুলা । জোড়া নদী মিলনের আক্রোশে
ফুঁসছে । এনায়েতপুর শ্মশানের অগ্রদানী ঘরের দরজা ভাঙে বৈতল । জলের তাণ্ডবকে ভয় পায়
না বৈতল । তাও লুলাকে বারণ করে বৈতল । রিপুতাড়িত লুলা নিভিয়ে দেয় কুপি লন্ঠন, বৈতলের হাতে এক তরফা মার খেতে অভ্যস্ত লুলা
অন্ধকারে বৈতলকে আক্রমণ করে । জলের পোকা বৈতলকে আক্রমণ করলে কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, লুলাকে বুঝিয়ে দেয় । রাতের অন্ধকারে বন্ধু
লুলার লাশ পিয়াইনের স্রোতে ভাসিয়ে দেয় বৈতল । বলে,
--- যা দোস্ত ! মাটি দিতাম পারলাম না, পানি দিলাম এক আইজলা । লুলার শেখানো মন্ত্র উচ্চারণ করে ‘ বিসমিল্লার রাহমানির রহিম’ । দুর্গা বতীর বাপ ভুরুৎ ঠাকুরকে দেখেছে উপর জল
ছিটিয়ে বলতে ‘ পবিত্রোপবিত্রবা’ । বৈতলও বলে,
--- পবিত্রপবিত্রবা ।
আরবি কথা কিংবা সংস্কৃত কথার অর্থ জানে না
বৈতল । বৈতল জানে শুধু সদ্গতি । বন্ধু যেখানেই থাকুক শান্তিতে থাকুক ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন