.. আশু পাল..
তিতাবর থেকে ফেরার জন্য বাইক স্টার্ট দিলাম। চকিতে মাথায় খেলে গেল, এখান থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে মরিয়ানি, আর মরিয়ানি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ভারতের একমাত্র ‘ঊল্লুকের অভয়ারণ্য’ Hoolongpar Gibbon Wildlife Sanctuary, ওটা দেখে গেলে হয় না ! যেমন ভাবা, তেমনি কাজ, বাইকের মুখ দিলাম ঘুরিয়ে। আরেকটা ‘বিশেষ’ কারণও অবশ্য আছে। ট্রেনে চেপে বহুবার মরিয়ানি জংশন পেরিয়ে গেছি, কিন্তু নামা হয়নি একবারও। অথচ সেখানেই নাকি জন্মেছিলেন এক ‘বিশিষ্টা’ নারী – ঘটনাক্রমে যিনি আমার গিন্নি। বিয়ের পরে আমার প্রয়াত শ্বশুর মশাই ওখানেই ব্যবসা করতেন। থাকতেন শাশুড়িকে নিয়ে। সেখানেই তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম।
মরিয়ানি – নাগাল্যাণ্ড থেকে আসা পশ্চিমাভিমুখী ভোগদৈ নদীর তীরে ছোট্ট জনপদ। বাঙালি জনসংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। নদীপথে নাগাপাহাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলির সাথে ব্যবসার সূত্রেই শহরটির জন্ম এবং কলেবর বৃদ্ধি। নাগাপাহাড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে তার বিকাশ থমকে গেছে। গত কুড়ি বছরে মরিয়ানির আর তেমন শ্রীবৃদ্ধি হয়নি। যোরহাট যাওয়ার জন্য এখানে ট্রেন পাল্টাতে না হলে হয়তো একেবারেই মিইয়ে যেতো এই শহর। মরিয়ানি থেকে ‘ধোদর আলি’ নামের রাস্তাটি নদী পেরিয়ে চলে গেছে ন’ কাছারি, আমগুড়ি হয়ে নাজিরার দিকে। উত্তর পূবে। আর পশ্চিম দিকে আরেকটা রাস্তা গেছে যোরহাটে যাওয়ার। সেই পথেই যেতে হবে আমাকে।
মরিয়ানি – নাগাল্যাণ্ড থেকে আসা পশ্চিমাভিমুখী ভোগদৈ নদীর তীরে ছোট্ট জনপদ। বাঙালি জনসংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। নদীপথে নাগাপাহাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলির সাথে ব্যবসার সূত্রেই শহরটির জন্ম এবং কলেবর বৃদ্ধি। নাগাপাহাড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে তার বিকাশ থমকে গেছে। গত কুড়ি বছরে মরিয়ানির আর তেমন শ্রীবৃদ্ধি হয়নি। যোরহাট যাওয়ার জন্য এখানে ট্রেন পাল্টাতে না হলে হয়তো একেবারেই মিইয়ে যেতো এই শহর। মরিয়ানি থেকে ‘ধোদর আলি’ নামের রাস্তাটি নদী পেরিয়ে চলে গেছে ন’ কাছারি, আমগুড়ি হয়ে নাজিরার দিকে। উত্তর পূবে। আর পশ্চিম দিকে আরেকটা রাস্তা গেছে যোরহাটে যাওয়ার। সেই পথেই যেতে হবে আমাকে।
দেড়-দুই কিলোমিটার যেতেই ডান দিকে বেশ খানিকটা দূরে চোখে পড়ল ঘন জঙ্গলে ভরা অভয়ারণ্য। আরও খানিকটা এগোতেই একটা তিন রাস্তার মোড়, বাজার আর জনবসতি। এটাই হলংপার গ্রাম। ডানদিকের রাস্তাটাই সোজা গিয়ে ঢুকেছে ঊল্লুক অভয়ারণ্যে। এগোলাম সেদিকেই। গ্রাম শেষ হতেই কাঁটাতারের ঘেরা দেওয়া এলাকায় ঢোকার গেট। সরকারি রক্ষী জানতে চাইলেন, কোথায় যেতে চাই, কোত্থেকে আসছি ইত্যাদি। মনোবাসনা জানাতেই অযাচিত ভাবে কথা বললেন পাশে চেয়ারে বসে থাকা সুদর্শন যুবক। বললেন, ‘ আমার নাম সুরজিত মহন। ১৯৯৭ সালে অভয়ারণ্য ঘোষণার দিন থেকেই এখানে আছি পরিদর্শকের দায়িত্ব নিয়ে। আজ প্রথম পেলাম একজনকে, যিনি ডিব্রুগড় থেকে ১৬৫ কিলোমিটার বাইক ঠেঙিয়ে ‘হলৌ বান্দর’ (ঊল্লুক) দেখতে এলেন।‘ জমে গেল আলাপচারিতা। থার্মোফ্লাস্ক নিয়ে সাইকেলে বাজার থেকে চা নিয়ে এলেন বনরক্ষী। চা খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম জংলী রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতেই সুরজিত বাবু জানালেন, দ্রুত কমতে থাকা ঊল্লুকদের নিয়ে দেরীতে হলেও টনক নড়ে সরকারের। ১৯৯৭ সালে ২২ বর্গ কিলোমিটারের এই জায়গাটিকে কেন্দ্রীয় সরকার Hoolock Gibbon Sanctuary ঘোষণা করে। ২০০১ সালে রাজ্য সরকার নাম পরিবর্তন করে রাখে Hoolongpar Gibbon Wildlife Sanctuary, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আগে পূর্বদিকে খুব সংকীর্ণ হলেও নাগাল্যাণ্ডের ঘন জঙ্গলের সঙ্গে একটু খানি যোগাযোগ ছিল। ঊল্লুকেরা ওইপথে নাগাপাহাড় হয়ে মায়ানমার, তাইল্যান্ডের জঙ্গলে যাওয়া আসা করত। সাতানব্বই-আটানব্বই সালেও দলে দলে ঊল্লুকের ‘গানে’ ( ঊল্লুকের হুক্কু হুক্কু চীৎকারকে ইংরাজিতে Song বলে) সারাদিনমান মুখরিত হয়ে থাকতো। সকাল আর সন্ধ্যাবেলা ছাড়া ওই আওয়াজ আর শোনা যায়না। কারণ, এখন বাগান মালিকেরা পূবদিকেও জঙ্গল কেটে চা বাগান তৈরি করে নেওয়ায় এই অভয়ারণ্য এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে চারিদিকে জনবসতি আর চা বাগানে ঘেরা একটা দ্বীপে পরিণত হয়েছে। রাজ্য বা কেন্দ্র, কেউই এটা আটকাবার জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কাটনিবাড়ি, চেনিজান, মেলেং, কঠালগুড়ি ইত্যাদি চা বাগান আর রামপুর, পুখুরাই, কলিয়াগাঁও, মধুপুর প্রভৃতি গ্রাম গড়ে উঠেছে অভয়ারণ্যকে ঘিরে। ব্রহ্মপুত্রের তাণ্ডবে মাতুলির বাস্তুজমিহারা মানুষেরা দলে দলে এদিকে এসে গড়ে তুলছেন নতুন নতুন গ্রাম। ফলে ঊল্লুকেরা অভয়ারণ্যকেও নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে আর সাহস পাচ্ছেনা। ঊল্লুকেরা সাধারণত পাঁচ-ছয় সদস্যের দল হিসাবে থাকতে পছন্দ করে। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক ঊল্লুকের সঙ্গে দু-তিনটি ভিন্নবয়সী সন্তান নিয়েই গড়ে ওঠে ওই দলগুলি। স্বাভাবিক চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতে, গত এক বছরে সুরজিত বাবু দুটি দল দেখতে পেয়েছেন – দুই সদস্যের একটি দলে দুটিই স্ত্রী ঊল্লুক, আর দ্বিতীয় দলটিতে আছে তিনটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু। তার মানে লুকিয়ে চুরিয়ে হলেও মানুষের হাতে ঊল্লুক নিধন এখনও চলছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। বেলা পড়ে আসছে। সুরজিত বাবু বললেন, অন্ধকার নামার আগেই জঙ্গল ছেড়ে যাওয়া উচিৎ। কারণ, ঊল্লুকের সংখ্যা কমে এলেও নেকড়ে, বন্য শূকর, খাটাশ, বনবিড়াল এমন কি ছোট প্রজাতির চিতাবাঘও এখানে রয়েছে। নির্বিরোধ প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় স্লো-লরিস, বাঁদর, বনরুই আর কয়েক ধরণের টিয়া পাখি। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে সুউচ্চ হলং গাছের জঙ্গলে হেঁটে আমরা ফিরে এলাম।
তাদের আতিথেয়তা আর সহযোগিতার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরে যেতে
যেতে মনে মনে বললাম, পরবর্তী প্রজন্ম যাতে আমার মত বাঁদরকেই ঊল্লুক বলে ভুল
না করে, তার জন্যও অভয়ারণ্যের মাঝে সভয়ে হলেও বেঁচে থাকুক ঊল্লুক। (ছবি
আন্তর্জালের সৌজন্যে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন