“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

এপ্রিলের মনোরম সকালে ১০০ শতাংশ নিখুঁত মেয়েটিকে দেখে

    






    মূল জাপানিঃ হারুকি মুরাকামি 
বাংলা অনুবাদঃ রণবীর পুরকায়স্থ                                  

                                                                                     

      
প্রিলের এক মনোরম সকালে, টোকিওর কেতাদুরস্ত হারাজুকু এলাকার এক সংকীর্ণ গলিপথে আমি ১০০ শতাংশ মেয়েটির মুখোমুখি হেঁটে চলে যাই।
       সত্যি কথা বলতে গেলে সে তেমন সুন্দরও নয় দেখতে। কোনোভাবেই সে বিশেষ কিছু নয়, তার পোশাক-আশাকেও কোন বিশেষত্ব নেই। ঘুম থেকে ওঠার পর পেছনের চুল যেমন অবিন্যস্ত ও কোঁকড়ানো এখনও তেমনই আছে। সে ঠিক বালিকা নয়, মনে হয় ত্রিশের কাছাকাছি বয়স, সঠিক অর্থে যুবতি বলার মতোও নয়। তাও পঞ্চাশ ফুট দূরত্ব থেকেও আমি বুঝতে পারি সে আমার মনের মতো ১০০ শতাংশ নিখুঁত কন্যা। আমি তাকে যে মুহূর্তে দেখেছি তখন থেকেই বুকের মধ্যে একটা গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে আর আমার মুখের ভিতরটাও শুকিয়ে মরুভূমির মতো হয়ে যাচ্ছে। হয়তো সবারই একজন বিশেষ ভালোলাগার নারী থাকে, থাকে কিছু অনন্যতা। কারও পায়ের গোড়ালি সরু কারও চোখ ডাগর কিংবা খুব সুন্দর আঙুল কিংবা অকারণেই কারও ভাল লাগে সেইসব মেয়েদের যারা খুব তারিয়ে তারিয়ে খায়। আমারও নিজের কিছু পছন্দের ব্যাপার আছে। কোন রেস্তরাঁর পাশের টেবিলে সুনাসা যুবতিটির দিকে আমিও দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখি ভাল লাগে বলে। কেউই বলতে পারবে না তার ১০০ শতাংশ নিখুঁত মেয়ের কল্পনা কোনও বিশেষ ধারণার উপর নির্ভরশীল। আমি যেমন নাক পছন্দ করি, শুধুই নাক। এছাড়া তার আকার মনে করতে পারি না এমনকি তার নাকের সঠিক অবস্থানও বলতে পারি না। যা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাহলো সে কোন অর্থেই বিশিষ্ট সুন্দরী নয়। সে রহস্যময়ী।
       “গতকাল আমি এ পথেই ১০০ শতাংশ নিখুঁত মেয়েটিকে অতিক্রম করে গেছি।আমি কাউকে বলি নি।
       “তাই?” সে বলে, “দেখতে সুন্দর ছিল ?”
       “ঠিক তেমনটি নয়।
       “তোমার মনের মতো, তাইতো?”
       “ঠিক জানি না। আমি আসলে তার বিষয়ে কিছুই জানি না-তার চোখ কেমন কিংবা তার বুকের মাপ।”...
       “আশ্চর্য!
       “ঠিক। আশ্চর্য বটে।
       “বুঝলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলে, “তুমি কী করলে তারপর? কথা বললে? পিছু নিলে?”
       “মুখোমুখি পেরিয়ে গেলাম পথ।
       “পূব থেকে পশ্চিমে হেঁটে গেল সে, আর আমি পশ্চিম থেকে পূবে। কী সুন্দর এপ্রিলের সকাল, বলো?”
       ভেবেছিলাম কথা বলব। আধঘণ্টা সময় তো যথেষ্ট: ও শুধু ওর কথা বলত, আমি আমার কথা বলতাম এবং আমাদের ভাগ্যের জটিলতার কথা বলতাম যা ১৯৮১ এপ্রিলের এক মনোরম সকালে এই হারাজুকুর পাশের গলিপথেই আমাদের দুজনের দুদিকে চলে যাওয়ায় ঘটেছিল। এক উষ্ণ এবং গোপন সত্যের মতো দুর্মূল্য সুখশান্তিতে ভরপুর পৃথিবীতে তৈরি হওয়া দুষ্প্রাপ্য ঘড়ির মতো ঘটনা।
       কথা শেষ হলে আমরা কোথাও খেয়ে নিতে পারতাম, উডি অ্যালেন এর একটা ছবি দেখতাম, একটা হোটেলের পানশালায় ঢুকে যেতাম, ককটেলের মৃদু নেশা করতাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে শয্যাসুখে সমাপ্তি টানতাম।
       সম্ভবতা আমাদের দুয়ারে কড়া নেড়েছিল।

       আমাদের দূরত্ব এখন পনের ফুটে দাঁড়িয়েছে। আমি কী করে ওর কাছে যাব? কী বলব?
       “সুপ্রভাত, মহাশয়া। দুটো কথার জন্য কী আপনার কাছে আধঘণ্টা সময় হবে?”
       হাস্যকর। আমার কথাগুলি যেন  বিমার দালালের মতো হয়ে যাচ্ছে।
       “মাফ করবেন আপনি কী এই এলাকায় কোন ধোপার বাড়ির খবর দিতে পারেন?”
       না, এতো আরও হাস্যকর। আমার হাতে ধোয়ার বা ইস্ত্রি করার মতো কোন কাপড়ের প্যাকেটও নেই। এসব বোকামি শুনে কেই বা কথা বলতে পারে।
       এর থেকে সরল সোজা কথাটাই কার্যকরী। সুপ্রভাত। আপনিই আমার ১০০ শতাংশ নিখুঁত মেয়ে। না, সে একথাও বিশ্বাস করবে না। যদিও বা করে সে আমার সঙ্গে কথা নাও বলতে পারে। দুঃখিত, সে বলতে পারে আমি আপনার ১০০ শতাংশ নিখুঁত মেয়ে হতে পারি কিন্তু আপনি আমার ১০০ শতাংশ নিখুঁত ছেলে নন। এরকম ঘটতেই পারে। এ অবস্থায় আমি নিজেকে সামলাতে পারব না, আমি ভেঙে পড়ব। আমি কখনই এ আঘাত থেকে মুক্ত হতে পারব না। আমি এখন বত্রিশ, আর এই হল আমার বেড়ে ওঠার বৃত্তান্ত।

       আমরা একটি ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাই। উষ্ণ বাতাসের এক সামান্য ঝলক আমাকে ছুঁয়ে যায়। পিচ-ঢালা পথটি স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে, আর এদিকে আমি গোলাপের মিষ্টি সুবাসও পাচ্ছি। আমি তার সঙ্গে আর কথা বলার চেষ্টা করিনি। তার গায়ে ছিল সাদা সোয়েটার আর তার ডানহাতে ডাক টিকিট বিহীন এক ছোট খাম। তার মানে সে লিখেছে কাউকে তার মনের কথা সারারাত জেগে, তার ঘোর লাগা চোখ দেখেই বোঝা যায় নিশি জাগরণ কথা। খামটির ভিতরেই হয়তো তার সব গোপন কথা ভরে দিয়েছে সযতনে।
       মোড় ঘোরার আগে আমি কয়েক পা এগিয়ে যাই। সেও ইতিমধ্যে ভিড়ের ভিতর হারিয়ে যায়।
       এখন অবশ্য আমি জানি ঠিক কী কথা বলতাম তাকে। এক দীর্ঘ ভাষণ, যদিও আমার পক্ষে গুছিয়ে বলায় অতিদীর্ঘ হয়ে যেত। আর ভাবনা চিন্তাগুলিও তো আমার খুব বাস্তব সম্মত ছিল না। সে যাই হোক। গল্পটি একদা দিয়ে শুরু হতে পারত আর শেষে, “এক বিষাদ কথার সমাপ্তি, তাই তো?”
       একদা... সেখানে একটি ছেলে ও মেয়ে বসবাস করত। ছেলেটির বয়স আঠারো আর মেয়েটির ষোল। সে অস্বাভাবিক রূপবান ছিল না, মেয়েটিও তেমন সুন্দরী না। তারা অন্য অনেকের মতো সাধারণ নিঃসঙ্গ এক যুবক আর সাধারণ এক একাকী যুবতি। তারা শুধু হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করে এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তাদের জন্য ১০০ শতাংশ নিখুঁত কেউ অপেক্ষা করে আছে। তারা অলৌকিকে বিশ্বাস করে এবং একদিন যে সত্যি সত্যি সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাটিও ঘটে যায়।
       একদিন ওরা অজান্তেই দুজন একটি পথের ধারে মিলিত হয়।
       “দারুণ তোসে বলে, “আমি জানো সারা জীবন ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমিই আমার জীবনে ১০০ শতাংশ মানুষ যাকে আমি ছবির মতো সাজিয়েছি তিলে তিলে। ঠিক স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
       তারা হাত ধরাধরি করে বাগানের বেঞ্চিতে বসে নিজেদের গল্প বলে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। তারা আর একা থাকে না। তারা খুঁজে পায় তাদের বিপরীত ১০০ শতাংশ নিখুঁত জনকে। আশ্চর্যের ব্যাপার বটে, এক একজন তাদের ১০০ শতাংশ নিখুঁত অপরকে খোঁজে এবং চিনে নেয় ঠিকঠাক। এ এক অজাগতিক ব্যাপার, এক অলৌকিক মহাজাগতিক কাণ্ড।
       যখন তারা বসে কথা বলছিল, তখন অতিক্ষীণ কিছু বিভ্রান্তির রুপোলি শিকড় তাদের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। ভাবছিল একি সত্যি, সকলি সত্যি। এরকম কী ঘটছে যে তাদের আজন্মলালিত স্বপ্ন সাকার হচ্ছে এত সহজে?
       আর তাই, তাদের কথোপকথনের সাময়িক বিরতিতে সে মেয়েটিকে বলে, “চলো আমরা নিজেদের পরীক্ষা করে দেখি একবার। আমরা যদি ঠিকঠাক ১০০ শতাংশ নিখুঁত প্রেমিক হই, তাহলে কোথাও না কোথাও আমাদের আবার দেখা হবে নিশ্চিত। আর যখন আবার দেখা হবে, তখনই মেনে নেব আমরা পরস্পরের ১০০ শতাংশ নিখুঁত জন। আমরা তৎক্ষণাৎ বিয়ে করে ফেলব। কী বলো?”
       “ঠিক”, সে বলে, -“ঠিক, আমরা এরকম করতেই পারি।
       এবং তারা বিদায় নেয়, একজন চলে যায় পূবে, ছেলেটি পশ্চিমে।
       ওরা যে পরীক্ষায় স্বীকৃত হয়েছিল সেটা কিন্তু সর্বৈব অপ্রয়োজনীয় ছিল। ওরকম করা ঠিক হয় নি ওদের, কারণ তারা তো সত্যিকারের ১০০ শতাংশ নিখুঁত প্রেমিক ছিল পরস্পরের, আর এক অলৌকিক উপায়ে ওদের মিলনও হয়েছিল। হয়তো বয়স কম থাকায় তা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি ওদের তখন হয়নি। কিন্তু অপরিচিত ভাগ্যের শীতল ঢেউ যে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সেদিন।
       দারুণ শীতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার প্রকোপে সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ওরা দুজন সাতদিন শয্যাশায়ী থাকার সময় ওরা জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পূর্ববর্তী বছরগুলির সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। রোগশোক থেকে যখন তারা সুস্থ হয়ে ওঠে তখন তাদের লুপ্ত স্মৃতির ভাণ্ডার শূন্য, লেখক ডি এইচ লরেন্স এর হতদরিদ্র শৈশবসঞ্চয় ভাণ্ডারের মতো।
       ওরা দুজনেই উজ্জ্বল এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যুবামনের অধিকারী ছিল। তাই তাদের প্রত্যয় জ্ঞান আর মনোগুণ সমাজের পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়। ঈশ্বরের মহিমায় তারা আবার যথাযথ স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে যেতে পারে এক ভূগর্ভপথ থেকে অন্যটায়। তারা সম্পূর্ণ সক্ষমভাবে ডাকঘরের বিশেষ ডাকবিলি প্রক্রিয়া বিষয়েও ওয়াকিবহাল, তারা ভালবাসার জ্ঞানেও অভিজ্ঞ হয় শতাংশের হিসেবে, কখনও ৭৫ কখনও বা ৮৫ শতাংশ।
       সময় দুর্ভাগ্যজনক দ্রুততায় এগিয়ে যায় এবং ছেলেটির বয়স হয় বত্রিশ আর মেয়েটির ত্রিশ।

       এক সুন্দর এপ্রিলের সকালে এক কাপ কফির খোঁজে পশ্চিম থেকে পূবের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দিন শুরু করে আর মেয়েটিও একটি বিশেষ চিঠি পাঠানোর জন্য পূব থেকে পশ্চিমের দিকে হাঁটতে থাকে। দুজনেই টোকিওর কেতাদুরস্ত হারাজুকুর একটি সংকীর্ণ গলিপথ দিয়ে হেঁটে যায়। তারা দুজেনেই রাস্তার মাঝখান দিয়ে মুখোমুখি পেরিয়ে যায় দুজনকে। আলোর বিন্দুর আভাসের মতো মুহূর্তের মধ্যে একবার আলোকিত হয় তাদের হৃদয়। দুজনের বুকেই একটা ক্ষীণ কিন্তু তীব্র সংকেত অনুভূত হয়। আর তারা জানতে পারে:
       সে-ই তার জন্য ১০০ শতাংশ নিখুঁত মেয়ে।
       সে-ই তার জন্য ১০০ শতাংশ নিখুঁত পুরুষ।
       কিন্তু তাদের লুপ্ত স্মৃতির ঝলক এতো দুর্বল যে চৌদ্দবছর আগের মানসিক অবস্থান সঠিক অনুভব করতে পারে না। কোন কথা না বলে তারা দুজনকে অতিক্রম করে যায়, আর পথচারীদের মধ্যে হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য। একটি বিষাদ কথার সমাপ্তি, তাই তো?

       ঠিক তাই। এই কথাটাই আমি তাকে বলতে চেয়েছি।






                        
                                           

                                                                   ***************               

কোন মন্তব্য নেই: