“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

কথায় কথায়...

                                                                                                    ।।মিফতাহ উদ-দ্বীন।।
(c)Picture:ছবি


             ছোটো খালার বিয়েতেই ঠিক হয় যে আমি সরকারি স্কুলে পড়বো। জলিল স্যার ই আব্বাকে পরামর্শটা দিলেন, আর আমি ভর্তি হয়ে গেলাম “গম্মেন্ট স্কুলে” ভালো নাম “করিমগঞ্জ সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়”, ডাক নাম “গম্মেন্ট স্কুল” অবশ্য পরামর্শ দেয়ার সময় তিনি আমার “জলিল স্যার” ছিলেন না, আমার খালু ছিলেন। সে যাই হোক, যে জন্য এই লেখাটা তার বিষয় বস্তু কিন্তু বেশ পুরনো। আর ব্যাপারটা একটা ধুঁয়ার গুলার মত ঘুরপাক খাচ্ছে মগজে আজ কয়দিন। কাল এক মহাপুরুষের থেকে শুনেছিলাম লেখা নাকি এক বিরাট ডিসচার্জ। মগজ হালকা হয়, মন প্রসন্ন হয়,আর তাই লিখতে বসা। মগজ, মনের এই অবস্থান সুচক ধারনা আবশ্য আমার একান্ত নিজের। 

           এবার আসল কথায় আসি। ঘটনার শুরু সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই। সবে মায়ের স্কুল পাশ করেছি এখন স্কুলে যাওয়ার নতুন সঙ্গী আব্বা। তিরিশ পয়তিরিশ মিনিটের রিক্সা যাত্রার ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ক্লাসে ঢুকার অনুমতি নিতাম, ফার্স্ট পিরিয়ডের বয়স তখন দশ মিনিট। এমন ও হতো যে ফার্স্ট পিরিওড তাঁর প্রৌড়ের শেষ প্রান্তে, শেষ বেঞ্চের বাসিন্দাদের তোড়জোড় লেগে গেছে রাম নাম সত্য করতে আর আমি হাফাতে হাফাতে বইএ ভরা ট্রাঙ্ক নিয়ে ইংরাজিতে স্যারের অনুমতি প্রার্থনা করছি। এমন খুব কমই ঘটেছে যে ছ’শ ছাত্রের সাথে আমি ও বারান্দায় দাড়িয়ে ঠিক দশটা তিরিশে জনগন মন অধিনায়কের আগমনী গান দিয়ে একটা নতুন ক্লাসের জন্ম দিয়েছি আর হর্ষ উল্লাসে নিয়ে গেছি নিজের ক্লাসে। সব দোষ ছিল আমার আব্বার, তিনি সাইকেল কিনে দিতে ভয় পেতেন আর তাই আমাকে আসতে হতো রিক্সা করে উনার সাথেই। তো আমি বেচারা মফঃস্বলের ছেলে আর বাকিরা সবাই শহরের তাই কথা বলতে একটু অসুবিধা হতো। কথা বলতে বলতে হঠাৎ মুখ ফসকে যেই কোন সিলেটি শব্দ বেরুলো সঙ্গে সঙ্গেই মুখে কুলুপ এঁটে বসা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকতো না। বাক্যটা সম্পূর্ণ করার মানসিকতাটা ও চলে যেত। আমার অসুবিধেটা সিলেটি বা ছাপার ভাষায় ছিল না, ছিল ওদের কথ্য ভাষার প্রতি। আমি সেটা বুঝতাম না। সেটা না ছিল খাঁটি সিলেটি না ছিল শুদ্ধ বাংলা। বাংলা আর সিলেটির মিশ্রণে তৈরি সে এমন এক ভাষা যা আমার বলতে একদম ইচ্ছে হতো না। তাই কথা বলতে বলতে থেমে যেতাম। পরে অবশ্য অভ্যাস হয়ে গিয়ে ছিল। কিন্তু কোনদিনই আনন্দ পাইনি ওইগুলো বলতে। আমি কিছু নমুনা দিচ্ছি, যেমন ধরুন কেউ এসে বললো, “তোরার মতন আইজ আমরার ও উপবাস” বাক্যটা কতটা শুদ্ধ বাংলায় হয়েছে তা জানিনা তবে একটুকুও সিলেটি হয় নি। সিলেটি হলে এমন হতো, “তুমরার লাখান আইজ আমরার ও উপবাস”, “রোজা” হতে পারতো “উপবাসের” জায়গায়, কিন্তু সে না হয় বাদ দিলাম, যেহেতু শব্দটা আরবিক। “চল একটু জল (‘জ’ কে একটু হালকা ভাবে উচ্চারণ করুন) খাইয়া আই” কে তো এভাবে বলা যায় “চল থুড়া পানি (‘প’ কে একটু ‘ফ’ এর মত উচ্চারণ করুন) খাইয়া আই”, “সাইকেলর চাকা ইগু গর্তত ঢুকি গেসিল” না বলে “সাইকেলর সাক্কা ইগু গাতো হামাই গেসিল” বলা যেত অনায়াসেই। এরকম আরও হাজারটা উদাহরণ আছে যা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু শুধু ওই সিলেটি কে সিলেটির মত বলায় অনেক সময় তথাকথিত “বাংলেটি”রা (বাংলা এবং সিলেটির মিশ্রণ) খাঁটি সিলেটীদের “বাঙ্গাল” তকমা এঁটে দিত। যদিও আমাকে কেউ কোনদিন বলেনি, তবে ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা শুনে একটা গালির মত মনে হতো। সবচেয়ে প্রধান ফারাক টা ছিল ‘জল’ আর ‘পানি’ তে, জল বলে অমুসলিম সিলেটিরা আর পানি বলে ‘বাঙ্গাল’রা। তো এরকম শব্দ আর কথার অন্তর্ঘাত নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। কলেজে ওঠার পর জানতে পারলাম যারা নাকি “উঠরা” তাঁদের ভাষা হচ্ছে এই “বাংলেটি”। ‘উঠরা’ শব্দ টা আমার কাছে নতুন ঠেকল, জিজ্ঞেস করলাম এটা আবার কি? শুনলাম যারা নাকি বাংলাদেশ থেকে উঠে এসেছে তাঁদের ভাষা হচ্ছে এটা। আর যারা এখানের ই ছিল তারা বলে খাঁটি সিলেটি। বাংলা নাটক সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম, শুনতাম। অনেক রকম বাংলা শুনেছি, কলকাতার বাংলা, ঢাকাইয়া বাংলা, চাঁটগাইয়া বাংলা, ময়মনসিংহের বাংলা, বরিশালের বাংলা, সিলেটের বাংলা। সবটাতেই একটা রস ছিল। কিন্তু সেই রস টা ভারতীয় সিলেটিদের কাছ থেকে পাইনি কখনও। জানিনা এই তফাতটার কারণ কী? কেন একই সিলেটি হয়ে মুসলিমরা পানি বলে আর অমুসলিমরা জল। 

এখন মনে পড়ে সেসব দিনগুলি। কোথায় জল আর কোথায় পানি? একাধারে ইংরাজি, হিন্দি সব ঝেড়ে যাই একটু তাজা সব্জি কেনার জন্য আর ওপাশ থেকে অনর্গল তামিল ছুটে আসে তীক্ষ্ণ বাণের মত। আমার সব্জি কে ফালা ফালা করে কেটে ওখানেই “লাবড়া” বানিয়ে দেয়। 

২৫ মার্চ, ২০১৩
মাদ্রাজ

কোন মন্তব্য নেই: