।। পার্থ প্রতিম আচার্য ।।
দেশের
সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যে দেশের প্রতিটি সিনেমা হল এ শো শুরুর
আগে রাষ্ট্র গীত বাজতে হবে ।ঐ সময় হল এ উপস্থিত সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে উঠে
দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে- যা তাদের পবিত্র কর্তব্য (sacred obligation) । এ
প্রসঙ্গে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পরে গেল হঠাৎই ।
ঘটনাটা
বেশ আগের ।সেই ১৯৯৪ এর এক দুপুর । ইউনিভার্সিটির দিন । রূপসী সিনেমা হল এ জোর
চলছে অনিল কাপুর অভিনীত 1942 ,A Love Story. অনেক
কষ্টে মানসের (ঐ
সময় ঐ হলের টিকেট মাস্টার) বদান্যতায় টিকেট হলো , নুন
শো । আমার যেখানে বসা , তার পাশের সীটে একজন বয়স্ক লোক, অন্য দিকে তিনটে লোকের একটা গ্রুপ , অত্যন্ত সাধারণ পোশাক, বুঝিবা কোন দোকান কর্মচারী , কারণ শো শুরুর আগে কোন এক অজানা মালিকের
বাপের শ্রাদ্ধ চলছিলো। ওরা বয়সের দিক থেকে আমার
থেকে অন্তত বছর পাঁচেকের ছোট গ্রুপ হবে ।অনবদ্য
ছবি ।একসময় পরিচালকের গল্প বলা শেষ হল ।আমি যথারীতি বেরুনোর জন্য উঠলাম । আমি
চলতে শুরু করতেই দেখলাম আমার পাশের সীটের বয়স্ক ভদ্রলোক ইঙ্গিতে আমাকে পর্দার দিকে
কী যেন দেখাচ্ছেন । এবার লক্ষ্য করলাম পর্দায় জাতীয় সঙ্গীত বাজছে । সম্মান জানিয়ে
উনি দাঁড়িয়ে আছেন , একেবারে
এটেনশন ভঙ্গিতে । আমার সেই যৌবনে মনে হয়েছিল অন্তত পূর্ব প্রজন্মের প্রতি শ্রদ্ধায়
আমার দাঁড়ানো উচিত । দাঁড়িয়ে রইলাম । হঠাৎই পেছন থেকে সেই ছেলেদের দল আমায় ধাক্কা
দিয়ে সরিয়ে বেরুনোর পথ করে নিল । যৌবনের আমি ইচ্ছে হলে ওদের আটকাতে পারতাম ।
কিন্তু নজর সামনের পর্দায় । তত গুরুত্ব হয়তো সে কারণেই দেই নি । কিন্তু এবার যা ঘটলো তা
বলতেই প্রসঙ্গ উত্থাপন । পথ আটকে সেই বয়স্ক লোকটি । ওরা উনাকে সরাতে
গেলেন । উনি মুখে বিচিত্র আওয়াজ করে পর্দার দিকে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা
করছেন ।ভাবলাম সাহায্য করি তার আগেই একটি ছেলে বলে উঠলো ‘অ কী ? জাতীয়
সঙ্গীত ? সরেন ঢং কইরেন না’ –এরপর এক ধাক্কা মেরে লোকটিকে সরিয়ে দিয়ে ওরা
বেরিয়ে পড়লো । আমি ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম সঙ্গীত শেষ হওয়া পর্যন্ত । বেরিয়ে
আসার সময় উনি শুধু বললেন –“দেখছ
আইজ কালকার পুলাপান” ।
উত্তর জানা ছিল না , আমিও
বেরুলাম।
আজ
এতদিন পর এই ঘটনাটা মনে পড়ল হঠাৎ । কেন সেটা আজ বলবো না। তবে ভেবেছি অনেক। এই
দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য কেন ?
এটা
কি শুধুই প্রজন্মের ফারাক ? না
অন্য কিছুও রয়েছে । ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বাস করিনা আগের চেয়ে আজকের প্রজন্ম
খারাপ ।এ আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লব্ধ বিশ্বাস।
যা শেষমেশ মনে হোল তা নিতান্তই ব্যক্তিগত
।পাঠকরা দ্বিমত হতেই পারেন । সমাজ বিজ্ঞান আমাকে এই ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে । তাই
রাখছি ।
মানুষ
প্রতিনিধিত্ব করে তার অর্থনৈতিক বর্গের ।এখন মনে হয় বয়স্ক লোকটির শ্রেণি অবস্থান ছিল মধ্যবিত্ত । সেই সময়ের ছাত্র আমি যদিও কোনও
অর্থনৈতিক শ্রেণি তে পরতাম না তবে জন্ম সূত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি ।আমার
রাষ্ট্র ভাবনা আর ঐ লোকটির ভাবনা অনেকটাই একরকম ।এ রাষ্ট্রে আমরা বেশ ছিলাম-
ভবিষ্যতে আরও বেশ থাকার আশাও ছিল । রাষ্ট্র গীতের প্রতি আমাদের টান তাই অন্যরকম
।(এখানে বলে নেয়া ভাল সমাজ বিজ্ঞানে রাষ্ট্র আর দেশ দুটো পৃথক অর্থ বহন করে)।অন্য
দিকে ওই ছেলে গুলোর কাছে হয়তো রাষ্ট্র মানে- “অবাক
পৃথিবী ,অবাক করলে তুমি...” রাষ্ট্র ভক্তি না থাকার জন্য তাদের শুধু
অশিক্ষিত নব প্রজন্ম বললে বোধহয় তাই বিশ্লেষণটা একদেশদর্শী হয়ে যায় । আমি নিশ্চিত
ওরা দেশদ্রোহী ছিল না । ওরা যে নিজের শ্রেণি অবস্থান সম্পর্কেও অবহিত ছিল না তাতেও
আমি নিশ্চিত । কিন্তু ওদের এই সব নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না এটা ঘটনা ।যখনই কোন কিছু
আইন করে বলে দেয়া হয়-দেখেছি এর ভেতরে নিহিত থাকে একটা মূল্যায়ন । সেটা হল ঐ বিষয়টা
অনেকের না মেনে চলা। তাই তো আইন করে বলে দিতে হয়- নির্দেশিকা জারী হয় । প্রশ্ন
জাগে আজ কেন এই নির্দেশিকা ?
রাষ্ট্র- ভক্তি কমে গেলে (দেশ ভক্তি বলছি না ) এ দায় কার ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন