পুরুষ ঊল্লুক (ছবি আন্তর্জাল থেকে) |
স্ত্রী ঊল্লুক (ছবি আন্তর্জাল থেকে) |
বিদ্যাসাগরের বই নয়, আমার বর্ণ পরিচয়
হয়েছিল কলকাতার আহিরীটোলা লেনের “তারাচাঁদ দাস
এন্ড কোং” থেকে প্রকাশিত “হাতে খড়ি বর্ণবোধ”
বইয়ের মাধ্যমে।
কমদামী খয়েরি খসখসে কাগজে ছাপা ওই বইয়ে অ-য়ে ছিল অজগর, আ-য়ে ছিল আনারস।
হ্রস্ব ই-য়ে ইঁদুর, দীর্ঘ ঈ-য়ে ঈগল পাখি।
হ্রস্ব উ-য়ে ছিল উট আর
দীর্ঘ ঊ-য়ে ছিল ঊল্লুক।
অজগর, আনারস, ইঁদুর,
ঈগল আর উটের ছবি
বেশ বোধগম্যই ছিল, কিন্তু ঊল্লুক-এর ছবিতে ছিল একটা বাঁদর। আমার শিশুমন বাঁদরকেই ঊল্লুক বলে
মেনে নিয়েছিল। স্কুল-কলেজ জীবনেও সেই
ভুল শোধরানোর সুযোগ আসেনি। অনেক পরে,
১৯৭৭ সালে
মিজোরামে চাকরি করতে গিয়ে একদিন জঙ্গলে রাস্তার কাজ দেখতে গিয়ে ওই ভুল ভাঙল। অনেক
গুলো ঊল্লুক সেদিন মনের আনন্দে হুক্কু হুক্কু করে চেঁচামেচি করছিল। আমার সঙ্গী
সুশিক্ষিত ঠিকাদার কাপঠুয়ামা-ই চিনিয়ে দিলেন, এগুলো বাঁদর নয়,
ঊল্লুক। সেই আমার
প্রথম ঊল্লুক দেখা।
গত জুলাই মাসে
ডিব্রুগড়ে একটা শিশু কর্মশালা হয়েছিল। প্রতি বছরই হয়। শিশুদের মধ্যে প্রকৃতি
সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু বলার জন্য এবার ধুবড়ি থেকে এসেছিলেন সৌম্যদীপ দত্ত। ‘নেচারস্ বেকন্’ নামে
রাজ্যভিত্তিক একটি প্রকৃতিপ্রেমী সংস্থার তিনি সাধারণ সম্পাদক। তার কাছ থেকে ঊল্লুক সম্বন্ধে জানলাম
আরও অনেক অজানা তথ্য। এদের ইংলিশে বলে Hoolock
Gibbon. গোটা ভারতবর্ষের জঙ্গলে Ape
(বন মানুষ) জাতীয়
প্রাণী বলতে একমাত্র ঊল্লুকই পাওয়া যায়। তাও শুধু আসাম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
জঙ্গলেই আছে এরা। আরেকটা তথ্য হল, ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরেই এদের দেখা পাওয়া যায়, কোনও এক অজানা
কারণে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ের ঘন জঙ্গলে ওরা যায়না। Ape প্রজাতির সকল প্রাণীর মত এদেরও ল্যাজ
হয়না। মানুষের অপরিণামদর্শী বনধ্বংস আর মাংসের লোভে বেপরোয়া শিকারের বলি হয়ে এরা
আজ এদেশের সবচেয়ে বিপদাপন্ন প্রাণী। ১৯৭১ সালে আসামের জঙ্গলে ৭৮ হাজার ঊল্লুক ছিল, ২০১১ সালে সেই
সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজারেরও কম। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ঊল্লুক ২/৩ বছর পরপর
একবারে একটিই মাত্র সন্তানের জন্ম দেয়। তাছাড়া ঊল্লুক একগামী (Monogamous) প্রাণী। মানে একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রী
উল্লুক যে জুটি বাঁধে, তাদের একটিকে কেউ মেরে ফেললে জীবিতটি আর কোন দ্বিতীয়
উল্লুকের সঙ্গে জুটি বাঁধবে না। সারা জীবন একাই কাটিয়ে দেবে। এর ফলে সারা জীবনে
সেটি আর কোন ঊল্লুক সন্তানের জন্ম দেবে না। একটি ঊল্লুক আকৃতিতে দু-ফুট থেকে আড়াই
ফুট উঁচু হয়, ওজন গড়ে ৭ কেজি। পুরুষ উল্লুক ঘন কালো রঙের হলেও মানুষের মত একজোড়া স্পষ্ট
সাদা ভুরু থাকে। স্ত্রী ঊল্লুকের গায়ের রং বাদামী, তামাটে বা ঘিয়ে রঙের হয়। তাদেরও সাদা ভুরু আর মুখমণ্ডলের পাশে
হাল্কা সাদা দাগ থাকে। জন্মের সময় সব ঊল্লুক শিশু থাকে দুধসাদা রঙের। ৬ মাস থেকে ১
বছর বয়সের মধ্যে পুরুষ শিশুর রং পুরোপুরি পালটে যায়। ঊল্লুকের হাত দুটি খুব লম্বা
এবং যথেষ্ট শক্তিশালী। জীবনের বেশির ভাগ সময় (গড়ে ৩০-৩৫ বছর আয়ু) এরা উঁচু গাছের ডালে ঝুলে ঝুলেই কাটিয়ে দেয়। রাতে ঘুমায়
মোটা ডালে বসে বসে। প্রায় সব রকম গাছের ফল খায় যদিও, তবে ডুমুর তাদের বেশী প্রিয়। মোট খাদ্যের প্রায় পঁচিশ শতাংশ
জুড়ে থাকে পাতা। ঊল্লুক মাটিতে প্রায় নামেই না বলা চলে। দুই হাতে গাছের ডাল ধরে
লাফিয়ে লাফিয়ে ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার বেগে ওরা ছুটতে পারে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক
তথ্যটি সৌম্যবাবু আমাকে জানালেন সব শেষে।
আসামের জাতীয়
বৃক্ষের নাম হলং। শক্ত কাঠের এই সু-উচ্চ গাছটি এক
সময় আসামের সমস্ত জঙ্গলে প্রচুর পাওয়া যেত। এখন তা লক্ষ্যণীয় ভাবে কমে গেছে। কেন ? কারণ,
হলং গাছের বীজ
মাটিতে পড়লে সেটা থেকে চারাগাছ গজায় না,
যদি না সেটা
ঊল্লুকের পেটের ভিতর ঘুরে আসে। অর্থাৎ,
হলঙের বীজের
অঙ্কুরোদ্গম হয় ঊল্লুকের পাচন প্রক্রিয়ার রসে জারিত হয়ে। পাখির পেটে সেই জারণ
হয়না। শুধুমাত্র ঊল্লুকের মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসা হলঙের বীজ থেকেই নতুন হলং চারা
জন্মাতে পারে। ঊল্লুক কমছে, তাই কমে যাচ্ছে
হলঙের জঙ্গলও। ঊল্লুক বিলুপ্ত হলে আসামের জাতীয় বৃক্ষটিও আমাদের প্রতি প্রতিশোধ
নিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হায় ঊল্লুক,
এতই ছিল তোমার
পেটে পেটে !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন