“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫

আয়স কাল ১২


  

দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের ২য়   ভাগ: -- শিবানী দে)

(C)Image:ছবি
কেউ গাড়ির উইণ্ডস্ক্রিনে পাথর ছুঁড়েছিল । একটা বাচ্চার মাথার মত বড় পাথরটা, নির্বাক, কিন্তু ছড়ানো কাচের টুকরোর মধ্যে সিটের উপর পড়ে আছে, যেন ও-ই গাড়িটার মালিক । আমার প্রথম চিন্তা ছিল, এখন এই হিলম্যানটার উইন্ডস্ক্রিন আমি কোথায় পাব ? তারপর ভাবলাম, কি সৌভাগ্য যে সব কিছু একসঙ্গে শেষ হতে চলেছে ।
আমি সিট থেকে পাথরটা তুলে ফেললাম, উইন্ডস্ক্রিন থেকে আলগা হয়ে যাওয়া কাচের টুকরো কুড়োতে আরম্ভ করলাম । এখন যেহেতু আমি কিছু কাজ করছিলাম, মন কিছুটা শান্ত হল । কিন্তু আমি এজন্যও শান্তবোধ করছিলাম যে এখন বেঁচে থাকব কি থাকব না তার জন্য আমার আর পরোয়া নেই । আমার কি হবে কি হবে না তা কোনো ব্যাপারই নয় । আমি ভাবলাম, আমার জীবনও এইরকম বিনষ্ট হতে পারে । আমরা এইসব লোকদের গুলি করে মেরেছি যেন এরা আবর্জনা, কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাদের নিজেদের জীবনই বাঁচার যোগ্য হতে নাও পারে ।
আমার মনে এল দগ্ধ হলঘরের মধ্যে পাঁচটি শবদেহের সরল সঘন উপস্থিতি । তাদের আত্মা চলে যায়নি, আমি ভাবলাম, এবং চলে যাবে না । তাদের আত্মা সেইখানেই তাদের শরীর ধরে শক্তভাবে বসে আছে ।
কেউ যদি আমার জন্য বালিতে তখনি একটা কবর খুঁড়ে ওদিকে নির্দেশ করত, আমি কোনো বাক্যব্যয় না করে তখনি সেখানে হাতদুটো বুকের উপর জড়ো করে শুয়ে পড়তাম । আর যখন বালি আমার মুখে, চোখের কোনায় পড়ত, আমি তা সরানোর জন্য একটা আঙ্গুলও উঠাতাম না ।
আমার প্রতি সহানুভূতি  দেখিয়ে পড়ো না, আমার হৃদয়ের সঙ্গে তোমার হৃদয় যেন বেজে না ওঠে ।
আমি জানালা দিয়ে একটা মুদ্রা ধরলাম । সেটা নেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেল । বাচ্চারা ধাক্কা দিল, ইঞ্জিন চালু হল । বাড়ানো হাতগুলোর মধ্যে আমার পার্স উপুড় করে দিলাম ।
ঝোপঝাড়ের মধ্যে যেখানে রাস্তা একটা পায়ে চলা সরু পথে পরিণত হয়েছে, সেখানে আমি দেখলাম, তিনটে নয়, পাঁচটা মিলিটারি ট্রাক দাঁড়িয়ে । জলপাই রঙের বর্ষাতি ও টুপি পরা প্রায় বালক নজরদারের সামনে আমি গাড়ি থেকে বেরোলাম, ভেজা কাপড়ে এত ঠাণ্ডা লাগছিল যে মনে হচ্ছিল গায়ে কোনো জামাকাপড়ই নেই ।
আমি ভেবেছিলাম যে যেকথা আমি বলতে চাই তা আসবে, কিন্তু এল না হাত বাড়ালাম, হাতের তালু উপর করে । আমার হাত বলল, আমি পরিত্যক্ত, বাক্যের দ্বারা পরিত্যক্ত । আমি কথা বলতে এসেছি, কিন্তু কিছু বলবার নেই ।
সেই নজরদার তরুণ হেঁকে বলল, “গাড়িতে অপেক্ষা কর, আমি পুলিশ ডাকছি ।গালে ব্রণ ছেলেটার, সে এই আত্মগর্বী মারণখেলা খেলছে । অপেক্ষা কর, নাহলে পুলিশ ডাকছি ।আমি মাথা নাড়লাম, মাথা নাড়াতেই থাকলাম । সে কারো সঙ্গে কথা বলছিল, যার সঙ্গে কথা বলছিল তাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না । সে হাসছিল । নিঃসন্দেহে, তারা প্রথম থেকেই সব কিছু নজর রাখছিল, আমার সম্পর্কে ওদের কিছু কিছু মতামত তৈরি হয়েছিল একটা পরহিতৈষী পাগল বুড়ি  বৃষ্টিতে আটকেছে, পালক খসা মুরগির মত দেখাচ্ছে । ওরা কি ঠিক ? আমি কি পরহিতৈষী ? না । আমার মনে হয় না আমি কার কিছু ভাল করেছিলাম । আমি কি পাগল ? হ্যাঁ, আমি পাগলকিন্তু ওরাও তো পাগল । আমরা সবাই পাগল, শয়তানে ভর করা যখন সিংহাসনে পাগলামি আরোহণ করে, তার ছোঁয়াচ কে এড়াতে পারে ?
আমিও হেঁকে বললাম, “পুলিশকে ডাকতে হবে না, আমি নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারি ।কিন্তু ফিসফাস কথাবার্তা, বাঁকা চাহনি চলতেই থাকল । বোধ হয় ওরা এরই মধ্যে রেডিও যোগাযোগ করছিল ।
আমি ছেলেটাকে হেঁকে বললাম, “তোমরা কি করছ বলে ভাবছ ?” তার মুখে হাসি আটকে গেল । তোমরা কি  করছ বলে ভাবছ ?” আমি চেঁচালাম, গলা ভেঙ্গে যাবার মত শোনাল । আশ্চর্য হয়ে ছেলেটা নিচের দিকে তাকাল । আশ্চর্য, কেননা একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা তাকে চিৎকার করে ভর্ৎসনা করছে, একজন যে তার দিদিমার বয়সী ।
একজন যুদ্ধের সজ্জায় সজ্জিত লোক পরের গাড়িটা থেকে নেমে এলো আমার সামনে এসে আমাকে দেখল । সমস্যাটা কি ?” সে সৈন্যবাহী গাড়িটায় দাঁড়ানো ছেলেটাকে জিগ্যেস করল । ছেলেটা বলল, “কোনো সমস্যা নেই । এই ভদ্রমহিলা কিছু বলতে চান ।
লোকটা আমার দিকে ফিরে বলল, “ ম্যাডাম, এটা বিপজ্জনক জায়গা লোকটি দৃশ্যত একজন অফিসার ।এখানে যখন তখন কিছু ঘটতে পারে । আমি বড়রাস্তার মোড় পর্যন্ত আপনার সঙ্গে যাবার জন্য একজন লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি ।
আমি মাথা নাড়লাম । আমি নিজের উপর কর্তৃত্ব রাখতে পারছিলাম, আমার চোখে এখন জলও নেই , যদিও এটা বলতে পারিনা যে কখন অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গে পড়বে ।
আমি কি চাইছিলাম ? বুড়ি মহিলাটি কি চেয়েছিল ? সে চেয়েছিল কিছু কথা ওদেরকে খোলাখুলি বলতে, এই স্থান, এই কালে যে কথা উপযুক্ত, তেমন কিছু কথা সে চেয়েছিল ওরা তাকে তাড়াবার আগে একটা ঘা, একটা জখম তাদের জোর করে দিতে, স্বচক্ষে দেখিয়ে দিতে এই যন্ত্রণার জখম, কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই জখম তো আমারই জখম, কারণ আমরা নিজেরা শুধু নিজেদের ঘা-ই বইতে পারি । আমি এমন কি একটা হাত উপরে তুললাম নিজের পোশাকের বোতাম অবধি ।কিন্তু আমার আঙ্গুলগুলো নীল, বরফঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ।
তোমরা কি ঐ হলের ভেতরে গিয়েছিলে ?” আমি ভাঙ্গা গলায় জিগ্যেস করলাম । এখন চোখের জল আপনা আপনি নেমে আসছিল ।
অফিসারটি সিগ্রেট ফেলে দিয়ে ভিজে বালিতে পা দিয়ে ঘষে ফেলল ।
সে নরম গলায় বলল, “গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই ইউনিট একটিও গুলি ছোঁড়েনিঁ। আমি একটা কথা বলছি, শুনুন । আপনি যে বিষয়ে বলছেন, তার সম্পর্কে ভাল করে না জেনে উদ্বিগ্ন হবেন না । ওখানে যারা আছে, তারাই শুধু মারা যায় নি । এই হত্যালীলা সব সময়ই চলছে । হলের মৃতদেহগুলোকে কালকে থেকে তুলে আনা হয়েছে ।এখনকার মত লড়াই থেমেছে বটে, কিন্তু বৃষ্টি থামলেই আবার শুরু হয়ে যাবে । আমি জানিনা আপনি কিভাবে এখানে এলেন-----ওদের তো রাস্তা বন্ধ রাখবার কথা-----কিন্তু এটা খুব খারাপ জায়গা, আপনার এখানে থাকা ঠিক নয় । আমরা পুলিশকে রেডিওর মাধ্যমে জানাচ্ছি, তারা আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে ।
ট্রুপ ক্যারিয়ার থেকে বালক ফৌজিটা বলল, “আমিও এই কথাই বলছিলাম ।
আমি বললাম, “তোমরা কেন তোমাদের বন্দুকগুলো নামিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে যাও না ? তোমরা সবাই ? কারণ তোমরা এখানে যা কিছু করছ, তার চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না । আমি বোঝাচ্ছি, তোমাদের আত্মার জন্য, মনের জন্য ও ভয়ঙ্কর ।
না,” সে বলল । আমি ভেবেছিলাম আমার কথা হয়তো সে বুঝতে পারবে না, কিন্তু না, সে আমার কথার অর্থ ভালোই বুঝল । আমাদের এখন ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত করতে হবে ।
আমার পা থেকে মাথা অবধি কাঁপছিল, আমার আঙ্গুলগুলো হাতের ভেতরে কুঁকড়ে গেছে, কিছুতেই সোজা হচ্ছে না । ভেজা পোশাকের মধ্য দিয়ে বাতাস আমার চামড়া অবধি ঢুকছে ।
আমি বললাম, “এই মারা যাওয়া ছেলেদের একজনকে আমি চিনতাম । ওর বয়স যখন পাঁচ, তখন থেকেই চিনতাম । ওর মা আমার কাজ করে । তোমরা সবাই এই খুনোখুনির জন্য বড় অল্পবয়স্ক । এইসব কথা আমাকে পীড়িত করে তোলে । এই হল আমার কথা ।
আমি গাড়ি নিয়ে হল অবধি গেলাম, গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম । ওরা এখন মৃতদেহগুলোকে বের করে আনছিল । আমার মনে হল জনতার মধ্য থেকে আমার প্রতি একটা ঢেউ আসছিল : রাগ, হিংসা ; তার চাইতেও খারাপ : ঘৃণা । আমি যদি ফৌজিদের সঙ্গে কথা না বলতাম তাহলে কি অন্যরকম হত ? না ।
মিঃ থাবেন আমি কি চাই জানতে এগিয়ে এলো । আমি বললাম, দুঃখিত, কিন্তু কোন রাস্তায় ফিরে যাব তা বুঝতে পারছি না ।
পিচরাস্তায় উঠুন, ডানদিকে মোড় নিয়ে চিহ্নগুলো ধরে যান ।সে কাটকাট করে বলল ।
হ্যাঁ, কিন্তু কি চিহ্ন ?”
সভ্যতার চিহ্ন,” সে পিছন ফিরে চলে গেল ।
আমি আস্তে আস্তে চালাচ্ছিলাম, কিছুটা এজন্য যে আমার শরীর মন দুইই অবশ হয়ে গিয়েছিল । আমি এমন সব শহরতলির রাস্তায় যাচ্ছিলাম যেসব নাম কখন শুনিনি, এবং কুড়ি মিনিট ধরে একই রকম দেখতে গলিগুলোতে চলতে চলতে বেরোনোর রাস্তা খুঁজছিলাম । শেষ পর্যন্ত ফুরট্রেকার রোড পেলাম । এখানে, প্রথমবার লোকে আমার গাড়ির ভাঙ্গা উইন্ডস্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছিল । বাড়ি পৌঁছা অবধি এই রকম তাকানোই আমার সঙ্গী হল ।
বাড়িটা ঠাণ্ডা ও অচেনা মনে হল । আমি নিজেকে বললাম, গরম জলে চান কর, বিশ্রাম কর । কিন্তু একটা বরফশীতল আলস্য আমাকে চেপে বসল । অনেক শক্তি ব্যয় করে টেনে টেনে উপরের তলায় উঠলাম । চামড়ার মত সেঁটে বসে যাওয়া ভেজা কাপড় খুললাম, অন্য পোশাক পরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম । কেপ মালভূমির ধূসর বালুকণা আমার পায়ের আঙ্গুলের মধ্যে মধ্যে জমে আছে । ভাবলাম, আমি আর কখনোই উষ্ণ হব না । ভারকুয়েইলের অন্তত: একটা কুকুর আছে, যার গায়ে ঠেস দিয়ে সে ঘুমোয় । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, এবং সেই শীতল শরীরের বালক, তার ক্ষেত্রে কুকুর আর কিছুই করতে পারবে না । বালি তার মুখে আগেই ঢুকে গেছে, আস্তে আস্তে সারা শরীরে উঠছে, তাকে অধিকার করে নিচ্ছে ।
ষোল বছর হয়ে গেল আমি কোনো পুরুষ বা বালকের সাথে এক বিছানায় শুইনি । ষোলবছর ধরে একা । তুমি কি আশ্চর্য হচ্ছ ?
আমি লিখতামআমি লিখি । আমি কলমকে অনুসরণ করে চলি, সে আমাকে যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাক । আমার আর কি আছে ?

আমি বিধ্বস্ত অবস্থায় উঠলাম । আবার রাত হয়ে গেছে । দিনটা তবে কোথায় গেল ? টয়লেটে আলো জ্বলছিল । সিটে বসে ভারকুয়েইল । ট্রাউজার্স হাঁটুতে নামানো, মাথায় টুপি, ভারকুয়েইল ঘুমোচ্ছিল । আমি আশ্চর্য হয়ে তাকালাম ।
সে জাগল না । যদিও তা্র মাথা একপাশে কাত, তার চোয়াল খোলা, সে একটা শিশুর মত ঘুমোচ্ছিল । তার লম্বা রোগা উরু লোমহীন ।
রান্নাঘরের দরজা খোলা, এবং আবর্জনার বালতি উপচে মেঝেয় পড়ে গড়াচ্ছিল । বাসি খাবার জড়ানো কাগজের সামনে বসে কুকুরটা যেন উদ্বিগ্ন । যখন সে আমাকে দেখল, অপরাধীর মত ভাব করে কান ঝুলিয়ে ল্যাজ নাড়াতে থাকল । বাড়াবাড়ি, এসব বড্ড বাড়াবাড়ি ।কুকুরটা বেরিয়ে গেল ।
আমি টেবিলে বসলাম, কান্নাকে আর চেপে রাখলাম না । আমার বোধবুদ্ধি তালগোল পাকাচ্ছিল, তার জন্য নয়, আমার বাড়ি চূড়ান্ত অব্যবস্থায় পড়েছিল, তার জন্যও নয়, আমি কাঁদলাম সেই ছেলেটির জন্য, ভেকির জন্য । যেদিকেই আমি ফিরি, আমার চোখের সামনে ভাসছিল তার শিশুসুলভ চোখের অবুঝ দৃষ্টি, যে দৃষ্টি নিয়েই সে মৃত্যুর সাক্ষাৎ পেয়েছিল । বাহুতে মাথা রেখে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম, ওর জন্য দুঃখ করতে করতে, যে ওর কাছ থেকে কি জিনিষ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে আমারও কি জিনিষ চলে গেছে । সে হল সব চাইতে ভাল জিনিষ, জীবন ! ঈশ্বরের কি আশ্চর্যজনক সেই ধারণা ! সব চাইতে ভাল ধারণা । ঈশ্বরের দান, সব চাইতে উদার দান, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনন্তরূপে নবীন হয় । আর এখন ভেকির কাছ থেকে সেই দান কেড়ে নিয়ে প্রজন্ম-সূত্র থেকে তাকে ছিঁড়ে ফেলা হল !
আমি বাড়ি যেতে চাই !লজ্জাকরভাবে আমি জুতোবিক্রেতা মিঃ থাবেনের কাছে এই বলে কেঁদেছিলাম । একটা বয়স্ক মানুষের কাছ থেকে শিশুর স্বর ! আমার নিরাপদ বাড়িটার আশ্রয়ে, আমার শৈশবের সুখনিদ্রার বিছানায় । আমি কি কখনো পুরোপুরি জেগেছি ? আমি হয়ত জিগ্যেস করতে পারতাম : মৃতরা কি জানে ওরা মৃত ? না : মৃতদের  তো কোনকিছু জানতে দেবার জন্য নির্ধারিত করা হয় না । কিন্তু আমাদের মৃত্যুর মত নিদ্রায় আমরা আভাস পেতে পারি । যে কোনো স্মৃতির চাইতে পুরোনো, স্থির এক আভাস আমার আছে যে আমি একদা জীবন্ত ছিলাম । জীবন্ত ছিলাম এবং আমার জীবন চুরি করে নেওয়া হয়েছিলশৈশবের দোলনা থেকেই সেই চুরি হয়েছিল । একটা শিশুকে নিয়ে গিয়ে তার জায়গায় একটা পুতুল রাখা হয়েছিল, যাকে পোষণ এবং প্রতিপালন করা হয়েছিল, আর সেই পুতুলটি হল যাকে আমি বলা হচ্ছে ।
একটা পুতুল ? একটা পুতুলের জীবন ? এই জীবনটাই কি এতকাল বেঁচে এলাম ? একটা পুতুলের কি এরকম করে ভাবতে পারার ক্ষমতা আছে ? না কি চিন্তাটা আভাসের মত আসে এবং যায়, বিদ্যুৎ-ঝলকের মত, কুহেলিজাল ভেদ করে আসা দেবদূতের বুদ্ধির তরবারির অগ্রভাগের মত ? একটি পুতুল কি আরেকটি পুতুলকে চিনতে পারে ? পুতুল কি মৃত্যুকে জানতে পারে ? না । পুতুলরা জন্মায়, তারা কথা বলতে, চলতে শেখে, তারা হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে দুনিয়াতে চলে ; তারা বুড়ো হয়, শুকিয়ে যায়, তারা নষ্ট হয়ে যায়; তাদেরকে আগুনে দেওয়া হয়, কিংবা মাটির কবরে, কিন্তু তারা মরে না । সমস্ত স্মৃতির পূর্বমুহূর্তেই যখন জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সেই মুহূর্তের শঙ্কিত বিস্ময়ে তারা বাঁচে সেই জীবন যা তাদের নয়, যার স্মারকহিসেবে তাদের ফেলে রাখা হয়েছে । তাদের জ্ঞান সারহীন, বাস্তবের ভারবর্জিত জ্ঞান, তাই পুতুলের মাথার মতই ফাঁপা, বাতাসে ভরা তারা নিজেরা শিশু নয়, কিন্তু শিশুর আদর্শ, তাই আসল শিশুদের চাইতে আরো গোলগাল, আরো গোলাপি, আরো ফাঁপা, এবং নীলচোখো ; তারা জীবন নিয়ে বাঁচে না, তাদের আছে জীবনের আদর্শ কিংবা আভাস, যা মৃত্যুহীন, যেমন অমর সব আদর্শ, সব তত্ত্ব
হেড্‌স, হেল, নরকের যে নামই হোক না কেন, নরক হল আদর্শের রাজ্য । কেন আণ্টার্কটিকার বরফের মধ্যে কিংবা আগ্নেয়গিরির গর্তের ভেতরে নরক হবে ? আফ্রিকার পাদদেশে কেন নরক হতে পারে না , আর নরকের জীবেরা কেন জীবন্ত প্রাণীদের মধ্যে বিচরণ করতে পারে না ?
শিশুটি তার বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কাতরস্বরে বলছিল, বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না আমি জ্বলছি ?” কিন্তু তার বাবা ঘুমোচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছিল, তাই দেখতে পায় নি ।
এইজন্যই---- আমি তোমার সামনে কারণটা পেশ করছি---- এইজন্যই আমি আমার মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে থাকি । তিনি যদি আমাকে জীবন না দিয়ে থাকেন, কেউ দেয় নি । আমি শুধু তাঁর স্মৃতি আঁকড়েই থাকি না, তাঁকে, তাঁর শরীরকে, এই পৃথিবীতে তাঁর শরীর থেকে আমার জন্মকে আঁকড়ে থাকি । রক্ত ও দুধের সঙ্গে আমি তাঁর শরীরকেই পান করেছি ও জীবন পেয়েছি । তারপর সেই জীবন চুরি হল, আর চিরকালের মত হারিয়ে গেল ।
আমার একটা ফোটোগ্রাফ তুমি দেখেছ, কিন্তু সম্ভবত তোমার  মনে নেই । এটা ১৯১৮তে নেওয়া হয়েছিল, যখন আমার বয়স দু বৎসরও ছিল না । আমি দাঁড়িয়েছি ; মনে হচ্ছে আমি ক্যামেরা ধরতে চাইছি ; আমার মা, আমার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার কাঁধের উপর দিয়ে কোনো কিছু দিয়ে আটকে আমাকে ধরে রাখছেন । আমার একপাশে, আমাকে গ্রাহ্য না করে আমার দাদা পল দাঁড়িয়ে, তার মাথার টুপি একপাশে হেলানো ।
আমার ভুরু কোঁচকানো, আমার চোখ উৎসুক ভাবে ক্যামেরার দিকে স্থির । আমি কি শুধু সূর্যের আলোর জন্য চোখ কুঁচকে আছি, অথবা বোর্ণিওর জংলিদের মত আমার কোনো ভাসাভাসা বোধ আছে যে ক্যামেরা আমার আত্মাকে কেড়ে নেবে ? তার চাইতেও খারাপ : আমার মা আমাকে ক্যামেরাটা মাটিতে ফেলে দেবার চেষ্টা থেকে আটকাতে চাইছেন, কারণ আমি, আমার পুতুলের জ্ঞান অনুসারে জানি যে চোখে যা দেখতে পাওয়া যায় না, ক্যামেরার চোখে তা-ই ধরা পড়বে, যে আসল আমি ওখানে নেই ? আমার মাও কি জানেন যে তিনিও ওখানে নেই ?
লিখতে লিখতে কলম আমায় মৃত পলের কাছে নিয়ে এল । সে যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখন আমি তার হাত ধরেছিলাম । তাকে ফিসফিস করে বলেছিলাম, “তুমি মাকে দেখতে পাবে, তোমরা দুজনে খুব সুখী হবে ।সে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, এমন কি তার চোখ বিবর্ণ দূর আকাশের রঙ হয়ে গিয়েছিল । সে ক্লান্ত শূন্য চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যেন এই বলতে,”তুই কত কম বুঝিস ।পল কি কখনো সত্যি বেঁচেছিল ? এক চিঠিতে ধার করা ভাষায় সে আমাকে লিখেছিল, “আমার জীবনসম বোন। শেষ মুহূর্তে কি তার মনে হয়েছিল যে সে ভুল করছে ? তার সেই অসচ্ছ দৃষ্টি কি আমার মনের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিল ?
সেই দিনে আমাদের বাগানে আমাদের ফোটো তোলা হয়েছিল । আমাদের পেছনে ফুলের বাগান ছিল, ফুলগুলো দেখতে হলিহক-এর মত লাগছিল । আমাদের বাঁদিকে তরমুজের খেত । আমি জায়গাটা চিনতে পারি । ওটা হল ইউনিয়নডেল, চার্চ স্ট্রিটের বাড়ি যেটা আমাদের দাদু কিনেছিলেন যখন উটপাখির পালকের ব্যবসা খুব লাভজনক ছিল । বছরের পর বছর বাগানটি ফুল ফল সবজিতে ভরে গিয়েছে, গাছগুলো তাদের বীজ দিয়েছে, মরে গেছে, আবার নতুন করে গজিয়েছে, তাদের ভরভরন্ত দিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করেছে । কিন্তু কারা ভালবেসে তাদের যত্ন করেছিল ? কে হলিহকগুলোকে ছেঁটে দিত ? কে তরমুজের বীজগুলোকে উষ্ণ ভেজা বীজতলায় লাগাত ? সেই ব্যক্তি কি আমার দাদু যিনি চারটেয় বরফঠান্ডা ভোরে উঠে স্লুইস গেট খুলে বাগানে জল দিতেন ? যদি তিনি না হন, তাহলে এই বাগানের আসল মালিক নিয়মমতো কে ? কারাই বা অশরীরী, কাদেরই বা  শরীরী উপস্থিতি ? ছবির বাইরে, নিড়ানির উপর ভর করে, কোদালের উপর ভর করে, আবার কাজে ফেরার জন্য অপেক্ষা করে, আয়তাকার ক্ষেত্রের ফ্রেমে ঠেসে, তাকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে, তার সীমানা ভেঙ্গে  ভেতরে ঢুকে কারা ওরা ?    Dies irae, dies illa , যখন অনুপস্থিতরা উপস্থিত, এবং উপস্থিতরাই অনুপস্থিত হবে । ছবিটা এখন আর বাগানের ফ্রেমে সেদিন কারা ছিল তাদের আর দেখায় না, কিন্তু যারা ছিল না, তাদের দেখায় । সারা দেশে অনেক বছর ধরে সুরক্ষিত স্থানে, অ্যালবামে, অন্ধকার ড্রয়ারে রাখার পর এই ছবি ও তার মত আরো হাজারো ছবি ধীরে ধীরে বয়স্ক, রূপান্তরিত হয়েছে । মেরামতি কাজে লাগে নি, অথবা ছবিগুলো আর বেশি ডেভেলপ্‌ড হয়ে গিয়েছিল যে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি---- কে জানে কি করে এমন হল----যে তারা আবার নেগেটিভে পরিণত হবে, এক নতুন ধরণের নেগেটিভ, যাতে আমরা যেন মন্ত্রসিদ্ধির জোরে দেখতে আরম্ভ করি ফ্রেমের বাইরে কারা ছিল, তাদেরও
এজন্যই কি আমার ভুরু কোঁচকানো ছিল, এজন্যই কি আমি ক্যামেরা ধরতে গিয়েছিলাম : আমি কি অস্পষ্টভাবে জানতাম যে ক্যামেরাই শত্রু, যে ক্যামেরা আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা বলবে না, বরং আমরা যে আসলে পুতুল-মানুষ, তা ঠিকঠাক বলে দেবে ? এজন্যই কি বেশি দেরি হবার আগেই আমি বাঁধন থেকে মুক্ত হবার জন্য ছটফট করছি যাতে ক্যামেরাটাকে আঘাত করব, যে-ই সেটা ধরে রাখুক না  কেন ? আর, ক্যামেরাটা কে ধরে আছে ? কার অশরীরী ছায়া সেই চষা জমির উপর দিয়ে আমার মা ও তাঁর দুই সন্তানের উপর ঝুঁকে আছে ?
কান্নার পর দুঃখ । আমি শূন্যগর্ভ, আমি খোলস মাত্র । আমাদের প্রত্যেককে ভাগ্য ঠিকঠাক রোগ দিয়ে পাঠায় । আমার রোগটা আমাকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে । আমাকে যদি কেউ খুলে ফেলত, তাহলে দেখত ঠিক পুতুলের মত ফাঁপা, একটা পুতুল যার ভেতর একটা কাঁকড়া বসে তার ঠোঁট চাটছে, হঠাৎ আলোর বন্যায় বিহ্বল ।
আমি যখন দুবছরের ছিলাম, তখন কালো বাক্স থেকে উঁকি মারা এই কাঁকড়াটাকেই কি ভবিষ্যৎ জানার মত করে দেখেছিলাম ? আমি কি আমার সকলকে এই কাঁকড়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম ? কিন্তু তারা আমাকে ধরে রাখল, তারা বোতাম টিপল, আর কাঁকড়াটা লাফিয়ে বেরিয়ে এসে আমার  মধ্যে ঢুকে গেল ।
আমার শরীরে এখন আর কোন মাংস অবশিষ্ট নেই, তাই সে আমার হাড় চেঁচে খাচ্ছে । আমার নিতম্বের অস্থিসন্ধি চাঁচছে, আমার মেরুদণ্ড খেয়ে খেয়ে এখন আমার হাঁটুতে ধরেছে । বিড়ালগুলো, সত্যি কথা বলতে কি, আমাকে কখন ভালোবাসে নি । শুধুমাত্র এই জীবটিই আমার প্রতি শেষপর্যন্ত বিশ্বস্ত । আমার পোষ্য, আমার বেদনা ।
আমি উপরের তলায় গেলাম ও টয়লেটের দরজা খুললাম । ভারকুয়েইল এখনো গভীর ঘুমে কুঁজো হয়ে আছে । আমি তাকে নাড়ালাম । মিঃ ভারকুয়েইল,” আমি ডাকলাম । একটা চোখ খুলল । এসো, শুয়ে পড়ো ।
কিন্তু সে এলো না । প্রথমটা আমি সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ শুনলাম, বুড়ো মানুষের মত একটা একটা করে পা ফেলে যাচ্ছিল । তারপর পেছনের দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল ।



কোন মন্তব্য নেই: