।। আশু পাল।।
ঘটনা এক :
প্রতিদিনের মত সেদিনও সন্ধ্যা নাগাদ ব্লাড ডোনার্স ফোরামের
অফিসে গিয়ে ঢুকলাম। বিশ্বনাথ বাবু আর তিলক আগে থেকেই সেখানে বসেছিল। পঁচিশ
ছাব্বিশের এক বিবাহিতা মহিলাও বসে আছেন চেয়ারে। আমি ঢুকতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রায়
হুমড়ি খেয়ে ওই মহিলা এসে আমার পায়ে ধরার চেষ্টা করলেন, “স্যার আমার
মেয়েটাকে বাঁচান”। আমি লাফিয়ে সরে
গিয়ে ভদ্রমহিলাকে শান্ত হয়ে বসতে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার ? হাউমাউ করে
কেঁদেকেটে এক্সা হয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, তার চার বছর বয়সী মেয়েটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। প্রতি
পনেরো দিন পরপর রক্ত দিতে হয়। গত সাত-আট মাস ধরে বিভিন্ন পরিচিত ব্যক্তির হাতে
পায়ে ধরে কোনক্রমে রক্তের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতালের কোনও এক ব্যক্তি আমাদের ঠিকানা দিয়েছেন, তাই ছুটে এসেছেন এখানে। ভদ্রমহিলাকে
প্রথমে আশ্বস্ত করলাম। বললাম ঠিক আছে, আপাতত আমরা রক্তের ব্যবস্থা করছি, কিন্তু পুরো
ব্যাপারটা আমাদের খুলে বলুন তো।
সুতপা দেব। বয়স ছাব্বিশ। ছোটবেলা মা বাবা দুজনকেই হারিয়ে
মামাবাড়িতে বড় হয়েছেন। মেট্রিক পাশ করার পর আর পড়াশোনা হয়নি। স্কুলে পড়ার সময়
থেকেই জ্যোতিষের সঙ্গে পরিচয় এবং ভাব। বি এ পাশ করার পর বাবা মারা গেলে বাধ্য হয়ে
পড়াশোনা ছেড়ে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনে ওয়াটার লেভেল রিডার পদে চাকরি নেন জ্যোতিষ। সামান্য চাষের জমিও আছে। ভাগ চাষেও মাস
ছয়েকের খোরাক হয়ে যায়। বাবার জীবিতাবস্থাতেই দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেলেও অজানা এক
কারণে ছোটবোন তার বরের সঙ্গে ডিভোর্স নিয়ে বাপের বাড়িতেই আছে। বছর পাঁচেক আগে
জ্যোতিষের সঙ্গে বিয়ে হয় সুতপার। সুতপার মামা সানন্দে সম্মতি দিলেও জ্যোতিষের মা
আর বোন ওই বিয়েতে খুব একটা খুশি ছিলেন না, তবে মেনে নিয়েছিলেন। সুতপাও ভেবেছিল, ভালবাসা আর
পরিশ্রম দিয়ে সে শাশুড়ি আর ননদের মন জয় করে নেবে। সে ভাবেই এগোচ্ছিল। বিয়ের এক বছর
চার মাসের মাথায় জন্ম হয় সুতপার মেয়ে জয়িতা-র। সুতপা মনে করে, মেয়ের ভাগ্যেই
অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কারের চাকরি হয়েছে তার। বাড়িতে বেশ খুশির আমেজ। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন কপালে সইলো না। বছর তিনেক বয়স
হওয়ার পরেই খেয়াল হল, আর পাঁচটা বাচ্চার মত হেসে খেলে ছুটে বেড়ায় না শিশুটি। কেমন
যেন একটা ঝিমানো ভাব তাকে ঘিরে রাখে সব সময়। প্রাইভেট ডাক্তার দেখানো হলেও কোন
ওষুধ দিলেন না তিনি। বরং পাঠিয়ে দিলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কি সব পরীক্ষার
জন্য। বাচ্চাটির বিভিন্ন পরীক্ষার পাশাপাশি তিনি সুতপা আর জ্যোতিষের রক্ত পরীক্ষার
কথাও বলে দিলেন। সব শুনে ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল সুতপার, ‘হে ঈশ্বর, কোন বড় সড় অসুখ হয়ে যায়নি তো !’
তিনদিন পর সেই রিপোর্ট দেখে মেডিকেলের ডাক্তারেরা জানালেন, শিশুটি
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। কোনোদিন এই রোগের নামও শুনেনি সুতপা বা জ্যোতিষ। রক্ত
দিতে হবে তাকে। জ্যোতিষেরই এক বন্ধু এগিয়ে এল রক্ত দিতে। দিন দুয়েকের মধ্যেই বেশ চনমনে
হয়ে উঠলো জয়িতা। মাস দুয়েকের মাথায় আবার রক্ত দিতে হল। এবার রক্ত দিলো সুতপার
মামাতো ভাই। এভাবেই চলল। অফিস থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে সুতপা আর জয়িতাকে নিয়ে
জ্যোতিষ এবার ভেলোরে গিয়ে হাজির।
সেখানকার ডাক্তারবাবুরাও
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। তারপর একদিন তাদের দুজন কে নিয়ে বসলেন আলোচনায়।
জানালেন, সুতপা আর
জ্যোতিষ - দুজনেই থ্যালাসেমিয়া বাহক। কাজেই তাদের যদি আরও সন্তান হয়, তারাও
থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ৭৫ শতাংশ। কিন্তু ডাক্তার বাবু, সুতপা বলে উঠল, ‘আমার বা জয়িতার
বাবার তো কোনদিন এরকম সমস্যা হয়নি। এখনও দুজনেই যথেষ্ট পরিশ্রম করে থাকি, কোন দুর্বলতা বা
অন্য কোন রোগব্যাধি তো নেই ?’ চিকিৎসক বেশ যত্ন সহকারেই তাদের বোঝালেন, থ্যালাসেমিয়া
বাহক যে কেউ হতে পারেন, এবং বাহক হওয়ার জন্য তাদের কোন সমস্যাই হয়না, হবেওনা। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে তাদের
কোন অসুবিধাই নেই। কারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক, একমাত্র রক্ত পরীক্ষা করা ছাড়া বোঝার আর অন্য কোন উপায়ও
নেই। সমস্যা তখনই হয়, যদি অজান্তে দুইজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থ্যালাসেমিয়া বাহক হলেই সন্তানেরা হয় থ্যালাসেমিয়া রোগী।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের পেট সাধারণের চেয়ে বড় হয়, কপাল বেশ চোখে
পড়ার মত উঁচু হয়ে থাকে, নাক সাধারণত একটু চ্যাপ্টা হয়। চোখ দুটোও মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের
হতে পারে। শিশুর মধ্যে দুর্বলতা ও ঝিমানো ভাব থাকে। প্রচুর ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা
পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলেও সুস্থ হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। নিয়মিত রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু বিপুল পরিমাণ রক্তের যোগান দিতে
পারলেও ২০-২৫ বছরের বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বাঁচানো কঠিন। কারণ সমস্ত সাবধানতা
অবলম্বন করা সত্বেও ফাঁক-ফোকর গলে রক্তের মধ্য দিয়ে কিছু সংক্রমণ ও অন্যান্য
জটিলতা এসে দেখা দেয়। এই রোগ সারানো যায়না ঠিকই, কিন্তু এটাকে প্রতিরোধ করা যায়। বিয়ের
আগে যে কোন সময়, ছেলে মেয়ে সবারই রক্তের থ্যালাসেমিয়া বাহক পরীক্ষা করিয়ে রাখা উচিৎ। তাতে যদি
কেউ থ্যালাসেমিয়া বাহক ধরা পড়ে, তবে বিয়ের আগে যে পাত্র কিংবা পাত্রীর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব
এসেছে,
তারও
থ্যালাসেমিয়া বাহক পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। পরীক্ষার ফলাফলে যদি দেখা যায় সেই
পাত্র/পাত্রীও একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক, তবে সেই বিয়ে বাতিল করে দেওয়াই উচিৎ। আর যার ক্ষেত্রে দেখা
গেল সে বাহক নয়, সে নিশ্চিন্তে যে কোন পাত্র/পাত্রীকে বিয়ে করতে পারে।
জ্যোতিষ আর সুতপা হতাশ হয়ে ফিরে এলো বাড়িতে, জয়িতাকে নিয়ে।
এবার শুরু হল রক্তদাতার খোঁজ। পাড়ায়, অফিসে, দোকানে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে – সব জায়গাতেই
সুতপার এক লক্ষ্য, রক্তদাতা খুঁজে বেড়ানো। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধে হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে
রক্তদাতা পাওয়া কঠিন হয়ে এলো। ওদিকে জয়িতার রক্তের প্রয়োজনের সময়ও কমে এলো। আগে
দেড়-দুই মাসে একবার দিলেই চলতো, এখন প্রায় ১৫-২০ দিনেই রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা জয়িতার
প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত রক্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম। পনেরো কুড়ি দিন পরপরই
সুতপা এসে আমাদের কাছ থেকে ব্লাড ডোনার কার্ড নিয়ে যেতেন। অফিসে আমি না থাকলেও
যে-ই থাকতো সে-ই তাকে কার্ড দিয়ে দিত। জয়িতার বাবা, পিসি বা ঠাম্মাকে কিন্তু একদিনও কার্ড
নেওয়ার জন্য আসতে দেখিনি। মাস ছয়েক পর একদিন অফিসে ঢুকে দেখলাম সুতপা বসে আছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, কার্ড পাননি ? সুতপা সেদিনও কাঁদতে শুরু করলেন। কার্ড তিনি পেয়ে গেছেন আগেই, কিন্তু আমার সাথে
দেখা করার জন্য বসে আছেন। কি ব্যাপার ? তিনি যা বললেন তার সারমর্ম এই রকম – তার শাশুড়ি আর
ননদ শুরু থেকেই বলে আসছিলেন যে, সুতপার শারীরিক ত্রুটির জন্যই শিশুটির এই অসুস্থতা। ভেলোর
থেকে ফিরে আসার পর তাদের সেই ধারণা আরও দৃঢ় হয়। তারা বারংবার জ্যোতিষ কে দ্বিতীয়
বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকেন।
জ্যোতিষ
প্রতিবারই বলে এসেছেন যে শারীরিক ত্রুটি শুধু সুতপার নয়, তার নিজেরও।
কিন্তু তার মা-বোন সেটা মানতে রাজী নন। মরীয়া চেষ্টা করতে তারা এবার বলছেন, ঠিক আছে, এবার বিয়ের আগে
প্রস্তাবিত মেয়েটির থ্যালাসেমিয়া বাহক পরীক্ষা না হয় আগেই করিয়ে নেওয়া হবে। তাদের
যুক্তি, ডাক্তারেরা তো বলেই দিয়েছেন, স্বামী স্ত্রী-র একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে সমস্যার কিছু
নেই। কিন্তু সুতপার কি হবে ? তাদের জবাব, সে এখানেই থাকবে, তার নিজের যখন ত্রুটি রয়েছে, কাজেই সতীনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই তাকে
থাকতে হবে। জ্যোতিষ সে প্রস্তাব এখনও মেনে নেননি ঠিকই, কিন্তু সুতপার
বিবেচনার জন্য প্রস্তাবটি তার কাছে রেখেছেন। সুতপার এখন ভয়, আজ না হোক কাল
জ্যোতিষ হয়তো এই প্রস্তাব মেনে নিতেই পারেন। সুতপা জানেন, তিনি সম্মতি না
দিলে জ্যোতিষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবেন না। কিন্তু আইনের ভয় দেখিয়ে স্বামীকে নিরস্ত করা গেলেও তার মন থেকে উঠে যেতে হবে।
এভাবে কি বেঁচে থাকা যায় ! জয়িতাকে বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি এখন এই দ্বিতীয় সমস্যা
এসে জুটেছে।
এ ব্যাপারে কোন সু-পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলনা, এখনও নেই। সুতপাও
এটা জানেন। তবু মনের ভার হাল্কা করতেই আজ এই কথা গুলো আমাকে বললেন। কার্ড নিয়ে উঠে
ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন সুতপা। এই ঘটনার পর আরও বছর খানেক তিনি নিয়মিত আমাদের কাছে
এসে কার্ড নিয়ে যেতেন। তারপর একদিন আর এলেন না। নিশ্চয় কার্ড নেওয়ার প্রয়োজন
ফুরিয়েছে তার। আজও যখন সুতপা-জয়িতার কথা মনে পড়ে, মনটা গভীর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
শ্রদ্ধেয় পাঠক পাঠিকা, সন্তানের বিয়ের আগে ঠিকুজি-কোষ্ঠী মিলিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ
আমাদের অনেকের, মিলিয়ে নিন, আপত্তি নেই, কিন্তু এই সত্য ঘটনা জানার পরও যদি কেউ থ্যালাসেমিয়া বাহক পরীক্ষা না করিয়েই
সন্তানের বিয়ে দেন, তা হলে কিন্তু সুতপা বা জ্যোতিষের মত আপনার সন্তানের ভাগ্যেও এসে জুটতে পারে এ
রকম বিপর্যয়। সম্ভাব্য বিপদের কথা জানা না থাকলে অন্য কথা ছিল, কিন্তু জেনেই
গেলেন যখন, তখন একটু ভুলের জন্য সারা জীবন, এমন কী মৃত্যুর পরও আপনি কেন এর জন্য দায়ী থাকবেন ?
ঘটনা দুই :
অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে টেবিলেই মাথা রেখে ঝিমুচ্ছিল
কিষনলাল- আমার সরকারি
অফিসের একমাত্র হিন্দিভাষী সহকর্মী। বছর বত্রিশের যুবক। গতকাল রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় শহরের এক
বেসরকারি নার্সিংহোমে তার স্ত্রী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। প্রথম (পুত্র)
সন্তানের বয়স এখন
পাঁচ। কি সব সব জটিলতা ছিল, তাই বেশ রাত অবধি তা নিয়ে ছুটোছুটি করতে হয়েছিল। ঘুমোতে পারেনি। আজ তাই অফিসেই ঘুমে ঢুলে পড়ছে। বেলা দুটো নাগাদ তার মোবাইলে একটা ফোন
পেয়ে ধড়মড় করে জেগে সোজা আমার কাছে চলে এলো।
পাল দা, কি জানি হয়েছে,
প্রচুর রক্তপাত
নাকি হচ্ছে, ডাক্তার বলেছে
এখুনি এ-পজিটিভ রক্ত দিতে
হবে। উৎকণ্ঠায় তার গলা শুকিয়ে গেছে। এক মুহূর্ত চিন্তা করে আমি ব্লাড
ব্যাঙ্কে ফোন করে জেনে নিলাম,
হ্যাঁ এ-পজিটিভ রক্ত মজুত আছে। কিষনলাল কে বললাম, তুই সোজা নার্সিংহোমে যা, তোর স্ত্রীর রক্তের স্যাম্পল আর ইন্ডেন্ট ফর্ম নিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্কে চলে গিয়ে আমাকে ফোন করিস, আমি রক্তের ব্যবস্থা করে দেব। আশ্বস্ত হয়ে সে প্রায় দৌড়েই চলে গেল।
ঘণ্টা দেড়েক পরেও তার কাছ থেকে কোন ফোন না পেয়ে আমিই ফোন করলাম
তাকে। কি ব্যাপার, ফোন করিস নি যে
? কিষনলাল জানালো, ডাক্তার যখন রক্তের কথা বলছিলেন, তখন অন্যান্যদের সাথে সামনেই ছিল ওর স্ত্রীর খুড়তুতো ভাই। সে জানায়, তার রক্তের গ্রুপ এ-পজিটিভ। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিয়ে
নার্সিংহোমের ল্যাবরেটরিতে চলে যান এবং তার কাছ থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে রোগীকে দিয়ে
দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে আর রক্ত লাগবে না। প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় বোতলের জন্য সে
আমাকে ফোন করবে। আমার মাথায় বিপদের সম্ভাবনা ঝাঁ ঝাঁ করে
উঠলো। আমি জানি কিষনলালের ওই রক্তদাতা শ্যালকটি নেশাখোর। প্রায় নিয়মিত মদ্যপান করে, সাথে আরও কি কি
করে কে জানে ! তখন আমি তাকে কিছু বললাম না। পরদিন অফিসে আসতেই তাকে খুব ঝাড়লাম।
তোর এই শ্যালকের স্বভাব-চরিত্র তুই জানিস না ? তা ছাড়া এই সব নার্সিংহোমের ব্লাড
ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স নেই, ওরা রোগীকে রক্ত দিতে পারে কিন্তু কারো কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ
করতে পারে না, কারণ প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা এদের নেই – এটা তো তোকে
অনেকবার আমি বলেছি। ও আমতা আমতা করে বলল, আমি গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ওরা আমার খুড়-শ্বশুরের দিকের
শ্যালককে নিয়ে গিয়ে রক্ত সংগ্রহ শুরু করে দিয়েছিল। তারপর নিজেকে সাহস দেওয়ার মত
করেই বলল, আমিতো কারো কোন ক্ষতি কোনদিন করিনি পাল দা, আমার কোন বিপদ হবে না, দেখে নিও।
হপ্তা খানেক পর স্ত্রী এবং নবজাত কন্যাকে নার্সিংহোম থেকে
বাড়ি নিয়ে গেল কিষনলাল। ভালই কাটছিল দিনগুলি। ছ’-সাত মাস পর একদিন অফিসে এসে কিষনলাল
সোজা চলে এল আমার টেবিলে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা। ফিসফিস করে বলল, কাল রাতে আমার
সেই শ্যালক মারা গেছে পাল দা। ডাক্তারেরা বলেছে তার এইডস্ হয়েছিল। সর্বনাশ, বলে কি ছেলেটা !
আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিয়ে মেডিকেল কলেজের
ART সেন্টারে গেলাম।
রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেল, সে এইচ আই ভি পজিটিভ। পরদিন তার স্ত্রীর রক্ত পরীক্ষায়ও একই
ফল বেরিয়ে এলো। বাচ্চাদের রক্তও পরীক্ষা করালাম। ভাগ্য ভাল, ওরা দুজনের কেউই
এইচ আই ভি তে আক্রান্ত নয়। তার স্ত্রী নার্সিংহোম থেকে রিলিজ হওয়ার সময় যে সমস্ত
নথিপত্র দেওয়া হয়েছিল, সে গুলি তন্নতন্ন করে খুঁজেও রোগীকে রক্ত দেওয়ার কোন প্রমাণ
পাওয়া গেলনা। নার্সিংহোম কর্তারা জানে, তাদের হাসপাতালে রক্ত সংগ্রহ বেআইনি, তাই সতর্কভাবেই
রক্ত দেওয়ার কোন তথ্যই তারা তাদের রেকর্ডে রাখেনি। রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে
নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা ক’জনই বা কাগজপত্র দেখে তা’তে চিকিৎসার সমস্ত বিবরণ ঠিকঠাক দেওয়া
আছে কিনা, তার প্রতি নজর রাখি ? এ অবস্থায় নার্সিংহোমে গিয়েও কোনভাবেই তাদের আইনগত ভাবে
দায়ী করা যাবেনা।
শিলচর মেডিকেলের ডাক্তার তাদের চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন।
কিষনলাল বিশ্বাস-ই করতে পারছিল না যে সে সত্যিই এইচ আই ভি সংক্রমিত হয়ে পড়েছে।
সপরিবারে সোজা চেন্নাই এপোলো হাসপাতালে চলে গেল সে, পরীক্ষা করাতে। কিন্তু সেই পরীক্ষায়ও
একই ফল ধরা পড়লো। শুরু হল চিকিৎসা। এখন দুজনে মিলে তেরো হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয়
প্রতি মাসে। ছ’মাস এক বছরে
একবার চেন্নাই গিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে আসতে হয়। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য তার
অনুরোধে একবার শিলচর মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলাম তাকে নিয়ে। কিন্তু চিকিৎসকেরা
জানালেন, এপোলো থেকে যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেটা দ্বিতীয় স্তরের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট, তবে রোগীর
শারীরিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এই ওষুধ ক্ষেত্র বিশেষে দেওয়া যেতেই পারে। সরকারি
হাসপাতালের বিনামূল্যের ওষুধ সেই স্তরের দেওয়া যাবেনা। কাজেই একবার যখন দ্বিতীয়
স্তরের ওষুধ শুরু হয়ে গেছে, এখন আর সরকারি ওষুধে তেমন কাজ হবে না। অতএব, যা হবার তাই হল।
সব সময়েই টুকটাক অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে তাদের। একবার টিবি-ও হয়ে গেছে। ওজন কমে যায়
মাঝে মাঝেই। তখনই দৌড়তে হয় চেন্নাইয়ে। এই মুহূর্তে, যখন আমি এই নিবন্ধ লিখছি, সস্ত্রীক কিষনলাল
রয়েছে চেন্নাইতে। সপ্তম বছরের বাৎসরিক চেক-আপে গেছে তারা। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর
তৃতীয় স্তরের ওষুধ দেওয়া হয়েছে তাকে। তার স্ত্রীর অবশ্য এখনও দ্বিতীয় স্তরের ওষুধই
বহাল রয়েছে। প্রতিমাসে ওষুধের খরচ এখন আরও প্রায় তিন হাজার টাকা বাড়ল। কিন্তু এত
সতর্কতা, এত ব্যয়, এত শিলচর-চেন্নাই ছোটাছুটির পরও কিষনলাল ও তার স্ত্রী কতদিন বেঁচে থাকবে, তার কোন নিশ্চয়তা
কিন্তু দিতে পারেন না কোনও চিকিৎসক। তেরো আর আট বছরের সন্তান দুটি এখনও নিতান্তই
শিশু।
প্রশ্ন হল, কিষনলালের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী কে বা কারা ? সীমাহীন মুনাফার
লোভে লালায়িত কিছু কিছু নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই ভর্তি হওয়া রোগীদের
রক্তের প্রয়োজন হলে বেআইনি জেনেও নিজেদের হাসপাতালেই যে কোন দাতার কাছ থেকে রক্ত
সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে চালান করে দেন, এবং খুব সতর্কভাবেই তারা এ সংক্রান্ত কোন রেকর্ড রাখেন না
বা রোগীর আত্মীয়দের হাতে দেন না। চেহারায় মানুষ হলেও প্রকৃত অর্থে এরা যমের এজেন্ট। কিন্তু আমরা নিজেরাও কি এর জন্য কম দায়ী
? চিকিৎসা
বিজ্ঞানের এই উন্নতির যুগে, রক্তবিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ সচেতনতা না থাকাও কিন্তু
এই সমস্যার জন্য দায়ী। ডাক্তার চিকিৎসা করবেন, তাই বলে তা নিয়ে আমরা কোনও খবরাখবর
রাখবো না – এটা হতে পারে না। কেননা, চরম ক্ষতি হয়ে গেলে সে তো হবে আমার কিংবা আপনার, ডাক্তারের বা
নার্সিংহোমের তো কোন ক্ষতি নেই। তাই, আপনার রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্লাড
ব্যাঙ্ক থেকেই শুধু রক্ত সংগ্রহ করুন। সম্ভব হলে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকেই রক্ত
নিয়ে আসুন। মনে রাখবেন, অধিকাংশ নার্সিংহোমেরই ল্যাবরেটরি থাকলেও ব্লাড ব্যাঙ্ক
লাইসেন্স নেই। অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করা বিপজ্জনক হতে পারে।
রক্তদান করলে শরীরের কোন ক্ষতি হয়না, কাজেই নিজেই রক্ত দিতে ভয় করবেন না। ১০০ শতাংশ নিরাপদ রক্ত
এই পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি সত্য, তবে স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরে দান করা রক্ত সবচেয়ে নিরাপদ ও
নির্ভরযোগ্য।
প্রতিটি জেলায় রক্তদান আন্দোলন গড়ে ওঠা অত্যন্ত দরকার, দরকার রক্ত
সচেতনতা বাড়ানো।
এ ব্যাপারে আমার, আপনার প্রত্যেকেরই
দায়িত্ব আছে। কিছু লোক রক্তদান করে যাবে, আর আমি প্রয়োজনের সময় বসে বসে রক্ত পেয়ে যাবো, তা হবার নয়।
সবাইকেই সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। কিষনলাল এখন আমাদের রক্তদান আন্দোলনের
নিয়মিত এবং সক্রিয় সদস্য। প্রায় প্রতিটি সচেতনতা সভা এবং রক্তদান শিবিরে সে
উপস্থিত থেকে সে নিজের উদাহরণ দিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস চালিয়ে যায়।
সে ঠেকে শিখেছে। কিন্তু আপনিও কি সক্রিয় ও সচেতন হওয়ার জন্য আপনার কোন প্রিয়জনের
সর্বনাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন ? না কি, সময় থাকতেই নিজেকে এবং সবাইকে রক্তবিজ্ঞান ও রক্তদান
সম্পর্কে সচেতন করে তুলবেন ? প্রিয় পাঠক, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু আপনার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন