।। রজতকান্তি দাস।।
কালই ২৬ ডিসেম্বর
২০১৬ বাংলা লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন থেকে
ফিরলাম। ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বরে তিনসুকিয়া শহরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের আয়োজকদের প্রশংসা করতেই হয়। ছোট শহরে বিপুল আয়োজন
এবং সারা উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে
আসা শতাধিক অতিথিদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাপনায় ব্যবস্থাপকদের নিষ্ঠার ত্রুটি ছিল না। এছাড়া এবারে ছোট
পত্রিকার সংখ্যাও কিছু বেশিই মনে
হয়েছে। কয়েকটি পত্রিকায় বেশ কিছু গবেষণাধর্মী লেখাজোখা দেখে মনে হয়েছে লেখকদের মধ্যেও চিন্তাচর্চা ও লেখালেখির
মানোন্নয়নে আগ্রহ বেড়েছে।
ছোট পত্রিকা বলতে
আমরা আসলে কি বুঝি। সাধারণ কথায় বলতে গেলে যা বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকা নয়। অর্থাৎ যেখানে বৃহৎ
পুঁজিনিবেশ কম এবং সেই পুঁজি লাভ সহ
তুলে আনার ব্যাপারে অতোটা আগ্রহী নয়। সামান্য মূলধন নিয়ে স্বল্প পরিমাণে ছাপা কিছু পত্রিকা যার পাঠক সংখ্যা কম
কিন্তু মনন ও সমাজ সচেতনতার দিক
থেকে নিষ্ঠা নিয়ে যারা আগ্রহের সঙ্গে নিজেদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে লেখালেখি করেন তারাই ছোট পত্রিকা বের করেন।
ছোট পত্রিকার লেখকরা ঠিক পেশাদার না হলেও তারা নেশাদার তো বটেই। তাদের এই
নেশাদারিত্বের জোরেই ছোট পত্রিকা চলে। এই সব পত্রিকার লেখক ও সম্পাদকদের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসের স্বীকৃতি এবং বার্ষিক মিলন ও
মতবিনিময়ের ক্ষেত্র হলো লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন। আমার বন্ধু শ্যামানন্দের মাথাতেই এই
চিন্তা প্রথমে আসে। শুরুতে বন্ধুবরের
এই প্রয়াসকে সাফল্যদানের জন্যই আমি নিজেও এর সঙ্গে জড়িত হয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে এই বার্ষিক সম্মেলন আমার আত্মার
সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আগামী বছরে
আগরতলায় এর আয়োজন হবে। পরের বছরে হয়ত অন্য কোথাও। তবে মনে হচ্ছে এই বার্ষিক সম্মেলন চলবে এবং চলতে থাকবে।
এখন প্রশ্ন হলো
যে ছোট পত্রিকা বৃহৎ
বাণিজ্যিক পত্রিকার একটি বিপরীতমুখী সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র কি না । আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো তা মোটেই নয়।
অথবা বলা যেতে পারে এই বিপরীতমুখীনতা
হলো আংশিক সত্য তবে পূর্ণ সত্য নয়। ছোট পত্রিকা আসলে বৃহৎ পত্রিকার পরিপূরক ও সম্পূরক ভূমিকা পালন করে। কারণ
বৃহৎ পত্রিকায় যে মূলধনী ব্যয় তুলে
আনার ব্যাপার থাকে তার জন্য এই দায়িত্ব পালন করতে হলে সমস্ত কবি সাহিত্যিকদের মননকে স্থান দেওয়া হয়ত বাস্তবিক
ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তাই মূলধনী
ব্যয় যেখানে বেশি সেখানে সেই সব লেখাই স্থান পাবে যেখানে বৃহৎ সংখ্যক পাঠককে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এক হিসেবে বৃহৎ
পত্রিকা আমাদের সমাজের বৃহৎ
অংশের রুচিবোধকেই দর্শায়। সেখানে যদি রুচিবোধের অভাব দেখা দেয় তাহলে পত্রিকা
সেই রুচিবোধকেই সন্তুষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লাগে।
আমরা আমাদের
যৌবনকাল থেকেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি ‘দেশ’ পত্রিকা পড়েই। এছাড়া ‘শুকতারা’ কিংবা ‘কিশোর ভারতী’র মতো বাণিজ্যিক
পত্রিকা আমাদের শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোকে আনন্দময় করে রেখেছিল। বাংলার শিক্ষিত
মহলের অনেক পরিবারই এই সব পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক ছিল। এক সময়ে 'দেশ' পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত সমরজিৎ করের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা
পড়েই বাংলা ভাষায়
বিজ্ঞান সম্পর্কীয় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেছিলাম। এর জন্য দেশ পত্রিকার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তবে ইদানীং মনে হচ্ছে এই সব
বাণিজ্যিক পত্রিকার পাঠকের রুচি
পাল্টাচ্ছে। মননশীল লেখা আর পাওয়া যায় না। গুণমানে অধিকাংশ বৃহৎ পত্রিকাগুলোরই একই হাল। তাই চিন্তাশীল লেখকরাও মনে হয়
এখানে আর পাত পান না। তারাও
হয়ত ছোট পত্রিকার দিকেই ঝুঁকবেন। তবে ছোট পত্রিকা যদি সমাজের রুচি পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে উন্নত মানের লেখার
পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে পারে
তাহলে বাণিজ্যিক পত্রিকাও বাধ্য হয়ে লেখার মান উন্নয়নে ব্রতী হবে কারণ চাহিদা ও জোগানের উপর নির্ভরশীল পত্রিকা চাহিদাকেই
দেখে। তাই ছোট পত্রিকার আন্দোলন
বৃহৎ পত্রিকার বিপরীতমুখী কোন যাত্রা না বলে বলা যেতে পারে সমাজের পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে বৃহৎ পত্রিকার ভূমিকার
মধ্যে যে খামতি আছে তার পরিপূরক ও
সম্পূরক ভূমিকা পালনে ছোট পত্রিকার বাড়ন্ত চেহারাকে উৎসাহ প্রদানে বার্ষিক লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন এক অর্থবহ ভূমিকা
পালন করতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন