।। শিবানী দে ।।
(C)Image:ছবি |
নতুন বছর এলো বলে
। লোকে প্রার্থনা করে, যেমন প্রতি নববর্ষে করে, এবার আগের বছরের
চাইতে থেকে ভাল হোক, শুভ হোক । সে এবং তার পরিবারটি ভালো থাকুক, তার ছেলেমেয়ে ভাল
করে পড়াশুনো করুক/চাকরি করুক, নিরাপদে থাকুক ।
কিন্তু নতুন কিছু হোক ভাবে কি ? নতুন কিছু বলতে
একখানা নতুন কেজো যন্ত্র ঘরে আনা, নতুন খাবার খাওয়া, নতুন পোশাক পরা, নতুন জায়গায়
ঘোরা---এই নতুন নয়, কোনো চিন্তা ভাবনা আইডিয়ার কথা ? অনেকেই বলে, নতুন কিছু হলে
ভাল হত, কিন্তু আসল জীবনে নতুনত্বের সামনা করতে
হলেই আঁতকে ওঠে ।
তার যা প্রার্থনা তা তো
নতুন নয় । এই প্রার্থনা সফল হলেও নতুন কিছু হবে না । এই প্রার্থনা সে কেন, তার মা বাবা
ঠাকুরদা ঠাকুরমা এবং তাদের ঊর্ধ্বে আরো অনেক প্রজন্ম করে আসছে । একই কামনা যুগযুগ
ধরে চলে আসছে । নতুন কিছু হয় নি । জন্ম হয়েছে অভ্যাসবশত: । তারপর মা-বাবা তাকে
প্রোগ্রামিং করেছে নিজেদের আইডিয়া ধ্যান-ধারণা অনুসারে । মা-বাবার পর আত্মীয়স্বজন, সমাজ, বিদ্যালয়, রাষ্ট্র--- সকলেই
কিছুকিছু নিজস্ব আইডিয়া গিলিয়েছে, যার মূল কথা হল, যা চিরাচরিত, তার বিরুদ্ধাচরণ
করো না । গণ্ডীর বাইরে গেলে বিপদ আছে ।
মা-বাবা চায়
সন্তানটি তার মতই হোক। মা-বাবা যদি জীবনে তেমন সফল না হয়, তবে তারা যা হতে
চেয়েছিল, তার একটা কাল্পনিক সফল মূর্তি সামনে রেখে সন্তানকে তা-ই
হওয়াতে চায় । সেই লক্ষ্যে বাচ্চাটাকে সবরকমের ট্রেনিং দেওয়ানো হয়, তার ভাল লাগুক বা
না-ই লাগুক । বাচ্চাটার নিজস্ব বুদ্ধিতে কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তা বুঝবার তাকে
অবকাশ দেওয়াই হয় না । মা-বাবার শেখানো লাইন থেকেই চলে গন্ডীবদ্ধ ভাবনার বিকাশ, বিচ্যুত হলেই
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে । আহা, ও পথে যেও না, ওরকম ওটা আমাদের
বংশে কেউ করেনি, পাড়া-প্রতিবেশীতে কেউ করে নি । তোমাকে
এত কষ্ট করে পড়াচ্ছি, এত খরচা করছি, আমার কথা শোনা
তোমার কর্তব্য । না মানলে শিশুটির পিঠে চড়চাপাটির অভাব ও হয়না । বাঙালি মধ্যবিত্ত
বাড়ির ছেলেমেয়ে যদি খেলাধুলো, নাচগান, আঁকা, অভিনয়, এমনকি ব্যবসায়ের
ক্যারিয়ার গড়তে চায়, বাবা-মায়ের থেকে প্রথমেই বাধা আসে। আগে
পড়াশুনো, তারপর বাকি সব । যদি নিতান্তই ইচ্ছে করে
তাহলে পড়াশুনো চালিয়ে যদি পারা যায়, বাকি কিছু করতে
হবে । পড়াশুনোর সময়ে সে কলা না বিজ্ঞান না বাণিজ্যবিভাগে যাবে, জেনারেল কলেজে
যাবে না কারিগরি বিভাগে পড়বে, সেটাও সন্তানের
ইচ্ছা অনুযায়ী নিরূপিত হয় না । ক্যারিয়ার বেছে অভিভাবকরা সেদিকে ঠেলতে থাকে, পছন্দ না হলেও
তাকে সেই পথে যেতে হয় । তারপর যখন সন্তানটি থিতু হয়, তখন তার জীবনসঙ্গী
বাছার কাজও অভিভাবকরা করে দেয় । আজকাল কিছু কিছু ছেলেমেয়ে নিজেই জীবনসঙ্গী বাছছে
ঠিকই, তবে বেশিরভাগই সামাজিক কোড মেনে, জাতি বর্ণ ধর্ম
বেছে, যেরকম হলে পরিবার সমাজ সবাই তুষ্ট ।
দুচার জন যারা এর বাইরে যাচ্ছে, তাদের পারিবারিক
সামাজিক বিরূপতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । কোনো দিক থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক বিকাশের
অবকাশ রাখা হচ্ছে না ।
সমাজ বলবে
গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকতে, ব্যক্তিগতভাবে, আলাদাভাবে নয় ।
আলাদা হলে কেউ সহযোগিতা করবে না । সঙ্গে যদি না-ও আস, বিরুদ্ধাচরণ
কদাপি নয় । সমাজের কথা, কাজ যদি তোমার পছন্দ না হয়, চুপ করে থাক ।
উলটো কথা বলবে না । সাধারণত ধর্মই সমাজের
সবচেয়ে ক্রিয়াশীল শক্তি, পরিচালিকা শক্তি । যে সারা বছর পাড়াপড়শির সঙ্গে দেখা করতে পায় না, সে ও অষ্টমীতে
অঞ্জলি দিতে নামে, ঈদের নামাজে জোটে । তার জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ধর্মের
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত--- তার জাতকর্ম, বিয়ে, পারলৌকিক কর্ম
এবং তার মাঝখানে মাঝখানে আর আর কিছু থাকলে সেগুলো সবই হয় ধর্মের নিয়মানুসারে ।
নগণ্য ব্যতিক্রম যারা থাকে, তাদেরকে আড়চোখে দেখা হয়, বেশি কট্টর সমাজ
হলে বহিষ্কার, এমন কি হত্যাও করা হয় । এতো গেল লৌকিক
ভয়-দেখানো । তার পর আছে আধিভৌতিক ও পারলৌকিক ভয় ---- ধর্মের নিয়ম না মানলে ইহজন্মে
আধিব্যাধি, অর্থক্ষতি, প্রিয়জনের কষ্ট
ইত্যাদি নানারকম ক্ষতি,পরলোকে নরকের শাস্তি । আছে লোভ দেখানো----ধর্মের নিয়ম মানলে
ইহলোকে যদি নাও হয়, পরলোকে অবশ্যই সব অভীষ্ট সুখ পাওয়া যাবে
। তাই যে ধর্মের সমাজ, তার রীতিনীতি পছন্দ না হলেও মানতে হবে, না হলে শাস্তি হবে, সেই ভয়
মানবশিশুটির মনে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় । তাই সে আর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পায়
না, সবাই যা আওড়ায়, যা করে, সেও তা-ই আওড়ায়, তা-ই করে । তার ইচ্ছের ডানাকে মেলতে দেওয়াই হয় না ।
তার চিন্তাশক্তিকে গণ্ডীর বাইরে বেরোতে দেওয়াই হয় না । সে ভাবতেই পারে না
ধর্মগ্রন্থে ভুল থাকতে পারে, বিশেষ গোষ্ঠী
নায়ক, বা ধর্মপ্রবর্তকের জীবন ও বাণী
সমালোচনার যোগ্য হতে পারে । যদি কখনো তেমন ভাবনা আসেও, সে ভাবে সে ভুল করছে, অনুচিত ভাবনা
ভাবছে, পাপ করছে ।
বাচ্চাকে তার
ধর্মে ধরে রাখতে শৈশব থেকে কত আয়োজন । অনর্থক অহেতুক সংস্কার দিয়ে মার্কা মেরে
দেওয়া । টিভিতে অসংখ্য ধর্মীয় প্রোগ্রাম । রাস্তায় ঘাটে
মন্দির মাজার মসজিদের ছড়াছড়ি, এমন কি
শিক্ষায়তনে, হাসপাতালে, রেলওয়ে
প্ল্যাটফর্ম, এয়ারপোর্টে ও ধর্মীয় স্থানের অভাব নেই । টিভি নাহয় সুইচ অফ
করে দেওয়া যায় । কারো যদি মনে হয় ঢাক ঢোল কীর্তন আজান মেহফিলের শব্দে শব্দদূষণ
ঘটাচ্ছে, উৎসবের আড়ম্বর রুচিবিরুদ্ধ লাগছে, সে কথা তার বলবার
উপায় নেই, বললে ধোলাই দিয়ে তাকে সমাজের উপযুক্ত
করে তোলা হবে ।
শিশুর কাছে
রাষ্ট্র আসে পরোক্ষে । একটু বড় হলে স্কুলে গেলে সে রাষ্ট্রের প্রভাবের সংস্পর্শে
আসে । রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থায় তাকে নানা কায়দায় শেখানো হয় কোন বিশেষ দেশকে, গোষ্ঠীকে, ব্যক্তিকে
ভালবাসতে, শ্রদ্ধা বা ঘৃণা করতে হবে, সেই ধরণের
বাছবিচার । বিশেষ করে ভাষা, সাহিত্য ও
ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে সরকার ছড়ি ঘোরাতে থাকে । ফলে দেখা যায় সরকার পালটালেই ইতিহাস
বদল । এই সরকারের আমলে যে ঐতিহাসিক ঘটনা গৌরবযুক্ত, পরের সরকারের
আমলের পাঠ্যক্রমে তা হয়তো নগণ্যভাবে উল্লিখিত । এই আগের সরকারের ক্যারিকুলামে যে
নেতাকে নামকাওয়াস্তে উল্লেখ করা হয়েছে, পরের আমলে সেই
নেতাকেই মহাপুরুষ হিসেবে দেখিয়েছে । সাহিত্যের পাঠক্রমেও সরকার সেই পাঠ বাছাই করা
হয় যা সরকারের মতাদর্শের সঙ্গে মেলে । সিভিক্স-এর বইয়ে মানবাধিকারের চ্যাপ্টারে
বলা আছে, সব মানুষের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার
অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে
অধিকার ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু কার্যত দেখা যায় সবই নিয়ন্ত্রিত, নিয়ম মেনে, মেপে জোকে । সেই
মাপজোক রাষ্ট্রের । সেই চশমা রাষ্ট্রের । তা দিয়ে না দেখলে, নিজস্ব দৃষ্টিকোণ
তৈরি করলেই মহা বিপদ, যে দেখতে যায়, সে দেশদ্রোহী
বলে পরিগণিত হতে পারে । রাষ্ট্র যা করছে সবই ভাল, রাষ্ট্র
কল্যাণকামী অভিভাবক----এরকম বিশ্বাস রাখতেই হবে ।
খোলা চোখে যদিও অন্য রকম লাগে, তা নিয়ে প্রশ্ন
করা, সমালোচনা চলবে না । কোন কোন রাষ্ট্রে যেমন বিবর্তনবাদ
ক্যারিকুলাম থেকে বাদ, কোথাও কোথাও ইতিহাস শুরু হয়
ধর্মপ্রবর্তকের জন্ম থেকে, কোথাও আবার তথ্য ছাড়াই নিজেদের সভ্যতার সুপ্রাচীনত্ব দাবি
করা হয় । প্রশ্ন যেন এইসব বিশ্বাসের গণ্ডি না
ছাড়ায়, এরকমই অলিখিত নির্দেশ থাকে । এর বাইরে গেলেই মুণ্ড খসে
পড়ার সম্ভাবনা ।
এভাবে প্রথম
থেকেই বাচ্চাটি দ্বিচারিতার মুখোমুখি হয় । বাড়িতে সে দেখছে
শুনছে জাতপাত মানতে । পইতে, রত্নের আংটি তাবিজ কবচ পরতে, ওদিকে বইতে আছে
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মহামানবদের লড়াই । সে মা-বাপকে এ বিষয়ে জিগ্যেস করল; মা-বাপ বলল, বইয়ে যা আছে সবই
মানতে হয় না । এমন কি সে দেখল তার মাস্টারমশাইও পইতে কিংবা তাগাতাবিজ পরে আছে, পিকনিকে সকলের
সঙ্গে বসে খাচ্ছে না । সে বুঝে নিল যে বইতে যে সে পড়েছে সব মানুষ সমান, তা ঠিক নয় ।
বাড়িতেই ছেলেটি বাবামায়ের মুখে স্কুলের বা শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন সব কথা শুনতে
থাকল যে তার স্কুল বা শিক্ষক সম্পর্কে কোনো শ্রদ্ধা গড়েই উঠল না । অথচ বইয়ে তাকে
শেখানো হচ্ছে শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে । সে দেখে তার বাবা
সাধারণ মধ্যবিত্ত, কিন্তু তার বন্ধুর বাবা ধনী । কেন
জিগ্যেস করতে সে জানল যে বন্ধুর বাবার উপরি আছে । বুঝতে পারল যে
মাইনে থেকেও উপরি থাকলে সচ্ছলতা বেশি আসে । সে বড় হলে উপরি পাবার চাকরিই করবে, ভেবে নিল । সে
দেখল তার ও তার বোনের সমান অধিকার নয় । সে যা যা স্বাধীনতা পায়, বোন তা তা পায় না
। সে বুঝে গেল মেয়েরা ছেলেদের সমান নয় । সে দেখল সে দুষ্টুমি করলে তার মা বলে, বাবা এলে বলে
দেবে । সে বুঝল মার তাকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, বাবা মায়েরও উপরে
। সে বুঝল মা বোন এরা মেয়েমানুষ, ক্ষমতা কম, এদের না মানলেও
চলে । অসম্মান করা অভ্যাস হয়ে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপে বল প্রয়োগের
ভাবনা আসে । পরিবারের বাইরের মেয়েকে রাস্তায়ঘাটে অসম্মান করার ব্যাপারটার বীজ
এভাবেই উপ্ত হয় । এইভাবে সমাজই সমাজবিরোধী হবার পাঠ দেয় ।
আসলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সবই একধরণের
বাহুবলীদের । বাহুবলীরা যুক্তির কথা বোঝে না । মানুষকে ভয় দেখিয়ে
সিধে করে রাখে । তখন মানুষের বিচারবোধ হারিয়ে যায়, সে-ও এই সমস্ত
প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে ওঠে, চর্বিতচর্বণ করে, তার দ্বারা নতুন
আর কি হবে ?
তবুও আমাদের
ইচ্ছে করে নতুন কিছু হোক । আমাদের মনের গণ্ডি খুলুক, কোনো বিশেষ মতের
চশমা না পরে জগৎটাকে দেখি, নিজের বিচারবুদ্ধি দ্বারা কার্যকারণ
খুঁজি । যদি নিজে উত্তর না পাই, অন্যদের প্রশ্ন
করি, অনেক উত্তর থেকে যেটা আমার মতে
যুক্তিযুক্ত মনে হয় সেটাকে গ্রহণ এবং প্রকাশ করি । বলবানের বল যেন আমার সেই গৃহীত
মতকে ত্যাগ করার জন্য প্রভাবিত না করে । এই চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের
স্বাধীনতাই খোলা হাওয়া আনতে পারে, নতুন কিছু গড়তে
পারে, নতুন আনতেও পারে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন