“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

পোষা কবি


রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
(C)Image:ছবি














ধার দেনা করে কিছু লাইক
আর কিছু পোষা কবি ফেইসবুকে
অহেতুক চেঁচাবে না আজ।

মদখোরের ভরাট পাতায় জেগে উঠবে না
 পেন্ডুলামের উলঙ্গ নিশ্বাস।

শয়তান- ভগবান-কবি তিনে মিলে
অস্তিত্ব ময়দানে খেলায় মদমত্ত
প্রত্যেকেই নিজেদের লেজটুকু পেঁচিয়ে
কুতুকুতুতে গা এলিয়ে প্রতিশব্দ শুনতে চায়।

আলস্য রাতে তিন নারীর আচল ভিজিয়ে ভদকা প্রেমী
কবিতা খাতায় শুকায় ছেড়া কন্ডোম


মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

চৈখোয়াঘাট - গুরুত্বহীন এক গ্রামের উপাখ্যান

Dhola CHaikhowa bridge
ধলা-ছৈখোয়া সেতু

।। আশু পাল।।

২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে বিবেক র‍্যালি থেকে ফিরে আসার সময় প্রথম খেয়াল করলাম। যোগীঘোপার পর ব্রহ্মপুত্রের উপর নর-নারায়ণ সেতু পার হতেই যে গ্রামটি, তার নাম পঞ্চরত্ন। এখান থেকেই রাস্তার নাম পালটে হয়ে গেল ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়ক। সেতুর উপর ট্রাফিক জ্যাম থাকায় আমাদের গ্রুপের বেশ কয়েকজন আটকা পড়ে রয়েছে। এখনও এসে পৌছায় নি। তাই অপেক্ষা করতে হবে। পঞ্চরত্ন বাজারের পথের পাশের দোকানে ঢুকলাম। দোকানে বসেছিল সাত আট বছরের একটি শিশু। শুধালো, কি চাই ? বললাম, বড় কেউ নেই ? তুমি কি পান দিতে পারবে ? বাচ্চাটি পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচালো, “বাবা, একজন-রে পান দিয়া যাও আইয়া। আইব্বাস ! এ তো দেখি সিলেটি বাঙালি ! মালিককে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তারা ৬২ পরিবার ত্রিপুরার চন্দ্রপুর থেকে এসেছেন বছর চল্লিশেক আগে। জানালেন, ব্রহ্মপুত্রের গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া টিলা গুলোতে গড়ে ওঠা গ্রামে রয়েছেন প্রচুর বাঙালি। প্রায় সবাই মৎস্যজীবী। কথা আর বেশী এগোয় না। ইতোমধ্যে সঙ্গীরা চলে এলে আমরা আবার যাত্রা শুরু করি। গুয়াহাটির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করলাম রাস্তার পাশের মাইল ফলক গুলিতে কৃষ্ণাই, দুধনৈ, ছয়গাঁও ইত্যাদি নামগুলো যেমন আছে, তেমনি মাঝে মাঝে আছে আরেকটা নাম, চৈখোয়াঘাট। দূরত্বের হিসাবে সবচেয়ে বেশী। নামটা শোনা শোনা লাগলেও আমার দুর্বল ভূগোল জ্ঞানের জন্য চৈখোয়াঘাটের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি। তারপর নামটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। ডিব্রুগড়ে এসেও দেখি সেই চৈখোয়াঘাটের নাম রাস্তার পাশের ফলকে জ্বলজ্বল করছে। বাপ্‌ রে, আরও দূর ! প্রায় ৮৬ কিলোমিটার।

Dhoal Bridge and Ferry Ghat
ধলা সেতু এবং ফেরিঘাট
BIchakocpi T.E
বিছাকুপি চা-বাগান
Bhuban Khal Beidge
ভূবনখাল সেতু
Dhaba NH 37
NH37 ধাবা
          আমার সহকর্মী হিফজুর জানালো, তার এন আর সি ডিউটি পড়েছে চৈখোয়াঘাটে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার সে গিয়েও এসেছে। রবিবারের ভোরে চললাম সেই অদেখাকে দেখতে। তিনসুকিয়ায় পৌছে গেলাম সাড়ে আটটায়। তার হাতের রান্না আলু-টম্যাটো দিয়ে ট্যাংরা মাছের ঝোল ভাত এক থালা সাবাড় করে তাকে নিয়েই আবার যাত্রা করলাম শুরু। ৮ কিলোমিটার দূরে মাকুম। এখান থেকেই ডানদিকে রেল লাইন পেরিয়ে যেতে হয় ডিগবয়, মার্ঘেরিটা। তারপর লিডু, লেখাপানি, জাগুন, জয়রামপুর হয়ে স্টিলওয়েল রোড চলে গেছে মায়ানমারের শহর Mytkyinya পর্যন্ত। আজ ওদিকটা থাক। আমরা এগোই আমাদের পথে। প্রথমেই পেলাম সাপজান (অসমীয়া উচ্চারণে হাপজান’) চা বাগানের ফ্যাক্টরি মাত্র ১০৪ বছরের পুরোনো। পরের গঞ্জ (এ গুলিকে শহর বলা যায়না, আবার গ্রাম বললেও তাদের প্রতি অন্যায় করা হবে) বড় হাপজান। অসমীয়ায় ছোট খাল-কে বলে জুরি’, মাঝারী জলস্রোত কে বলে জান। (বরাক, ত্রিপুরায় যেমন বলে ছড়াবা ছড়ি’, উত্তরবঙ্গে বলে ঝোরা’ ) সাপের মত এঁকেবেঁকে গেছে বলে এই ছড়াগুলোর নাম হাপজান। আরও কিছুটা এগোতেই দেখি নিরালা জায়গায় সুন্দর একটা হোটেল। যেমন মনোরম করে সাজানো, তেমনি অভিনব নাম – ‘ধাবা NH 37’ আধ মিনিট না দাঁড়িয়ে পারলাম না। এর পরেই এলো হাঁহচরা। (ইংরাজিতে Hansara) নিচু জলাভূমিতে একসময় শীতকালে প্রচুর হিমালয়ান হাঁস এসে আস্তানা গড়তো। তাই হাঁহচরা। মানুষনামের একপ্রকার দু-পেয়ে হিংস্র প্রাণীর দৌরাত্ম্যে হাঁসেরা এখানে আর আসেনা। শুধু নামটাই রয়ে গেছে। পরের শহর ডুমডুমা বা দুমদুমা। ছোট্ট চা বাগান ভিত্তিক শহর হলেও প্রায় সমস্ত নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থাই রয়েছে এখানে। দুমদুমার গায়েই লেগে আছে এক বিশাল চা বাগান। নাম, বিছাকুপি। স্থানীয়রা বললেন, আয়তনে বিছাকুপি নাকি এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বাগান। কোনও স্বীকৃত তথ্য কেউ অবশ্য দিতে পারলেন না। হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। বিশালত্বে মোহিত হয়ে অতিরঞ্জন মানুষের বড় প্রিয় অভ্যাসতিন কিলোমিটার পর রূপাই। আসল নাম রূপসী বা রূপহী। এখান থেকেই ডান দিকে শুরু হয়ে যায় জাতীয় সড়ক ৫২-বি। অরুণাচল প্রদেশের নামসাই ও লোহিত জেলায় যাওয়ার এটাই রাস্তা। পরশুরাম কুণ্ড বা ব্রহ্মকুণ্ডেও যেতে হয় এই পথেই। আমরা আজ ওদিকে যাবোনা। সোজা রাস্তায় বাইক ছুটছে। কালো গর্তহীন মসৃণ রাস্তা। বরাক উপত্যকার রাস্তাগুলির দুরবস্থার কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। পেরিয়ে গেলাম ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশের একটা বিরাট স্থায়ী ক্যাম্প। এখান থেকেই পুরো অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তের জওয়ানদের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আরও দুটো বড় চা বাগান টিপুকআর খবংপেরিয়ে এলাম। এবার তালাপ। একেবারে ছবির মত সুন্দর একটা জনপদ। ৪৫ ফুট চওড়া রাস্তা দেখে ঈর্ষা হয়। ব্যবসাকেন্দ্রটির প্রকৃত নাম বালি বাজার। পাশেই তালাপ চা বাগান, তাই বাগানের নামেই বেশী পরিচিত হয়ে গেছে জায়গাটি। ডাঙরি নামের একটা নদীর সেতু পেরিয়ে পেলাম একই নামের বাজার। আরও মাইল চারেক ধানের ক্ষেত পেরিয়ে এল ধলা। এই ধলা-ই এখন চৈখোয়াঘাট নামে পরিচিত। আমারা যেখানে থামলাম, ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়কও সেখানেই শেষ হয়ে গেল।
A Part of DHola Bridge frm 2km Distance
দুই কিমি দূর থেকে ধলা সেতুর একাংশ
             
100 Years old LP School
শতবর্ষ প্রাচীন প্রাথমিক বিদ্যালয়
            টাই-আহোম ভাষায় চৈমানে হচ্ছে কর, খাজনা বা ট্যাক্স। যিনি চৈআদায় করে খান, মানে ট্যাক্স আদায় করা যার জীবিকা, তিনিই চৈখোয়া। শিবসাগর থেকে উজানে ধলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরের সমতলে আহোম-রাজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ছিল না উত্তর পাড়ের পাহাড়ে। পাহাড় অঞ্চলে ছিল চুটিয়া আর ভূঞা রাজাদের শাসন। অথচ এখানে, মানে ধলা এলাকায় নদীর উত্তর দিকে রয়েছে প্রচুর কৃষিযোগ্য সমভূমি। ওই এলাকার নাম সদিয়া। আহোমরাজ চাইলেন সদিয়া দখল করতে। আহোম আর চুটিয়াদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয় এই চৈখোয়াঘাট অঞ্চলে। চুটিয়ারা পরাস্ত হয়ে সদিয়া ছেড়ে পশ্চাদপসরণ করে। সদিয়া চলে আসে আহোম করায়ত্তে। কিন্তু বর্ষার ভয়াল লোহিত পেরিয়ে সদিয়ায় যাওয়া আসা অসম্ভব। তাই বেশ কিছু সৈন্য সহ একজন চৈখোয়া’ (ট্যাক্স কালেক্টার) নিযুক্ত করা হল সদিয়ায়। হেমন্তে তিনি সংগৃহীত রাজস্ব এনে জমা দেন রাজকোষে। তা ছাড়াও বিভিন্ন কাজে এপারে তাঁকে আর গ্রামবাসীদের আসতেই হয়। উপযুক্ত জায়গা দেখে তৈরি হল নদী পারাপারের ঘাট। নাম হয়ে গেল চৈখোয়াঘাট। আসল চৈখোয়াঘাট ওপারে, সদিয়ায়। কিন্তু নৌকা তো এপারের ঘাটে এসেও ভীড়ে। তাই এপারের ঘাটের নামও তাই। সেতু না হওয়া অব্দি ওপারে রাস্তা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই এপারেই শেষ হয়ে যায় ন্যাশনাল হাইওয়ে থার্টি সেভেন।

Indo Tivetan Border Police camp
ভারত তিব্বত পুলিশ চৌকি
              সাধারণ ভাবে সবাই এখানে নদীকে বলে ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু ভূগোল বলছে, এটা ব্রহ্মপুত্র নয়। তিনটে বড় নদীর জলধারা একসাথে মিলে যাবার পর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। অরুণাচল প্রদেশের একেবারে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে নেমে আসা কয়েকটি জলধারা মিশে তৈরি হয়েছে লোহিত নদী। মহাভারতের যুগের আগে এই লোহিতের জলরাশিই আটকা পড়ে (সম্ভবত ভূমিকম্প বা অন্য কোন কারণে পাহাড়ে বিশাল ধস্‌ নেমে স্রোতধারা থেমে গিয়েছিল) তৈরি হয়েছিল এক বিশাল হ্রদ। তার নাম ছিল ব্রহ্মকুণ্ড। পিতার আদেশে কুঠার দিয়ে মাতৃহত্যা করার পর যখন সেই কুঠার পরশুরামের হাতে চিপ্‌কে গেল, তখন পিতাই তাকে মুক্তির উপায় বলে দিলেন। ব্রহ্মকুণ্ডের একটা অংশ কেটে সেই জলরাশিকে মুক্ত করে দাও। পরশুরাম সেই কাজটাই করলেন এবং হাত থেকে কুঠার খসে পড়ল।  ওটাই লোহিত নদী। ব্রহ্মকুণ্ড থেকে উৎপত্তি বলেই সে নদ ব্রহ্মার পুত্র ব্রহ্মপুত্র। পরশুরাম কুণ্ড থেকেই লোহিত নদী পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে আসে এবং পশ্চিম অভিমুখী হয়ে এগোতে থাকে। লোহিত অববাহিকার এই সমতলে আহোম রাজত্ব কায়েম ছিল। উত্তরের পাহাড় থেকে যে আরও দুটো বিশাল নদী এসে মিশেছে, সেটা শুরুর দিকে আহোম-দের অজানা থাকার সম্ভাবনাই বেশী। কেননা, চুটিয়া ও ভূঞাদের দাপটে ওই অঞ্চলে আহোমেরা ঢুকতেই পারেনি। তাই নিম্ন অববাহিকায়ও ব্রহ্মপুত্রের পরিচিতি থেকে যায় লোহিত বা লুইত নামেই। চৈখোয়াঘাটের পাঁচ-ছকিলোমিটার নিম্ন অববাহিকায় অজস্র ধারায় এসে মিশেছে দিবাং নদী। তার আয়তনও বিশাল। দিবাং এসেছে উত্তর অরুণাচলের পাহাড়ের জলরাশি নিয়ে। তবে তার মূল উৎপত্তি ভারতের সীমানা ডিঙিয়ে চীন ভূখণ্ডের সামান্য ভিতরে। দিবাং আসছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, কিন্তু লোহিতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরও মিলিত জলধারার দিশা থেকে যায় পশ্চিমেই। আরও একুশ কিলোমিটার নেমে আসার পর দেখা মেলে সিয়াং নদীর। এই সিয়াং-ই আসছে হিমালয়ের মানস সরোবরের কাছাকাছি এলাকা থেকে, অরুণাচলের পাসিঘাট শহরের গা ধুইয়ে। এটা মিশেছে ডিব্রু-চৈখোয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের উত্তর দিকে। এখান থেকেই ব্রহ্মপুত্র মহাবাহু চেহারা নিয়েছে। এ নিয়ে কেউ বিতর্ক করতেই পারেন। আমার যুক্তি হল, লোহিত বা লুইতকে যদি ব্রহ্মপুত্র বলতে হয়, তা হলে তার উৎপত্তিস্থল হিসেবে মানস সরোবরকে বলা অযৌক্তিক। আর মানস সরোবরকে যদি ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থল বলে দাবী করতে হয়, তা হলে লোহিতকে ব্রহ্মপুত্র বলা উচিৎ নয়। তিন নদী একসাথে মিলে যাওয়ার পরই তাকে ব্রহ্মপুত্র নামে ডাকা সঠিক।

             সদিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য তৈরি হচ্ছে সুদীর্ঘ এক সড়ক সেতু, এই ধলা-চৈখোয়াঘাটে। অনেকটাই এগিয়ে গেছে সেতুর কাজ। দৈর্ঘ্যের তালিকায় এটা কত নম্বরে পড়বে জানিনা, তবে এটাকে সুবিশাল বলতে কোন বাধা নেই। মোট দৈর্ঘ্য ৯.৬ কিলোমিটার। সেতুর জন্য জায়গা নির্বাচন করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নদী এখানে প্রায় সমতল। দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা নিচু জলাভূমি। হেমন্তে সামান্য শুকোলেও বর্ষা এলেই জল থৈ থৈ, নদী ঢুকে পড়ে নিচু সমতলেও। ফলে, মূল নদীর উপর সেতুর দৈর্ঘ্য ৪.৪ কিলোমিটার হলেও দুই পাড়ে অনেক দূর থেকে সেতু শুরু এবং শেষ করতে হয়েছে।
Sanat Debnath in his shope
সনৎ দ্দেবনাথের পানের দোকান
Wide Road At Talap
তালাপ বস্তির প্রশস্ত রাজপথ
৩৭ নম্বর জাতীয় সড়ক যেখানে শেষ, সেখান থেকে বাঁয়ে ঢুকে গেছে একটা ছোট পাকা রাস্তা। মিরিপাথার, হাতিঘুলি, বরমুরা প্রভৃতি গ্রাম রয়েছে এদিকে। আর সোজা এগিয়ে গেলে ভুবন খাল। মাঝারী একটা জলধারা। এসেছে সুদূর ন-দিহিং নদী থেকে ছিট্‌কে গিয়ে। ভুবনখালের ওপারে খেরবাড়ি, মিলনপুর গ্রাম। বর্ষায় ব্রহ্মপুত্র যখন রুদ্ররূপ নেয়, তারা চলে আসেন ধলার উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে। খুব আশ্চর্য হয়ে জানলাম, এই গ্রামগুলির নব্বই শতাংশই বাঙালি এবং আরও অবাক করার কথা, তাদের প্রায় সবাই সিলেটি। শুধু খেরবাড়িতেই আছেন ২১০ ঘর। কবে, কি কারণে এরা এখানে এসে বসত গড়েছিলেন, বর্তমান প্রজন্ম জানে না। কৃষির পাশাপাশি মাছ ধরে বিক্রি করা এদের পেশা। হিফজুরের এন আর সি তথ্যের ভিত্তিতে, এদের আশি শতাংশই পদবী লেখেন দেবনাথ। আর রয়েছেন দাস আর নমশূদ্র পদবীধারী মানুষ। ডিব্রুগড়েও বেশ কিছু সিলেটি আছেন। কিন্তু তাদের বর্তমান প্রজন্মের মুখের ভাষায় সিলেটি প্রায় নেই। আছে কলকাতার ভাষার আধিক্য। কিন্তু ধলা-চৈখোয়াঘাটের সিলেটিরা একেবারেই খাস সিলেটিতে কথা বলেন। কয়েকজন যুবকের সাথে কথা বলে মনে হল, শিলচরের পাশে কোনও বাজারে বসে আলাপ করছি। ধলা বাস স্ট্যান্ডের পাশের দোকানী ৬৫ বছরের সনৎ দেবনাথ তো পানের দামই নিলেন না। বললেন, “আফ্‌নে আমরার দেশি মানুষ ছার, কুন ভাইজ্ঞে ভাইজ্ঞে আইছইন, আফ্‌নারে চা খাওয়ানি উচিৎ আছিল্‌, পারছি না। এর উফ্‌রে পানর পইসা লইলে শরমর শেষ থাকতো নায়

              পঞ্চরত্ন থেকে থেকে চৈখোয়াঘাট, মোট ৭৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়কের দুই প্রান্তেই বাঙালি বহু জাতির বাসস্থান, বহু ভাষাভাষী মানুষের আবাস আসামের এও এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি-- ভাটি পর্ব ১৫


পনেরো
 (দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার পঞ্চর্দশ  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
    কোথায় যায় বৈতল । এমন মানুষকে ছেড়ে থাকা যায় । পাহাড় বেয়ে নামতই নামতে কচি চা পাতার গন্ধে বিভোর হয়কিছুদূর পর চায়ের গন্ধ কড়া হয়, নেশা ধরে । চাঘরে চা হচ্ছে খাকি হাফপ্যান্ট আর হ্যাট মাথায় চাঘর বাবুর কাছে চাইবে একমুঠো চা, তাজা চা । চায়ের গন্ধে বিভোর হওয়া মানে শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি হওয়া । তবে কি আবার রেলগাড়ি চাপবে, আবার রইদপুয়ানি , তারের উপর ফিঙ্গে পাখির নাচ । না, বৈতল আর পুব মুখো হবে না, এবার উত্তরে গমন । আবার বইয়াখাউরি । ওখানে সে কার জন্য চা নিয়ে যাবে । এবার লুলাকে খুঁজে বের করবে । বলবে,
--- আয়, এঙ্গা ভাঙ্গিদে, মিল কর । আবার আমরা বন্ধু ।
       লুলাকে মিষ্টি কথা বললে হবে না । ওকে মারতে হবে কষে এক লাথি । তবেই সে ঠিক হয় । এত কথা জমে গেছে যে একা একা বইতে পারছে না । চামেলি চায়নার  কথা বলতে হবে । লুলা তো আবার সাধুমানুষ , মেয়েমানুষের কথা পছন্দ করে না । কিশোর বেলায় সেই এক ধলা মেয়ের কান ছেঁড়ায় রেগেছিল, বলেছিল ,
--- গুনা  করিলাইচছ দোস্ত ।
       প্রায়শ্চিত্ত তো করেছে বৈতল । কালো বরণী ফিঙে পাখির গায়ে হাত দেয় নি, ছেড়ে চলে এসেছে । লুলা পাইয়ে দিয়েছিল বৈতলকে তার গুরু । গুরুর কথা বলতে হবে না ! গুরুর কথা শুনলে খুশি হবে লুলা । খুশিতে উজ্জ্বল মুখটাও তার মলিন হয় অভিমানে । একবার, এত বছরে একবার বন্ধুকে দেখার  ইচ্ছে হয়নি । কিসের তবে বন্ধুত্ব । বৈতল আবার উল্টোপায়ে হাঁটে । কাজ নাই গিয়ে বইয়াখাউরির ভাটিতে । জালুয়াগিরি করে কী হবে বড় হাওরে । এর থেকে ভাল ওঝার চেলাগিরি । কত কথা শোনা যায়, দেখা যায় নিত্যনতুন গ্রাম, চেনা হয় জানা যায় ইতিহাস । অর্গল খুলে বেরিয়ে আসা ঘরে না হয় মাথা নুইয়ে আবার ফিরে যাবে । গুরুকে  বলবে,
--- নিমু, আপনার কালা পুড়িরেউ বিয়া করমু ।
   গুরুর চাহিদাও নেই খুব বেশি । দিনে একবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেই খুশি । খুশি হয়ে বলেন,
--- যাইতায় নি বাবাজি ।
--- কই যাইতা ।
---অউ দেখ, আইর ভাণ্ডার থাকি বার করছি চৌষট্টি পয়সা । পুরা এক টেকা ।
--- এক টেকা দিয়া কই যাইবা । কুনুখানো যাওয়া অইত নায় ।
--- কেনে অইত নায় । অইব । দেখবায় পুরা এক টেকাউ ফিরাইয়া আনমু ।
--- তে আনা পয়সায় অউ চলইন ।
--- রাজার বাড়িত যাইতে টেকা পয়সা লাগে না । তে লগে যে নিলাম , টেকা থাকলে বল বাড়ে । দুই জনর জাগাত তিনজন । তুমি আমি আর এক টেকা ।
--- আপনার খালি হাউরি মাত । রাজার বাড়ি কই ।
--- সুনামগঞ্জ ।
--- ইতা কিতা কইন । আমরার দেশো যাইতা । যাইবানি বইয়াখাউরি ।
        বৈতলের খুব খুশি, খুশিতে ডগমগ । গুরুকে সে জল দেখাবে , ভাটির দেশের জল, বিল আর হাওরের জল । মাধবগঞ্জ হয়েই তো যেতে হবে সুনামগঞ্জ , সোজা গেলে সুনামগঞ্জ ডান দিকে ছাতক । তবে একটা আশঙ্কাও আছে বৈতলের মনে । কোথায় নিয়ে যাবে সে মানী মানুষকে । বাপ যদি রাগারাগি করে । মা থাকলে খুশি হত , বিব্রতও হত । এত বড় মানুষ , তার বৈতল যাকে গুরু মেনেছে তিনি কি আর তাদের মতো সাধারণ । কোথায় থাকতে দেবে ,  কী খেতে দেবে । বৈতল শুধু মুচকি মুচকি হাসবে । বৈতল তো জানে গুরু তার কোন মাটির মানুষ । কিন্তু সৃষ্টিধর  ওঝা যদি  না করে দেন , বলে দেন যাবেন না বিল হাওর ভাটির দেশে । সুনামগঞ্জও তো ভাটির দেশ , তবে । তবে  কেন চুপ শিষ্য বৈতলের প্রিয়তম মানুষ । বৈতলের উৎসাহের জবাবে চুপ থাকার অর্থই তো যাবেন না । বৈতল লুলাকে বলেছিল একসঙ্গে যাবে লক্ষণশ্রী । লুলা যদি বইয়াখাউরিতে অপেক্ষা করে থাকে বৈতলের জন্য । গুরু সৃষ্টধরকে অবিশ্বাস করে না বৈতল, নিশ্চয় কারণ আছে চুপ থাকার । নৌকো করে আসতে আসতে বৈতল গুরুর কাছ থেকে শোনে তাঁর চুপ থাকার হেঁয়ালি রহস্য । বলেন,
--- সুরমা নদী দিয়া সুনামগঞ্জ যাওয়া সব থাকি সহজ রেবা , ভাটির টানে লামি যাইবায় ।
--- আর ফিরার  সময় তো উজান ।
--- ই ও এক মজা, যখন উজাইবায় তখনও কিন্তু কষ্ট কম, সময় কম লাগে ।
         সুনামগঞ্জের ঘাটে নৌকো থেকে নেমেই দেওয়ান বাড়ি । দেওয়ান  বাড়ির পিছনে এক মস্ত বড় দিঘী, দিঘীর সঙ্গে সুরমা নদীতে যাওয়ার জলপথ ছিল এক কালে । নদীর ভাটিতে দুলতে দুলতে গুরু শুনিয়েছেন তার আগবেড়ানির বার্তা । রামপাশা আর লক্ষণশ্রীর তীর্থভ্রমণ কথা ! এক জমিদার কথা , দেওয়ানজির কথা । বলেন,
--- লেখত পারব নি কও কেউ এমন কথা, এমন গান
‘মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন’
    সৃষ্টিধর গুরু শ্যামলা সুনামগঞ্জের এদিক ওদিক দেখেন আর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন । শিষ্যকে ডেকে বলেন,
--- দেখরায় নি, চাইরো দিকে হাসন রাজা । আর তান গান,
‘আমিই মূল নাগররে
আসিয়াছি খেউড় খেলিতে
ভব সাগররে রে ।
আমি রাধা আমি কানু
আমি শিবশঙ্করী’
মুসলমান ধর্মের তো নাচগান মানা । হাসন রাজা কিন্তু মনের আনন্দে গাইতেন,
‘হাছন রাজার লাগিয়াছি শ্যাম পীরিতের টানা
হাছন রাজায় শুনে না ত কট মুল্লার মানা
বাজায় ঢোলক,বাজায় তবলা আর গায় গানা’
     তাইন সব মানতা, অন্ধতা মানতা না, তাইন বাঙালি আছলা রেবা, কুনু ভেদাভেদ আছিল নাতান বাপর বাড়ি সিলেটর রামপাশা, কিন্তু থাকতা সুনামগঞ্জর লক্ষ্মণছিরি । কেনে জানো নি ।
--- জানি । গাঙর লাগি, সুরমা গাঙর লাগা তান বাড়ি এর লাগি । আপনার লাখান আমারো মনে লর একটা গান গাই গাইতাম নি ।
--- গাও রেবা গাও, দিওয়ানা অইয়া গাও ।
   গুরু দিওয়ানার সূত্র ধরিয়ে দেওয়ায় বৈতল গায় ।
---  ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল ।
দেওয়ানা বানাইল মোরে, পাগল করিল
   গুরু সৃষ্টিধরের ভালর মধ্যে মন্দও আছে কিন্তু ।  গুরুর প্রাণের আরাম যখন হয় তখন কোনও বাধা মানে না । সুরমা নদীর জলকল্লোলের সঙ্গে বাউলার গান গুন গুন করেই চলেছে তাঁর কণ্ঠে । তাই শিষ্যকে থামিয়ে নিজেই গেয়ে চলেন একমনে,
        হাসন রাজা বাঙালি হয়ে কাঙালি
         প্রেমানলে জ্বলিয়ে যায় প্রাণ
        আমি তোমার কাঙালি গো সুন্দরী রাধা...
        তোমার লাগি কান্দিয়া ফিরে
        হাসন রাজা বাঙালি গো ।
        হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা
        রাধা বলিয়া ডাকিলে মুল্লা মুসল্লিয়ে দেয় বাধা ।
 শিষ্যকে শোনান অনেক মজার তথ্য । বলেন,
--- তান শখ আছিল বউততা হাত্তি পালতা, ঘোড়দৌড় করাইতা, জলমুরগি পালতা । বউত শউখিন আছলা ই জমিদার । কিন্তু তান ঘরো কুনু শখর জিনিস আছিল না, এক কাঠর তক্তা ছিড়া পাটি নাইলে শতরঞ্চি চেয়ার টেবিল টুল অতাউ বাড়ির উতরে দি নু সুরমায় নাচতা, তাইনও নাচতা , নৌকাত উঠিয়া ধেই ধেই করি নাচতা । আর গান গাইতা । বহুত সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়া বার অইতা রাস্তাত । একজনর হাতো থাকত এক লেমটন, দিনও জ্বলত । আর তাইন গাইতা একমনে গান,
      ‘ প্রেমের আগুন লাগল রে, হাছন রাজার অঙ্গে
       নিভে না আগুন, ডুবলে সুরমা গাঙে ।’
    লন্ঠন জ্বালিয়ে দিনের বেলা পথ চলতেন হাছন রাজা । সুফী সাধুরা যে মনে করতেন এই জগৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন , তাই আলোর প্রতীক । গুরুর মতো এত না জানলেও বৈতলও জানে কিছু কিছু । লুলার কাছ থেকেও জেনেছে কিছু । সেই জানা অংশ থেকে সুনামগঞ্জের বৈতল শোনায় কিছু তথ্য । বলে,
 --- হাসন রাজা তো নাই ।
--- না রে বা নাই ।
--- একলেমুর রাজা আছইন । তান পুয়া । তাইনও অলাখান , দেওয়ানা । তারা বুলে আগে হিন্দু আছলা ।
--- তে কিতা অইল বাবা । খালি হিন্দু থাকিনি মুসলমান অইছইন , বাংলাত তো বেশিরভাগ মানুষ আছিল বৌদ্ধ । নেড়া মাথা থাকি বেশি অইছইন মুসলমান । শঙ্করাচার্য নামর এক সাধু না অইলে আমরাও অইলাম নে বৌদ্ধ , তার পরে মুসলমান । ইতা কিচ্ছু নায় , ধর্মর গুরু হকল খুব ভালা আছলা , মাইনষর ভালা করতা চাইতা , হাছন রাজার মতো । তার পরে তারার শিষ্য সাবুদে সব নষ্ট করি দিছইন । ইতা আমার গাউআলা বুদ্ধি দিয়া  যেতা বুঝি বা ।
--- ইলাখান আর একজনর গানও আমি জানি । হুনতানি ।
--- গানর লাগি বাবা জিগানি লাগে নি, গাও ।
     উচ্চ গ্রামে ‘ওগো সজনি’ র ধুয়া ধরতেই প্রমাদ গোনেন গুরু । ‘ গুয়াগাছো টেক্সো লাগিল নি’র পর আবার ‘ও সজনি’ গাইতেই বৈতলের মুখ চেপে ধরেন সৃষ্টিধর ওঝা । বলেন,
--- চুপ চুপ বাবাজি । ইগান হুনলে পুলিশে ধরব ।
--- ইতা কিতা কইন । গান গাইলে কেনে পুলিশে ধরত । ইতা কুনু চুরি ডাকাতি নি ।
--- বন্দেমাতরমও তো গান রেবা । কেনে পুলিশে ধরে । আসাম সরকারর এক কালা কানুনর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলা বাগরসাঙ্গনর পল্লীকবিয়ে । গাও বাবা গাও ইতা এমনেউ কইলাম । গাউর মাইনষর উপরে টেক্সো লাগাইছিল আসাম সরকারে । তখন ইগান হুনলেউ পুলিশে ধরত । অখন নাই । তান নাম আব্দুল গফ্‌ফার দত্ত চৌধরী । তান লেখা শ্যামাসঙ্গীতও আছে, হুনো,
              ‘লুকাবি আর বল কোথা মা
               ধরেছি এই অভয় চরণ ভয় দেখানো মিছে শ্যামা ।’

চলবে
 < ভাটি পর্ব ১৪ পড়ুন                                                    ভাটি পর্ব ১৬ পড়ুন >