এখানে কিছু ছায়াছবিতে দেখতে পাবেন সম্মেলন।
উজান আসামের তিনসুকিয়া শহরে ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করে আসছে
গেল প্রায় এক যুগ ধরে। যে সব কর্মকাণ্ডে ‘উজান’
নিজেকে ব্যস্ত রাখে তার অন্যতম হল ছোট্ট পত্রিকা ‘উজান’-এর নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সংক্রান্তিয় বিভিন্ন ছোট
–বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করা। সেই ক্রম মেনে ‘উজানে’র কাঁধে
দায়িত্ব এসে পড়েছিল তিনসুকিয়াতে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয়
বাংলা ছোট পত্রিকার (লিটল ম্যাগাজিন) ৬ষ্ঠ সম্মেলনটি আয়োজন করবার। ৫ম সম্মেলন
হয়েছিল শিলঙে, ২০১৪র মে মাসে। সেখানে এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে পরের সম্মেলনটি হবে
তিনসুকিয়াতে। ২০১৬-র
২৪ এবং ২৫শে ডিসেম্বর, শনি এবং রবিবার
দুদিনে বিচিত্র সব ঠাসা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে সেই সম্মেলন হয়ে গেল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে
বঙ্গীয় দুর্গাবাড়ি প্রেক্ষাগৃহে।
গোটা পূর্বোত্তর এবং
পশ্চিম বাংলার থেকে শতাধিক লেখক, সম্পাদক, শিল্পী অতিথি তথা প্রতিনিধির সমাবেশ ঘটে
তিনসুকিয়াতে।আগরতলা,ধুবড়ি,ডিফু,ডিব্রুগড়,ডিগবয়,ডিমাপুর,গুয়াহাটি,হোজাই,কলকাতা,করিমগঞ্জ,কোচবিহার,কুমার
ঘাট, লামডিং,রায়গঞ্জ,শিলং,শিলচর,তিনসুকিয়া,তেজপুর,উদয়পুর
ইত্যাদি শহর তথা শহরতলি অঞ্চল থেকে এই শহরে
পূর্বোত্তরের প্রকাশনা তথা সাহিত্য কর্ম নিয়ে এধরনের সমাবেশ এই প্রথম। পঁয়তাল্লিশটির
বেশি কাগজ এবং গুয়াহাটির ভিকি পাব্লিশার্স এবং আগরতলার অক্ষর প্রকাশনী,এবং কুমারঘাটের
স্রোত প্রকাশনী তাদের বই,পত্র-পত্রিকা নিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্পাদকেরা
অন্য আরো বহু প্রকাশক এবং সম্পাদকের বই পত্র পত্রিকা নিয়ে আসাতে সেই সংখ্যাও প্রায়
শ’খানিক
হবে। স্রোত প্রকাশনীর গোবিন্দ ধর জানিয়েছেন,তাঁর প্রায় সাত আট হাজার টাকার নগদ
কেনাবেচা হয়েছে।তার মানে সম্মেলনে বিক্রিবাটার পরিমাণও নিতান্ত কম ছিল না।
যদিও ২৩শে সকাল থেকেই অতিথি তথা প্রতিনিধিদের
আসা শুরু হয়ে যায়,২৪শে
সকাল ৮টা থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দুর্গাবাড়ি প্রাঙ্গণে পঞ্জিয়ন শুরু করে অভ্যর্থনা
উপসমিতি।
সকাল ৯-৩০ এ স্মৃতিতর্পণ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করবার কথা
ছিল।হয়েওছিল তাই।কিন্তু খানিক বিলম্ব তো শুরুতে হয়েছিল। দু’দিনের
পুরো অনুষ্ঠান ঘড়ি ধরে পরিচালনা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল।ফলে দিনের শুরুতে যদিও না
কিছু বিলম্ব হয়েছিল, কোনো অনুষ্ঠানকেই কাটছাঁট না করে
সঞ্চালনার জোরে দিনের শেষে দুদিনেই প্রায় সময় মতো অনুষ্ঠান শেষ হয়।
স্মারকবেদীতে প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং ফুল ছড়িয়ে একে একে
শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন পবিত্র সরকার,উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,
সন্দীপ দত্ত,ক্ষিতীশ রায়,নক্ষত্র বিজয় চৌধুরী,ডাঃ কীর্তি রঞ্জন দে,সুজয় কুমার রায়, দিলীপ কান্তি লস্কর প্রমুখ।
এর পরে উজানের পতাকা উত্তোলন করেন পরিচালন সমিতির কার্যকরী সভাপতি, তথা
উজানের সভাপতি সুজয় রায়।সঙ্গে উজানের শিল্পী গোষ্ঠী সমবেত গান করেন ‘শুভ
কর্মপথে...’।দুদিনের সম্মেলনে এই শিল্পী গোষ্ঠী একাধিক সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন জীবন কৃষ্ণ
সরকারের পরিচালনাতে।তাতে অন্যান্য শিল্পীরা ছিলেন ডাঃ তুহিনা ভট্টাচার্য,বনশ্রী
দত্ত,মুনমুন চৌধুরী, উমা গাঙুলি,মৃণালিনী সরকার,বর্ণালী সেনগুপ্ত,পায়েল ভট্টাচার্য,মহুয়া সেন,শতাব্দী
গাঙুলি,সুজয় কুমার রায়,অতনু চক্রবর্তী
এবং বিনায়ক সেনগুপ্ত। তবলাতে সঙ্গত করেন দীপ চক্রবর্তী।
ডাঃ নক্ষত্র বিজয়
চৌধুরীর পৌরোহিত্যে মোটামুটি ১০-৩০ নাগাদ সম্মেলনের মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু
হয়। উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি পবিত্র
সরকার।উজানের শিল্পীরা পরিবেশন করেন সমবেত সঙ্গীত—মোদের গরব মোদের আশা।
উজান সাহিত্য গোষ্ঠীর তরফে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সমাজসেবী ডাঃ কীর্তি রঞ্জন দে’কে
একটি মান পত্র,জাপি এবং
সরাই দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়। কথা ছিল কবি-নাট্যকার হরেন্দ্রনাথ
বরঠাকুরকেও সংবর্ধিত করে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে।কিন্তু তিনি এহেন
সম্মানে গররাজি হওয়াতে সে আর করা হয়ে উঠেনি। ডাঃ কীর্তিরঞ্জন দে তাঁর বক্তব্যে বলেন,লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে এতো উন্মাদনা,উদ্যোগ
হতে পারে ধারণা ছিল না।তিনি আসাম তথা পূর্বোত্তরের লেখকদের বাংলা ভাষাতে সাহিত্য
চর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্যের উল্লেখ করেন।
এর পরে একে একে উজান সভাপতি সুজয় রায় এবং সম্মেলন
পরিচালন সমিতির সভাপতি নক্ষত্র বিজয় চৌধুরী অতিথি-অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়ে
ভাষণ প্রদান করেন।সুজয় রায় বলেন বহু প্রতিকূলতা,বাধা
বিপত্তি,অস্তিত্বের সংকটের মতো পরিস্থিতিতে এই সম্মেলনের আয়োজন সম্ভব হয়েছে।এই
সম্মেলন সমন্বয়ের এক নতুন বার্তা বয়ে এনেছে। গোটা পূর্বোত্তর এবং বাইরেও সাড়া ফেলে
এক মিলন মেলাতে পরিণত হয়েছে। ডাঃ নক্ষত্র বিজয় চৌধুরী বলেন ১৯২৩শে কল্লোল পত্রিকার
প্রকাশের মধ্যে দিয়ে যে আন্দোলনের ঢেউ দেখা দিয়েছিল কলকাতাতে সে তিনসুকিয়াতে এসে
পৌঁছেছিল তার কিছু পরেই,কিন্তু সম্মেলনের মতো বড় আয়োজনে এই শহরে নিয়ে এলেন ‘উজান
সাহিত্য গোষ্ঠী’।
এর পরেই শুরু হয় বই পত্র পত্রিকা উন্মোচন। শুরুতেই
উন্মোচিত হয় সম্মেলন স্মরণিকা ‘ঐকতান’ (সম্পাদক গোপাল বসু), ‘উজান’ পত্রিকা (সম্পাদক সবিতা দেবনাথ) এবং বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের মুখপত্র ‘বাঁক’ (সম্পাদক বাসব রায়, তাপস পাল)।এছাড়াও সারা পূর্বোত্তরের প্রায় পঁচিশটি বই,পত্র পত্রিকা
সম্মেলনে উন্মোচন করেন মঞ্চে আসীন অধ্যাপক পবিত্র সরকার,অধ্যাপক
উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,অধ্যাপক ক্ষিতীশ রায়,সন্দীপ দত্ত,ডাঃ কীর্তি রঞ্জন দে,ডাঃ নক্ষত্র বিজয় চৌধুরী এবং সুজয় রায়। সম্পাদিত পত্রিকা গুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নির্ঝরিণী’ (ডিফু),‘পাগলবনে’(সম্পাদক
রাজেশ শর্মা,শিলচর) ‘প্রতাপ’ (সম্পাদক শৈলেন দাস,শিলচর),‘বজ্রকন্ঠ’ (সম্পাদক রাজেশ
দেবনাথ,আগরতলা), ‘মুহূর্ত’ (সম্পাদক নৃপেন্দ্রনাথ শিকদার, কলকাতা) ইত্যাদি।উন্মোচিত
বইগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর গল্পগ্রন্থ ‘জলরঙ জীবন কথা’,ভানুভূষণ
দাসের কবিতার বই ‘হৃদয় জুড়ে’,সুমিতা ধর বসু ঠাকুরের কবিতার বই ‘মরুশঙ্খ’,সজল পালের
কবিতাগ্রন্থ ‘শুধু মল্লিকার জন্য’,অপাংশু দেবনাথের ‘নিস্তব্ধ নৌকা’,সুশান্ত কর
সম্পাদিত নির্মল চৌধুরীর উপন্যাস ‘ইন্দিরা ওভারব্রিজ’ ইত্যাদি।এখানে উল্লেখ থাকা
ভালো যে অমিতাভ সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘কবিতা যাপন’ পত্রিকারও উন্মোচন এই সম্মেলন
উপলক্ষে হয়েছে।কিন্তু গুয়াহাটি থেকে সম্মেলনে দল বেঁধে আসবার পথে রাজধানী এক্সপ্রেসেই
সেই কাজটি করেন দেবলীনা সেনগুপ্ত এবং মহুয়া চক্রবর্তী।
দুপুর ১২টা ৩০এ
শুরু হয় দিনের প্রথম আলোচনা চক্র।কবি হীরেন ভট্টাচার্য বাংলা এবং অসমিয়া দুই
ভাষাতেই কবিতা লিখতেন।তাঁর স্মরণে অধিবেশনটি উৎসর্গিত হয়।বিষয় ছিল পূর্বোত্তরের
মাতৃভাষাগুলোতে বৌদ্ধিক চর্চা এবং ছোট বা
সাময়িক পত্রিকা।অধিবেশনে বলবার জন্যে শিলং থেকে এসেছিলেন যুব সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার প্রাপ্ত সুপরিচিত
অসমিয়া কবি কমল কুমার তাঁতি,ডিগবয়ের
সুপরিচিত নেপালি কবি দেবীচরণ সেডাই,উত্তর বাংলার প্রতিনিধি
বাংলা এবং রাজবংশী ভাষার বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক দীপক রায়,গুয়াহাটির
কবি অধ্যাপক এবং জলসিঁড়ি পত্রিকার সম্পাদক তিমির দে। অধিবেশনের সঞ্চালনা করেন
করিমগঞ্জের লালন মঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক কবি
দিলীপ কান্তি লস্কর।কমল কুমার তাঁতি বাংলা অসমিয়া ভাষার প্রতি তাঁর সমান আকর্ষণের কথা উল্লেখ
করেন।শিলঙে থাকার সুবাদে খাসি ভাষার প্রতিও আকর্ষণ একটি রয়েছে।তিনি মূলস্রোতের
বাণিজ্যিক কাগজের বিপরীতে লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্বের কথা বলে বলেন,এখন অনলাইন ছোট
পত্রিকাও করা যায়।বাংলা লেখাগুলোকে অসমিয়া এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করার উপরে জোর দেন।দেবী
চরণ সেডাই উল্লেখ করেন ১৮৯৪তে ‘গোর্খা ভারত জীবন’ দিয়ে নেপালি সাময়িক পত্রিকার
যাত্রা শুরুর কথা উল্লেখ করেন। ১৯৩৬শে অসমে প্রকাশিত হয় ‘গোর্খা’ পত্রিকা।অসম তথা
পূর্বোত্তরে এর পরে অনেকগুলো নেপালি পত্রিকা বেরোবার তথ্য তিনি তুলে ধরেন।তার
মধ্যে ১৯৬২থেকে লামডিং থেকে প্রকাশিত ‘বিন্দু’
কাগজটিকে তিনি সর্বোত্তম নেপালি কাগজ বলে উল্লেখ করেন।দীপক রায় রাজবংশী, হাজং, কোচ,
চাকমা,কগবরক ভাষাতে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা গ্রন্থাদির তথ্য সমৃদ্ধ বক্তৃতা করেন।
অধ্যাপক তিমির দে বাংলা পত্রপত্রিকাগুলোতে অসমিয়া সহ প্রতিবেশী ভাষা সাহিত্যকে
গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে সমন্বয়ের আদর্শকে তুলে ধরবার গুরুত্বের কথা বলেন।
দুপুর ২টো
থেকে ৩টা অব্দি আহার বিরতির পরে ছোট্ট এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে
সঞ্চয়িতা সঙ্গীত বিদ্যালয়ের শিল্পীরা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সঞ্চয়িতার শিক্ষক
অমল মুখার্জি। শুরুতে লোকগান পরিবেশন করে কিশোরী শিল্পী পৌষালি কর।ও গায় লালনগীতি কৃষ্ণপক্ষ, কালো পক্ষ...’। ওর সঙ্গে অরিজিৎ চক্রবর্তী কী-বোর্ডে,কৌষিক দাস এবং শুভম রায়
গিটারে, নিরুপম দে কঙ্গোতে সঙ্গত করে। এর পরে যন্ত্র সঙ্গীতে
ধুন বাজিয়ে শোনায় সঞ্চয়িতার তরুণী শিল্পী দল। শিল্পীরা ছিল পল্লবী দাস (তবলা),স্বর্ণদীপা দেব এবং
দীক্ষা গুপ্তা (গিটার),অস্মিতা মজুমদার (হাওয়াইন গিটার),দেবাঞ্জনা চৌধুরী (অক্টোপ্যাড),এনিকা এবং (কী-বোর্ড),বিজয়া (কঙ্গো),কণ্ঠ সঙ্গীতে দেবশ্রী রায়,তনুশ্রী
রায়,পল্লবী ভট্টাচার্য,সুস্মিতা ভট্টাচার্য,
তৃষা পাল,স্মৃতিরেখা
দাস,পল্লবী দাস,প্রিয়াঙ্কা
কর্মকার,প্রতিভা (পরি) এবং বিজয়া দাস।
৩ টা ১৫তে দিনের দ্বিতীয় আলোচনা
চক্র কবি বিমলেন্দু দে’র স্মরণে উৎসর্গিত ছিল। বিষয় ছিল পূর্বোত্তর ভারতে বাংলা ছাপা এবং বৈদ্যুতিন প্রকাশনা শিল্প: সত্তা,সংকট
এবং সম্ভাবনা।এতে বক্তব্য রাখেন কুমারঘাটের স্রোত প্রকাশনার গোবিন্দ ধর,গুয়াহাটির
ভিকি পাব্লিশার্সের সৌমেন ভারতীয়া,কলকাতার সরসুনা কলেজের
বাংলার অধ্যাপক তন্ময় বীর, আগরতলার অক্ষর প্রকাশনীর আকবর
আহমেদ।সঞ্চালনা করেন অক্ষর প্রকাশনীর শুভব্রত দেব। সঞ্চালক শুভব্রত দেব শুরুতেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা
কিছু বলে নেন,রাজাদের আনুকূল্যেই ত্রিপুরাতে প্রকাশনা শিল্পের সূচনা হয়।১২০-২৫ বছর
আগে বেরোয় রাজমালা।১৯৮১ থেকে আগরতলাতে সরকারি উদ্যোগে বইমেলা শুরু হয়। সেই বই মেলা
দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই ‘অক্ষর’ প্রকাশনীর যাত্রা শুরু।তার পরে বহু বাধাবিঘ্ন ঠেলে এই
অব্দি এগোনো। আকবর আহমেদ বলেন,‘বই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে। ডোনাল্ড
ট্রাম্প-উত্তর দুনিয়াতে সত্যের কোনো স্থান নেই।’ পরিস্থিতিটাকে আমরা কীভাবে কাজে
লাগাবো,তিনি সেই নিয়ে ভাবনা উস্কে দেন।মুখাবয়ব সম্পাদক দেবব্রত দেব বলেন,পূর্বোত্তরের
প্রকাশনা শিল্প পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারছে না।পাঠকের আনুকূল্য পাচ্ছে না।তিনি
পূর্বোত্তরের এক ভাষার সাহিত্য আর ভাষাতে অনুবাদের উপরে জোর, দেন।বহু ছোট ভাষা
লুপ্ত হয়ে যাওয়াটা মনে হয় এভাবে কিছু আটকানো যেতে পারে। ‘স্রোত’ প্রকাশনীর গোবিন্দ
ধর বলেন, ছোট পত্রিকার হাত ধরেই এই অঞ্চলে প্রকাশনা শিল্পের সূচনা।তবে ত্রিপুরার
মতো মনে হয় আর কোথাও নিরন্তর প্রকাশনা শিল্পের কাজ সেভাবে হতে পারছে না। সৌমেন
ভারতীয়া নিজের প্রকাশনা সংস্থা চালাবার ইতিবৃত্ত,তার সংগ্রামের কথা বলেন। তিনি মনে
করেন এই সম্মেলন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা।এই ভাবে পূর্বোত্তরের নানা জায়গাতে ঘুরে
ঘুরে আমাদের সাহিত্যের বার্তা পৌঁছে দেবার ধারা যদি অব্যাহত রাখা যায় তবে অনেক দূর
এগোনো যাবে।তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্বোত্তরের বাংলা সাহিত্য জগতের সম্পর্ক সহজ
করবার কথা বলেন। তথ্য প্রযুক্তি,সামাজিক মাধ্যমকেও ব্যবহার করা শিখতে হবে।পাঠক্রমে
উত্তর পূর্বকে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।পাঠ্যক্রম
প্রসঙ্গে দেবব্রত দেব বলেন ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বোত্তরের সাহিত্য নিয়ে অনেক
সদর্থক ভূমিকা পালন করে এসেছে।অধ্যাপক তন্ময় বীর বলেন পূর্বোত্তর প্রথম দিকে ছাপার
ক্ষেত্রে কলকাতা নির্ভর ছিল। ধীরে ধীরে প্রযুক্তিগত ভাবে যত এগিয়েছে স্বাবলম্বী
হয়েছে,নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলেছে।তথ্য প্রযুক্তিকে এখনো সেভাবে ব্যবহার করতে পারছে
না,অথচ এদিকটাতেই পূর্বোত্তরের নতুন সম্ভাবনা রয়েছে।শুধু ছাপা বই নির্ভর থাকলেও
চলবে না। আন্তর্জাল কম্প্যুটারের কথাও ভাবতে হবে।
বিকেল ০৪-৪৫ মিনিটে আবার অনুষ্ঠিত হয় ‘ছড়ায়
কবিতায়’ নামে একটি কবিতালেখ্য পরিবেশিত হয় সৌমেন
বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনাতে। তাতে সৌমেন ছাড়াও অংশ নেন নমিতা ঘোষ।এবং তিন কিশোরী
বাচিক শিল্পী স্বর্ণালি ঘোষ, পৌলমী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং
পৌষালি কর। ছোট পরিবারের সংকীর্ণতা,শিশুর উপরে ক্যারিয়ারের চাপ,মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করতে
শেখানো –এই সব অবক্ষয়কে দারুণ ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই আলেখ্য।
কিছু বই পত্রিকা উন্মোচনে বাকি থেকে গেছিল। সুজয় রায়ের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে সেগুলো উন্মোচন করেন সন্দীপ দত্ত এবং পবিত্র সরকার।উন্মোচিত হয় জ্যোতিষ কুমার দেবের ‘বেড়ালটাকে মারল কে?’,‘সঞ্জয় চক্রবর্তীর ‘সঞ্জয়
উদাস’,তপন মহন্তর ‘অশ্রুকথা’,গোবিন্দ ধর সম্পাদিত ‘স্রোত’ পত্রিকার সাম্প্রতিক
সংখ্যা এবং দিলীপ কান্তি লস্কর সম্পাদিত কাগজ ‘লালন মঞ্চে’র সাম্প্রতিক সংখ্যা।
বিকেল ০৫টায় কবি,সমাজবিজ্ঞানী অমলেন্দু গুহের
স্মরণে উৎসর্গিত অনুষ্ঠান ছিল বহু-ভাষিক কবিতা পাঠের আসর।
সুপরিচিত কবি-নাট্যকার হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের সঞ্চালনাতে সেই অধিবেশনে
বাংলা অসমিয়া নেপালি হিন্দি সহ বিভিন্ন ভাষাতে কবিতা পাঠ করেন রামকুমার দুবে,খড়গরাজ
গিরি,সুব্রত চৌধুরী,খোকন সাহা,সুমিতা ধর বসু ঠাকুর,দেবলীনা সেনগুপ্ত, প্রীতিলতা রায়,ফাল্গুনী চক্রবর্তী,জ্যোতিষ কুমার দেব,পার্থ সারথি দত্ত,পারমিতা ভাওয়াল,রবীন্দ্র কুমার বর্মণ প্রমুখ। এই আসরের শেষে পূর্বোত্তরের অন্যতম প্রধান কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী এবং বাচিক
শিল্পী গৌতম ভট্টাচার্য মঞ্চে উঠে এসে শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্তি
উপলক্ষে সম্মেলনের পক্ষ থেকে তাঁরই কবিতায় তাঁকে অভিনন্দিত করেন।
সন্ধ্যা ৬ টা ৩০এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন ‘রবিরাগিনী’র শিল্পীবৃন্দ।এর পর সন্ধ্যা ৬টা ৪৫এ দিনের তৃতীয় আলোচনা চক্রের বিষয় ছিল ‘পূর্বোত্তর ভারতের বাংলা কথা সাহিত্য’। কথাশিল্পী নির্মল চৌধুরীর স্মরণে উৎসর্গিত
হয়েছিল সেই অধিবেশন। অনুবাদে সাহিত্য একাদেমী প্রাপ্ত কথাশিল্পী শ্যামল
ভট্টাচার্যের সঞ্চালনাতে এই অধিবেশনে কথা বলেন,দেবব্রত দেব,বাসব রায় এবং মৃন্ময় দেব। শুরুতেই শ্যামল
ভট্টাচার্য সূচনা বক্তব্যে বলেন তিনসুকিয়া বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার একটি
প্রাচীন স্থান।এই অঞ্চলের সংস্কৃতি চর্চাকে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে
যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার জন্যে তিনি আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।তিনি বলেন,প্রাক
স্বাধীনতার কাল থেকেই ছোট গল্পে,উপন্যাসে এই অঞ্চলের প্রয়াসটি অনুভব করা যায়।মৃন্ময়
দেব মূলত বরাক উপত্যকার কথা সাহিত্যেই নিজের বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেন। তিনি বলেন
ষাটের অতন্দ্র গোষ্ঠীর মধ্যে একটি উদ্বাস্তু মানসিকতা কাজ করেছিল।তারা অন্তর্বস্তুর
থেকে আঙ্গিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সমাজ জীবনের সঙ্গে যে সংলাপ তৈরি হবার কথা
ছিল সেটি তখন হয়নি হয়েছে পরে।তিনি মলয় কান্তি দে,শেখর দাস,রণবীর পুরকায়স্থের
উপন্যাসের কথা বলেন।সুরমা গাঙর পানিকে যুগান্তকারী উপন্যাস বলে দাবি করেন। দেবব্রত
দেব তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিমল সিংহ,নৃপেন চক্রবর্তী,দুলাল ঘোষদের কথা
সাহিত্যের উপরে আলোকপাত করেন।বাসব রায় বেশ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনাতে অংশ নেন।
সম্প্রতি দুই একটি সংকলন সম্পাদনার সূত্রেও কিছু ভালো গল্প এবং উপন্যাস তাঁর পড়া
হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন,পূর্বোত্তরের সামাজিক বাস্তবতাকে না জানলে বাকি ভারত
বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার পাঠক এখানকার কথা সাহিত্যের ভাষা শৈলী ধরতে পারবেন না।তিনি
বলেন,অসমে এখন অব্দি সার্থক প্রেমের গল্প লেখা হয় নি। এবং লেখা উচিতও নয়। কেননা,আগে
বাঁচার প্রশ্ন,তার পরে প্রেম। আলোচনা এতো জমে উঠেছিল যে মনযোগী শ্রোতা হিসেবে
বসেছিলেন পবিত্র সরকার।সঞ্চালককে বলে তিনি মঞ্চে উঠে আসেন তিনি বলেন,নিজেও তিনি
পূর্ববাংলারই লোক। দুর্বিপাকে পশ্চিমে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দা হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে
তাঁকে মাথা ঘামাতে হয়েছে। উপন্যাসের দুটো বিষয়—বাইরে থেকে ঢোকাচ্ছি---লেখকের ভাষা,
চরিত্রের মুখের ভাষা। চরিত্র তাঁর নিজের ভাষায় একটা আখ্যান তৈরি করেছে। লেখক তাঁর
নিজের মতো করে বলছেন---সেটা মান্য বাংলাতে নাও হতে পারে।কিন্তু কেউ যদি বলেন সেই
ভাষা বাংলাই নয়--- তবে এটা শোনে ধাক্কা লাগে। চলিত বাংলাতেও ভাঙচুর হতে পারে,কিন্তু
সেটি বোধগম্য হওয়া উচিত।পূর্বোত্তরের লেখা পড়বার সময় প্রথম ভুবনের পাঠককে এখানকার
ভাষা বাস্তবতাকে জেনে বুঝে পড়তে হবে।
রাত ০৮টা ৩০শে লোকগানের আসর সাজিয়ে তোলেন উজানের তিন
সদস্য সদস্যা তুহিনা ভট্টাচার্য,বর্ণালি সেনগুপ্ত এবং জীবন সরকার।এই গানের আসর এতোই জমজমাট হয়ে উঠেছিল যে পেছনে
প্রসূন বর্মণ, জ্যোতিষ কুমার দেব,সৌমেন ভারতীয়া,অমিতাভ সেনগুপ্তেরা স্টল ফেলে
নাচতে শুরু করেন।মদন গোপাল গোস্বামী অনুষ্ঠান বিবরণীতে লিখেছেন, “জ্যোতিষদা অশীতিপর নারায়ণদাকে
(সরকার) দু’চক্কর নাচিয়ে দেন।”দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শন।
চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সমালোচক আলতাফ মজিদের স্মরণে উৎসর্গিত এই অধিবেশনে
পূর্বোত্তরের চলচ্চিত্র আন্দোলন বিশেষ করে করিমগঞ্জের ঋত্বিজের সন্দীপন ভট্টাচার্য
এবং কুমারঘাটের ‘উড়ুম্ভুম’ গোষ্ঠীর কাজের
সম্পর্কে আলোকপাত করেন ঋত্বিজ সভাপতি মৃন্ময় দেব। পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় গুয়াহাটির
চলচ্চিত্র কর্মী তাপস পালের সঙ্গে।পরে পরে প্রদর্শিত হয় তাপস পালের ‘অঞ্জলি লাহিড়ি’, উড়ুম্ভুমের ‘তুমি
আমি’ এবং সন্দীপন
ভট্টাচার্যের ‘রেলপাহাড়’ ।
২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬, রবিবার ভোর থেকে বৃষ্টি ভাবনাতে ফেলে দিয়েছিল।সকাল সাতটায় একটি শোভাযাত্রা
বেরিয়ে শহরের পথ পরিক্রমা করবার কথা ছিল।বৃষ্টি সেই সাতটাতেই থামায় শোভাযাত্রা সেই
বেরুল, কিন্তু সামান্য
দেরিতে এবং পথ ছোট করতে হল। দুর্গাবাড়ি থেকে বেরিয়ে শোভাযাত্রা খগেশ্বর রোড হয়ে
তিনকোনীয়াতে গোপীনাথ বরদলৈ রোডে উঠে প্রকাশ বাজার, ডেইলি বাজার, থানা চারআলি হয়ে দুর্গাবাড়িতে যখন ফিরে আসে তখন ঘড়িতে সকাল ৯টা ৩০। পরের দিনের মঞ্চ উদ্বোধনের সময় হয়ে গেছিল।
শোভাযাত্রাতে একটি সুসজ্জিত ট্রাকে উজান শিল্পী গোষ্ঠী সমবেত কণ্ঠে একে
একে গাইছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত,গণসংগীত।পথ হাঁটছিলেন গোটা পূর্বোত্তর এবং পশ্চিম বাংলার
থেকে আসা অতিথি-প্রতিনিধি তথা
লেখক,সম্পাদক,শিল্পী কলাকুশলীরা। শারীরিক অসুস্থতার জন্যে সন্দীপ দত্তকে ট্রাকে চড়ে বসতে হয়েছিল।পবিত্র
সরকারকে এই বৃষ্টিতে বিব্রত করা হয় নি।তার বাইরে আর সবাই ছিলেন এই প্রতিবেদনে
যাদেরই নাম কোনো না কোনো ভাবে এসেছে। ছিলেন সম্মেলন আয়োজন সমিতির সদস্য-সদস্যা এবং
স্বেচ্ছাসেবীরা। যোগ দিয়েছিল বেঙ্গলি গার্লস স্কুল,বিবেকানন্দ কেন্দ্র
বিদ্যালয় এবং কঙ্কণ আর্ট একাডেমীর ছাত্র-ছাত্রীরা। এই তিনটি স্কুলকে পরের অধিবেশনে
একটি করে অংশগ্রহণের প্রমাণ পত্র, এবং সমবেত সম্পাদক
প্রকাশকদের থেকে সংগৃহীত বই পত্রিকার গুচ্ছ
উপহার হিসেবে তুলে দেন পবিত্র সরকার,সন্দীপ দত্ত,
এবং উষারঞ্জন ভট্টাচার্য।
শোভাযাত্রাতে
সামান্য দেরি হওয়াতে সকালের জলখাবার সেরে পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু করতে বেশ
খানিকটা দেরিই হয়েছিল। ৯ টা ৩০শে উন্মোচিত হবার কথা ছিল মঞ্চ। হল ১১টায় করলেন দৈনিক যুগশঙ্খ কাগজের কার্যনির্বাহী সম্পাদক নীলোৎপল
চৌধুরী।এদিনে মঞ্চ উৎসর্গ করা হয়েছিল কবি নিখিলেশ্বর চৌধুরীর স্মরণে। নীলোৎপল
চৌধুরী সম্পর্কে তাঁর ভাইপোও হন। উন্মোচিত মঞ্চে শুরুতেই সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা
গেয়ে উঠেন ‘চির চেনেহি মোর ভাষা জননী’। শিল্পীরা ছিলেন কামিনী কুমার গোঁহাই, রঞ্জিত
ফুকন, তরুণ চলিহা, মঞ্জুরি ফুকন,
ইন্দিরা গোঁহাই, জ্যোতি বড়ুয়া গোঁহাই, হিরামনি বড়ুয়া, গায়ত্রী খনিকর, নবনীতা দত্ত নেওগ, চন্দ্রমা বুঢ়াগোঁহাই, জুরিমনি বরদলৈ, বন্দিতা নেওগ গোঁহাই এবং পূর্ণিমা
কোঁয়র।পুরো হল তখন এই সঙ্গীতের সম্মানে উঠে দাঁড়ায়। এর পরেই উজানের শিল্পীরা পরিবেশন করেন কবিতালেখ্য ‘ভারততীর্থ’। তাতে আবৃত্তিতে অংশ নেন সুজয় রায়, সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায়,
নমিতা ঘোষ এবং ডালিয়া দাস। সঙ্গীতে অংশ নেন কিংশুক দাশ,শতাব্দী গাংগুলি এবং পায়েল ভট্টাচার্য ।
অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত
পরবর্তী অনুষ্ঠানে সাধারণ ভাবে বাংলা ছোট পত্রিকা এবং এই সম্মেলন নিয়ে নিজের
অনুভবের কথা ব্যক্ত করেন প্রধান অতিথি
অধ্যাপক পবিত্র সরকার এবং বিশেষ সন্দীপ
দত্ত। সভাপতি উষারঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন,তিনসুকিয়ার এই
সম্মেলন আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছে।বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বন্ধুরা এসেছেন। যারা আসেন নি
তাঁদের কাছেও আমরা এক সদর্থক বার্তা পাঠিয়ে দিতে পেরেছি।তিনি নিখিলেশ্বর চৌধুরীর
সম্পর্কেও সামান্য স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন,বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো পাঠকের
দাসত্ব করে। তিনি বলেন সব ছাপা জিনিসই লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে না।যাচ্ছেতাই ছাপা
লিটল ম্যাগাজিনের কাজ নয়।নতুন সম্ভাবনাকে তুলে ধরা লিটল ম্যাগাজিনের কাজ। তিনি
বাংলা ছোট কাগজের একটি ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন।আক্ষেপ করেন পশ্চিম বাংলা থেকে যেখানে
বাংলা বিদায় নিচ্ছে সেখানে পূর্বোত্তরে বাংলা কাগজের সংখ্যা বাড়তে দেখে আশা জাগে।অধ্যাপক
পবিত্র সরকার ‘বাঙালি’ পরিচয় দিতে গিয়ে বাঙালি কেমন বহু পরিচিতিকে বাইরে ঠেকে দেয়
সেই প্রসঙ্গ টেনে কেন্দ্র-প্রান্ত তর্ককে তুলে আনেন।এবং ভাষা সাহিত্য,কেন্দ্র
প্রান্তের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। তিনি প্রশ্ন করেন,বাঙালি হিসেবে
আমাদের গৌরব বোধ থাকতেই পারে।তাই বলে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কেন অসমিয়া বিহারি
তামিলদের হাত ধরতে পারব না? লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্র প্রান্তের ভেদ ঘুচিয়ে দিক এই
আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
এর পরে দিনের প্রথম তথা সম্মেলনের চতুর্থ আলোচনা চক্রের
বিষয় ছিল --বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়
স্তরের বাংলা পাঠ্যক্রম এবং শিশু-কিশোরদের বাংলা চর্চা।কবি,সাংবাদিক
এবং শিক্ষাবিদ দেবরঞ্জন ধরের স্মরণে
উৎসর্গিত হয়েছিল এই অধিবেশন। মদন গোপাল গোস্বামীর সঞ্চালনাতে সেই আলোচনা
চক্রে বললেন তুষার কান্তি নাথ,বাসব রায়,প্রাণকৃষ্ণ কর, খোকন সাহা এবং তাপস পাল।
পরবর্তী অধিবেশনের ফাঁকে দুটি রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন
করে সুচয়িতা চক্রবর্তী এবং শতাব্দী গাঙুলি।পরবর্তী অধিবেশনের সময় যদিও ছিল দুপুর
১২টা ৩০,দিনের অনুষ্ঠান শুরু করতেই দেরি হওয়াতে এই অধিবেশন শুরু করতেই প্রায় ২টো
বেজে যায়। আহার বিরতি না দিয়েই দৈনিক যুগশঙ্খের মুখ্য সম্পাদক অরিজিৎ আদিত্যের
সঞ্চালনাতে শুরু হয় পরবর্তী অধিবেশন।কথাশিল্পী অঞ্জলি লাহিড়ির স্মরণে উৎসর্গিত এই
অধিবেশনের বিষয় ছিল --পূর্বোত্তরীয় বাংলা সাহিত্যের বাহিরানা (আঞ্চলিকতা)।তাতে অংশ নেন শুভব্রত দেব,অশোকানন্দ
রায়বর্ধন,সঞ্জয় চক্রবর্তী,শুভপ্রসাদ
নন্দী মজুমদার।এতে নির্ধারিত বক্তার বাইরেও উষারঞ্জন ভট্টাচার্য এবং সুশান্ত কর
খানিকক্ষণের জন্যে অংশ নেবার পরেও দুপুর তিনটার মধ্যেই অধিবেশন শেষ হয়ে গিয়ে
পরবর্তী অনুষ্ঠানের সময় ধরে ফেলে। শুভপ্রসাদ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লোকগান প্রসঙ্গে উচ্চারিত ‘বাহিরানা’ শব্দটির
মানে ব্যাখ্যা করে শুরু করে বলেন,লোকগানের কোনো ঘরানা নেই,সেখানে শুধুই বাহিরানা।
তিনি কাছাড়ের রাজসভাতে রচিত প্রাকব্রিটিশ যুগের সভাকবি থেকে শুরু করে শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী,অমিতাভ দেব চৌধুরীর কবিতার নজির দিয়ে পূর্বোত্তরের সাহিত্যের বাহিরানা
বস্তুটিকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করেন।সঞ্জয় চক্রবর্তীর মনে হয়েছে ‘বাহিরানা’ কথাটি
‘কেন্দ্র-প্রান্তে’র ধারণাকে মনে করিয়ে দেয়,তাই তিনি ‘আঞ্চলিকতা’ শব্দটিতেই জোর
দিতে আগ্রহী।তিনিও পূর্বোত্তরের বিভিন্ন কবিদের নজির দিয়ে জোরের সঙ্গেই দাবি করেন,আমদের
কথা আমাদের বলতেই হবে।মদন গোপাল গোস্বামী লিখেছেন,“সঞ্জয়দার বক্তৃতাটিও কাব্যিক
বক্তৃতা হয়েছে।” শুভব্রত দেব ‘তিতাস একটি নদীর নাম’,সুবর্ণ দেববর্মার ‘পাহাড়ের
কোলে’ ইত্যাদি উপন্যাসের উল্লেখ করে স্বতন্ত্র চিহ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।মাঝে
অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্যকে বলতে বললে তিনি মনে করিয়ে দেন,বাংলা সাহিত্যে পাহাড়
একটি বড় বিষয় আর আসামের কবিতাতে প্রথম পাহাড়ের দেখা মেলে অশোক বিজয় রাহার কবিতাতে।
সঞ্চালক সুশান্ত করকেও দুই একটি কথা বলতে বললে, তিনি বলেন আমাদের স্বাতন্ত্র্য
রয়েছে নানা ভাবে। আমরা নিজেদের দিকে তাকাই না বিশেষ। আমরা হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে চিনি
না, এই নিয়ে লজ্জাও বোধ করি না। তিনি মাসকয় আগে ডিগবয়ের এক সঙ্গীত অনুষ্ঠানে
শুভপ্রসাদের করা মন্তব্যের উল্লেখ করেন,যেখানে শুভপ্রসাদ বলেছিলেন,“আমি আসামের
ছেলে। কলকাতার পরিচয়ে এখানে আসতে চাই না। এখানকার পরিচয় নিয়ে কলকাতা যেতে চাই।”
দুপুরটায় মঞ্চে আসেন মালবিকা দাস। তিনি কয়েকটি নজরুল
গীতি পরিবেশন করেন।এর পরে ৩টা ৩০ নাগাদ
সঞ্জয় চক্রবর্তী এবং আকবর আহমেদের সঞ্চালনাতে বসে বাংলা কবিতা পাঠ এবং
কাব্যগীতির আসর। আসরটি কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাসের স্মরণে উৎসর্গিত হয়েছিল। আসরে কবিতা
পড়েন অপাংশু দেবনাথ,অশোকানন্দ রায়বর্ধন,গোবিন্দ
ধর,জহর দেবনাথ, তপন কান্তি নাথ,দেবলীনা
সেনগুপ্তা,নির্মলা মহন্ত,নিশিথ রঞ্জন পাল,নীলদীপ চক্রবর্তী,ফাল্গুনী চক্রবর্তী,রাজেশ শর্মা,পার্থসারথি দত্ত,মাধুরী
ভট্টাচার্য,সুব্রত চৌধুরী,তিমির দে,নারায়ণ চন্দ্র সরকার,সঞ্জীব দেব,দীপ্তি শর্মা,নীহারিকা দেবী,ধনঞ্জয়
চক্রবর্তী, পারমিতা ভাওয়াল,রামমোহন
বাগচি,মনোমিতা সেনগুপ্ত (পড়েন প্রদীপ
সেনগুপ্তের কবিতা),সজল পাল,কুশল ভট্টাচার্য,সুকান্ত দাস,রাজু
দাস,সবিতা দেব নাথ,তপন দে,প্রদীপ কুমার রায়,সুশীল দাস,নিবেদিতা সরকার,সুপ্রীতি
বর্মণ এবং দিলীপ কান্তি লস্কর।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ তিনসুকিয়ার নৃত্যাঞ্জলি ড্যান্স
স্কুলের শিল্পীরা কয়েকটি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন।
এর পরে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণে উৎসর্গিত প্রতিনিধি সম্মেলনের
আলোচনার মূল কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল লিটিল
ম্যাগাজিন সম্মেলন গুলোর থেকে লেখক-সম্পাদকদের প্রাপ্তি –অপ্রাপ্তি
এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। একা এবং কয়েকজন পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক শ্যামল বিশ্বাসের
সঞ্চালনাতে এই অধিবেশনে শুরুতেই ডাক পরে
সম্মেলনে প্রথম আসা প্রতিনিধি শিলচরের ‘পাগলবনে’ পত্রিকার সম্পাদক রাজেশ শর্মা,ডিফুর নির্ঝরিণী পত্রিকার
সম্পাদক গৌতম কুমার রায়দের। এছাড়াও নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন স্রোত প্রকাশনীর গোবিন্দ
ধর,আকাশের ছাদ পত্রিকার সুমিতা ধর বসু ঠাকুর,শিলঙের
কর্মশালা পত্রিকার হয়ে ফাল্গুনী চক্রবর্তী, পূর্বাদ্রি
পত্রিকার হয়ে রামমোহন বাগচি,তিতির পত্রিকার,নাইন্থ কলামের প্রসূন বর্মণ,লেখাকর্মী পত্রিকার
নারায়ণ সরকার,লালন মঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক দিলীপ কান্তি লস্কর,এবং মজলিশ পত্রিকার সজল পাল,তিতির পত্রিকার সঞ্জয়
সাহা,সেবা পত্রিকার প্রবাল কান্তি সেন,মুখাবয়ব পত্রিকার সম্পাদক দেবব্রত দেব,উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,সন্দীপ দত্ত,রজত
কান্তি দাস প্রমুখ অনেকে।এই অনুষ্ঠানের শুরুতে এ যাবত অনুষ্ঠিত সমস্ত
সম্মেলনে উপস্থিত বদরপুরের প্রতিনিধি হুসেন এবং জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি নারায়ণ সরকার
এবং রজতকান্তি দাসকে বিশেষ সংবর্ধনা জানানো হয়। শ্যামল বিশ্বাস ঘোষণা করেন এবারের ‘একা এবং কয়েকজন’ পুরস্কার দেয়া হবে নাইন্থ
কলাম সম্পাদক প্রসূন বর্মণ এবং লেখাকর্মী সম্পাদক নারায়ণ সরকারকে।
এর পরেই এক সংক্ষিপ্ত সমাপ্তি অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি,প্রতিনিধি,
সম্মেলন সফল করতে যারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, শ্রম এবং সময় দিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানান সম্মেলন পরিচালন সমিতির
কার্যকরী সভাপতি সুজয় রায়, কিছু সংযোজন করেন
মুখ্য সমন্বয়ক সুশান্ত কর। এর পরে সমবেত সমস্ত প্রতিনিধিদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে ছবি তোলা হয়।
সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।খালেদ চৌধুরী
তথা চিরকুমার দত্তচৌধুরীর স্মরণে উৎসর্গিত সেই অনুষ্ঠানে একে একে একক নৃত্য
পরিবেশন করেন রেশমি পাল,নজরুল গীতি পরিবেশন করেন শিলা দে সরকার,বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেবদুলাল গোস্বামী।এর পরে মঞ্চে উঠেন অতিথি
শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার এবং অমিতাভ সেনগুপ্ত। শুভপ্রসাদ ঘণ্টাখানিক ধরে
বেশ কিছু গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান,সঙ্গে তার প্রেক্ষাপট এবং
আনুষঙ্গিক ভাবনা নিয়ে কথা বলেন।তিনি অনেক গানের সঙ্গে তিনি কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কথায় নিজের সুর দেয়া
গান ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যে জলধি নদী/ নির্বাসিতা নদীর বুকে বাউল আয় গান
বাঁধি’ গানটিও করেন। শেষ করেন নিজের সুরে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার
গীতিরূপ দিয়ে।অমিতাভ সেনগুপ্ত তাঁর দুই সহযোগী অনুব্রত দে এবং রাণা দে’কে
সঙ্গে নিয়ে যন্ত্রসঙ্গীতে শ্রোতাদের মোহিত করেন। রাণা দে শেষে বিকাশ সরকারের একটি কবিতা গেয়ে শোনান।
সব শেষে রাত প্রায় সাড়ে নটায় উজানের ধামাইল শিল্পী
গোষ্ঠী মঞ্চে এলে হল এলোমেলো হয়ে যায়। দুটো গানের সঙ্গে
শিল্পীরা নাচ করেন।নাচে ছিলেন পৌলমী বন্দ্যোপাধ্যায়,পায়েল ভট্টাচার্য,শতাব্দী
গাঙুলি,বর্ণালি সেনগুপ্ত,রাখি দাস, সোনালি গগৈ,ডলি আইচ,মৃণালিনী সরকার সুমি মুখার্জি ও শিলা দে সরকার।গানে ছিলেন ডাঃ
তুহিনা ভট্টাচার্য এবং অন্যান্যরা, ঢোল বাজান সঞ্জনা পাল। গোটা অনুষ্ঠান পরিচালনা
করেন ডাঃ তুহিনা ভট্টাচার্য।
শিল্পীরা যখন মঞ্চে
নাচছেন গাইছেন হলে তখন কোমর দোলাতে শুরু করেছেন উষারঞ্জন ভট্টাচার্য,সৌমেন
ভারতীয়া,নীলোৎপল চৌধুরী,নক্ষত্র বিজয়
চৌধুরী,সঞ্জয় চক্রবর্তী,মহুয়া
চক্রবর্তী,গৌতম ভট্টাচার্য,দেবলীনা
সেনগুপ্ত,সুমিতা ধর বসু ঠাকুর,প্রসূন
বর্মণ,গোবিন্দ ধর,রাজেশ শর্মা,রাজেশ দেবনাথ,শৈলেন দাস তথা উপস্থিত সবাই।সত্রীয়া
দিয়ে যে সম্মেলনের সূচনা হয়েছিল,পরদিনের কাগজে সংবাদ হল,ধামাইল দিয়ে সেই সম্মেলনের শেষ বিভিন্ন ভাষাভাষীর মধ্যে এক সমন্বয়ের
বার্তা ছড়িয়ে দিল।
১)
এতো কবি একই মঞ্চে, নয় তবু কবির লড়াই;
মাতৃভাষার পূজক এরা, আমরা করি এদের বড়াই।
২)
মহুয়া-রীতা বই বেচে ঐ, সঞ্জয় গৌতম আড্ডা;
দূরে দূরে থাক ভায়ারা , কাছে গেলেই গাট্টা।
৩)
বাসবদাদার কথা শুনে চারপাশেতে ভিড়;
সৌমেন শ্যামল তাপস আছেন সঙ্গে তন্ময় বীর।
৪)
সুশান্ত কী ছুটছে দেখ যেন তুর্কী ঘোড়া;
বয়সটা
আর বাড়বে না তাঁর হবে নাকো বুড়া!
৫)
উত্তর পূর্বের সংস্কৃতি-দূত শুভপ্রসাদ নন্দী;
সেথায় উড়ায় বিজয়- নিশান মনটা হেথায় বন্দী।
৬)
লিটল ম্যাগের ‘ট্যাবল’ চলে
সঙ্গে
মিছিল লম্বা।
তোমরা না হয় মস্ত বড়,
আমরাও
কিসে কম বা!
৭)
পৌষালি সই নিয়ে বিতরিছে চপ-চা,
কবি
তোরা মঞ্চেতে যতখুশি কপচা।
৮
) শুভব্রত সৌমেন আছে, আছে ধর-গোবিন্দ,
এরপরেও বলিস তোরা বাংলা হবে বন্ধ?
৯)
তুমি যে ছড়া লিখছ, সেটা হোক স্মরণীয়
স্মরণ
করার সময় আমাকেও সঙ্গে নিও।
১০)
বদরপুরের হোসেন মিঞা শিলং হোক বা তিনসুকিয়া,
আসবে
ছুটে ঠিকঠাক।
মুখ জুড়ে তাঁর মিষ্টি হাসি ঘুরে ঘুরে দেখে
কাণ্ডক্রিয়া,
থাকবে
শুধু চুপচাপ!
১১)
কেনার , বলার ধূম লেগেছে সম্মেলন আজ শেষ,
চলত যদি আরো দুদিন লাগত মোদের বেশ!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন