“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১০ জুন, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি-- ভাটি পর্ব ১০

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  দশম  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)





দশ

      দেশ বলতে সিলেট ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না বৈতল । উত্তরে খাসিয়া পাহাড় দক্ষিণে লুসাই তিপরা আর চাকমা পূর্বে কাছাড় পশ্চিমে ময়মনসিংহ । দাড়িওলা পাঞ্জাবি ছাড়া সিলেটে ভারতের সব প্রদেশের মানুষের বসবাস । গুরুসঙ্গ করে বৈতল শিখেছে অনেক । গুরু সৃষ্টিধরের সঙ্গে ঘোরাঘুরিও কম হয় না । এর মধ্যেই দেশভাগের গল্প শুরু হয়ে যায় পথে ঘাটে । গুরুর দোকানে ঠাকুরের কুর্সি বানানো কম হয়ে যায় । কারণ হিন্দুরা কোনরকম প্রাণরক্ষা করে টিকে থাকে , ঠাকুর যখন ভাল থাকতে দেবে না তখন আর আসন কুসনের হয়ে  ভার বাড়িয়ে কী লাভ । সবাই বলাবলি করে সিলেট জেলা পাকিস্তান হয়ে যাবে । গুরু বলেন,
--- করিমগঞ্জ মহকুমা যাইত নায় । আমরার বিয়ানিবাজার রইদপুয়ানি ইন্ডিয়াত অউ থাকব ।
     আবার একদিন খবর হয় সিলেট আসামেই থাকবে । থাকবে আর যাবের এই টানা পোড়নে বিরক্ত বৈতল গুরুকে বলে,
--- ঠাকুর ,দেশ কিতা ।
--- ভালা কতা কইলায় বাবা । কিতা কইতাম কও চাইন । দেশ অইল, বুঝছনি , এক ঝাণ্ডা । বদমাশির জয়পতাকা । দেখিয়া ডরাইতা ।
--- বুঝছি না কুন্তা ।
--- অত বুঝিয়া কিতা করতায় । কিচ্ছু করতায় পারবায় নি । আটকাইতায় পারবায় কিচ্ছু । অখন দেশ অইল মন্দির আর মসজিদ । হিন্দুর আর মুসলমানের জোর যার দেশ তার । সিলেট অখন বউত পক্ষর এক কমরর তেনা । এইন টানলে হেইন লেংটা । আসামি হকলে ডরাইন বাঙালি রাজা অই যাইব । বাংলা ভাগ না অইলে হিন্দুয়ে বাবইন প্রধানমন্ত্রী পাইতা নায় । মুসলমানে ভাবইন ইন্ডিয়াত থাকলে পাড়ার তলর বেঙ অইয়া থাকন লাগব । অতাউ খেইড় । দেশ উশ কিচ্ছু নায় । মাটি লইয়া কামড়াকামড়ি ।
--- মাটিউ নি সব । জল আছে না নি ।
--- জলও ভাগ অইব । হিন্দুয়ে নিবা বরাক কুশিয়ারার জল আর মুসলমানে সুরমার পানি ।
--- পাহাড় ।
--- পাহাড়ও ভাগ অইব শুনছি । জয়ন্তীয়া ভাগ অইব । যাইতায় নি পাহাড়ো ।
      পাহাড় চড়ায় বাড়তি উৎসাহ নেই বৈতলের । জলের মানুষ জল দেখলেই খুশি । পাহাড় দূর থেকে দেখাই ভাল, মাথা উঁচু হয় । দুই দেশ হয়ে গেলে ছাতকের মেঘ এবার আসবে বিদেশ থেকে কী অপরূপ দৃশ্য হয় যখন খাসিয়া পাহাড় থেকে মেঘ ভাসতে ভাসতে ঢুকে যায় ছাতকের কমলাবাগানে । মনে হয় যেন আকাশ ভেঙে পড়বে হুড়মুড়িয়ে ।
      দেশ যদি ভাগ হয় মানুষের কী হবে তবে । হিন্দুস্তানের মানুষ পাকিস্তানে যেতে পারবে না । গুরু বলেন,
--- না ।
--- গরু ছাগল ।
--- না ।
--- জংলি জানোয়ার ।
গুরু আমতা আমতা করে বলেন,
--- পারব পয়লা পয়লা । তার পরে পারত না ।
বৈতল বলেছে,
--- আর পাখি । আকাশ কেমনে ভাগ অইব ।
গুরু বলেন,
--- অইব , কিচ্ছু একটা উপায় অইব । সীমা তো ঠিক করন লাগব ।
বৈতল আরো কঠিন প্রশ্ন করে এবার ,
--- হিপার থাকি মেঘ আইলে কে আটকাইব । হিপারোর জলে ভরা মেঘ ইপারো আইয়া ভাসাই দিলে কিতা অইব । সীমা ভাঙার শাস্তি নাই ।
গুরুর তূণে আর অস্ত্র নেই । তাই বলেন ,
--- কী জানি বা ।
    বৈতলের ছেলেবেলায় বাপ বলত ,
--- মেঘ অইল আকাশের গরু । মেঘ আকাশো চরে । জল খাইয়া পেট মোটা করে । আকতা বিয়ান দেয় ঝমঝমাইয়া ।
     জয়ন্তীয়া পাহাড়ের পুঞ্জিতে করাত টানতে টানতে বৈতল গুরুকে বলে বাপের কথা । গুরু বলে,
--- অয় ঠিক অউ কইছইন । দেখিলাও বালা করি অখন , গাই তো বুড়ি, বিয়ানও শেষ । আর বিয়ান দেয় কী না দেয় ।
      গুরুর সঙ্গে থাকতে থাকতে ওস্তাদ হয় বৈতল । বাইশ করাত আর র‍্যাঁদা চালাতে শেখে । গুরু প্রশংসা করে বলেন,
--- তুমি বাবা জাত কারিগর । যে কামোউ লাগো , সুন্দর করি শেষ করো । হিদিন অনিপণ্ডিতর সীতেশ ভটে তোমার কতা খুব কইলা । খুব সুন্দর কুস্‌সি বানাইছ , কুসসির মাথাত বুলে গড়ুড় খোদাই করি দিছ । ইতা কেমনে করলায় ।
--- আপনেউ তো কইলা বিষ্ণুর রথোর মাথাত গড়ুর বই থাকইন ।
--- অয় অয় । লেখাপড়া শিখলায় না, কিন্তু বাইশ কবি ষষ্ঠীবর দত্ত আর চৈতন্যচরণ পালর পদ্মাপুরাণ যে লাখান মুখস্ত গাইতায় পার রেবা । পাক্কা উঝা হকল হারি যাইবা ।
    গুরুর প্রশংসা নেওয়ার মতো মানসিক শারীরিক অবস্থা নয় বৈতলের । পান খেয়ে মুখের ব্যথা । পাহাড়ের পানে যে এত ঝাল জানে না বৈতল । তার উপর চুন বেশি কোয়াই সুপারিতেও নেশা বেশি । গালে ব্যথা আর মাথার চক্কর , এর মধ্যে গুরুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে । মাথা তুলে তাকাতে পারেনি, পাহাড় থেকে নেমে পালিয়েছে সোজা বইয়াখাউরি ।
    পালাবে , বৈতল আভাস দিয়ে রেখেছে আগে । গুরু তার সদা হাস্যময় । রাগ করে নি, বলেছেন,
--- বুঝি গো বাবা । পানি না দেখলে তোমার পরাণ ঠাণ্ডা হয় না । ভাটির দেশর ই এক বেমার ।
     বৈতলকে কেউ কাঁদতে দেখে নি । তবু আগের রাতে বৈতল অঝোরে কেঁদেছে শুকনো কান্না । আর পান চুন কোয়াই সুপারি খেয়েছে , মনে মনে গুরুর পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে । পরদিন নেমেছে নিচে । ওঝা বোঝে নি , কেউ বোঝে নি বৈতল কেন নামে ।
     টেলিগ্রাফের তারে ফিঙ্গা পাখির লেজ ঝোলানো নাচ দেখে কী যে নেশা হয় বৈতলেরগানে নাচে কাঠের কাজে মন কমে । চামেলির গন্ধে বিভোর হয়ে থাকে সর্বক্ষণ । গুরুর বাড়ির গুরুমা গুরুকন্যারা যখন এদিক ওদিক যায় বৈতল সঙ্গে থাকে । সৃষ্টিধর গুরুর পাঁচফুল থেকে চামেলিকে নিয়ে বাসুদেববাড়ির মন্দির অঙ্গনে হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে বারবার সঙ্গী হয়েছে উনকোটি গোটাটিকর ঢাকাদক্ষিণে । এবার বারুণি মেলা। ওঝার বাড়ির সবাই যাবে কপিলাশ্রম সিদ্ধেশ্বর শিবের বাড়ি । সিলেট জেলার সীমার বাইরে মন্দির কিন্তু মেলামণ্ডপ সিলেটে । কোথাও যাওয়ার আগে গুরু স্থান- মাহাত্ম্য শুনিয়ে দেন । বলেন, আগবেড়ানি । বেড়ানোর আগেই বেড়িয়ে আসা । বৈতলের উৎসাহের কেন্দ্রে তো গুরুর কনিষ্ঠা কন্যা । তাই চায়নাকেই বলে,
--- রেল গাড়িত ত ! যাওয়া অইব কেমনে ।
--- অয় , রেল গাড়িত অউ । টিকেট কাটিয়া যাইমু আমরা । তুমি যাইবায় তারে তারে । লেইঞ্জ ঝুলাইয়া । নাচতে নাচতে ।  

চলবে।
< ভাটি পর্ব ৯ পড়ুন                                                    ভাটি পর্ব ১১ পড়ুন >  


কোন মন্তব্য নেই: