(লেখাটি সাময়িক প্রসঙ্গে বেরিয়েছে) |
।। আশু পাল।।
১৯৬৭ সাল। আমি ক্লাস ফাইভের ছাত্র। গেল বছর থেকেই বরাক উপত্যকায় দারুণ খাদ্য
সংকট চলছে। চালের দাম একলাফে ৪০ টাকা মণ। দশ সদস্যের পরিবারের একমাত্র রোজগেরে
বাবার কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। আমাদের
মত নিম্ন মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালি বাড়িতেও রাতে রেশনে পাওয়া আটা দিয়ে রুটি খাওয়া
বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। প্রতি শুক্রবার দুই পিরিয়ড পরেই টিফিন এক ঘণ্টার হওয়ার প্রথা ছিল নরসিং স্কুলে। টিফিনে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখি
ডি সি অফিসের সামনে এক সুদর্শন যুবক টিনের চোঙ মুখে লাগিয়ে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় শিলঙের বিমলা প্রসাদ চলিহা সরকারের ব্যর্থতা আর দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী
সরকারের উদাসীনতা নিয়ে তীব্র আক্রমণাত্মক বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর শ’ খানেক লোক
চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছেন। অন্য কিছু বুঝিনি, মনেও নেই, শুধু মনে আছে, আমি
অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আমার মত সাধারণ মানুষের বাড়িতে যে একবেলা রুটি খাওয়া চালু হয়ে
গেছে, তা তিনি জানলেন কি করে ! বাসায় গিয়ে দেখি বাবাও সেই ভদ্রলোকের বিষয়েই আলোচনা
করছেন। উনার নাম নূরুল হুদা। বাড়ি শিলচরের কাছেই বাঁশকান্দি এলাকায়। শিলচর
গভর্নমেন্ট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করার পর কলকাতার যাদবপুর থেকে
ইঞ্জিনিয়ারিং আর আইনের ডিগ্রি নিয়েও চাকরিতে নাম লেখান নি। ছাত্রাবস্থাতেই এসেছেন
বাম রাজনীতির সংস্পর্শে। এখানকার বার লাইব্রেরিতে নাম লেখালেও উনি কমিউনিস্ট দলের
সর্বক্ষণের কর্মী। বাবার কথার মধ্যে ছিল একটা অবিমিশ্র শ্রদ্ধার স্পষ্ট আভাস, যা
ধীরে ধীরে আমার মনের কোণে কোণেও ছড়িয়ে পড়েছিল সেই দিনই।
১৯৭১ সালে নরসিং স্কুলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আমার বন্ধু দুলাল মিত্র সাধারণ
সম্পাদক পদে, আমি বুক ব্যাঙ্ক সম্পাদক আর গঙ্গেশ দেব পুরকায়স্থ (বর্তমানে প্রয়াত)
সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে লড়ছি। আমাদের নেতা স্বদেশ বিশ্বাস, মণীন্দ্র সিংহ আর গোলাম
কিবরিয়ার সঙ্গে রোজই শলা-পরামর্শ হয় স্কুল নির্বাচন নিয়ে। সেই সুযোগেই একদিন আসাম
প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের অস্থায়ী অফিসে দেখা হয়ে গেল নূরুল হুদার সঙ্গে। আলাপ
পরিচয় হল। সেই প্রথম আলাপ। এর পরেই এলো বাহাত্তরের ভাষা আন্দোলন। তাঁর নেতৃত্বে
আমরা ছাত্র যুবরা লড়েছি গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণতান্ত্রিক ভাষা সার্কুলারের
বিরুদ্ধে। ওটা যে নিছক গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলার নয়, এর পিছনে যে রয়েছে
সেই সময়কার কংগ্রেসি রাজ্য সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়, বিষয়টি যে নিখাদ একটি রাজনৈতিক অভিসন্ধি, তা তিনিই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে
তখন মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। জেলার এই গ্রাম থেকে ওই গঞ্জে, এই শহর থেকে ওই
বাজারে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। সরকারি ভাবে আন্দোলনের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে দলীয়
ভাবে আন্দোলন ভাঙতে মাঠে নামে শাসক দল। তাদের কর্মীদের হাতে করিমগঞ্জে খুন হয়ে যান
ভাষা আন্দোলনের নেতা এবং কমিউনিস্ট কর্মী বাচ্চু চক্রবর্তী। আন্দোলনের বিভিন্ন
কর্মসূচীর পালে আরও জোরে হাওয়া লাগে। সারা কাছাড় জেলা
(অবিভক্ত) জুড়ে উত্তাল আন্দোলনের সামনে সে যাত্রায় পিছু হটলো শাসকগোষ্ঠী। সাধারণ
মানুষের সামনে এক গ্রহণযোগ্য সৎ, নিষ্ঠাবান নেতা হিসেবে প্রতীয়মান হলেন নূরুল
হুদা। ১৯৭৪ সালে মারা গেলেন শিলচরের সাংসদ জ্যোৎস্না চন্দ। অনুষ্ঠিত হল
উপ-নির্বাচন। সি পি আই (এম) দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি।
অন্য দুই প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের মহীতোষ পুরকায়স্থ এবং নির্দল দ্বারিকা প্রসাদ
তিওয়ারি। তখনও আমার ভোট দেওয়ার বয়স হয়নি। রাজনৈতিক জ্ঞানও প্রায় শূন্যের কোঠায়।
শুধুই ছিল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। সেই পুঁজি
নিয়েই তাঁর পক্ষে প্রচার করেছি মধ্যশহর এলাকায়। ভোট গণনা হয়েছিল সরকারি গার্লস
স্কুলে। দলের একজন কর্মী হিসেবে কাউন্টিং এজেন্টের দায়িত্ব নিয়ে আমিও গণনা-কেন্দ্রের
ভিতরে। দেড় শতাধিক পোস্টাল ব্যালট গোণার পর দেখা গেল মহীতোষ বাবু পেয়েছেন ১২৮ টি,
আর নূরুল হুদা পেয়েছেন ১৪ টি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সামান্য বিরতির সুযোগে কর্মীদের জন্য চা আনতে বাইরে যাচ্ছিলাম। এক জায়গায় জটলা
করে আছেন কয়েকজন কংগ্রেস নেতা। তাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন নূরুল হুদাও। তাঁর দিকে
তাকিয়ে যুব কংগ্রেস নেতা অরুণ দত্ত মজুমদার হেসে হেসেই বললেন, দাদা, “মর্নিং শোজ্
দ্য ডে”। তিনিও হেসে হেসেই জবাব দিলেন, অরুণ, “মেঘ দেখে কেউ করিস্নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে”। পোস্টাল ব্যালটের
ফলাফল দেখে মুষড়ে পড়া আমি তাঁর প্রত্যয় দেখে অবাক হয়েছিলাম। সত্যিই ভোট গণনা
এগোবার সাথে সাথে মেঘের আড়াল থেকে সেই সূর্য স্ব-মহিমায় প্রকাশিত হয়েছিল, ব্যাপক
ব্যবধানে জয়ী হয়ে দেশের আইনসভায় প্রবেশ করেছিলেন নূরুল হুদা। এলো জরুরি অবস্থার সেই
কালো দিনগুলি। বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনেক সেনানায়কের মত সাংসদ নূরুল হুদাকেও
গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেওয়া হল কারান্তরালে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল
পর্যন্ত চাকরির সুবাদে আমাকে মিজোরামে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়টা আর তাঁর সাথে বিশেষ
কোন যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। ইতোমধ্যে তিনিও কারামুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন রাজনীতির
আঙিনায়। ১৯৮১-৮২ থেকেই আবার তাঁর নেতৃত্বে কাজে নেমে পড়ার সুযোগ এসে যায়। তাঁরই
নির্দেশে দিনের বেলা পার্টির প্রভাবাধীন “আসাম দর্পণ” পত্রিকার সংবাদ ও প্রকাশনার
কাজে, এবং রাতের বেলা শহর ও শহরতলী জুড়ে দেওয়াল লিখনের দায়িত্ব পাই আমি। ১৯৮৫ সালে
শিলচরে অভূতপূর্ব বন্যা হয়। কমরেড গোপেন রায় তখন দলের জেলা সম্পাদক। রেল শ্রমিক
নেতা দিগেন দাশগুপ্ত ও কৃষকনেতা রুক্মিণী কুমার আচার্য সহ গোপেন দা তখন থাকেন
মালুগ্রামের শহিদ ভবনে। মালুগ্রামের রাস্তায় কোন কোন জায়গায় তখন এক বুক বন্যার জল। নূরুল দা আমাকে ডেকে বললেন, খবর পেয়েছি শহিদ ভবনে জল ঢুকে গেছে।
মালুগ্রাম অঞ্চলে লোকেরা ছাদের উপর জায়গা নিয়েছে। টেলিফোনগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে।
গোপেন দা, দিগেন দা ওরা কি করছেন, কিছুই জানতে পারছি না। তুমি লম্বা আছো, অন্যদের
বুক সমান হলে তোমার কোমর জল হবে। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের খবর নিয়ে এসো। পার্টির
বর্ষীয়ান নেতাদের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধের
পরিচয় সেদিন পেয়েছিলাম তাঁর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখের অভিব্যক্তিতে।
সততা, নিষ্ঠা আর
সময়ানুবর্তিতায় নূরুল দার জুড়ি আমি কাউকে পাইনি। নিজের কোন ভুল হয়েছে বুঝতে পারলে
জোর গলায় তা স্বীকার করতেন প্রকাশ্যে। বাংলা আর ইংরাজি বানানে ভুল একেবারেই সহ্য
করতে পারতেন না। একবার দ্রুত চোখ বোলালেও তাঁর চোখে ভুল বানানটা ধরা পড়ে যেতো। তাই
প্রায় কোন আবেদন, প্রচার পুস্তিকা, বিজ্ঞপ্তি – কোন কিছুই তাঁকে একবার না দেখিয়ে
ছাপাখানায় দেওয়া হতো না। একবার অরূপ চৌধুরির খসড়া একটি লিফলেট প্রথমে আমি তারপর
তিনি দেখে দিয়েছেন। সেখানে একটি বাক্য ছিল
এই রকম, “দেশের গরীব মেহনতি মানুষ কংগ্রেস সরকার অনুসৃত দীর্ঘ দিনের ভ্রান্ত
অর্থনীতির শিকার”। এখানে ‘শিকার’ শব্দের জায়গায় অরূপ লিখেছিল ‘স্বীকার’। আমি এবং
নূরুল দা দুজনেই এটা খেয়াল করিনি। ছাপা হয়ে আসার পর প্রথমেই তাঁর চোখ পড়ে গেল ওই
জায়গায়। তিনি উত্তেজিত। এটা একটা লিফলেট হল ? আমাকে পেয়ে গেলেন সামনে। যাকে বলে
একেবারে রাম ঝাড়ন। প্রথমে আমি চুপ থাকলেও পরে বললাম, এটার প্রুফ তো আপনিও দেখে
দিয়েছেন। আর যাই কোথায়। “হতেই পারেনা। আমি দেখলে এই ভুল থাকতেই পারেনা”। সমস্ত
ক্ষোভ তিনি ঝেড়ে দিলেন আমার উপর। টানা প্রায় পাঁচ মিনিট আমাকে বকতে থাকলেন। আমি
প্রতিবাদ করতে চেয়েও মুখ কালো করে সরে পড়লাম। পরের রোববার সকালবেলা তিনি হাজির
আমার বাসায়। আমি তো অবাক, নির্ঘাত কোন জরুরি কাজ পড়েছে, তাই সোজা বাসায় চলে
এসেছেন। বললেন, অনেকদিন তোমার বাসায় চা খাইনি, আর তোমার সাথে একটা কথাও আছে, তাই
এলাম। আমি জানি চা খাওয়ার জন্য আমার বাসায় আসার লোক তিনি নন্। কিছুক্ষণ আমার
বাবার সাথে কথাবার্তা বললেন। আমি অপেক্ষা করছি কি জানি কি কাজের কথা বলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি উঠলেন। আমাকে ডেকে বাইরে নিয়ে এলেন। বললেন, সেদিন আমার মাথাটা খুব বেশী গরম হয়ে গিয়েছিল, তাই তোমাকে যথেচ্ছ বকে দিয়েছি।
পরে মনে পড়েছে, সত্যিই তো, লেখাটা তো আমিও দেখে দিয়েছিলাম। যে কোন কারণেই হোক
ভুলটা তো আমারও চোখে পড়েনি। শুধু শুধু তোমায় বকে দিলাম। মনে কিছু নিওনা। আমি কুঁকড়ে গিয়ে বললাম, ওসব ছাড়ুন, আমি ও কথা ভুলেই গেছি। কি কাজের জন্য
এসেছেন, সেটা বলুন। জবাব দিলেন, অন্য কোন কাজ নয়, আমার সেদিনের কথার জন্য অনুতাপ
প্রকাশের জন্যই আজ এসেছি। তাঁর এই মহানতায় আমার চোখ ফেটে জল এলো। এই হলেন নূরুল
হুদা।
আজ বরাকের রাজনীতিতে উগ্র ধর্মান্ধতার
দপদপানি। নির্বাচন প্রার্থীর যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশী প্রাধান্য পায় তার ধর্মীয়
পরিচয়। নূরুল দার জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে এই বিষফল কিন্তু বরাকে আমদানি করেছিল
কংগ্রেস নিজেই। রশিদা হক চৌধুরির বিরুদ্ধে তিনি যখন লড়াই করেছিলেন, তখন এই প্রশ্ন
আসেনি। কিন্তু পরের নির্বাচনে যেই কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন একজন ‘হিন্দু’, অমনি
গ্রামে-শহরে প্রচার শুরু হয়ে গেল, নূরুল হুদা মুসলমান। তাঁর হাতে রাখা ডায়েরির
ভিতরে রাখা থাকে একটা ‘তকি’। মুসলমান গ্রামে ঢোকার আগেই তিনি সেটা খুলে মাথায় পরে
নেন। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। কাজেই হিন্দুদের উচিৎ একজন ‘হিন্দু’ প্রার্থীকে
ভোট দিয়ে জয়ী করা। ...... আজ ভাবতেও কষ্ট হয়, একজন সত্যিকারের সংগ্রামী মানুষকে
নির্বাচনে হারানোর জন্য কত নীচেই না নেমেছিল ওই দল। সেই একই অস্ত্রে সেই দল, সেই
প্রার্থী নিজেই পরবর্তীতে ঘায়েল হয়ে পরাজয়ের মুখ দেখেছেন।
সি পি আই (এম) নেতা কমরেড এম
বাসবপুন্নাইয়ার মৃত্যুর পর শিলচর আর ডি আই হলে আয়োজিত এক শোকসভায় বক্তব্য রাখতে
গিয়ে আমার দেখা আরেকজন শ্রেষ্ঠ কমিউনিস্ট নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “এক
শ্রেণীহীন সমাজ ও দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সচেতন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছি
এই আদর্শের বাস্তবায়নে। উদ্দাম যৌবনে ভাবতাম, এই জীবনেই দেখে যাবো সাম্যবাদী সমাজ
ব্যবস্থা। আজ যাবার সময় হয়ে এলো আমাদেরও, এখন দেখছি, আমরা কেন, আপনারাও কেউ হয়তো
দেখে যেতে পারবেন না ওই স্বপ্নের দেশ। তবে জানবেন, এটাই পথ। অন্যগুলো সব
ভুলভুলাইয়া। এ পথ থেকে কেউ বিপথগামী হবেন না। আজ না হোক কাল, সাম্যবাদের জয়
সুনিশ্চিত”। কমরেড বীরেশ মিশ্র, অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, নন্দেশ্বর তালুকদার, গোপেন
রায়, দিগেন দাশগুপ্ত, রুক্মিণী আচার্য এবং অবশ্যই কমরেড নূরুল হুদা হেঁটে গেছেন ওই
পথে। আদর্শের জন্য তাঁদের এই আত্মত্যাগ কখনোই বিফলে যাবেনা, যেতে পারেনা। এই
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে বাতিঘর হয়ে তাঁরা আমাদের পথ দেখাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন