(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার নবম অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
নয়
লোভের আঠায় জড়িয়ে পড়ে বৈতল । বইয়াখাউরির কথা
ভুলে যায় । লুলার কথাও মনে পড়ে না । মাকে দেখার ইচ্ছে হলেও দমন করে । মা-ই তো তাকে বলেছে
মানুষ হতে । মানুষের মতো মানুষ না হলে সংসারে সুখী হতে পারবে না । বৈতলের মা ভুলেও
বাপের অত্যাচারের কথা বলে না । একা একা সব সহ্য করে তার দুখিনি জননী ।
বইয়াখাউরিতে ফিরে এসে বৈতল মাকে পায়নি ।
স্বার্থপরএক মানুষকে দেখে বাড়ি ছেড়ে হাওরের পারে
বাঁশের টঙ বানিয়ে বসে থাকতে । জল দখে , মাছ দেখে, সুতার লাছি দিয়ে জাল বোনে । বৈতল
একা মানুষকে প্রশ্ন করে ,
--- আর রাইত অইলে কিতা করো ।
--- পানিত নামি । মাছ ধরি, বেচি, শুটকি দেই ।
--- পয়সা কিতা করো ।
--- তোরে জবাব দিতাম নি ।
--- দিও না । কও মারে মারলায় কেনে ।
--- জানি তুই জিগাইবে । আমি মারছি না । মারছে
তোর হউ বেটিয়ে ।
--- কে । কার কথা কইরায় ।
--- যে বেটির লাগি সবরে ছাড়িয়া গেলে গি । তুই
যাওয়ার পরে খালি কান্দত তোর লাগি । তোর মামায় আইয়া লই গেল মিরতিঙ্গা । হনো
সাপে কামড়াইল , লুলা আছিল ইনো , হেও গেল । ঝাড়াঝাড়ির কতা কইছিল হে খালি কান্দল ।
--- তেও আমারে খবর দিলায় না । তুমি নি গেছলায় ।
--- আইজ তর লাগি মাছ ধরমু ।
--- বাদ দেও ইতা মাত । আমি থাকতাম নায় তুমার
টঙ্গো ।
--- তুই আর যাইছ না । থাকি যা ।
--- আইমু । তোমার লগে হিসাব আছে ।
কিসের হিসাব কিছুই জানে না বৈতল । শুধু এটুকু জানে তার মা নেই । বৈতল জানে
তার মা জীবনে সুখের মুখ দেখে নি এই মানুষটার জন্য । মাকে দগ্ধে দগ্ধে মেরেছে তার
বাপ । সাপের কামড়ে মুক্তি পেয়েছে , বাপ এমনিতেই তার
শরীর মন বিষে নীল করে রেখেছে কবেই । তবু বৈতল বাপের বিরুদ্ধে কথা বলে নি । কিশোর
বৈতলের বয়স হয়নি তখনও হিসেব চাওয়ার । বাপকে ভয়ও করত বৈতল ।
এতদিন পর আগল ভেঙেছে, একটা অপরিচয় তৈরি হয়েছে বলে মুখের উপর বলতে পারে । হয়তো বৈতল
নিজের সঙ্গেই হিসেব হিসেব খেলা খেলছে । কার দোষ , মার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী । বাপ
, নাকি সে নিজে । কালনাগ তো উপলক্ষ । মা তো অনেক আগেই চলে গেছে
তার জীবন থেকে । মা বলেছে তাই মানুষ হওয়ার জন্য যখন ছেড়ে যায় মাকে ।
এভাবে কেউ মাকে ছেড়ে যায়, নিজের বাড়ি ছেড়ে যায় । পাটনি বাড়ির দারিদ্র্যের সঙ্গী
অশান্তি এড়াতে গিয়ে নিজেই পালিয়ে যায় বৈতল । বৈতল থাকলে মার মিরতিঙ্গা যাওয়া হত না
একা একা । মা বৈতলকে সঙ্গে নিয়েই যেত । বৈতল ভগবান মানে না , মাকে মানে বলে বড়াই
করে । গ্রাম ছাড়া থাকতে পারে না । শহরবাসীর স্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ
করে না । পাগলা বা ছাতক গেলে পাগল হয়ে যায় বাড়ি ফেরার জন্য ,
মায়ের হাতের শুঁটকি পোড়া ভাত-এর জন্য । সুখী মানুষের বাচ্চাদের দেখে হিংসা হয়
বৈতলের । বৈতল তার মার জন্য গর্ববোধ করে, জানে সবার মার থেকে ভাল মা তার । তাই
পাগলার দামবাড়ির বৌদের গায়ে সোনাদানা দেখলে হাত নিশপিশ করে । পেশকারের মেয়ে তাকে
চাকর বলায় অপমানিত হয় । বৈতল মার কাছেই বারবার ফিরে আসতে চেয়েছে । বৈতল মাছ ধরাটা
জানে, মাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারে । চুরি করাটাও জানে , মা জানে না । কিন্তু বেশ তো
থাকতে পারে মনের ব্যথা আনন্দ একজনের কাছে সপে দিয়ে । হ্যাঁ , যখন অসহায় হয়েছে
ভগবানের কাছে মাথা কুটেছে । নিজের জন্য নয় , মাকে সুখী করতে সুস্থ রাখতে অলৌকিকের
আশ্রয় চেয়েছে । নিজের জন্য বৈতল কারো কাছে হাত পাতেনি । ভগবানের কাছেও না । লুলা
মানে । বলে,
--- আমি তোর মতো নায় । আল্লা আছইন , সব দেখরা ।
বৈতল ছোটবেলা থেকেই মনসাপূজোর
ধূমধামে সামিল হয় । বোঝা বেঁধে কাঠালপাতা খেতে দেয় বলির পাঁঠাকে । পাঁঠার মাংসে
তার লোভ আছে । মা রাঁধে লংএলাচ দারচিনি দিয়ে । বাপ কখনও পূজাপার্বণের ধার ঘেঁষে না
। কিন্তু মনসা পূজায় মেতে ওঠে । বলে,
--- ই বেটিও জমিদারনি । কিন্তু মাতন যায়, কথা
কওয়া যায় । আদায় করা যায় । চন্দ্রধরে যেলাখান পারছে ।
সাধারণ পুজোর গল্প নয়, শুধু চালকলার নৈবেদ্য নয় , আছে সংকল্প , মনসামঙ্গলের
কথায় আছে প্রতিবাদের গল্প । প্রতিরোধ আর সংঘাত । ধর্মকে নিপুণভাবে তছনছ করার কথা ।
ছোটবেলা থেকেই বাপের কথায় প্রভাবিত বৈতল । মায়ের উপর বাপের অত্যাচারকে বাপের পৌরুষ
বলে মেনেছে । ওদিকে মনসা পুঁথিতেও চন্দ্রধরকে পছন্দ করেছে । চেঙমুড়ি কানি বলে
প্রতিষ্ঠানকে গালাগালি করার সাহস কার হয় । প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে, স্নেহ মমতার
কাছে হেরে গিয়েও বাঁ হাতে ফুল দেওয়ার শর্তে জয় না পরাজয় বোঝা যায় না । হেরো নেতা
নয় চান্দ সদাগর । বৈতলও কোনও সমঝতায় যায় না । বৈতল
প্রতিশোধ নিতে জানে । বৈতল ভুল করলে তার প্রায়শ্চিত্ত করার পথ এখনও খুঁজে পায় নি ।
মায়ের মৃত্যও বৈতলকে অপরাধী করে । বৈতলের মমতাময়ী মা কোন অপরাধ করেনি, তবে
কেন আইর অভিশাপ । মা মনসার কোপ কেন সবসময় নিরীহ মানুষের উপর হয় । কালনাগের নিশানা
কালো মানুষটাই হতে পারত । প্রতাপের কাছে দেবতারাও হেরে যায় আর মনসা আই তো আধা
দেবতা । গ্রামের দেবতা , লোকমানসের ত্রাতা । ত্রাতা কোথায় , বৈতল তার মায়ের প্রতি
অবিচার মেনে নেবে না । আর পড়বে না পুঁথি । গুরু সৃষ্টিধরের কাছ থেকে শেখা
পুঁথিবিদ্যা কোনও কাজেই লাগবে না তার । সাপ দেখলেই এবার ধরে ধরে মারবে । মাকে যে
মেরেছে তার বংশ নাশ করবে বৈতল । বৈতল এবার ঘুরিয়ে দেবে তার জীবনের রাশ । মা চেয়েছে
বৈতল মানুষ হবে বিষহরির শরণ নিয়ে । নাম হবে , প্রতিপত্তি হবে! মা যে থাকবে না তার সে
কথা মা একবারও বলেনি ।
মা মরে গেছে, মা আর নেই তার জীবনে, মায়ের গায়ের গন্ধ নেই , নেই শুঁটকি –
পোড়া পান্তাভাতের স্নেহ । তাই মৃত্যু পরবর্তী আচরণে কোনও উৎসাহ নেই বৈতলের ।
শ্রাদ্ধশান্তি নিয়েও কিছু ভাবে না । মানুষ মরে গেলে কিছুই থাকে না স্মৃতি থাকে
প্রিয়জনের মনে । তিলে তিলে গড়ে তোলা
সন্তানের দেহ থাকে , থাকে তার মন । সেই একাকী মন নিয়ে বৈতল আপাতত বইয়াখাউরি ছাড়ে ।
শুধু বাপের সঙ্গে নিবৃত্তিহীন এক যুদ্ধের ঘোষণা করে যায় । কবে ফিরবে জানে না ,
কোথায় গিয়ে প্রস্তুতি নেবে তাও জানে না । রইদপুয়ানি যাবে না আর , বিয়ানিবাজারে আর
কেউ নেই তার । বন্ধু লুলার খোঁজে ঘোরে
এদিক ওদিক । লুলাকে ধন্যবাদ জানাতে হবে । বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েছে । মাকে শেষ
দেখা দেখেছে সে । অকারণ কেন যে এতগুলো বছর নষ্ট হয় দুই বন্ধুর ।
‘বুলবুলি
গো মাই
পান
খাইয়া মুখ লাল করলায় চুন পাইলায় কই’
বৈতল
নিজের মতো করে অশৌচ পালন করে একা একা ! অভুক্ত থেকে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক ।
শ্রীমঙ্গল থেকে রেল গাড়িতে চড়ে বসে । কোথায় যাবে জানে না । তবু জানি কিসের আকর্ষণে
দক্ষিণমুখী হয় তার যাত্রা । নেশার ঘোর থেকে মুক্তি পেতে বিয়ানিবাজার ফেরে আবার ।
আবার রইদপুয়ানি গ্রাম । বৃন্দাবন কামারের বাড়ির সামনে এসেই ঝাঁপ দেয় জলে ।
পুকুরপারে কামারের হাপরের সামনে এসে হাত মেলে আগুন চায় বৈতল । বৃন্দাবন চন্দ্র
কিছু না বুঝে আগুন এগিয়ে দেয় বৈতলের হাতে
। লোহা ছুঁয়ে শুদ্ধ হতে হয় , কামার সদ্যপ্রস্তুত লোহার অস্ত্র দেয় হাতে ।
মাতৃদায়ের প্রাথমিক শুদ্ধতার পাঠ শেষ করে বৈতল যায় গুরুগৃহে ।
বৈতলের খুব খিদে পায় এবার । কী করবে , কার কাছে
জানতে চাইবে এই অবস্থায় তার করণীয় কী । বাড়িতে ছোট মেয়ে চামেলি ছাড়া কেউ নেই ।
তাহলে কি চায়নাকে বলবে, ভাত দাও । কিন্তু তার যে অশৌচ । অশৌচ কতদিন থাকে । বৈতল তো
জানেও না কবে মৃত্যু হয়েছে তার জননীর । বৈতলের উদাসী হতভম্ব মুখ দেখেই হয়তো চায়না
বুঝতে পারে ক্ষিদের কথা । গুরুর কনিষ্ঠা কন্যা তাকে খেতে দেয় । বলে,
--- মা গেছইন শেওলার হিপারো , সরিষাত আমার মৌসা
মরছইন । তান শ্রাদ্ধ । আমারে কইছইন তুমি আইলে খানি দিতাম ।
--- আমি আইমু কেমনে জানো ।
--- আমি জানি । মায়েও জানইন ।
--- আইলাম নানে ! আর করাতির কাম করতাম নায় ঠিক
করছি ।
--- কিতা করতায় তে ।
--- গেলাম গি নে হাকালুকি ।
--- তুমি যে কইলায় তুমার বাড়ি বইয়াখাউরি । ভাটির
দেশো ।
--- তে কিতা সব অউত্ত সিলেটো । হাকালুকি কুনু
দূর নি , হাওরর রাজা অইল হাকালুকি , আর আমি অইলাম পানির পুক, অউত্ত রইদপুয়ানি থাকি
এক দৌড়ে গিয়া পড়তাম পারি পানিত । হুনছ নানি কথা, হাওরর মাঝে
হাকালুকি , আর সব কুয়া ।
--- অয় হুনছি , মানুষর মাঝে মনসুর মামুদ ,বাকি
সব পুয়া । তে আইলায় কেনে ।
--- তুমার লাগি নায় ।
--- জানি ।
--- না জানো না । খামোকা মাত মাতিও না ! হুন,
শ্রীমঙ্গল থাকি রেলগাড়িত উঠলাম । আর ঝমঝমি শব্দে আমার মন বদলি গেল ।
--- আমার মন ইলাখান কেনে !
--- কিলাখান ।
--- ছাতকর মেঘর লাখান । খনে ধলা , খনে কালা !
--- ছাতক নায় কও চেরাপুঞ্জি । হুনছ নানি ,
‘ পিঞ্জামেঘর আঞ্জা আঞ্জি চেরাপুঞ্জির পাড়ো ,
ধলাভেড়া ফালদি পড়ে কালা ভেড়ার ঘাড়ো ।’
অউত্ত কথা ! তে এক কথা থাকি আর এক কথাত লই যারায়
গি কেনে ।
--- আইচ্ছা কও ।
--- কইবায় আড়ুয়ামি । রেললাইনর ধারো লুয়ার খুটি
দেখছ নি । খুটির উপরে ধলা ধলা পাত্থরর কইতর বওয়াই রাখি দিছে । কুনুখানো চাইরটা,
আট্টা । আর কইতরর গলাত দড়ি । কত লম্বা কী জানি । রেললাইনর লগে যার অউ যার ।
--- ইতা দেখছি । বদরপুর গেছি না নি ।
--- আমি হি কথা কইছি না । মাঝখানো
ফালাও কিতা ।
--- আর ফালাইতাম নায়, কও ।
--- ঠিক তো । রেলগাড়ি চলে আর তারও দৌড়ে । কি
সুন্দর শব্দর ঝমঝমি ।এর মাঝে এক পাখি অউ লম্বা লেইঞ্জ ঝুলাইয়া বই রইছে ।
পাখির নাম ফিঙ্গা । আমার খুব ভালা লাগে ।
তুমার লাখান । খালি ফালায় ।
--- তেউ ।
--- আইলাম ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন