।।
শিবানী
দে।।
সপ্তাহ ধরে
একটানা বৃষ্টি হচ্ছে । প্রথমে নিচু হাওর, তারপর শালি ধানের
জমি, তারপর আউশ ধানের খেত সব একে একে ডুবে
গেল । রাঙ্গিছড়া ডবল প্রমোশন পেয়ে নদী হয়ে গেছে । শীতকালে গরীব
দিনমজুরের একবেলা খেতে পাওয়া মেয়ের মত শীর্ণ, তিরতির করে বয়ে
চলে, চৈত্রমাসে অনেক জায়গাতেই শুকিয়ে যায় ।
বৈশাখ মাস পড়তেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় এই করিমগঞ্জ অঞ্চলে । বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়
যেন বালতি বালতি জল । দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দেশে ঢুকবার অনেক আগে থেকেই তার
দূত উপদূত পাঠিয়ে দেয়, তারা মেঘালয়ের পাহাড়ের গায়ে মেঘকে
ধাক্কা মেরে ভেঙ্গে ফেলে সব জল পাহাড়ের ঠিক নিচে করিমগঞ্জেই ফেলে দেয় । পাকুছড়া, কালাছড়া, লাঠিছড়া, রাঙ্গিছড়া তখন
তাদে আট দশ ফুট তফাতের দুই পাড় উপচে প্রথমে হাওর, তারপর শালি ধানের
জমি, তারপর আউশ ধানের খেত ভাসায় । আরো বৃষ্টি
হলে আলপথ ডুবে যায়, কোনো কোনো জায়গায় বড় সড়কের উপরও জল উঠে
যায় । টিলাগুলো ঘোলা জলের সমুদ্দুরে দ্বীপের মত জেগে থাকে ।
নিচু জমিতে
ছনবাঁশের বাড়িগুলোতে তখন জল ঢুকে যায়, কোনো কোনো বাড়ির
মাথাটুকু জেগে থেকে নিজেদের অবস্থিতিটুকু জানায় । বাড়ির আশেপাশে লাগানো বড়বড়
গাছগুলোকে দেখে মনে হয় হাঁটু অবধি জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । সবজিখেত জলের তলায় ।
মানুষ যতদিন পারে বাড়িতেই মাচান বেঁধে থাকে, তারপর মাচানও
ডুবে যাবার মত হলে সড়কে স্কুলে হাটের চালায় উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয় ।
গরুছাগল হাঁসমুরগি কতক জলের তোড়ে ভেসে যায়, কতক মানুষের সঙ্গে ডাঙ্গায় আশ্রয়
পায় ।
এরকম যে নতুন
কিছু হচ্ছে, তা নয় । বছর বছর এরকম বন্যা হয়, এদিকের লোকের গা
সওয়া । লঙ্গাই সিংলা কুশিয়ারা বরাক বাঁধ ভাঙ্গে, কালাছড়া পাকুছড়া
রাঙ্গিছড়া গান্ধাইছড়া ডাবল ট্রিপল প্রমোশন পেয়ে প্রায় নদী হয়ে জোর বাড়িয়ে পুল
ভাঙ্গে, রাস্তা ভাঙ্গে, মানুষের ঘর
ভাঙ্গে । লোকে যা পারে তা-ই বাঁচিয়ে ত্রাণশিবিরে যায়, অবশ্য তাদের ঘরে
থাকেই বা কি ! নিচু জমিতে ঘর বাঁধে যারা, তাদের বেশির ভাগই
হয় এক আধ বিঘে জমির মালিক অতি ক্ষুদ্র
চাষী কিংবা ক্ষেতমজুর । তাদের ঘরে সোনা দানা নেই, দুচারটে হাঁস
মুরগি ছাগল থাকলেও থাকতে পারে । লাঙ্গল বলদ সবই
বড় চাষীর, তাদের জমিতেই এরা কাজ করে । বর্ষার জন্য
কিছু ধান হয়তো মজুত করেছিল, সেটাও বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিংবা জলে ভিজে পচে
যায় । ত্রাণশিবিরে দুচার দিন খাবার দেয়, তবে সেটা ট্যাল্টেলে
খিচুড়ির বেশি কিছু নয় । তবে মধ্যে মধ্যে কোনো কোনো ক্লাব ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে
সস্তার হলুদ দেওয়া মশলাদার খিচুড়ির সঙ্গে দু-এক পদ তরকারি ও দিয়ে দেয় । মাঝেমাঝে
নৌকো করে পিকনিকের মেজাজে নেতা মন্ত্রী অফিসার দুচারজন চ্যালা চামুন্ডা সঙ্গে নিয়ে
আসেন, আহাউহু করেন । ক্যামেরার ফ্ল্যাশে
তাঁদের মাসাজ ফেসিয়াল করা চকচকে পরিপুষ্ট চেহারা ধরা পড়ে, টিভিতে খবরের
কাগজে বেরোয় । নেতাদের অন্তত হাড়হাভাতে চেহারা নয়, জনগণ পরিচয় দিতে
লজ্জা পায় না ।
নিচু জমিতে তৈরি
বাড়ির সামনের ডোবাটার পাড় ছাপিয়ে জল উঠোনে ঢুকলে লতুমিয়া ঘরের মধ্যে উঁচু করে
মাচান বাঁধতে শুরু করে । দু বস্তা ধান, যা বর্ষার জন্য
জমিয়ে রেখেছিল, তা যথাসম্ভব পলিথিনে মুড়ে রাখে । যাহোক
কাঁথাকানি হাঁড়িকুড়ি সব মাচা্নের উপর তুলে রাখে । বাড়ি বাঁধার সময় ডোবা কেটে তার
মাটি দিয়ে বাড়ি যথাসম্ভব উঁচু করা হয়েছিল । নতুন ভরানো মাটি যাতে বৃষ্টির জলে ধুয়ে
না যায়, তার জন্য বাঁশের গড় বেঁধে সীমানার উপর
কলা, কাঁঠাল, সুপুরি ইত্যাদি
কিছু প্রয়োজনীয় গাছের চারা লাগানো হয়েছিল । গত দুতিন বছর এ
অঞ্চলে অতিবৃষ্টি না হবার কারণে গাছগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সুন্দর বেড়েছে ।
দুটো কাঁঠালগাছে এবারই প্রথম কয়েকটা কাঁঠাল ধরেছে । কাঁঠাল শুধুমাত্র একটা ফলই নয়, গরিবের গরমকালের
প্রধান পার্শ্ব খাবার । খিদে পেলেই কাঁঠাল ভেঙ্গে দুচার কোয়া খেয়ে নাও, বীজগুলো দিয়ে হয়
তরকারি, খোসাটা গোরুর উপাদেয় খাবার । মাঝে মাঝে
কাঁঠালবিচির সাথে দুচারটে কুচোমাছ কিংবা শুঁটকির ঝোল দিয়ে মেখে তারা একথালা ভাত
খেয়ে নেয় । এবারে গাছগুলোর গোড়া এখনি ডুবে গেছে, বেশিদিন ডুবে
থাকলে গাছ বাঁচবে না ।
মাচান বাঁধায়
সাকিনা বিবি খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়, পানি ঘরে ঢুকলেও
নিশ্চয়ই অতটা ঊঁচুতে উঠবে না, আল্লার রহমে তার
সংসার বেঁচে যাবে । ছোটছোট ছেলেমেয়েরা উঠোনের জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে, বড়মেয়ে বছর
এগারোর ফতিমা তাদের উপর নজর রাখে । তারও যে জলে ঝাঁপানোর ইচ্ছে করছে না তা নয়, কিন্তু তাকে বলা
হয়েছে সে বড় হচ্ছে, সে তো আর বাচ্চাদের মত গায়ের জামা খুলে
রেখে জলে ঝাঁপাতে পারে না । তার ক্ষয়াটে গায়ে একটাই ময়লা ছিটের জামা দিনরাত ঢলঢল
করে । সেটা যখনতখন ভিজালে চলে না ।
লতুমিয়া ভাগে আউশের
চাষ করেছিল, আপাতত সেই খেতের ধান জলের তলায় চলে গেছে
। এবার আর আউশের আশা নেই । জমানো দু-বস্তা ধান দিয়ে সারা বর্ষা কিভাবে কাটবে সে
তাই ভাবে । তবে অল্পস্বল্প বন্যা হলে আল্লার মর্জিতে শাইলের ফলন ভালোই হবে । সেই
ভরসায় লতুমিয়া আকাশের দিকে তাকায় ।
সপ্তাহখানেক
একটানা পড়ার পর বৃষ্টি থামল বটে, কিন্তু জল থামার
কোনো লক্ষণ নেই, বরং বাড়ছে । উঠোন ছাপিয়ে ঘরে ঢুকল বলে ।
একদিন বড়রাস্তা দিয়ে মাইকে বলে গেল, লঙ্গাইয়ের বাঁধ ভেঙ্গেছে, নিচু এলাকার
লোকজন যেন নিরাপদ জায়গায় উঠে যায় ।
এই বন্যাপ্রবণ
অঞ্চলে গত দুবছর প্রায় খরা হবার যোগাড় হয়েছিল, কর্তাব্যক্তিরা
বোধ হয় ভেবেছিলেন ভালই হল, ঈশ্বর আবহাওয়ার চিরস্থায়ী পরিবর্তন করে
দিয়েছেন, তাঁদের আর বন্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে
না । বাঁধগুলোর ফাটলে বা ক্ষয়ে যাওয়া জায়গায় দুচার ঝুড়ি মাটি দেওয়ানোর কথা মনে
হয়নি । এদিকে নতুন জেলাশাসক কাজে যোগ দেবার আগেই ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে এসেছেন, তাই বর্ষার আগেই
দুমাসের জন্য ছুটিতে বাইরে চলে গেলেন । বর্ষায় রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যায়, তখন এখান থেকে
বেরোতে বড়ো অসুবিধে হয় । দু এক বছরের জন্য এসব হতচ্ছাড়া জায়গায় এসে অত কষ্ট পোষায়
না । বন্যা হলে ত্রাণশিবির খোলো, শরণার্থীদের
আশ্রয়ের খাবারের বন্দোবস্ত কর, সুযোগসন্ধানী ও
সমাজবিরোধীদের মোকাবিলার জন্য আইনশৃঙ্খলার যথাযথ প্রয়োগ কর-----অনেক ঝামেলা । তার
চাইতে ভাল শুরুতেই কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া ।
নদীর বাঁধ
ভাঙ্গার খবর শুনেও লতুমিয়া প্রথমে গা করেনি । কিন্তু যখন ওদের মুরগির খাঁচায় জল ঢুকে রাতারাতি মুরগিগুলো
মরে গেল, দুটো হাঁস নিখোঁজ হয়ে গেল, তখন লতুমিয়া
সাকিনাবিবিকে বলল, অখন ইনত’ হরন লাইগব । ঘর
উর ডুবি যাইব জেন লাগের ।
সাকিনাবিবি
জিগ্যেস করল, কান’ যাইতা ?
হকলে যেন’ যাইরা । ইশকুলঘরত
। ঘরর হক্কলতা লইয়া যাওয়াও যাইত নায় ।
ঘরের সবকিছু বয়ে
নিয়ে যাওয়া যাবে না, মাচানের উপর মাচান বেঁধে লতুমিয়া ও
সাকিনাবিবি ধান ও অন্যান্য জিনিষপত্রকে আরো একটু উপরে ছাদের কাছে তুলে আল্লার
ভরসায় রাখল, তারপর বাকি জিনিষপত্রকে পোঁটলাপুঁটলি
বেঁধে ঘাড়ে মাথায় বয়ে কোথাও এককোমর, কোথাও একগলা জল
ভেঙ্গে সন্ধ্যাবেলা ছাগলদুটো সমেত সপরিবার স্কুলবাড়িতে পৌঁছল ।
স্কুলবাড়িটি বড়
সড়কের ধারে খানিকটা উঁচু জায়গাতে হওয়ায় জল ঢোকেনি । তাই সেখানে বন্যাদুর্গতদের
আশ্রয়শিবির করা হয়েছে । ইতিমধ্যে গ্রামের কয়েকটি বন্যাদুর্গত পরিবার সেখানে পৌঁছে
গেছে, লতুমিয়া কোনোরকমে একটা ক্লাসঘরের একধারে
পরিবার ও পোঁটলাপুঁটুলিসহ স্থান পেল । একটা চাটাই বিছিয়ে বাচ্চাগুলোকে শুইয়ে দিয়ে
বড় মেয়ে ফতিমা ও সাকিনাবিবি কোনোরকমে একধারে বসে রইল ।
দুবেলা পচা আলু ও
জলে ডুবে শক্ত মেরে যাওয়া কুমড়োর জালি মেশানো ট্যাল্টেলে খিচুড়ির বেশি কিছু
খাদ্যের যোগান দেওয়া যায়নি শরণার্থীদের জন্য । জেলাশাসক বাইরে থাকাতে
ফ্লাড-রিলিফের টাকা পাওয়া যায়নি । স্থানীয় নেতারা যারা তখনো রাজধানীতে যেতে
পারেননি, তাঁদের ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে টাকা নিয়ে
ও স্থানীয় ক্লাবের উদ্যোগে এইটুকু আয়োজন করা গেছে । দিনতিনেক পর জল কিছুটা নামলে বাড়িগুলোর ভিটে
বেরিয়ে এলো । তখন বন্যাপীড়িত লোকগুলো বাড়ি ফিরবার জন্য উন্মুখ । কাদাময় হলেও হাজার
হোক নিজের বাড়ি । সেটাকে এখন সারাতে হবে । তারপর আগামী হেমন্তের ফসল শালি ধানের
হালিচারা লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে । আব্দুর রহমান চৌধুরির বিঘাতিনেক জমি বর্গা
নেওয়া আছে লতুমিয়ার । যে ধানগুলো মাচানের মাথায় আছে, দিনরাত আল্লার
কাছে দোয়া মেগেছে সেগুলো যেন ডুবে না যায় । ডুবে যায়নি অবশ্য, আল্লা শুনেছেন । এখন
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি, হালি লাগাতে হলে আর দেরি করা চলবে না ।
লতুমিয়া সপরিবার বাড়ি ফিরে এলো ।
বাড়িতে এসে
উদয়াস্ত খাটুনি । রিলিফ ক্যাম্পে বিশেষ কাজ না করেই দুবেলা যাহোক খাবার জুটছিল, এখন তা নয় ।
সাকিনাবিবি ঘরদোর
লেপে, মাটি দিয়ে ফাটল মেরামত করে, ধান যা ছিল রোদে
শুকোয়, ঢেঁকিতে কুটে । ফতিমা ও তার পরের ভাই
মনির বাপের সঙ্গে চাষের কাজে সাহায্য করে, কাজ শেষ হলে কাদা
ছেঁচে কুচোমাছ ধরে । জলে ডুবে গাছগুলো হলদেটে হয়ে গেছে, বাঁচবে কিনা
সন্দেহ, কাজেই কচি কাঁঠালগুলো ও ঝরে গেছে ।
কাদামাটিতে ঘাস গজায়নি এখনো । তাই ফতিমা ও মনির ছাগলগুলোকে চরাতে নিয়ে যায় তাহের
আলির জমিতে । তাহের আলির ডাঙ্গা জমি উঁচু, তাতে অনেক ঘাস, আর বেশ ক’টি কাঁঠাল গাছ ।
অনেক কাঁঠাল হয়েছে, তাহের পাইকারকে বক্রি করে দিয়েছে সেই
চৈত্র মাসে ।
ছাগল চরাতে দেখে
তাহের আলি ধমকে বলেছিল, ইন’ ছাগল আনছস কেনে ? লামা ছাগল ।
ফতিমা বলেছিল, আমরার বাড়িত ঘাস নাই চাচা । আমি রশিত
ধরি রাইখমু ।
দেখিছ, আর কুনুবায় হাত
দিছ না । বলে সে চলে যায় । আসলে ফতিমার বাপ তাহেরের বাড়িতে কামলা খাটে । তাই সে
বেশি কড়াকড়ি করে নি । ঘাসের দাম কাজ করিয়ে উসুল করা যাবে ।
একদিন মনির দেখে, গাছের মগডালে কাক
একটা কাঁঠাল ঠোকরাচ্ছে । দেখে আধপেটা খাওয়া পেটের খিদে যেন চাগিয়ে ওঠে । বলে, বু, গাছ’ কাটল অগু পাকনা ।
কাউয়ায় খা’র । পাইড়তাম নি ?
চাচায় দেইখলে
ঠ্যাং ভাঙ্গি দিব । আর ছাগল আইনতেও দিত নায় । ফতিমা তাকে সাবধান করে ।
কিন্তু মনির তার
কথা শোনে না । গাছে চড়বার চেষ্টা করে । একটু চড়েছে কিনা, অমনি কোত্থেকে
উদয় হয় তাহের আলির বড় ছেলে ইয়াসিন । কিতা বে, গাছ’ কিতা ?
মনির লাফিয়ে গাছ
থেকে নামে । দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
কাটল চুরির মতলব? খাড়া অ, বা’জিরে ক’ই আর পাচইন লইয়া
আ’ই ।
ফতিমা ভাই ও ছাগল
নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসে ।
সারাদিন খেটে
খেটে আর পারেনা লতুমিয়া, তেল নুন কেরোসিন ইত্যাদি আনতে বাজারে
যেতেই হয়, কাকে পাঠায় । বাজারে যেতে হলে নৌকোয়
যেতে হয়, কারণ বন্যায় রাঙ্গির পুল ভেঙ্গে গিয়েছে
। রাঙ্গি এখনো দুকূলছাপানো নদী । স্থানে স্থানে হাওর ও নদী মিলেমিশে একাকার ।
লতুমিয়া অল্প টাকা দিয়ে মেয়েকে বাজারে পাঠায় । ছেলেটা এখনো পয়সার হিসেব বোঝে না, তায় জল পেলে
দাপাদাপি শুরু করে । খিদের জ্বালায় হাতে পয়সা পেলেই সে যে তা দিয়ে কিছু কিনে খেয়ে
ফেলবে না তার ঠিক নেই । সেদিন তাহের আলির কাঁঠালগাছে উঠেছিল । তাই মনিরকে বিশ্বাস
নেই । ফতিমা প্রত্যেকটা পয়সা ঠিকঠাক খরচা করবে । বাজারে যাবার সময় সাকিনা বিবি জলা
থেকে তুলে আনা কয়েকগাছে শাপলা লতা আর কলমি শাকও দিয়ে দেয়, যদি বেচে দু-এক
টাকা পায়, লঙ্কাহলুদ আনবে । ফতিমা বিকেলে বেরিয়ে
যায় । গাঁয়ের সামাদচাচার নাও, আরো গাঁয়ের লোক
এই নৌকোতেই যাতায়াত করে, কাজেই ভয় নেই । ভয় পেলে চলেও না ।
ফতিমাকে এরকম
মাঝেমাঝেই যেতে হয়, বাপের সাহায্য হয় । নৌকোয় যেতে একটাকা
হলেও ভাড়া লাগে । তাই সে একাই যায় । একদিন ওপাড়ার শাকিলভাই তাকে নৌকোর জন্য
অপেক্ষা করতে দেখে বলে, আমার নাওত আয়, জল্দি অইব ।
পইসা লাইগত নায় । শাকিল আব্দুর রহমান চৌধুরির ছেলে, ফতিমার বাপ ওদের
জমিতেই কাজ করে । ধান মাড়ানোর সময় দুএক বার বাপের সঙ্গে ওদের বাড়িতে গিয়েছে, তাই চেনে ।
পয়সাওলা লোকের ছেলে, তাই কাজকাম করতে হয় না, প্রায়ই
বন্ধুবান্ধব নিয়ে তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় । ইদানীং সে নিজেদের নৌকাখানি নিয়ে
বন্যাত্রাণের দলে নাম লিখিয়েছে, মাঝেমাঝে মুখ
দেখাচ্ছে । ফতিমা ওর প্রস্তাবে না-বোধক ঘাড় নাড়ে । সে সামাদচাচার নাওয়েই যাবে ।
কিছুদিন পর আবার
ফতিমাকে বাজারে যেতে হয় । হাটের পাট চুকিয়ে সে শেষ বিকেলে নৌকোর জন্য ঘাটে অপেক্ষা
করছে । সামাদ আলি আরেক ট্রিপ যাত্রী আনতে গাঁয়ে গেছে, এখনো ফেরে নি ।
পেছন থেকে শাকিল বলল, নে, বিস্কুট খা ।
ফতিমা পেছন ফিরে দেখে শাকিল, হাতে একটা বড়সড়ো
টোস্ট । সেই কখন আধপেটা খেয়েছে, তাই বিস্কুট দেখে
খিদে চাগিয়ে ওঠে । তবু সে নেয় না, ইতস্তত করে ।
শাকিল বলে, নে, খা । ভুখ লাইগছে
না নি ? ফতিমা এবারে বিস্কুটটা নিয়ে খেতে থাকে ।
শাকিল বলে, চল, আমি অখনউ যাইমু ।
নাওত উঠ গি । পইসা লাইগত নায় । পইসা অগু দিয়া কাইল বিস্কুট খাইলাইছ ।
ফতিমা এবার আর না
করতে পারে না । হাটের পেছনে হাওরের গায়ে শাকিলের নৌকো
বাঁধা । সেখানে গিয়ে সে চড়ে বসে । ফতিমা বসতেই শাকিল দড়ি খুলে নৌকো ছেড়ে দেয় ।সঙ্গে
সঙ্গেই হঠাৎ কোত্থেকে দৌড়ে ওর আরো তিন সাকরেদ লাফ দিয়ে নৌকোয় চড়ে । ফতিমা ভয়ে জড়সড়
হয়ে বসে ।
শাকিল বলে, অত ডরাছ কেনে ? তিন সাকরেদ হাঃ
হাঃ করে হেসে ওঠে । কাটল খাইছলে নি হ’দিন ? ফতিমা মুখ তুলে
দেখে , ইয়াসিন । আইজ আমরা বউত কাটল খাওয়াইমুনে
।
ততক্ষণে লগি ঠেলে
নৌকো রাঙ্গির ভাটির দিকে অনেকদূর এগিয়ে গেছে ।
ফতিমা বলে, নাও কুনবায় লই
যাইরায় ? শাকিল ও তার সঙ্গীরা হাসে, বাড়িত পৌছাই
দিমুনে, চিন্তা করিস না । অখন একটুক ফুর্তি করি, আয়। তারা ফতিমার
গায়ে হাত দেয় । ফতিমা চীৎকার করে ওঠে । কিন্তু নির্জন হাওরের বাতাসে সে চীৎকার
হারিয়ে যায় ।
জনমানবহীন
জলাভূমিতে সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে শাকিল, ইয়াসিন ও তাদের
দুই সঙ্গী সেই শীর্ণ দুর্বল বালিকার উপর তাদের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করে । তারপর
তার রক্তাপ্লুত ব্যথায় অচৈতন্য দেহ ফেলে দেয় রাঙ্গির জলে । যা, বাড়িত যা, শাকিল বলে । নৌকো
ফিরে আসে ।
সন্ধেবেলা
লতুমিয়া ঘরে এলে সাকিনাবিবি বলে, ফতি এব ঘর আইছে
না । সামাদ আলির নাও তো আই গেছে দেইখলাম । একটুক দেখন লাইগব । কেনে যে পুড়িগুরে
পাঠাইলা । লতুমিয়া বলে, কিতা কইরতাম । আমার যাওনর উপায় আছিল নি ? অত কাম, কুনবায় যাইতাম ।
পুড়ি তো শিয়ান অইছে, হাঞ্জাবেলার আগে ফিরত আওন লাইগব ইতা
বুঝন লাগে । না বুইঝলে কিতা কইরতাম । গজগজ করতে থাকে লতুমিয়া ।
রাত বাড়ে, ফতিমা ঘরে ফেরে
না । লতুমিয়া অন্ধকারে কাদাজলের মধ্যে এদিকওদিক যায়, ‘ফতি’
‘ফতি’ বলে চেঁচিয়ে ডাকে, কোনো সাড়া মেলে
না ।
সকালবেলা
খোঁজাখুঁজি শুরু হয় । দেখা যায় সাকিনার অর্ধ উলঙ্গ দেহ পড়ে আছে রাঙ্গিছড়ার পাড়ে ।
জল তার লজ্জা রক্ষা করেনি । অনেক নেমে গিয়েছে ।
হাটের দুচার জন
ফতিমার মুখ চেনে । তাদের কেউ কেউ শাকিলকে তার সঙ্গে কথা বলতে ও তাকে শাকিলের নৌকোর
দিকে যেতে দেখেছিল । শাকিলের বাপের জমিতে তাদের অনেকেই খাটে, অসময়ে ধারধোর করে
। তাই গ্রামের লোক তাকে সমঝে চলে । তাছাড়া সে
গ্রামের লোক, তার অভিসন্ধি বিষয়ে কেউ সন্দেহ করে নি ।
পোস্ট মর্টেমের
পর দেখা গেল গণধর্ষণের পর ফতিমাকে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তাতেই তার মৃত্যু
হয়েছে । আর স্থানীয় খবরের কাগজে বেরোল, খেতমজুর আব্দুল
লতিফের মেয়ে ফতিমা বাজার করতে গিয়েছিল, সেখান থেকে শাকিল
ও তার সঙ্গীরা তাকে নৌকোয় ডেকে নিয়ে কামোদ্দীপক ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণ করে । যারা খবরের
কাগজ পড়ছিল, তাদের মনশ্চক্ষুর সামনে ভেসে উঠছিল
এগারো বছরের হাড়জিরজিরে ফতিমা কিভাবে কামোদ্দীপক ওষুধের প্রভাবে কিভাবে মুহূর্তমধ্যে
কামিনী হয়ে উঠেছিল, চারজন পুরুষের সঙ্গে মনের সুখে কামরঙ্গে
মেতেছিল । তারপর আর কি । জলে ফেলে দেওয়ায় মরেছে বটে, কিন্তু মরবার
আগে ‘সেইসব’ করেছিল
কামোদ্দীপ্ত হয়ে ।
থানার এজাহার পড়ল
বটে, কিন্তু শাকিল ও তার সঙ্গীদের খুঁজে
পাওয়া গেল না । তাদের মুরুব্বিরা লতুমিয়াকে বোঝাল, যা হবার হয়ে গেছে, আর মামলা করে কি
হবে ? তার চাইতে বরং টাকা নাও । মেয়েকে একা
বাজারে পাঠালে এরকম তো হতেই পারে । দেখোনি খবরের কাগজে কি লিখেছে ?তোমার মেয়ের মরার
পরও বদনাম ছড়াবে।তোমার আরো ছেলেমেয়ে আছে । তাই চুপচাপ থাক।হাজার টাকা লতুমিয়ার
হাতে ঠেকায় ।
লতুমিয়া হাউহাউ
করে কাঁদতে থাকে । আমার টেকা লাগেনা । আমার ফতির দাম দিরা নি ? আমার ফতিরে ফিরাই
দেইন ।
দেখ লতুমিয়া, তোমার ইচ্ছা হলে
টাকা নাও, ইচ্ছা নাহলে নিও না । কতল হলেও ‘দিয়া’ দিলে ফয়সালা হয়ে
যায়, শরিয়তে আছে । এখন তোমার মরজি ।
লতুমিয়া টাকাটা
ফেলতে পারেনা । তার যে টাকার বড় দরকার । ঘর মেরামত করতে
হবে, বেঁচে থাকা বাকি ছেলেমেয়েদের
গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে । বলবানের সঙ্গে সে একা যুঝতে পারবে কি করে !
মনকে বোঝায়, তক্দীর খারাপ ছিল, তাই মেয়ে গেছে, সবই আল্লার মরজি
।
রাঙ্গিছড়াতে এবার
আষাঢ়ের ঢল নামে ।
(গল্পটি কয়েকবছর
আগে দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ এবং দৈনিক যুগশঙ্খ, দুটি পত্রিকায়ই
প্রকাশিত হয়েছিল ।--- শিবানী দে)