দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা
এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের প্রথম অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের প্রথম অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
উজান পর্ব
বন্যার জল চৌকাঠ পেরোলে বৈতলের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ।
ঝমঝমাঝম বৃষ্টির শব্দে উতলা হয় শরীর । বেভুল হয়ে যায় সব । সাকিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে
জলের টানে । স্ত্রী কন্যা আর তিন চাকার বাহন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নদীর টানে । নতুন এক
নদী । বলেছিলেন তিনি মা নন, তিনি সৎ- মা । বৈতল এখন সৎ- মাকেই মা মানে । নদীবাঁধের
উপর নির্দিষ্ট সংকেত স্থানে জড়ো হয় আরো তিন ভবঘুরে । দুখু, বছই আর আপদ । চার বন্ধু
ভাতরুজির টানে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকে সারাদিন । বিকেল হলেই শুকনো নেশার ইশারায় ছটফট
করে তিনজন । দুখু সাধু মানুষ, ওদের সঙ্গ উপভোগের জন্য নেশাদ্রব্য সঙ্গে নিয়ে আসে ।
বৈতল আর দুখুর বনিবনা কম । বৈতল
যা বলে দুখু বলে তার বিপরীত । গরিব হলে সমাজের সবচে সাহসী অংশের প্রতিভু ভেবে
গর্বিত হয় বৈতল । দুখু ভাবে ওরা একেবারে নীচুতলার মানুষ, ছোটলোক । সমাজের আলোকিত
অংশের প্রতি দুখুর এক অসহায় ক্রোধ । বৈতলের ওসব নেই । বৈতলের ভয়ডর নেই । সে বলে,
--- ছুটলোক কিতা রে । আমরা কেউরে চুকি না ।
--- অইছে বেটা চুকছ না । ইদিকে জমিদারোর
গুলামি করছ,আর বড় বড় মাত।
--- অই গুলাম কইছ না ।
দুইদিনের বন্ধু দুখু বৈতলকে চেনে
না । বৈতলের রাগ চণ্ডাল । রাগলে পরে বৈতলের ভালমন্দ শত্রুবন্ধুর খেয়াল থাকে না । বৈতল তার মর্জির মালিক । বৈতল কারো গুলাম নয়, চাকর নয় । সিলেট দাড়িয়াপাড়ার
এক কিশোরীও তাকে অপমান করে । চাকর বলে । পেশকারের মেয়ের কান ছিঁড়ে তাকে শাস্তিও
দেয় বৈতল । সেই তার ভবঘুরে জীবনের শুরু । কম বয়সের ভাললাগা সেই ফক্ফকা সুন্দর
মেয়েকে এখনও ভোলে নি বৈতল । ফর্সা মেয়ে বুড়ির ছেড়া কানের মুখটাই তাকে চাকর ভাবতে
দেয়নি সারাজীবন । দুখুর মতো নিজেকে ছোটলোকও ভাবতে পারেনি । রাগারাগির কথা হলেও
বন্ধুত্ব নিয়ে টানাটানি করে না বৈতল । মারামারি হাতাহাতির শেষে নদীকে সাক্ষী রেখে
ওরা বন্ধু থেকে যায়। নতুন দেশের নতুন নদীকে সাক্ষী রেখে বৈতলের বলতে ইচ্ছে হয়,
--- আমরা
অইলাম পানির বন্ধু, নদীর বন্ধু ।
বলে না দুখুর ভয়ে । আবার কী
উল্টো কথা ভেঙে দেবে মন । সবে মন বসাতে শুরু করেছে নতুন দেশে । আসলে স্বদেশ ছেড়ে
তো স্বেচ্ছায় আসেনি বৈতল । কার্যকারণ তাকে বাধ্য করেছে । নইলে বন্ধু লুলার সঙ্গে
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল দেশ ছাড়বে না, আজীবন থেকে যাবে
দেখার হাওর, বড় হাওরের আশ্রয়ে । কিন্তু সমাজ সংসার রাজনীতির এমন চক্কর যে বেঁচে
থাকার জীবনটাও মানুষ নির্বাচন করতে পারে না । লুলার মৃত্যু আর দুর্গাবতীর ভালবাসার
ঢেউএ ভাসতে ভাসতে চলে এল অচেনা দেশে । ভেবেছে, থাকতে পারবে না, তকি লাগিয়ে মুসলমান
হয়ে চলে যাবে আবার আপন দেশে । সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ছাতক পাগলা বইয়াখাউরিতে জল
বিস্তর । কিন্তু এমন নদীঘেরা শহর তো নেই কোথাও । বর্ষায় নদী উপরে, শহর থাকে নিচে ।
তাই তো বাঁধ দিয়ে ঘিরে রাখা নদীর পার
। বাঁধের ভিতর সুরক্ষিত মানুষের ঘরবাড়ি, জীবন । এত সুরক্ষার কল্পনা করে না বৈতল ।
ভাটির দেশে আশ্রয় বলতে গাছেরউপর নয় মালির ভিটার কালী মন্দির । এখানেও বছরে একবার
লড়াই হয় জলের সঙ্গে । ঘর ছেড়ে, আশ্রয় ছেড়ে চলে যায় মানুষ কাছাড় হাই স্কুল নয়
সরকারি স্কুলে । গুরু সৃষ্টিধর বলেন বছরে বছরে ভিটে উঁচু করার কথা । নদীর পারে একটি ঘর কল্পনায় তাই বিভোর হয় বৈতল । বছর বছর যার ভিটে উঁচু করে
লড়াই করবে জলের সঙ্গে । মধুরামুখের বিস্তৃত নদীমুখ সবচেয়ে পছন্দ বৈতলের । বাঁধের
প্রতি, নদীর প্রতি টান মমতায় একা একা মেয়েকে নিয়ে বেড়ায় বৈতল । সাত বছরের কন্যার
হাত ধরে হাঁটতেও সুখ । বিস্তীর্ণ চরভূমির মালিকানা হয় বালিকার সঙ্গে । নদী বাঁধের এ মাথা থেকে ওমাথা বিস্তৃত তাদের চারণভূমি দেখিয়ে বলে,
--- ইখানো যদি একটুকরা জমি পাই । বুজছো নি
মাই, তুমার মার আর কষ্ট থাকত নায় । বাইঙ্গন পুড়তা, রান্দতে রান্দতে হাত বাড়াইয়া
পাড়ি লাইবা । লাউ কুমড়ায় ভরি থাকব চাল । চুনা কুমড়া আমার খুব ভালা লাগে । তুমার
ঠাকুমারবাড়িত আছিল ইতা । চৈ চৈ হাস আছিল, ছাগল আছিল, চান্দকপালি গাই আছিল ।
বাঁধের প্রতি, নদীর প্রতি, মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বৈতল ঘরবাড়ি সাজায় নদীর চরে
। মেয়েকে উপলক্ষ করে মনের কথা মুখে আনে । বাড়ি ফিরে মেয়ে মাকে বলে বৃত্তান্ত ।
অবাক দুর্গাবতীর কল্পবাড়ির সঠিক ঠিকানা জানতে চায় । বৈতল বলে,
--- মধুরামুখো অইব আমরার বাড়ি ।
--- ঠিক নি, সুরমা আর পিয়াইনর মুখো আছিল
আমরার বাড়ি ।
--- বাড়ি কৈ, হি তো শ্মশান । বউত কষ্ট করছ ।
অখন নিজর বাড়িত আরাম
করবায় ।
--- মানুষ যেখানো থাকে হিকানোউ বাড়ি । ভালা
অউত্ত আছি ।
--- না, ইখান আমার বাড়ি নায় । তুমার ই জমিদার
ইগুর তলুয়া অইয়া
থাকতাম নায় । আইজ দুখুয়ে কইছে আমারে গুলাম ।
--- আইচ্ছা অইবনে । অখন কও কুনখানো দেখলায় ।
--- কইলাম নু । বরাক নদীর পারো, আবার কুনখানো
। মাস্টরর বাড়ি বান্দর
ভিতরে, শিববাড়ির দিকে । আমি থাকমু নদীর পারো,
খুলা আশমান, জমিন
আর পানি । সরকারে দিব মাগ্না ।
--- দিবো নি । কুনখানো, বরাক নদী তো আমি চিনি
। কুনদিকে ।
দুর্গাবতীর চোখেও আপন বাড়ির আনন্দ । বৈতলও স্বপ্নের নাড়ুতে ঘি দেয়
বেশি করে ।
বলে,
--- অউ
যেখানো আরি ..., কেমনে বুঝাইতাম কও । অউ যে নদীর আটুর লাখান জাগাত ... ।
নদীর আবার হাঁটু কী । মা মেয়ে অবাক হয়ে বৈতলকে
দেখে । বৈতলও বোঝে জুতসই হয় না । তাই মিথ্যে বাড়ির ঠিকানা বদলে দেয় । বলে,
--- বি সি গুপ্তর বাড়ি দেখছ না নি । তারার
বাড়ির ধারো এক টুকরা জমি দিবা কইছইন । আমি কিচ্ছু মাতছি না । একদিন দেখাইয়া আনমুনে
। তারপরে কওয়া কওয়ি ।
দুর্গাবতী বৈতলের সঙ্গে কোথাও
যায় না । এ নিয়ে একটা মনখারাবির ঘুষঘুষে জ্বর আছে তার । সোজা কথা সোজা ভেবেই সে দুঃখের
পশরা সাজায় । সে কালো কৈবর্ত, সে রিক্সাচালক,
তাকে নিয়ে মানুষের নানা কথা । আর দুর্গাবতীর শিউলি ফুলের মতো গায়ের বরণ ; ব্রাহ্মণ
পরিবারের মেয়ে, সামাজিকতায় উঁচু নিচু একটু তো আছেই । বৈতলকে তো তার মা, কাথামালী
ফুলের বরণ মা কখনও অবজ্ঞা করেনি । দুর্গাও তাকে হেলাফেলা করে না ।নইলে একসঙ্গে
আছে কী করে এত বছর । সামাজিক বিয়ে হয়নি ওদের । সুরমা পিইয়াইনের সঙ্গম থেকে
গিরিবাবার কালীবাড়িও খুব দূরের নয় । বাবাজি মানুষটা মন্দ নয় । কৈবর্ত ব্রাহ্মণ
মানেন না । হাসিমুখে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যেতেন । কালী মন্দিরে যায়নি ওরা । দুর্যোগের রাতে লুলা বন্ধুকে জলসমর্পণ করেই
বেরিয়ে পড়েছে অজানার উজানে । ভোরা বাঁধতে বাঁধতে বিয়ের কথা মনেও পড়েনি । অজানার অনিশ্চয়তায় সব ভুলে গেছে
বৈতল । মেহেরপুর শিলকুড়ি মাছিমপুরের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ানো
শুধু দুর্গাবতী শর্মার অকর্মণ্য স্বামী হয়ে । নিজের নাম ঘুচিয়ে বিয়ানিবাজার
রইদপুয়ানির গুরু সৃষ্টিধরের নাম নেয় বৈতল । হয়ে যায় সৃষ্টিধর শর্মা । যদিও
এনায়েতপুরের নরহত্যার ছায়া একটা ওকে তাড়া করলেও ভয় পায়নি বৈতল । অস্থির সময়ে শুধু
সিলেট কেন সারা বাংলা জুড়ে ভ্রাতৃহত্যার তাণ্ডব । ভৈরব আর শ্রীমঙ্গলের হত্যাকাণ্ডে
বৈতল বিচলিত হয়েছে কিন্তু ভয় পায়নি । মানুষকে ভয় করে না বৈতল ।
লুলার মৃত্যুর আকস্মিকতায় বৈতল
ভয় পায়নি । একা যুবতি দুর্গারভবিষ্যত ভেবে আকুল হয়েছে । নইলে মা ছাড়া বন্ধু ছাড়া
একাকীর জীবন বড়হাওরের বুকে কাটিয়ে দেওয়া বৈতলের কাছে অসম্ভব নয় । ভদ্রলোকের
রান্নাঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভারে ভারে রূপোলি মাছ ধরতে পারে বৈতল । মালির ভিটা
কালীমন্দিরের সেবাইত গিরিবাবার অনুরোধ যে ঠেকানো যায় না । দুর্গাবতীকে রক্ষা করতে
গিয়ে কী থেকে কী হয়ে যায় ।
ভাল মানুষ দেখলেই গুরুর আসনে
বসিয়ে দেওয়ার স্বভাব বৈতলের । সৃষ্টিধর ওঝা মনের ধনে ধনী করেছেন বৈতলকে । গিরিবাবা
তার ব্যবহারিক শক্তির প্রয়োগ শিখিয়েছেন । মানুষের ভিতরকার ভেদাভেদ দূর করার
মন্ত্র, পুঁথি পত্র আর গানের সুরে ছড়িয়ে
দিয়েছেন কর্মজজ্ঞে । একজন শিখিয়েছেন মন্ত্র, অন্যজন তার সাধনা ।তাই গিরিবাবার আদেশ
শিরোধার্য করে তাকিয়েছে দুর্গাবতীর চোখে । সৃষ্টিধর গুরুর মন্ত্রই যোগায় দুর্গা । বৈতলের তৈরি করা কলা গাছের ভোরাকে সখী জ্ঞানে গেয়েছে গান,
চন্দ্র সূর্য সই সাক্ষী হইও তুমি
নদ্যার ঠাকুর হইল প্রাণের সোয়ামী
।
ময়মনসিংহের গান শিখিয়েছেন গুরু সৃষ্টিধর । তাই সেই দুর্যোগের রাতেও দুর্গা
বতীকে মহুয়া ভেবে গান গেয়েছে । আসলে বৈতল তখন পালানোর মতলবআঁটছে । কয়েক দিনের জন্য
গা ঢাকা দেওয়া । ভাটির টানে ভোরা গিয়ে পড়বে ব্রহ্মপুত্রে, ব্রহ্মপুত্র থেকে পদ্মায়
গঙ্গায় । জলে জলে কিছুদিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসা গ্রামে । ততদিনে লুলার মৃত্যু ভুলে
যাবে মানুষ । একাকী দুর্গাবতীর আকুল সমর্পণে বিবশ হয়ে যায় বৈতল । দুর্গা বৈতলের
হাত ধরে বলে,
--- আমারে কই ছাড়িয়া যাও ।
একটুখানি হাতের স্পর্শে বৈতল মহাবীর উজানে ঘোরায় ভোরায় গতি । টেনে
তোলে দুর্গাকে । বলে,
--- ছাড়তাম নায়, চলো । অখন তুমি আমার
ছিরিগুরু কাণ্ডারী ।
কোমরে গোঁজা এক কাঠের গুলতি ছাড়া
কিছুই সঙ্গে নেই বৈতলের । বৈতল ‘সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়’ । সে থেকেই
বৈতল সঙ্গী তার গুলতি। পেয়ারা গাছের ত্রিকোণ কাণ্ড ও বৈতলের সঙ্গে
তেলেজেলে বাড়ে । আর বৈতলের শরণ নিয়ে দুর্গাবতীও ভাসে জীবনজলে । বৈতল জানে বিয়ে না
হলেও দুর্গাবতী ভালবেসেই তার সঙ্গে ঘর বেঁধেছে । ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে বেরিয়েছে
এক সঙ্গে । মেয়ের জন্ম, না হরিৎবরণ জমিদার বাড়ির আশ্রয়, বৈতল জানে না কখন তারা
দুজন প্রকাশ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । তখন কোনও লজ্জা কিংবা জড়তার লেশ দেখেনি
দুর্গার হাবেভাবে । সবাইকে বলেছে,
--- আমার তাইন ।
এখন বলে,
--- মনির বাপ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন