।।সুশান্ত কর।।
বহুদিন দেখা হয় নি, কথা হয় নি বিমলের সঙ্গে। শিলচরে গেলেও দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই মাত্র মাস কয় আগে ফেসবুকে একদিন সে নিজেই টোকা দিয়েছিল। আশা করেছিলাম, পুরোনো স্মৃতি ঝালাই করা যাবে আবার। ও মা! দিন কয় পরেই শুনি কি না, সে নেই! কঠিন অসুখ তাকে নিয়ে গেছে অকালেই।
শুনলাম, সে বুঝি খুব টেনশনে থাকত। তাতেই বেঁধেছে বিপদ। কিন্তু বাইরে থেকে কোনোদিনই বোঝা যেতো না। একটা হাসি লেগেই থাকত এই সপ্রতিভ যুবকের মুখে। দেখা হলেই রঙ্গ রসিকতা ছাড়া কথা না হয়ে ছিল এমন দিন মনে পড়ে না। তখন সোনার কাছাড়। সোনার কাছাড় পরিবারের প্রতি আমার আবাল্য সম্পর্ক ছিল। সে বাড়ির লোকজনের কেউ আমার সহপাঠী বন্ধু, তো কেউ আমার প্রতিবেশী। ফলে যাতায়াত ছিলই। সারা শহর ঘুরে দিনে কিম্বা রাতে সোনার কাছাড়ে আড্ডা দেয়াটা একসময় আমার নিয়মে পরিণত হয়ে গেছিল। বিশেষ করে কবি সাংবাদিক বিজয় ভট্টাচার্য সেখানে যোগ দেবার পরে বেড়েছিল। পরে পরে যারা যোগ দিলেন তাদের মধ্যে দুই ‘দাসে’র একজন এই বিমল কান্তি দাস, অন্যজন পীযুষ কান্তি দাস। দু’জনেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গেছে শহরে জীবন গড়বার স্বপ্ন নিয়ে। বিমল তাপাঙ থেকে এসে প্রথমে পলিটেকনিকে, পীযুষ জালালপুর থেকে এসে গুরুচরণ কলেজে আমার সহপাঠী। দু’জনেই কবিতা লিখত। এবং দু’জনেই সামাজিক বিভিন্ন সংগ্রামে শরিক। এবং সোনার কাছাড়ে সাংবাদিকতা দিয়ে জীবনের শুরু সেই সোনার কাছাড়ে। অন্য সাংবাদিকদের থেকে এই দুই কবির সঙ্গে আড্ডা জমে উঠত বেশ ঘনিষ্ঠ। নিজেও কবিতা লিখতাম কিনা। সম্পর্ক সেখানে থেমে থাকে নি। দু’জনের সঙ্গেই নানা সামাজিক কাজেও এক সঙ্গে জড়াবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। চাতলাতে গড়ে উঠেছিল অসমের সংযুক্ত বিপ্লবী আন্দোলন পরিষদ তথা আর্মকার ভগ্নি সংগঠন তপশীলি জাতি সংরক্ষণ সুরক্ষা পরিষদ। সে সংগঠনের কিছু যোগাযোগ বিমলের সৌজন্যে পাওয়া গেছিল। যতদূর মনে পড়ে দুই এক সভাতেও সে গেছিল, আমাদের সঙ্গে। কিন্তু এহ বাহ্য। সে সাহিত্য করত, বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে , আসরে দেখাদেখি আড্ডা হতো। সোনার কাছাড়ে কাজ করত। সেখানেও গেলে ও থাকলে বসতেই হতো। আর একটা সময় দীর্ঘদিন সে আমাকে টেনে বসিয়ে রাখত। সে কারণটি অন্য। পীযুষের তখন এক ‘মাধবীলতা’ ছিল। মহিলাটি কবিতা লিখত। সুতরাং দেখাদেখি হলে আপডেট দিয়ে রাখত। দেখাদেখি একদিন দেখি, বিমলও মনের কথা বলে ফেলেছে। সেই মহিলার অমন কালিদাসী নাম পড়ে নি বটে, কিন্তু বিমলের টেনশনের শেষ ছিল না। সেই টেনশন সে আমার সঙ্গে ভাগ করে নিত। আর কারো সঙ্গে করত কিনা জানি না, কিন্তু একদিন চেপে ধরে বলে আমাকে ওর সঙ্গে সিনেমা যেতেই হবে । গোপীনাথ হলে। যেতেই হবে, কেন না ওর ‘মাধবীলতা’কে নিয়ে সোজা সিনেমা দেখতে যাবার সাহস গোটাতে পারছিল না বেচারা । যদি কারো নজরে পড়ে যায়। ফলে এই ‘নজরকাঁটা’টিকে সঙ্গে নিয়ে পরিচিতজনকে বিভ্রান্ত করবার ব্যবস্থা করা, আর কি। সেই ভালোবাসার দিনগুলোর ফসলই মনে হয়, তার কবিতার বই, “ভালোবাসার একশত সনেট।”
শুনলাম, সে বুঝি খুব টেনশনে থাকত। তাতেই বেঁধেছে বিপদ। কিন্তু বাইরে থেকে কোনোদিনই বোঝা যেতো না। একটা হাসি লেগেই থাকত এই সপ্রতিভ যুবকের মুখে। দেখা হলেই রঙ্গ রসিকতা ছাড়া কথা না হয়ে ছিল এমন দিন মনে পড়ে না। তখন সোনার কাছাড়। সোনার কাছাড় পরিবারের প্রতি আমার আবাল্য সম্পর্ক ছিল। সে বাড়ির লোকজনের কেউ আমার সহপাঠী বন্ধু, তো কেউ আমার প্রতিবেশী। ফলে যাতায়াত ছিলই। সারা শহর ঘুরে দিনে কিম্বা রাতে সোনার কাছাড়ে আড্ডা দেয়াটা একসময় আমার নিয়মে পরিণত হয়ে গেছিল। বিশেষ করে কবি সাংবাদিক বিজয় ভট্টাচার্য সেখানে যোগ দেবার পরে বেড়েছিল। পরে পরে যারা যোগ দিলেন তাদের মধ্যে দুই ‘দাসে’র একজন এই বিমল কান্তি দাস, অন্যজন পীযুষ কান্তি দাস। দু’জনেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গেছে শহরে জীবন গড়বার স্বপ্ন নিয়ে। বিমল তাপাঙ থেকে এসে প্রথমে পলিটেকনিকে, পীযুষ জালালপুর থেকে এসে গুরুচরণ কলেজে আমার সহপাঠী। দু’জনেই কবিতা লিখত। এবং দু’জনেই সামাজিক বিভিন্ন সংগ্রামে শরিক। এবং সোনার কাছাড়ে সাংবাদিকতা দিয়ে জীবনের শুরু সেই সোনার কাছাড়ে। অন্য সাংবাদিকদের থেকে এই দুই কবির সঙ্গে আড্ডা জমে উঠত বেশ ঘনিষ্ঠ। নিজেও কবিতা লিখতাম কিনা। সম্পর্ক সেখানে থেমে থাকে নি। দু’জনের সঙ্গেই নানা সামাজিক কাজেও এক সঙ্গে জড়াবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। চাতলাতে গড়ে উঠেছিল অসমের সংযুক্ত বিপ্লবী আন্দোলন পরিষদ তথা আর্মকার ভগ্নি সংগঠন তপশীলি জাতি সংরক্ষণ সুরক্ষা পরিষদ। সে সংগঠনের কিছু যোগাযোগ বিমলের সৌজন্যে পাওয়া গেছিল। যতদূর মনে পড়ে দুই এক সভাতেও সে গেছিল, আমাদের সঙ্গে। কিন্তু এহ বাহ্য। সে সাহিত্য করত, বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে , আসরে দেখাদেখি আড্ডা হতো। সোনার কাছাড়ে কাজ করত। সেখানেও গেলে ও থাকলে বসতেই হতো। আর একটা সময় দীর্ঘদিন সে আমাকে টেনে বসিয়ে রাখত। সে কারণটি অন্য। পীযুষের তখন এক ‘মাধবীলতা’ ছিল। মহিলাটি কবিতা লিখত। সুতরাং দেখাদেখি হলে আপডেট দিয়ে রাখত। দেখাদেখি একদিন দেখি, বিমলও মনের কথা বলে ফেলেছে। সেই মহিলার অমন কালিদাসী নাম পড়ে নি বটে, কিন্তু বিমলের টেনশনের শেষ ছিল না। সেই টেনশন সে আমার সঙ্গে ভাগ করে নিত। আর কারো সঙ্গে করত কিনা জানি না, কিন্তু একদিন চেপে ধরে বলে আমাকে ওর সঙ্গে সিনেমা যেতেই হবে । গোপীনাথ হলে। যেতেই হবে, কেন না ওর ‘মাধবীলতা’কে নিয়ে সোজা সিনেমা দেখতে যাবার সাহস গোটাতে পারছিল না বেচারা । যদি কারো নজরে পড়ে যায়। ফলে এই ‘নজরকাঁটা’টিকে সঙ্গে নিয়ে পরিচিতজনকে বিভ্রান্ত করবার ব্যবস্থা করা, আর কি। সেই ভালোবাসার দিনগুলোর ফসলই মনে হয়, তার কবিতার বই, “ভালোবাসার একশত সনেট।”
তার উপরে ‘কৈবর্ত’ হবার একটা চাপতো ছিলই। অনেকে স্বীকার করবেন না। অস্বস্তি বোধ করবেন। কিন্তু এটা থাকে। এমন একটি জনগোষ্ঠী যাদের অধিকাংশই দরিদ্র মৎস্যজীবী। যেসব গ্রামে থাকেন, সেখানে স্কুল, হাসপাতাল, বিদ্যুৎতো দূর একটা ভালো পথও থাকে না। যারা সেই জীবিকা কিম্বা গ্রাম থেকে বেরুলেন, শহরে এসে তাদের অধিকাংশই অসংগঠিত শ্রমে জড়িয়ে পড়েন। অসংগঠিত শ্রম মানেই কিন্তু জীবনের অনিশ্চয়তা। বিমলের মতো কেউ কেউ কখনো বা এই পলিটেকনিক অব্দি পড়তে পারেন। কিন্তু স্থায়ী চাকরি জোটাতে পারেন না। সাংবাদিকতাতে এসেও তো বিমলের সঙ্গ ছাড়ে নি সেই অনিশ্চয়তা। নাগরিক জীবনে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে শেকড়ে আর মগডালেও একটা দ্বন্দ্ব বাঁধে। তাই বোধ করি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনেও জড়িয়েছিল। তার মধ্যে একদিকে যেমন ছিল বরাক উপত্যকা কৈবর্ত সমাজ উন্নয়ন সমিতি সংস্থার মতো সামাজিক সংগঠন , অন্যদিকে আবার মহকুমা মাদক দ্রব্য নিবারণী সমিতিও ছিল। বিশেষ কোনো কাজের সংগঠন হয় না এই দ্বিতীয় ধরণের সংগঠনগুলো। শুধু একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠার অনুভব এনে দেয়। তাতে যা হয়--- লক্ষ্যচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। অর্থাৎ শুধু নিজের পিছিয়ে পড়া সমাজ কিম্বা শুধুই কবিতার জন্যে জীবন নিবেদন করলে যিনি আশ্চর্য প্রতিভার সাক্ষর রাখলেও রাখতে পারতেন, তা আর পেরে উঠেন না। অবশ্য কৈবর্ত সমাজের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা পরে কী ছিল সে আর আমরা বিস্তৃত জানি না। জানবার সুযোগ ছিল না। ছিল কবিতা নিয়ে জানবার, কেন জানা হলো না---সেই কথাই লিখলাম এতোক্ষণ। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা ছিল প্রশ্নাতীত। সাংবাদিকদের কাগজ পাল্টাতে হয়, সেও পালটেছিল। কিন্তু কাজের অভাব হয়েছিল, বলেতো মনে হয় না । সাংবাদিকতার কাজে শুনেছি ভাষা এবং বানানের প্রশ্নে সে ছিল আপস বিহীন। মৃত্যুকালেও সেই ছিল দৈনিক যুগশঙ্খের সাংবাদিক।
আশা ছিল, এবারে আবার আন্তর্জালে পুরোনো সম্পর্কেই ঝালাই পালাই হবে। আন্তর্জালে আমাদের পূর্বোত্তরের লেখকদের আড্ডা ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘে’ সক্রিয় হবে সে। সমৃদ্ধ করবে, সমৃদ্ধ হবে। সেরকম কিছু হবার আগেই চলে গেলো। ‘প্রতাপ’ কাগজের সম্পাদক কবি শৈলেন দাস সরল মনেই ব্যক্ত করেন নিজের জীবন যুদ্ধের কথা। ‘কৈবর্ত’ হয়ে নাগরিক বুধ-মণ্ডলে নিজের জায়গা খোঁজে নেবার চাপ এবং তাপের কথা। তিনি বিমল কান্তি দাসের স্মৃতিকে হারিয়ে যেতে না দিতে পণ করেছেন। প্রতাপের বিশেষ সংখ্যা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জেনে ভালো লাগল এই ভেবে যে বিমলের জীবন সংগ্রাম এবং ভাষা-সাহিত্য-সমাজের কাজের কথা যদি কোনো ভাবে এই সমাজকে সাহস এবং প্রেরণা যোগায় তবে তার শরিক হওয়া আমাদের দায়। আমাদের কর্তব্য। কোনো চাপ কিম্বা তাপ—আর কোনো বিমলকে না অকালে নিয়ে চলে যায়—সেই পথে যদি ‘প্রতাপ’ কাঁটা বিছিয়ে দিতে পারে, সেই বা কম কিসে। আমরা তাই ‘প্রতাপে’র সহযাত্রী।
এক সময় বিয়েও করে ফেলে। সংসারে সুখ দেখে ভালো লাগছিল। কিন্তু সোনার কাছাড় সরে পড়াতে সেই আড্ডাটি অনিয়মিত হতে শুরু করে। নিবেদিতা লেনের সেই প্রাচীন লেটার প্রেস সংস্কৃতির থেকে শ্যামাপ্রসাদ রোডের নবীন অফসেট সংস্কৃতিতে তাল মেলানো কঠিন হলো। আমাদের সঙ্ঘ ভেঙ্গে গেলো। তার পরেও দেখা হয় নি নয়। যখনি দেখা হতো, হতো সেই প্রাণোচ্ছল তরতাজা যুবকের সঙ্গে। লড়াই করে উঠে আসা তরুণ, সম্ভবত মৃত্যুকালেও তার আয় এবং উপায় বিশেষ কিছু ছিল না। ফলে সাধারণ ছন্দ অলংকার আয়ত্ত করেও কবিতার কর্ষণ করতে হলে যে নীরবতার দরকার পড়ে, মনে হয় না বিশেষ জুটিয়ে উঠতে পেরেছিল। নতুন লিখতেই শোনাতো প্রচুর সেই সব ব্যক্তিগত আড্ডাতে। দৈনিক কাগজে, ছোট কাগজে বেরুলেও পড়া হতো, আর সাহিত্য আসরগুলোতে তো বটেই। কিন্তু, এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ওর কবিতাতে জোরালো একটা বক্তব্য রাখবার চেষ্টা সবসময়েই করত, কিন্তু রসঘন হয়ে উঠতে পারত বলে মনে হয় নি। তাই মনেও থাকে নি বিশেষ। মাঝে মধ্যে গানও লিখবার চেষ্টা করত। কেউ কোথাও গেয়েছে কিনা, নিজের এই দেড় দশকের প্রবাস জীবনে জানা হয়ে উঠে নি। আরেকটা সমস্যা বরাক উপত্যকার কিছু লেখক লেখিকাকে নিয়ে রয়েছে, তাদের অনেকেরই লেখালেখি বড়াইল অতিক্রম করে আসে না খুব একটা। এই নিয়ে তাদের নিজেদের উদ্যোগও নজরে আসে না। ফলে যোগাযোগের একটা অভাব থেকেই যায়। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে শহর শিলচর অব্দি পৌঁছুতে পারলে অনেকেই যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এর বাইরে যে বিশাল বাংলা কবিতার গলি ঘুঁজি আছে সেদিকে নজর দিয়ে সেখানকার আলো –হাওয়া-রোদ্দুরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করবার দরকার এবং উৎসাহ দুইই অনেকে হারিয়ে বসেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন