পনেরো
(দেশভাগ
এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস
ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার
প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে
ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই
উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই
উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার পঞ্চর্দশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
কোথায় যায় বৈতল
। এমন মানুষকে ছেড়ে থাকা যায় । পাহাড় বেয়ে নামতই নামতে কচি চা পাতার গন্ধে বিভোর
হয় ।
কিছুদূর পর
চায়ের গন্ধ কড়া হয়, নেশা ধরে । চাঘরে চা হচ্ছে । খাকি হাফপ্যান্ট আর হ্যাট মাথায়
চাঘর বাবুর কাছে চাইবে একমুঠো চা, তাজা চা । চায়ের গন্ধে বিভোর হওয়া মানে
শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি হওয়া । তবে কি আবার রেলগাড়ি চাপবে, আবার রইদপুয়ানি , তারের
উপর ফিঙ্গে পাখির নাচ । না, বৈতল আর পুব মুখো হবে না, এবার উত্তরে গমন । আবার
বইয়াখাউরি । ওখানে সে কার জন্য চা নিয়ে যাবে । এবার লুলাকে খুঁজে বের করবে । বলবে,
--- আয়, এঙ্গা ভাঙ্গিদে, মিল কর । আবার আমরা বন্ধু ।
লুলাকে মিষ্টি কথা বললে হবে না । ওকে মারতে হবে
কষে এক লাথি । তবেই সে ঠিক হয় । এত কথা জমে গেছে যে একা একা বইতে পারছে না ।
চামেলি চায়নার কথা বলতে হবে । লুলা তো
আবার সাধুমানুষ , মেয়েমানুষের কথা পছন্দ করে না । কিশোর বেলায় সেই এক ধলা মেয়ের
কান ছেঁড়ায় রেগেছিল, বলেছিল ,
--- গুনা করিলাইচছ
দোস্ত ।
প্রায়শ্চিত্ত
তো করেছে বৈতল । কালো বরণী ফিঙে পাখির গায়ে হাত দেয় নি, ছেড়ে চলে এসেছে । লুলা
পাইয়ে দিয়েছিল বৈতলকে তার গুরু । গুরুর কথা বলতে হবে না ! গুরুর কথা শুনলে খুশি
হবে লুলা । খুশিতে উজ্জ্বল মুখটাও তার মলিন হয় অভিমানে । একবার, এত বছরে একবার
বন্ধুকে দেখার ইচ্ছে হয়নি । কিসের তবে
বন্ধুত্ব । বৈতল আবার উল্টোপায়ে হাঁটে । কাজ নাই গিয়ে বইয়াখাউরির ভাটিতে ।
জালুয়াগিরি করে কী হবে বড় হাওরে । এর থেকে ভাল ওঝার চেলাগিরি । কত কথা শোনা যায়,
দেখা যায় নিত্যনতুন গ্রাম, চেনা হয় জানা যায় ইতিহাস । অর্গল খুলে বেরিয়ে আসা ঘরে
না হয় মাথা নুইয়ে আবার ফিরে যাবে । গুরুকে
বলবে,
--- নিমু, আপনার কালা পুড়িরেউ বিয়া করমু ।
গুরুর চাহিদাও
নেই খুব বেশি । দিনে একবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেই খুশি । খুশি হয়ে বলেন,
--- যাইতায় নি বাবাজি ।
--- কই যাইতা ।
---অউ দেখ, আইর ভাণ্ডার থাকি বার করছি চৌষট্টি পয়সা । পুরা
এক টেকা ।
--- এক টেকা দিয়া কই যাইবা । কুনুখানো যাওয়া অইত নায় ।
--- কেনে অইত নায় । অইব । দেখবায় পুরা এক টেকাউ ফিরাইয়া
আনমু ।
--- তে আনা পয়সায় অউ চলইন ।
--- রাজার বাড়িত যাইতে টেকা পয়সা লাগে না । তে লগে যে নিলাম
, টেকা থাকলে বল বাড়ে । দুই জনর জাগাত তিনজন । তুমি আমি আর এক টেকা ।
--- আপনার খালি হাউরি মাত । রাজার বাড়ি কই ।
--- সুনামগঞ্জ ।
--- ইতা কিতা কইন । আমরার দেশো যাইতা । যাইবানি বইয়াখাউরি ।
বৈতলের খুব
খুশি, খুশিতে ডগমগ । গুরুকে সে জল দেখাবে , ভাটির দেশের জল, বিল আর হাওরের জল ।
মাধবগঞ্জ হয়েই তো যেতে হবে সুনামগঞ্জ , সোজা গেলে সুনামগঞ্জ ডান দিকে ছাতক । তবে
একটা আশঙ্কাও আছে বৈতলের মনে । কোথায় নিয়ে যাবে সে মানী মানুষকে । বাপ যদি
রাগারাগি করে । মা থাকলে খুশি হত , বিব্রতও হত । এত বড় মানুষ , তার বৈতল যাকে গুরু
মেনেছে তিনি কি আর তাদের মতো সাধারণ । কোথায় থাকতে দেবে , কী খেতে দেবে । বৈতল শুধু মুচকি মুচকি হাসবে । বৈতল
তো জানে গুরু তার কোন মাটির মানুষ । কিন্তু সৃষ্টিধর ওঝা যদি
না করে দেন , বলে দেন যাবেন না বিল হাওর ভাটির দেশে । সুনামগঞ্জও তো ভাটির
দেশ , তবে । তবে কেন চুপ শিষ্য বৈতলের
প্রিয়তম মানুষ । বৈতলের উৎসাহের জবাবে চুপ থাকার অর্থই তো যাবেন না । বৈতল লুলাকে
বলেছিল একসঙ্গে যাবে লক্ষণশ্রী । লুলা যদি বইয়াখাউরিতে অপেক্ষা করে থাকে বৈতলের
জন্য । গুরু সৃষ্টধরকে অবিশ্বাস করে না বৈতল, নিশ্চয় কারণ আছে চুপ থাকার । নৌকো
করে আসতে আসতে বৈতল গুরুর কাছ থেকে শোনে তাঁর চুপ থাকার হেঁয়ালি রহস্য । বলেন,
--- সুরমা নদী দিয়া সুনামগঞ্জ যাওয়া সব থাকি সহজ রেবা ,
ভাটির টানে লামি যাইবায় ।
--- আর ফিরার সময়
তো উজান ।
--- ই ও এক মজা, যখন উজাইবায় তখনও কিন্তু কষ্ট কম, সময় কম
লাগে ।
সুনামগঞ্জের ঘাটে নৌকো থেকে নেমেই দেওয়ান বাড়ি । দেওয়ান বাড়ির পিছনে এক মস্ত বড় দিঘী, দিঘীর সঙ্গে
সুরমা নদীতে যাওয়ার জলপথ ছিল এক কালে । নদীর ভাটিতে দুলতে দুলতে গুরু শুনিয়েছেন
তার আগবেড়ানির বার্তা । রামপাশা আর লক্ষণশ্রীর তীর্থভ্রমণ কথা ! এক জমিদার কথা ,
দেওয়ানজির কথা । বলেন,
--- লেখত পারব নি কও কেউ এমন কথা, এমন গান
‘মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন’
সৃষ্টিধর গুরু
শ্যামলা সুনামগঞ্জের এদিক ওদিক দেখেন আর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন । শিষ্যকে ডেকে
বলেন,
--- দেখরায় নি, চাইরো দিকে হাসন রাজা । আর তান গান,
‘আমিই মূল নাগররে
আসিয়াছি খেউড় খেলিতে
ভব সাগররে রে ।
আমি রাধা আমি কানু
আমি শিবশঙ্করী’
মুসলমান ধর্মের তো নাচগান মানা । হাসন রাজা কিন্তু মনের
আনন্দে গাইতেন,
‘হাছন রাজার লাগিয়াছি শ্যাম পীরিতের টানা
হাছন রাজায় শুনে না ত কট মুল্লার মানা
বাজায় ঢোলক,বাজায় তবলা আর গায় গানা’
তাইন সব মানতা,
অন্ধতা মানতা না, তাইন বাঙালি আছলা রেবা, কুনু ভেদাভেদ আছিল না । তান বাপর বাড়ি সিলেটর রামপাশা,
কিন্তু থাকতা সুনামগঞ্জর লক্ষ্মণছিরি । কেনে জানো নি ।
--- জানি । গাঙর লাগি, সুরমা গাঙর লাগা তান বাড়ি এর লাগি ।
আপনার লাখান আমারো মনে লর একটা গান গাই । গাইতাম নি ।
--- গাও রেবা গাও, দিওয়ানা অইয়া গাও ।
গুরু দিওয়ানার
সূত্র ধরিয়ে দেওয়ায় বৈতল গায় ।
--- ‘সোনা বন্ধে
আমারে দেওয়ানা বানাইল ।
দেওয়ানা বানাইল মোরে, পাগল করিল ।’
গুরু সৃষ্টিধরের
ভালর মধ্যে মন্দও আছে কিন্তু । গুরুর
প্রাণের আরাম যখন হয় তখন কোনও বাধা মানে না । সুরমা নদীর জলকল্লোলের সঙ্গে বাউলার
গান গুন গুন করেই চলেছে তাঁর কণ্ঠে । তাই শিষ্যকে থামিয়ে নিজেই গেয়ে চলেন একমনে,
হাসন রাজা
বাঙালি হয়ে কাঙালি
প্রেমানলে
জ্বলিয়ে যায় প্রাণ
আমি তোমার
কাঙালি গো সুন্দরী রাধা...
তোমার লাগি
কান্দিয়া ফিরে
হাসন রাজা
বাঙালি গো ।
হিন্দুয়ে
বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা
রাধা বলিয়া
ডাকিলে মুল্লা মুসল্লিয়ে দেয় বাধা ।
শিষ্যকে শোনান অনেক
মজার তথ্য । বলেন,
--- তান শখ আছিল বউততা । হাত্তি পালতা, ঘোড়দৌড় করাইতা,
জলমুরগি পালতা । বউত শউখিন আছলা ই জমিদার । কিন্তু তান ঘরো কুনু শখর জিনিস আছিল না,
এক কাঠর তক্তা ছিড়া পাটি নাইলে শতরঞ্চি চেয়ার টেবিল টুল অতাউ । বাড়ির উতরে দি নু সুরমায় নাচতা,
তাইনও নাচতা , নৌকাত উঠিয়া ধেই ধেই করি নাচতা । আর গান গাইতা । বহুত সাঙ্গোপাঙ্গো
নিয়া বার অইতা রাস্তাত । একজনর হাতো থাকত এক লেমটন, দিনও জ্বলত । আর তাইন গাইতা
একমনে গান,
‘ প্রেমের আগুন লাগল রে, হাছন রাজার অঙ্গে
নিভে না
আগুন, ডুবলে সুরমা গাঙে ।’
লন্ঠন জ্বালিয়ে
দিনের বেলা পথ চলতেন হাছন রাজা । সুফী সাধুরা যে মনে করতেন এই জগৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন
, তাই আলোর প্রতীক । গুরুর মতো এত না জানলেও বৈতলও জানে কিছু কিছু । লুলার কাছ
থেকেও জেনেছে কিছু । সেই জানা অংশ থেকে সুনামগঞ্জের বৈতল শোনায় কিছু তথ্য । বলে,
--- হাসন রাজা তো
নাই ।
--- না রে বা নাই ।
--- একলেমুর রাজা আছইন । তান পুয়া । তাইনও অলাখান , দেওয়ানা
। তারা বুলে আগে হিন্দু আছলা ।
--- তে কিতা অইল বাবা । খালি হিন্দু থাকিনি মুসলমান অইছইন ,
বাংলাত তো বেশিরভাগ মানুষ আছিল বৌদ্ধ । নেড়া মাথা থাকি বেশি অইছইন মুসলমান ।
শঙ্করাচার্য নামর এক সাধু না অইলে আমরাও অইলাম নে বৌদ্ধ , তার পরে মুসলমান । ইতা
কিচ্ছু নায় , ধর্মর গুরু হকল খুব ভালা আছলা , মাইনষর ভালা করতা চাইতা , হাছন রাজার
মতো । তার পরে তারার শিষ্য সাবুদে সব নষ্ট করি দিছইন । ইতা আমার গাউআলা বুদ্ধি
দিয়া যেতা বুঝি বা ।
--- ইলাখান আর একজনর গানও আমি জানি । হুনতানি ।
--- গানর লাগি বাবা জিগানি লাগে নি, গাও ।
উচ্চ গ্রামে ‘ওগো
সজনি’ র ধুয়া ধরতেই প্রমাদ গোনেন গুরু । ‘ গুয়াগাছো টেক্সো লাগিল নি’র পর আবার ‘ও
সজনি’ গাইতেই বৈতলের মুখ চেপে ধরেন সৃষ্টিধর ওঝা । বলেন,
--- চুপ চুপ বাবাজি । ইগান হুনলে পুলিশে ধরব ।
--- ইতা কিতা কইন । গান গাইলে কেনে পুলিশে ধরত । ইতা কুনু
চুরি ডাকাতি নি ।
--- বন্দেমাতরমও তো গান রেবা । কেনে পুলিশে ধরে । আসাম
সরকারর এক কালা কানুনর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলা বাগরসাঙ্গনর পল্লীকবিয়ে । গাও
বাবা গাও ইতা এমনেউ কইলাম । গাউর মাইনষর উপরে টেক্সো লাগাইছিল আসাম সরকারে । তখন
ইগান হুনলেউ পুলিশে ধরত । অখন নাই । তান নাম আব্দুল গফ্ফার দত্ত চৌধরী । তান লেখা
শ্যামাসঙ্গীতও আছে, হুনো,
‘লুকাবি
আর বল কোথা মা
ধরেছি এই অভয় চরণ ভয় দেখানো মিছে
শ্যামা ।’