(দক্ষিণ আফ্রিকীয়
লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের বাংলা
অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের ১ম ভাগ:
-- শিবানী দে)
গতরাতের শেষদিকে একটা টেলিফোন এল । একটি মহিলা, ভারি শ্বাস ফেলার শব্দে মনে হল বেশ মোটা
সোটা, ওধার
থেকে বলল, “আমি
ফ্লোরেন্সের সঙ্গে কথা বলতে চাই ।”
“সে
তো ঘুমোচ্ছে । সবাই
ঘুমোচ্ছে ।”
“হ্যাঁ, তবুও ওকে ডেকে দিতে পারেন ।”
বৃষ্টি পড়ছিল, যদিও তেমন বেশি নয় । আমি ফ্লোরেন্সের
দরজায় টোকা দিলাম । সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল,
যেন সে ডাকার অপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছিল । তার
পেছন থেকে ঘুমন্ত শিশুর গোঙানি শোনা গেল। আমি বললাম,
“তোমার ফোন ।”
পাঁচ মিনিট পরে সে আমার ঘরে এল । চশমা
ছাড়া, খোলা
মাথা,
রাতপোশাক পরা, ফ্লোরেন্সকে
বেশ কমবয়সী দেখাচ্ছিল ।
“ঝামেলা
হচ্ছে,” সে
বলল ।
“ভেকি
কি ?”
“হ্যাঁ, আমাকে যেতে হবে । ”
“সে
কোথায় ?”
“প্রথমে
আমি গুগুলেতু যাব, তারপরে
সাইট সি-তে যেতে হবে ।”
“সাইট
সি কোথায় তাতো আমি জানিনা ।”
সে আমার দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে
দেখল ।
“আসলে
আমি বলতে চাইছি, আমাকে
যদি কেউ রাস্তা দেখিয়ে দেয়,
আমি গাড়ি করে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি ।”
“হ্যাঁ,” সে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল, “কিন্তু আমি তো বাচ্চাগুলোকে একা ফেলে
যেতে পারি না ।”
“তাহলে
ওদেরও নিয়ে যেতে হবে ।”
“হ্যাঁ,” সে বলল । আমি তাকে এতটা দ্বিধাগ্রস্ত
কখনো দেখিনি ।
আমি বললাম, “আর মিঃ ভারকুয়েইল, গাড়ি চালাতে সাহায্য করতে তাকেও আসতে
হবে ।”
সে মাথা নাড়ল ।
আমি জোর দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ,
তাকে আসতেই হবে ।”
কুকুরটা ভারকুয়েইলের পাশে শুয়েছিল । আমি
যখন গেলাম, সে
মেঝেতে আস্তে আস্তে লেজ ঠুকছিল, কিন্তু
উঠল না ।
আমি জোরগলায় ডাকলাম, “মিঃ ভারকুয়েইল !” সে চোখ খুলল ; আমি লাইট সরিয়ে ধরলাম । সে হাই তুলল ।
আমি বললাম, “আমাকে
ফ্লোরেন্সকে নিয়ে গুগুলেতু যেতে হবে । খুব জরুরি,
আমাকে এক্ষুনি রওয়ানা দিতে হবে । তুমি কি আসবে ?”
সে জবাব দিল না, কিন্তু একপাশে কাত হয়ে শুল । কুকুরটা
পাশ ফিরল ।
আমি লাইটটা ওর দিকে ধরে ডাকলাম, “মিঃ ভারকুয়েইল !”
সে বিড়বিড় করে অশ্রাব্য একটা গালি দিল ।
আমি ফ্লোরেন্সের কাছে গিয়ে বললাম, “ওকে জাগাতে পারলাম না । গাড়িটাকে তো
কাউকে ধাক্কা দিতে হবে ।”
সে বলল,
“আমিই ঠেলব ।”
পেছনের সিটে বাচ্চাদুটোকে ভাল করে ঢেকে
শুইয়ে দেওয়া হল,
ফ্লোরেন্স গাড়িটা ঠেলল । আমরা রওয়ানা হলাম । গাড়ির কাচ আমাদের শ্বাসের বাষ্পে
ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল, আমি
তার মধ্য দিয়ে কোনোরকমে দেখে আস্তে চালিয়ে দা ওয়াল ড্রাইভ-এর উপর উঠলাম, ক্লেয়ারমন্টের রাস্তা ভুল করে খানিকটা
এদিক ওদিক চালিয়ে ল্যান্সডাউন রোড খুঁজে পেলাম । ততক্ষণে দিনের প্রথম বাস রাস্তায়
বেরিয়ে গেছে, সেগুলো
ফাঁকা,
ভেতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে । তখন পাঁচটা বাজে নি।
আমরা শেষ বাড়িগুলো ছাড়ালাম, শেষ স্ট্রিট লাইট পেরোলাম ।
উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা অনবরত বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির হেডলাইটের হলদে আলো অনুসরণ
করে চলতে থাকলাম ।
ফ্লোরেন্স আমাকে বলল, “যদি লোকে হাত দেখিয়ে আপনাকে থামতে বলে, অথবা যদি আপনি তেমন কিছু দেখতে পান, থামবেন না, চালাতে থাকবেন।”
আমি বললাম, “নিশ্চয়ই থামব না । তুমি আমাকে আগে থেকে
সাবধান করোনি কেন ? একটা
কথা স্পষ্ট করে শুনে রাখো ফ্লোরেন্স । গণ্ডগোলের কোনো লক্ষণ দেখলেই কিন্তু আমি
ফিরে আসব ।”
“আমি
বলছি না যে গণ্ডগোল হবেই । আমি শুধু বলে রাখছি ।”
মনে সন্দেহ নিয়ে আমি অন্ধকারে গাড়ি
চালাতে থাকলাম । কিন্তু কেউ আটকাল না,
কেউ হাত নাড়ল না,
রাস্তায় কোনো ঝামেলা হল না । ঝামেলা, মনে হয় তখনো শুয়েছিল । ঝামেলা, পরের বার পাকিয়ে ওঠার জন্য শক্তিসঞ্চয়
করছিল । সাধারণত: এই ভোরবেলা রাস্তার কিনার দিয়ে হাজার হাজার লোক কাজে যাবার উদ্দেশ্যে
চলতে থাকে ; আজকে
নেই । কুয়াসার কুণ্ডলী ভেসে এসে আমার গাড়িকে জড়িয়ে পেরিয়ে গেল । প্রেত, অশরীরী যেন, প্রেতলোক এই জায়গা, পক্ষীহীন । আমার শরীর শিউরে উঠল, ফ্লোরেন্সের চোখে চোখ পড়ল । জিগ্যেস
করলাম, “আর
কতদূর ?”
“বেশি
নয় ।”
“টেলিফোনে
ওরা কি বলেছিল ?”
“কালকে
আবার গুলিগোলা চলেছে । ওরা উইট্ডয়েক্*দের বন্দুক দিয়েছিল এবং উইট্ডয়েক্রা গুলি
করেছিল ।”
“ওরা
কি গুগুলেতুতে গুলি করেছে ?”
“না, ওরা ঝোপঝাড়ের দিকে করছে ।”
“ফ্লোরেন্স, দেখ,
গণ্ডগোলের কোনো উপক্রম দেখলেই আমি ফিরব । আমরা শুধু ভেকিকে
নিতে এসেছি, এটাই
আমরা করব, তারপর
বাড়ি যাব । তোমার ওকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত হয়নি ।”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে এখানে গাড়ি ঘোরাতে হবে, বাঁদিকে ঘোরাতে হবে ।”
গাড়ি ঘোরালাম । একশ মিটার দূরে রাস্তা
বন্ধ করা ছিল । সেখানে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছিল । ব্যারিয়ারের দুধারে গাড়িগুলো
দাঁড়িয়েছিল, আর
ছিল বন্দুকধারী পুলিশ । আমি থামলাম । একজন পুলিশকর্মী এগিয়ে এল ।
“এখানে
আপনার কি কাজ ?” সে
জিগ্যেস করল ।
“আমি
আমার পরিচারিকাকে বাড়ি পৌছে দিতে এসেছি ।”
শান্তভাবে মিথ্যা কথাটা বলতে পেরে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম ।
সে উঁকি মেরে দেখল পেছনের সিটে
বাচ্চাগুলো ঘুমোচ্ছে । “সে
কোথায়
থাকে ?”
ফ্লোরেন্স বলল, “সাতান্ন নম্বর রাস্তায় ।”
“আপনি
তাকে এখানে ছেড়ে দিতে পারেন । বেশি দূরে নয়,
সে হেঁটে যেতে পারে ।”
আমি দৃঢ়ভাবে বললাম, “এখন বৃষ্টি পড়ছে । ওর বাচ্চাদুটো ছোট
ছোট । আমি ওকে এভাবে ছেড়ে দেব না ।”
পুলিশের লোকটি একটু ইতস্তত করল, তারপর তার হাতের ফ্ল্যাশলাইট দুলিয়ে
আমাকে যেতে দিল । একটা গাড়ির মাথায় একজন যুদ্ধের পোশাকপরা যুবক দাঁড়িয়ে, তার হাতে উদ্যত বন্দুক, অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে ।
এতক্ষণ বাতাসে একটা পোড়াপোড়া
ভাসছিল----ভিজে ছাই, পোড়া
টায়ার । আস্তে
আস্তে গাড়ি চালিয়ে আমরা একটা চওড়া কিন্তু কাঁচা রাস্তায় ঢুকলাম, দুধারে ম্যাচবক্সের মত বাড়ি । তারের জাল
দিয়ে ঢাকা একটা পুলিশের গাড়ি আমাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল । “ডানদিকে ঘোরান,” ফ্লোরেন্স বলল । “আবার ডানদিকে, এখানে থামান ।”
ছোট শিশুটিকে কোলে নিয়ে, আধঘুমন্ত ছোট মেয়েটাকে টেনে টেনে, সে কাদাজলের মধ্য দিয়ে ছপ ছপ করতে করতে
২১৯ নং বাড়িতে টোকা দিল, তারপর
ঢুকল । হোপ ও বিউটি, আশা
ও সৌন্দর্য, যেন
রূপকের সাথে জীবন যাপন । ইঞ্জিন চালু রেখে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম ।
পুলিশ ভ্যান যেটা আমাদের পাশ কাটিয়ে
গিয়েছিল, কাছে
এসে দাঁড়াল । আমার মুখে আলো ফেলল । আমি হাত দিয়ে চোখের উপর আলো আড়াল করলাম ।
ভ্যানটা চলে গেল ।
ফ্লোরেন্স তার ও কোলের বাচ্চাটার উপর
একটা প্লাস্টিকের বর্ষাতি চাপিয়ে বেরিয়ে এল,
গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসল । তার পেছন পেছন বৃষ্টির মধ্য দিয়ে
প্রায় দৌড়ে এল---- না, ভেকি
নয়, অন্য
একজন লোক, বয়স
তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, রোগা
গড়ন, চালাক
চতুর চেহারা, গোঁফ
আছে । লোকটা আমার পাশে বসল । ফ্লোরেন্স পরিচয় করিয়ে দিল, “এ হল আমার কাজিন মিঃ থাবেন, এ আমাদের রাস্তা দেখাবে ।”
আমি জিগ্যেস করলাম, “হোপ কোথায় ?”
“তাকে
আমার দিদির কাছে রেখে এসেছি ।”
“আর
ভেকি কোথায় ?”
জবাব নেই । লোকটা বলল, “আমি ঠিক জা্নিনা ।” তার গলার স্বস্বস্বর আশ্চর্যজনকভাবে নম্র । “সে কালকে সকালে এসে তার জিনিষপত্র রেখে
বেরিয়ে গেছে । তারপর থেকে তাকে আমরা আর দেখিনি । সে রাত্রে ঘুমোতেও আসেনি । কিন্তু
আমি জানি তার বন্ধুরা কোথায় থাকে । আমরা সেখানে দেখতে পারি ।”
আমি জিগ্যেস করলাম, “ফ্লোরেন্স, তুমিও কি তাই চাও ?”
ফ্লোরেন্স বলল, “আমাদের তো তাকে খুঁজতেই হবে । এ ছাড়া
আমি আর কি করতে পারি ?”
লোকটা বলল,“আপনি যদি চান, তাহলে গাড়িটা আমিই চালাতে পারি । মনে হয়
তাহলেই ভাল হবে ।”
আমি উঠে গিয়ে পেছনের সিটে ফ্লোরেন্সের
পাশে বসলাম । বৃষ্টিটা এখন আরো জোরে পড়তে থাকল । উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে জল ছিটিয়ে
গাড়ি চলল । ডাইনে বাঁয়ে রাস্তার রোগাটে কমলা আলোয় আমরা মোড় ঘুরলাম, তারপর থামলাম । “সাবধান,
গাড়িটা সুইচঅফ করোনা ,” আমি
মিঃ থাবেনকে বললাম ।
সে গাড়ি থেকে নেমে একটা জানালায় নক করল
। দীর্ঘ কথোপকথন চলল একজনের সঙ্গে যার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না । সে যখন ফিরে
গাড়িতে এল, তখন
ভিজে একসা, এবং
ঠাণ্ডা । ঠাণ্ডায় অবশ হাতে সে একটা সিগারেট প্যাকেট বের করে ধরাতে চেষ্টা করল ।
আমি বললাম, “দয়া
করে গাড়ির ভেতরে ধূমপান করোনা ।” তার
ও ফ্লোরেন্সের মধ্যে একটা ক্রোধ ও হতাশার দৃষ্টি বিনিময় হল ।
আমরা চুপচাপ বসেছিলাম । আমি জিগ্যেস
করলাম, “আমরা কিজন্য অপেক্ষা করছি ?”
“ওরা
আমাদের রাস্তা দেখানোর জন্য কাউকে পাঠাচ্ছে ।”
নিজের সাইজের চেয়ে বড় বাঁদুরে টুপি পরা
একটা ছোট ছেলে লাফাতে লাফাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল । অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে
সে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর
গাড়িতে বসে পথনির্দেশ দিতে থাকল । বড়জোর বছরদশেক বয়স হবে, এই সময়কার ছেলে, আশেপাশে হিংসা দেখে অভ্যস্ত । আমার
নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়লে মনে আসে রোদঝলমলে বিকেলবেলা, রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ইউক্যালিপ্টাসের
পাশ দিয়ে যেতে যেতে ধুলোর গন্ধ নাকে আসা,
রাস্তার কিনারে নালায় কলকল করে প্রবাহিত জল, ঘুঘুপাখির শান্ত কূজন । ঘুমের শৈশব, নিরুদ্বিগ্ন জীবন নিয়ে মসৃণ পথে
নির্বাণের দিকে এগিয়ে যাবার মুখবন্ধ । আমরা যারা সেই চলে
যাওয়া যুগের সন্তান,আমাদের
কি সেই ঈপ্সিত নির্বাণের পথে যেতে দেওয়া হবে ?
আমার সন্দেহ হয় । যদি ন্যায়ের রাজত্ব চলে, তাহলে পরলোকের দ্বারদেশেই আমাদের যাত্রা
রুদ্ধ করে দেওয়া হবে । সাদা কাপড়ে বাঁধা অনেকগুলো সাদা লার্ভার মত আমাদেরকে বের
করে দেওয়া হবে সেইসব শিশু আত্মার সঙ্গে যাবার জন্য,
যাদের অহর্নিশ ঘ্যান্ঘ্যান শুনে ঈনিয়াস* দুঃখের কান্না বলে
ভুল করেছিলেন । সাদা আমাদের বর্ণ, ত্রিশঙ্কু
জগতের বর্ণ : সাদা বালি, সাদা
পাথর, চারদিক
থেকে আসা সাদা আলো । এক অন্তহীন রবিবারে নিজের মতই হাজার হাজার অলস, আধঘুমন্ত লোকেদের মধ্যে অনন্তকাল ধরে
বেলাভূমির উপর শুয়ে থাকা, কানের
কাছে ঢেউয়ের কলকল ধ্বনি । না মৃত্যু,
না জীবনের দ্বারে । সাগরের দ্বারা ঠেলে দেওয়া, সৈকতের বালুকাতে আটকে যাওয়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দ্বিধাগ্রস্ত, কর্মচঞ্চলতায় উষ্ণ বা মৃত্যুতে শীতল----
কোনোটাই না, মাছও
না, মুরগিও
না ।
আমরা শেষ বাড়িগুলো পেরোলাম, ভোরবেলার ধূসর আলোয় পোড়া মাটির উপর দিয়ে, আগুনের শিখায় কালো আধপোড়া গাছের পাশ
দিয়ে যাচ্ছিলাম । একটা পিক-আপ ট্রাক আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল, গাড়িটার তেরপল ঢাকা পেছনে তিনজন লোক ।
পরের ব্যারিকেডেও আমরা ওদের আবার দেখতে পেলাম । আমরা যতক্ষণ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা
করছিলাম, ওরা
অভিব্যক্তিহীন চোখে আমাদের দেখছিল । একজন পুলিশকর্মী ওদের আগে হাত নেড়ে ছেড়ে দিল, তারপর আমাদেরও ।
আমরা পাহাড়ের থেকে দূরে উত্তরের দিকে
এগোলাম, তারপর
বড় রাস্তা ছেড়ে একটা মাটির রাস্তা ধরলাম,
যেটা আস্তে আস্তে বালিময় হয়ে গেল । মিঃ
থাবেন থামল । সে বলল, “আমরা
আর আগে যেতে পারব না, এখন
খুবই বিপজ্জনক ।” ড্যাশবোর্ডে
লাল লাইট জ্বলছে, সেদিকে
দেখিয়ে সে বলল,
“আপনার
গাড়ির অল্টারনেটরের কিছু খারাপ আছে ।”
আমি বললাম, “আমি সব কিছুই খারাপ হতে দিচ্ছি ।” আর ব্যাখ্যা করলাম না ।
সে ইঞ্জিন বন্ধ করল । কিছু সময় আমরা
গাড়ির
ছাদে বৃষ্টির শব্দ শুনতে থাকলাম । তারপর ফ্লোরেন্স বেরিয়ে পড়ল, সঙ্গে ছেলেটা । বাচ্চাটা ফ্লোরেন্সের
পিঠে বাঁধা, শান্তভাবে
ঘুমোচ্ছে । মিঃ থাবেন আমাকে বলল, “আপনি
গাড়ির দরজা বন্ধ করে রাখলে ভাল হবে ।”
“কতক্ষণ
লাগবে ?”
“তা
তো বলতে পারব না, কিন্তু
তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করব ।”
আমি মাথা নাড়লাম । বললাম, “আমি এখানে থাকছি না ।” আমার টুপি, ছাতা,
কিছুই ছিল না । বৃষ্টি আমার মুখে মারছিল । আমার চুল মাথার
চামড়ার সঙ্গে চেপ্টে গিয়ে ঘাড় বেয়ে পড়ছিল । আমি ভাবলাম, এইভাবে বাইরে ঘুরলে মরবার মত ঠাণ্ডা
লেগে যেতে পারে । আমাদের পথপ্রদর্শক বালকটি এরই মধ্যে এগিয়ে গেছে ।
মিঃ থাবেন আমাকে প্লাস্টিক বর্ষাতিটা
এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি
এটা মাথার উপর দিন ।”
আমি বললাম, “দরকার নেই। একটু আধটু বৃষ্টি আমি সইতে
পারি ।”
সে জোর করে বলল, “তবুও,
এটা আপনার গায়ে দিন ।”
আমি বুঝলাম । সে বলল,
“আসুন ।” আমি
তাকে অনুসরণ করলাম ।
আমাদের চারপাশে পোড়ো জমি, তাতে বালিয়াড়ি, পোর্ট জ্যাক্সন উইলো গাছ, আর ময়লা ও ছাইয়ের গন্ধ । প্লাস্টিকের
টুকরো, পুরনো
লোহা, কাচ
ও জন্তুর হাড়গোড় রাস্তার আশেপাশে ছড়ানো । আমি এরই মধ্যে ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম, কিন্তু যখন দ্রুত চলবার চেষ্টা করলাম,আমার হৃদপিণ্ড বিচ্ছিরিভাবে ধুপধুপ করতে
লাগল । আমি পিছোতে থাকলাম । ফ্লোরেন্স কি দাঁড়াবে ?
না । মাতৃহৃদয়----যে শক্তি কোনো অবস্থাতেই থামবে না ।
এক জায়গায় রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে, সেখানে মিঃ থাবেন অপেক্ষা করছিল । আমি
হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “ধন্যবাদ, তুমি দয়া করে দাঁড়ালে । আমি দুঃখিত যে
তোমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম। আমার পাছায় বড্ড ব্যথা ।”
সে বলল,
“আমার হাত ধর ।”
মানুষ আমাদের পেরিয়ে যাচ্ছিল, কালো,
দাঁড়িওলা, শক্তমুখ, হাতে লাঠি, পরপর সার দিয়ে দ্রুত চলছিল । মিঃ থাবেন
রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াল । আমি তাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়ালাম ।
রাস্তাটা একটু চওড়া হল, তারপর একটা বিস্তৃত পুকুরের মধ্যে শেষ
হল । পুকুরের অন্যধারে বস্তি শুরু হয়েছে,
সবচাইতে নিচু জায়গার ঘরগুলোতে বৃষ্টির জল ঢুকে গেছে । কিছু
কিছু ঘর শক্তপোক্ত করে কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি ,
বাকিগুলো ডালপালার কাঠামোর উপর প্লাস্টিকের চাদর বিছিয়ে কোনোরকমে বানানো, উত্তরের বালিয়াড়ির উপর দিয়ে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে ।
পুকুরের
পাড়ে এসে আমি ইতস্তত করছিলাম । মিঃ থাবেন বলল,
“এসো ।” তাকে
ধরে আমি পা বাড়ালাম, গোড়ালি
ডোবা জলের মধ্য দিয়ে ছপছপিয়ে চললাম । আমার একপাটি জুতো কাদায় আটকে গেল । সে সাবধান
করল, “ভাঙ্গা
কাচ থেকে সাবধান ।” আমি
জুতোটা তুললাম ।
একটা দরজার পাশে ঝুলে যাওয়া মুখের এক
বুড়ি ছাড়া কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছিল না । কিন্তু আমরা যত এগোচ্ছিলাম, তত কোলাহল শুনতে পাচ্ছিলাম । হঠাৎ
করে যে আওয়াজ বাতাস ও বৃষ্টির মনে হতে পারে,
সেই শব্দ ধীরে ধীরে চিৎকার,
কান্না, ডাকাডাকিতে
পরিণত হতে লাগল । সেই শব্দ মাটিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে হাওয়ার সঙ্গে ধাক্কা খেল, আমার মনে হল আমি যেন দীর্ঘশ্বাস শুনতে
পাচ্ছি , গভীর
দীর্ঘশ্বাস, তার
পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যেন
বিশাল পৃথিবী নিজে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে ।
সেই সময়ে আমাদের পথপ্রদর্শক ছোট ছেলেটা
আমাদের সঙ্গে চলে এলো, মিঃ
থাবেনের হাত ধরে উত্তেজিত হয়ে কিছু কথা বলছিল । ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল ।
আমি তাদের পেছনপেছন বালিয়াড়ির পাশ দিয়ে
কোনো রকমে চলতে থাকলাম ।
আমরা এসে পৌছুলাম কয়েকশ মানুষের ভিড়ের
সীমায় ; জনতা
কিছু একটা ধ্বংসকার্য প্রত্যক্ষ করছিল । বস্তির ঝুপড়িগুলো ভেঙ্গে জ্বালিয়ে দেওয়া
হয়েছে,
গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে । আসবাবপত্র,
বিছানা, ঘরের
ব্যবহারের জিনিষ, ডাঁই
হয়ে বৃষ্টির মধ্যে ভিজছে । দলে দলে লোক পোড়া ঝুপড়ির মধ্য থেকে কিছু কিছু জিনিষ বের
করবার চেষ্টা করছিল, একটা
ঝুপড়ি থেকে অন্য ঝুপড়ির পাশে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিল, অথবা আমারই এরকম মনে হচ্ছিল । কিন্তু
একটু পরে আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে ওরা উদ্ধারকারী নয়, বরং ধ্বংসকারী, যারা বৃষ্টির মধ্যে যা যা পুড়ে যায়নি, সেই সব জিনিষ খুঁজে খুঁজে পোড়াচ্ছিল।
বালিয়াড়ির এই বিশাল নাট্যশালার প্রান্তে
যেসব মানুষ দাঁড়িয়েছিল,
তাদেরই দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল । শ্মশানের শোকযাত্রীদের মত তারা ধারাপাতের মধ্যে
দাঁড়িয়েছিল, পুরুষ, নারী,
শিশু, ভিজে
একসা, কিন্তু
বৃষ্টির ত্থেকে নিজেদের রক্ষা করবার ইচ্ছেটাই যেন নেই । তারা ধ্বংসলীলা দেখছিল ।
কালো ওভারকোট পরা একটা লোক একটা কুঠার
ছুড়ল । ঝনঝন শব্দে একটা জানালা ভেঙ্গে পড়ল । সে দরজা আক্রমণ করল, তিনবারের চেষ্টায় দরজা ভেঙ্গে গেল ।
খাঁচা থেকে মুক্ত জানোয়ারের মত এক মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো, পেছন পেছন তিনটে খালিপায়ে বাচ্চা ।
লোকটা তাদের যেতে দিল। তারপর সে দরজার ফ্রেম ভাংতে শুরু করল । সমস্ত কাঠামোটাই
মচমচ করে উঠল ।
তার এক শাগরেদ একটা জেরিক্যান নিয়ে
ভেতরে গেল । স্ত্রীলোকটি দৌড়ে তার পিছন পিছন গেল,
কিছু বিছানার চাদর নিয়ে বেরিয়ে এল । তারপর দ্বিতীয়বার যখন সে
ঢুকতে গেল, তারা
তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ।
আবার ভিড়ের মধ্য থেকে দীর্ঘশ্বাস পড়ল ।
ঝুপড়িটার মধ্য থেকে ধোঁয়া বেরোতে আরম্ভ হল । স্ত্রীলোকটি উঠল, ভেতরে যেতে চাইল, কিন্তু আবারও তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে
দেওয়া হল ।
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একটা পাথর ছুঁড়ল, সেটা পুড়তে থাকা ঝুপড়ির মাথায় থাকা
টিনের চালে কটকট শব্দে পড়ল । আরেকটা পাথর পড়ল ঝুপড়ির দেওয়ালে, আরেকটা কুঠারধারীর পায়ের কাছে । সে
একটা ভয়ানক চিৎকার করে উঠল । সে ও তার আধডজন সাঙ্গোপাঙ্গ তাদের কাজে একটু থামল ।
তারপর লাঠিসোটা উঁচিয়ে ভিড়ের দিকে এগোল । চিৎকার করে ভিড়ের লোক পালাতে থাকল, আমিও তাদের সঙ্গে । কিন্তু বালিতে
বারেবারে পা আটকে পা তুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল । আমার হৃদপিণ্ড ধুকধুক করছিল, বুকে ব্যথাবোধ করছিলাম, একটু থামলাম, শ্বাস নিতে নিচু হলাম । ভাবলাম, আমারও কি এসব হতে পারে ? আমি এখানে কি করছি ? আমার ছোট সবুজ গাড়িটা রাস্তার পাশে
চুপচাপ অপেক্ষা করছে, তাকে
মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম । সেই মুহূর্তে যা আমার সব চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ছিল, তা হল কখন গাড়িতে উঠব, দরজাটা বন্ধ করব, আর এই ক্রোধ ও হিংসার জগৎ ছাড়িয়ে চলে
যাব ।
একটা অত্যন্ত স্থুলবপু কিশোরী যেতে যেতে
আমাকে কাঁধে ধাক্কা দিল, আমি
পড়ে যেতে যেতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
“জাহান্নামে যা ।”
সেও জবাব দিল,
“তুই
জাহান্নামে যা ।” তার
চোখে নগ্ন ক্রোধ জ্বলজ্বল করছিল ।“সরে
যা, সরে
যা,”
বলতে বলতে সে বালিয়াড়ির পাশ দিয়ে তার বিশাল পাছাটা দোলাতে দোলাতে থপথপিয়ে চলল ।
আমি ভাবলাম, আরেকটা এই রকম ধাক্কা, মুখ থুবড়ে বালিতে পড়া, তাহলে তো আমার হয়ে যাবে । এই লোকগুলো
অনেক ধাক্কা অনেক আঘাত সইতে পারে, কিন্তু
আমি তো একটা প্রজাপতির মত ভঙ্গুর।
অনেকগুলো পা আমার পাশ দিয়ে মচমচ করতে
করতে চলে গেল । আমি একটা বাদামি জুতো দেখতে পেলাম,
সেটার জিভ ঝুলছে,
জুতোর সোল তার দিয়ে বাঁধা । যে আঘাত আমি আশঙ্কা করছিলাম, তা আমার উপরে পড়ল না ।
আমি উঠলাম, আমার বাঁদিকে একটা ছোটখাট লড়াই চলছিল; একমিনিট আগে যেসব লোক ঝোপঝাড়ে পালিয়েছিল, তারা হঠাৎ করে বেরিয়ে আসছিল । একজন
মহিলা উচ্চস্বস্বরে কঁকিয়ে কেঁদে উঠল । এই ভয়ঙ্কর জায়গা থেকে
আমি কি করে বেরোব ? যে
পুকুরের মাঝ দিয়ে আমি এসেছিলাম,
সেটা কোথায়, গাড়ি
পর্যন্ত পৌঁছোবার রাস্তাই বা কোথায় ?
এখন তো দেখছি সব জায়গাতেই পুকুর,
হ্রদ, জমা
জল; রাস্তাও
দেখছি অনেক, সেগুলো
কোথায় নিয়ে যায় ?
স্পষ্টভাবে আমি বন্দুকের আওয়াজ শুনলাম, এক,
দুই, তিনবার
গুলির আওয়াজ । কাছে নয়, কিন্তু
খুব দূরেও নয় ।
“চলে
এসো,” একজন
মানুষের স্বর, আর
মিঃ থাবেন আমার পাশ দিয়ে এগোল । “হ্যাঁ,” আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম এবং
কৃতজ্ঞভাবে তাকে অনুসরণ করলাম । কিন্তু আমি তাল মেলাতে পারছিলাম না । “দয়া করে একটু আস্তে চলো,” তাকে ডাকলাম । সে অপেক্ষা করল; সে ও আমি একসঙ্গে জলাটা পেরিয়ে রাস্তায়
পৌঁছলাম ।
একজন অল্পবয়সী তরুণ, তার চোখ লাল, আমাদের কাছে এল । কর্তৃত্বের সুরে
জিগ্যেস করল, “তোমরা
কোথায় যাচ্ছ ?” কঠিন
প্রশ্ন, কঠিন
স্বর ।
“আমি
চলে যাচ্ছি, এখান
থেকে যাচ্ছি, এখানে
আমি বেমানান,”
আমি জবাব দিলাম ।
“আমরা
গাড়ি আনতে যাচ্ছি,” মিঃ
থাবেন বলল ।
“আমরা
তোমাদের গাড়িটা ব্যবহার করব ,” ছেলেটা
বলল ।
“আমার
গাড়ি আমি কাউকে দিচ্ছি না,” আমি
বললাম ।
মিঃ থাবেন বলল, “ইনি ভেকির বন্ধু ।”
“আমি
কেয়ার করি না, আমি
আমার গাড়ি ওকে দেব না ।”
যুবকটা----এখনো যুবক হয় নি, আসলে
একটা ছেলে বড়দের মত পোশাক পরা, বড়দের
মত আচরণ----অদ্ভুত ভঙ্গি করল : এক হাত মাথার সমান উঁচু করে অন্য হাত দিয়ে সেই হাতের
তেলোতে আঘাত করল, দৃষ্টিতেও
যেন আঘাত । এর মানে কি ? এর
কি কিছু অর্থ আছে ?
হাঁটার ফলে আমার পিঠে ভীষণ ব্যথা হচ্ছিল
। আমি ধীরে ধীরে চলতে চলতে একেবারে থামলাম । “আমাকে
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে,” বললাম
। এটা যেন একটা অনুরোধ, নিজের
স্বর কাঁপছে শুনতে পেলাম ।
মিঃ থাবেন এবারে যেন আগের থেকে দূরত্বে, বলল,
“তাহলে আপনার দেখার সাধ মিটেছে ?”
“হ্যাঁ, আমি অনেক দেখলাম, যদিও আমি এখানে এইসব দৃশ্য দেখতে আসিনি
। আমি এসেছিলাম ভেকিকে নিতে ।”
“আর
আপনি বাড়ি যেতে চান ?”
“হ্যাঁ, আমি বাড়ি যেতে চাই । আমার প্রচণ্ড ব্যথা
হচ্ছে, আমি
অত্যন্ত ক্লান্ত ।”
সে ঘুরে হাঁটতে লাগল । আমি টেনে টেনে
চললাম । সে আবার থামল,
“আপনি
বাড়ি যেতে চান,” সে
বলল, “কিন্তু
এখানে যারা থাকে তাদের ব্যাপারে ? যখন
তারা বাড়ি যেতে চায়, তাদের
তো এখানেই যেতে হবে । তাদের বিষয়ে কি ভাবছেন ?”
আমরা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে, রাস্তার মধ্যে, মুখোমুখি । পথিকরাও দাঁড়িয়ে পড়ে আমাকে
কৌতূহল নিয়ে দেখতে লাগল, আমার
ব্যাপার ওদের ব্যাপার, সকলেরই
ব্যাপার ।
আমি বললাম, “কি জবাব দেব, বলো ?
শুধু বলতে পারি,
বড় ভয়ানক ব্যাপার ।”
“এসব
শুধু ভয়ানকই নয়,” সে
বলল, “এসব
হল অপরাধ । আপনি দেখতে পাচ্ছেন আপনার চোখের সামনে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, আর আপনি কি বলছেন ? আপনি বলছেন, ‘অনেক দেখা হল, আমি এসব দৃশ্য দেখতে আসিনি, আমি বাড়ি যেতে চাই’ ?”
আমি দুঃখিতভাবে ঘাড় নাড়লাম ।
“না, আপনি বলেন নি,” সে বলল,
“সত্যি । তাহলে
আপনি কি বলছেন ? কি
ধরণের অপরাধ এটা, যা
আপনি দেখছেন ? এর
নাম কি ?”
সে পেশায় একজন শিক্ষক, আমি ভাবলাম । সেজন্যই সে এত ভালভাবে কথা
বলে । এখন সে যা আমাকে বলছে, তা
সে তার স্কুলের ক্লাসে অভ্যাস করেছিল । এ হল ছাত্রদের কাছ থেকে উত্তর বের করে
নেবার একটা কৌশল, যাতে
শিক্ষকের নিজের দেওয়া উত্তরটিই ছাত্রের উত্তর হয়ে যায় । একেই বলে ভেণ্ট্রিলোক্যুইজ্ম, যা সক্রেটিসের উত্তরাধিকার ছিল, তা যেমন ছিল আথেন্সে, তেমনি আজকালকার আফ্রিকাতেও সমান
পীড়াদায়ক ।
আমি আমার চারপাশে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে
থাকা দর্শকদের দেখলাম । ওরা কি আমার প্রতিকূল ? না,
আমি বুঝতে পারছি,
কোনো বিরুদ্ধতা নেই । ওরা শুধু আমি কি বলি তা শুনবার অপেক্ষা
করছিল ।
আমি বললাম, “মিঃ থাবেন, আমার মনে হয় আমি অনেককিছুই বলতে পারি, কিন্তু জবাবটা আমার অন্তর থেকেই আসা
উচিত । চাপের মুখে, তুমি
হয়তো জান,
সত্যি কথা সব সময় মুখ দিয়ে বেরোয়
না ।”
সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিলাম ।
“দাঁড়াও, এক মিনিট সময় দাও । আমি তোমার প্রশ্নটা
এড়িয়ে যাচ্ছি না । এখানে ভয়ানক ব্যাপার সব ঘটে যাচ্ছে । কিন্তু আমি এই সব নিয়ে যা
ভাবছি,
তা আমার নিজের ভাষায়ই বলা উচিত ।”
“তাহলে
আপনি কি বলতে যাচ্ছেন শুনি । আমরা শুনব,
অপেক্ষা করছি ।”
সে চুপ করাবার জন্য হাত তুলল । জনতা
বিড়বিড় করে সমর্থন করল ।
আমি হোঁচট খাওয়া গলায় বললাম, “এইসব দৃশ্য ভয়ানক, এসব ধিক্কার দেবার উপযুক্ত । কিন্তু আমি
অন্যলোকের ভাষায় এসবকে ধিক্কার দিতে পারি না । আমার নিজস্ব ভাষা খুঁজতে হবে, আমার অন্তরের ভাষা । না হলে আমার কথা
সত্য হবে না । এখনকার মত আমি এইটুকুই বলতে পারি ।”
“মেয়েছেলেটা
বাজে বকছে,” একজন
বলল ভিড়ের থেকে । সে চারদিকে তাকাল । “জঘন্য,” সে বলল,
কেউ প্রতিবাদ করল না । কিছু লোক এরই মধ্যে সরে যাচ্ছিল ।
আমি সোজাসুজি তাকেই বললাম, “তুমিই ঠিক, তুমিই সত্যিকথাটা বলেছ ।”
সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি
একটা পাগল ।
আমি বলে চললাম, “কিন্তু তুমি কি আশা কর ? “এ সম্পর্কে বলতে গেলে,” আমি হাত বাড়িয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে, ধোঁয়া,
রাস্তার উপর এবং আবর্জনার দিকে নির্দেশ করলাম-----“তোমার ঐশী ভাষার প্রয়োজন ।”
লোকটা আবারও আমাকে স্পর্ধার সঙ্গে বলল, “জঘন্য ।”
মিঃ থাবেন মুখ ফিরিয়ে হাঁটা দিল । আমি
তার পেছন পেছন চললাম । ভিড়ের লোকজন যে যার রাস্তা ধরল । এক
মিনিটে সেই ছেলেটা দ্রুতগতিতে আমাকে অতিক্রম করল । আমার গাড়িটা দেখা গেল ।
মিঃ থাবেন বলল, “আপনার গাড়িটা হিলম্যান, তাই না ?
আজকাল এসব গাড়ি রাস্তায় বড় একটা দেখা যায় না ।”
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম । দুজনের মধ্যে
যে ব্যাপারটা ঘটে গেল, তাতে
একটা বিভেদরেখা আঁকা হয়ে গেল ভেবেছিলাম । কিন্তু মনে হল সে বিদ্বেষ পোষণ করছে না ।
আমি উত্তর দিলাম, “এটা সেই সময়ের গাড়ি যখন বলা হত ‘ব্রিটিশই সেরা’ । দেখ,
আমি তখন যা বলেছিলাম,
তার অর্থ পরিষ্কার হয়নি বলে দুঃখিত ।”
সে আমার দুঃখপ্রকাশ গ্রাহ্য করল না, সেরকমই মনে হল । জিগ্যেস করল, “ব্রিটিশরা কি কোনোও দিন সেরা ছিল ?”
“না, অবশ্যই না । এটা হল যুদ্ধের সময়ের পর
কিছুদিনের জন্য একটা স্লোগান। তোমার হয়তো মনে পড়বে না, তুমি তখন নিতান্তই ছোট ছিলে ।”
সে বলল,
“আমার জন্ম ১৯৪৩ সালে,
এখন আমার বয়স তেতাল্লিশ । বিশ্বাস হয় না ?” সে আমার দিকে তাকিয়ে তার ভাল পরিচ্ছন্ন
চেহারাটা দেখাল । দেখানেপনা, তবে
আকর্ষণীয় দেখানেপনা ।
আমি স্টার্টারটা টানলাম । ব্যাটারি ঠাণ্ডা
হয়ে গেছে । মিঃ থাবেন ও ছেলেটা নেমে বালির উপর কষ্ট করে পা রেখে গাড়িটা ঠেলল ।
শেষপর্যন্ত ইঞ্জিন চালু হল । ছেলেটা বলল,
“সোজা চল ।” আমি
তার নির্দেশ মান্য করলাম ।
মিঃ থাবেনকে জিগ্যেস করলাম, “তুমি কি শিক্ষকতা কর ?”
“আমি
শিক্ষক ছিলাম, কিন্তু
এখনকার মত পেশাটা ছেড়ে দিয়েছি,
যতদিন না ভাল সময় আসে । আজকাল আমি জুতো বিক্রি করি ।”
“আর
তুমি ?” আমি
ছেলেটিকে জিগ্যেস করলাম ।
সে বিড়বিড় করে যা বলল তার কিছু বোঝা গেল
না ।
মিঃ থাবেন বলল, “এ হল একজন বেকার যুবক । কি, তাই না ?”
ছেলেটা আত্মসচেতন হয়ে মৃদু হাসল । বলল, “দোকানগুলোর পরেই মোড় ঘুরবে ।”
জনশূন্য জায়গাতে একসারিতে তিনটি ছোট
দোকান, আগুনে
ভস্মীভূত । একটার
সাইনবোর্ড এখনো অল্পস্বল্প পড়া যাচ্ছে ----ভাউদিয়েন ক্যাশ স্টোর ।
মিঃ থাবেন বলল, “অনেকদিন আগে থেকে, গতবছর থেকেই এই অবস্থা ।”
আমরা একটা বড় মাটির রাস্তায় এসে পড়লাম ।
আমাদের বাঁয়ে বাড়ির পুঞ্জ, এগুলো
ইট ও অ্যাজবেস্টস দিয়ে তৈরি ছাদ ও চিমনিওলা ঠিকঠাক বাড়ি । তাদের মধ্যে, তাদের চারপাশে অনেক দূর সমতল ভূমি অবধি
ভবঘুরেদের ঝুপড়ি ।
ছেলেটা সামনে দেখিয়ে বলল, “ওই বিল্ডিঙটা ।”
ওটা ছিল একটা নিচু লম্বা বাড়ি, হয়তো একটা হলঘর কিম্বা স্কুল, চারপাশে তারের জালের বেড়া দিয়ে ঘেরা ।
কিন্তু অনেকখানি দৈর্ঘ্য পর্যন্ত তারের বেড়াকে দুমড়ে মুচড়ে নিচে ফেলা হয়েছে ।
বাড়িটার ধোঁয়ায় কালো দেওয়ালই শুধু দাঁড়িয়ে আছে । বাড়িটার সামনে ভিড় জমেছে ।
হিলম্যান গাড়িটা পৌছাতেই লোকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকল ।
আমি জিগ্যেস করলাম, “গাড়ি কি বন্ধ করব ?”
মিঃ থাবেন বলল, “হ্যাঁ,
বন্ধ করতেও পারেন,
ভয় পাবার কিছু নেই ।”
আমি বললাম, “ভয় পাচ্ছি না ।” কিন্তু কথাটা কি সত্যি ? একদিক থেকে সত্যি, অথবা ঝোপঝাড় এলাকায় যা হয়েছিল, তারপর আমার কি হতে পারে তা নিয়ে এখন আর
ভাবছি
না ।
সে মোলায়েম করে বলল, “ভয় পাবার কোনো কিছু নেই । আপনাদের
ছেলেরা এখানে আপনাকে রক্ষা করার জন্য আছে ।”
সে একদিকে দেখাল ।
তখন আমি তাদের দেখলাম; রাস্তার ঢালের দিকে, কিছু দূরে : তিনটি খাকি-বাদামি সশস্ত্র
পুলিশের গাড়ি গাছপালার সঙ্গে মিশে,
আর আকাশের গায়ে সীমা এঁকে শিরস্ত্রাণধারী মাথাগুলো ।
“আপনি
যদি ভেবে থাকেন এসব কালো লোকেদের মধ্যেকার কাজিয়া,
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সেক্ষেত্রে
আর কি ! দেখুন, এই
যে আমার বোন ।”
সে তাকে ‘আমার
বোন’ বলল, ‘ফ্লোরেন্স’ নয় । হয়তো এই পৃথিবীতে আমিই একা তাকে
ফ্লোরেন্স বলে ডাকি । একটা ছদ্মনামে ডাকি । এখন আমি সেই জমিতে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে
লোক তাদের আসল নামে পরিচিত ।
সে দেওয়ালের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিল
বৃষ্টির থেকে রক্ষা পাবার জন্য ; একজন
রুচিশীল সম্ভ্রান্ত মহিলা, বার্গাণ্ডি-লাল
কোট এবং সাদা সুতোয় বোনা টুপি পরা । আমরা ভিড়ের মাঝখান দিয়ে কোনো রকমে রাস্তা বের
করে কাছে গেলাম । যদিও সে কোনো লক্ষণ দেখাল না,
আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সে আমাকে দেখেছে । “ফ্লোরেন্স,” আমি ডাকলাম । সে নির্জীবভাবে তাকাল । “তুমি তাকে পেয়েছ ?” সে পোড়া বাড়িটার দিকে ইশারা করল, তারপর আমাকে কোনো কথা না বলেই মুখ ফেরাল
। মিঃ থাবেন ঢোকার রাস্তায় দাঁড়ানো লোকেদের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে ঢোকার
চেষ্টা করছিল । বিব্রতভাবে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম । লোক তাড়াতাড়ি করে যেতে আসতে
থাকল, কিন্তু
আমার ছোঁয়া বাঁচিয়ে, যেন
আমি মূর্তিমান দুর্ভাগ্য ।
আপেল-সবুজ স্কুলের পোশাক পরা একটি মেয়ে
আমার দিকে এগোল, তার
হাতটা উপরের দিকে তোলা । আমি মাথা সরালাম । কিন্তু মেয়েটার ভঙ্গীটা অভিনয় মাত্র
ছিল, অথবা
হয়ত সে চড় মারার থেকে নিজেকে বিরত করেছিল ।
“আমার
মনে হয় আপনার ও দেখে আসা উচিত ।” মিঃ
থাবেন হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে বলল । সে ফ্লোরেন্সের কাছে গিয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে
ধরল । চশমাটা খুলে সে তার মাথাটা মিঃ থাবেনের
কাঁধের উপর রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ।
হলের ভেতরটায় দেখা গেল পোড়া কড়িবরগা, মেঝে আধপোড়া জিনিষের ছাইয়ে নোংরা ।
দূরের দেওয়ালের কাছে, যেখানে
বৃষ্টির ছাট কম আসছে, পাঁচটি
মৃতদেহ সার দিয়ে শোয়ানো । ঠিক মধ্যের মৃতদেহটা ফ্লোরেন্সের ভেকির । তার পরনে এখনো
ধূসর ফ্ল্যানেলের প্যাণ্ট, সাদা
শার্ট ও স্কুলের মেরুন পুলওভার, কিন্তু
তার পা খালি । তার চোখদুটো খোলা, এবং
তাকিয়ে থাকা, মুখও
খোলা । বৃষ্টি নিশ্চয়ই কয়েকঘণ্টা ধরে তার উপর পড়েছে,
তার ও তার সঙ্গীদের উপর,
শুধু এখানে নয়,
যেখানে তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল সেখানেও । তাদের পোশাক, তাদের চুল একেবারে চেপ্টে লেগে আছে, সবই মৃতের চেহারা । তার চোখের কোণায়
বালি, তার
মুখেও বালি লেগে আছে ।
কেউ আমার হাত ধরে টানছিল । আমি তাকিয়ে
দেখি একটা ছোট মেয়ে,
তার বড়বড় শান্ত চোখ, সে
বলল, “সিস্টার, সিস্টার-----”, কিন্তু তারপর কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না
।
একটি মহিলা নম্রভাবে মৃদু হেসে বলল, “মেয়েটি আপনাকে জিগ্যেস করতে চাইছে আপনি
কোনও সিস্টার কিনা ।”
আমি এক্ষুনি সরে যেতে চাইছিলাম না, এক্ষুনি না । আমি ঘাড় নাড়লাম ।
মহিলাটি বলল, “সে আসলে জানতে চাইছে আপনি কি ক্যাথলিক
চার্চের কোনো সিস্টার কিনা ।” তারপর
সে বাচ্চা মেয়েটিকে বলল, “না, উনি সিস্টার নন ।”
সে মেয়েটির হাত আমার বাহু থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিল ।
ফ্লোরেন্সকে খবরের কাগজের লোকেরা ঘিরে দাঁড়াল ।
আমি মিঃ থাবেনকে শুধোলাম, “ওরা কি বৃষ্টিতেই শুয়ে থাকবে ?”
“হ্যাঁ, ওরা সেখানেই শুয়ে থাকবে, যাতে সবাই দেখতে পায় ।”
“কিন্তু
কারা এ কাজ করল ?”
আমি কাঁপছিলাম । কাঁপন আমার শরীরের উপর
থেকে নিচে, নিচে
থেকে উপরে চলতে থাকল, আমার
হাতও কাঁপছিল । আমি ছেলেটার খোলা চোখের কথা ভাবছিলাম । ভাবলাম, জীবনের শেষ দেখায় সে পৃথিবীতে কি
দেখেছিল ? ভাবলাম, আমার জীবনের সব চাইতে খারাপ জিনিষটাই
আমি দেখে ফেললাম । আর ভাবলাম, এখন
থেকে আমার চোখ ও খোলা, আর
কখনো বন্ধ করতে পারব না ।
মিঃ থাবেন বলল, “কে করেছে ? আপনি যদি ওদের শরীর থেকে বুলেটগুলোকে
খুলে দেখতে চান, আপনাকে
স্বাগত । কিন্তু একটা কথা আমি আগে থেকেই বলে রাখি আপনি কি দেখবেন । আপনি দেখবেন যে
লেখা রয়েছে “দক্ষিণ
আফ্রিকায় তৈরি, ‘সাব্স’-এর দ্বারা অনুমোদিত ।”
আমি বললাম, “দয়া করে আমার কথা শোন । আমি উদাসীন নই
এই যুদ্ধের ব্যাপারে । কিভাবে উদাসীন হতে পারি ?
কোনো খিলই এত মজবুত নয় যে জীবন থেকে এই যুদ্ধকে দূরে রাখতে
পারে ।”
আমার কান্না পেল, কিন্তু
এখানে ফ্লোরেন্সের পাশে আমার কান্নারও কি অধিকার আছে ? ফিসফিস করে বললাম, “যুদ্ধ আমারও ভেতরে আছে, আর আমিও তাড় ভেতরে আছি ।”
মি;
থাবেন অসহিষ্ণুভাবে কাঁধ ঝাঁকাল । তার মুখভঙ্গি এখন কুৎসিত হয়ে
গেছে । আমিও সারাদিনে কুৎসিততর হয়েছি নিঃসন্দেহে । সেই রূপান্তরণ, যা বাক্কে জড়তাপূর্ণ করে, অনুভূতিকে ভোঁতা করে, আমাদের পশুতে পরিণত করে । এই দেশের কোন
সাগরতীরে সেই ওষধি জন্মায় যা আমাদের এই অবনমন থেকে রক্ষা করবে ?
আমি আজকে সকালের গল্প বলছি একথা মনে
রেখে যে গল্পকার তার নিজস্ব অবস্থান থেকে অধিকারের স্থান দাবি করছেন । তুমি যে
দেখছ, তা
আমার চোখ দিয়ে,
যে স্বর তোমার মাথায় কথা বলছে, তা
আমার । শুধু আমারই মধ্যদিয়ে তুমি নিজেকে এই পরিত্যক্ত মালভূমির মধ্যে দেখতে পাচ্ছ, আমার হতাশা অনুভব করতে পাচ্ছ এবং অনুভব
করছ তাকে প্রথম স্বাগত বলার জন্য চাঞ্চল্য,
যে এই চিন্তাস্রোতকে স্তব্ধ করে দেবে: হোক সে নিদ্রা, হোক সে মৃত্যু । তোমার সহানুভূতি আমার
প্রতি বহমান, তোমার
হৃদয় আমার হৃদয়ের সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে ।
এখন,
হে আমার সন্তান,
আমার রক্তমাংসের রক্তমাংস,
আমার উত্তম সত্তা,
তোমাকে বলি একটু পিছু হটতে । আমি তোমাকে এই গল্প বলছি অতটা এজন্য নয়
যে তুমি আমার জন্য সহানুভূতি বোধ করবে;
বরং এজন্য, যে
কিভাবে সবকিছু চলছে তা তুমি বুঝতে,
জানতে শিখবে । গল্পটা যদি অন্য কেউ
বলত, অপরিচিত
কারো কণ্ঠস্বর যদি তোমার কানে বাজত,
আমি জানি,
এটা তোমার পক্ষে সহজ হত । কিন্তু বিষয়টা হল যে আর তো কেউ নেই, আমিই একা আছি । আমিই লিখছি, আমি,
এই আমি । সেজন্য বলছি,
আমার লেখাতে মনোযোগ দাও,
আমাতে নয় । যদি মিথ্যে,
অনুগ্রহভিক্ষা,
ওজর---- এরা শব্দগুলোর মধ্যে জড়িয়ে লুকিয়ে থাকে, মনোযোগ দিয়ে শোন, ওদের পাশ কাটিয়ে যেয়ো না, ওদের সহজে ক্ষমা করো না । সব কিছুই পড়ো, এমন কি এই আদেশও, একেবারে শীতলদৃষ্টিতে পড়ো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন