।। আশু পাল।।
আমার শ্যালক সুজিৎ
বিয়ে করেছে একটি ফাকিয়াল মেয়েকে - বছর কয়েক আগেই। আক্ষরিক অর্থেই রূপসী এবং গুণবতী
আমার শ্যালক-গিন্নির নাম লন্ নেও উইঙ্কেন। আমি নাম দিয়েছি উমা। গিরিরাজ দক্ষের
কন্যা উমাও তো পর্বতদুহিতা, আজকের ভাষায় ট্রাইবেল। ফাকিয়াল জনগোষ্ঠী অষ্টাদশ শতাব্দীর
কোন এক সময় চীন-তাইল্যান্ড সীমান্তের শান (কোন কোন ঐতিহাসিকের উচ্চারণে 'খেন') সাম্রাজ্য থেকে
আসামে প্রবেশ করেছিল। বুড়ি দিহিং নদীর উত্তর এবং দক্ষিণ তীরে তাদের মাত্র তিন
চারটি গ্রাম রয়েছে। এই মুহূর্তে আসামে ফাকিয়াল জন সংখ্যা হাজার পাঁচেকের বেশী নয়।
নানা রকম প্রতিকূলতা সামলে এখনও তারা তাদের ভাষা এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে
রাখার চেষ্টা করছে।
গতকাল ছিল লন্-এর
ছোট বোনের বিয়ে। চিঠি পাঠিয়ে এবং ফোনে নিমন্ত্রণ করেছে - যে করেই হোক যেতে হবে।
অফিসে কাজের চাপে মনে মনে বাতিল করেছিলাম যাত্রা। কিন্তু তিনটে বেজে পনেরো মিনিটে
আবার ফোন, - কি হল, এখনও পৌঁছালেন না যে ? জবাব দিলাম, কাজের চাপে আটকে পড়েছিলাম, এক্ষুণি রওয়ানা হচ্ছি। বেরিয়ে পড়লাম বাইক
নিয়ে। দূরত্ব কম নয়, ৬২ কিলোমিটার। ফিরতে রাত হবে, তাই প্রয়োজনীয় গরম কাপড় নিয়ে নিলাম। জাতীয় সড়ক হলেও লাহোয়াল
অব্দি ১৬-১৭ কিলোমিটার রাস্তা খুব ভাল নয়। লাহোয়ালে রেল ক্রসিং পেরিয়ে যাবার পর
কালো মসৃণ রাস্তা। বাইকে স্পিড্ তুললাম ৭০ থেকে ৮০। চেচা নদীর সেতুতে গতি কমলো।
রাস্তার পাশে একজন মাছ নিয়ে বসেছেন, চেচা'র মাছ। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের চার চারটে বোয়াল কাৎ হয়ে
শুয়ে ল্যাজ নাড়ছে। পাশে বাঁশের কুলুঙ্গিতে আরও প্রায় চার কেজি বিভিন্ন প্রজাতির
মাছ। আহা চেচা'র মাছ। ডিব্রুগড়ের মানুষ জানেন, অন্য যে কোন নদীর মাছের চেয়ে চেচা'র মাছের দাম কেজি প্রতি অন্তত পঞ্চাশ
টাকা বেশী। কেননা, তার স্বাদই আলাদা। কিন্তু এখন আমি বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। রসনাকে মনের মধ্যেই চেপে
আমি এগিয়ে গেলাম। টেঙ্গাখাত, টিংরাই পেরিয়ে নাহারকাটিয়া। এবার রাস্তা পালটে জয়পুরের পথ
ধরলাম। প্রায় তিন কিলোমিটার পর নাহারকাটিয়া কলেজ। কলেজ পেরিয়ে খানিকটা এগোতেই বাঁ
দিকে মস্ত গেটে লেখা Welcome to Namphake village, 2 KM. রাস্তা ভাল নয়। একটু ধীরেই এগোতে হল। আলো
থাকতে থাকতেই পৌছে গেলাম লন-এর বাপের বাড়ি। ঘড়িতে তখন চারটে বেজে তেত্রিশ। তার
মানে এক ঘণ্টা দশ মিনিটে পাড়ি দিয়েছি প্রায় ৬৫ কিলোমিটার ! মনে মনে নিজেকে বললাম,
সাবাস বুড়ো,
সাহস কম নয় রে
ব্যাটা তোর !
নামফাকের বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দিরটা পেরিয়েই এসেছি,
কিন্তু ছবি তোলার সময় ছিল না। (আরেকবার দেবো,
কথা দিলাম) একটু পরেই বরপক্ষ এসে যাবে, তাই কনেপক্ষের সবাই খেতে বসে গেছে। আমাকে দেখে লন্ কৃত্রিম
রাগ দেখিয়ে বলল, সব ভাত শেষ, এখন তোমার আসার সময় হল ? থাকো উপোষ। টেনে নিয়ে বসিয়ে দিল খাবার টেবিলে। সাথে বসল সুজিৎ
আর তার শ্যালক। রান্না এবং পরিবেশনের দায়িত্বে নাহারকাটিয়ার বাঙালি ক্যাটারার।
কাগজের থালায় একটা তীর্তা পাতার পোঁটলা দিয়ে গেল ওরা। এটা কি ? ওমা, খুলে দেখি
সুগন্ধি ভাত। স্থানীয় বয়ানে "টোপোলা ভাত"। নারায়ণ পুজোর শিরণির মত বড়
চামচ দিয়ে দিয়ে গেল এক দলা অফ্ হোয়াইট থকথকে বস্তু। কি এটা ? সুজিতের শ্যালক বলল, এর নাম "টেঙ্গা মাছ"। এটা বরের বাড়ি থেকে আগেভাগে
কনের বাড়ির নিমন্ত্রিতদের জন্য পাঠিয়ে দিতে হয়। কেজি দশেক রুই বা কাতলা মাছ ছোট
ছোট পিস্ করে কেটে লেবুর রসে ভিজিয়ে রাখতে হয় দুদিন। তারপর তুলে কাঁটা বেছে বেছে
ফেলে দিয়ে নুন আর অল্প জিরে মিশিয়ে রান্না করতে হয়। হলুদ মোটেই দেওয়া যাবেনা। এই
টেঙ্গা মাছ-এর স্বাদ নিয়ে বরের বাড়ি আর কনের বাড়ির মহিলাদের মধ্যে খুনসুটি চলে
এন্তার। তার পরের আইটেম গুলো আমাদের পরিচিত। ডাল, বেগুনি, মিক্সড্ ভেজ,
শূকরের মাংস আর রসগোল্লা। লন্ বলল, আরেকটা আইটেম ছিল, যা শেষ হয়ে যাওয়ায় আমার পাতে পড়েনি। আমরুল পাতা, গন্ধলেবুর পাতা, তিসি, নারকেল কোরা, তুক্মা ইত্যাদি আট দশ রকম জিনিস মিশিয়ে একটা টক টক তরল
পদার্থ (পুরোটাই কাঁচা, মানে আগুনের
স্পর্শ ছাড়া) - যা গ্লাসে করে দেওয়া হয়। কপাল মন্দ, ওটার স্বাদ নেওয়া গেল না। রান্না ঘরের এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি
করে কয়েকটা ছবি তুললাম। বরপক্ষ এসে গেল, সবাই এখন ওদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সাড়ে পাঁচটা বাজে। এবার যাওয়া উচিৎ। সবার কাছ
থেকে বিদায় নিয়ে চাঁদনী রাতের আবছায়া অন্ধকার আর কনকনে শীত ঠেঙ্গিয়ে দু ঘণ্টায়
ফিরে এলাম আমার একান্ত আস্তানায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন