(দেশভাগ
এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের
করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর
প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ
উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক।
আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই
উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার সপ্তম অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
সাত
মাছ ধরার মতো
সাপ ধরাও শিখে নেয় বৈতল ।
লুলা মন্ত্র
মুন্ত্রো অনেক কসরত জানে । সাপের গন্ধ শুঁকতে জানে । বন্ধুর ঝুলিতে সাপ ভরে দিয়ে
বলে,
--- বেটা ডরাইছ না ।
আলদ ছাড়া বাকি সব অউ ধুড়ার লাখান । বিষ নাই কুলার লাখান চক্কর । তে আলদ ধরারও
কেরামতি আছে । আলদর বিষর বউৎ দাম । মানুষেরে আড়ুয়া না বানাইলে তোর কিওর কেরামতি ।
চল গাউত ঢুকিয়াউ আমি মন্ত্র পরমু আর কইমু
সাপ আছে মন্দিরো ।
বৈতলকে বলে,
--- যা অউ টিল্লার
উপরে মন্দিরর পিছে গাতাগুতা পাইলে ঢুকাই রাখি দিছ ইগুরে । লড়ত নায়, কামড়াইত
নায় ।
চৌচালা শিবমন্দিরের পিছনে মনসার বাহনকে রেখে
আসে বৈতল । বৈতল ফিরতেই লুলা সাপ সাপ চিৎকারে গ্রামের মানুষকে সচকিত করে । গ্রামের
মানুষও দুই কিশোরের পাশে হাসিমুখে জড়ো হয় । আসন্ন ভয়ের জন্য কোনও হেলদোল নেই । কেউ
একজন বলে,
--- কামড়াইত নায় তো
।
--- আমরা মন্ত্র
জানি । খেদাই দিমু । দেখতা নি । উঝা তুমি বাজাও ডঙ্কা , মা
মনসারে ডাকি খেদাও ইগুরে ।
অনেক মানুষের সামনে গান গাওয়ার সুযোগ হওয়ায়
বৈতলও খুব খুশি । সে লুলার শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্র গায় গানের সুরে ,
‘অং অগ্নি বং
হংসবাহনে মা মনসা
কই দেও তোমার কালাচান্দরে যেখানো
থাকউক
বার অইয়া
আউক ।
বাচিবার যদি আছে সাধ বেটা
প্রাণ লইয়া ভাগ এই বেলা
রাজা ভোজের কিরা তোরে মনসা আইর
দোহাই
মা মনসার দোহাই
বেটা তুই যদি থাকস গাউত
ভানুবিবির দোহাই তুই থাকতে পারতে
নায় ।’
মন্দিরের পিছনভাগে ইতিউতি খুঁজে কোথাও রেখে
-আসা সাপ পায় না বৈতল । দুই বন্ধু চোখাচোখি করে । কী হল , ভানুবিবির
ভেল্কি কি তবে টিকল না ।
ততক্ষণে গাঁয়ের মানুষ আবার হাসতে হাসতে ঘিরে
ধরে দুই কিশোর বহুরূপীকে । দুই বন্ধুতে কানাকানি হয় ,
--- কিতা অইছে ক
চাইন । আমি তো অউ গাতো রাখি গেলাম । তে ।
--- আমরা তো অখনও
কেরামতি আরম্ভ করলাম না , এর আগেউ ভাণ্ডা ফাটি গেল কেমনে ।
--- অইছে বাদ দে অখন
বার কর জড়ি বুটি । বেচি দেই কয়েকটা ।
ছোট ছোট বনাজি গাছের জড় কেটে রঙ লাগিয়ে সাপের
ঘুটি বানিয়েছে লুলা । লাল জড়ের গুণ একরকম সবুজে ভিন্ন । সাপের বিষ নামে , বাড়ির
ধারে কাছে সাপ আসে না । গায়ের মানুষ লুলার ভাষণ শুনে হাসিমুখে । একজন বলে,
--- দেও চাইন দেখি
আমার এক ভাঙানি ,---
‘ অউ দেখি অউ নাই
কই গেলা কালা রাই ’
লুলা বৈতল বিপদের গন্ধ শুঁকতে পারে ।
লুলা তাও সাহস সঞ্চার করে মন্দিরের পিছনে সাপের গর্তে হাত ঢোকাতে যায় । কিন্তু
ডিটান দেওয়া শিবুদা নিষেধ করেন ;
--- গাতো হাত দিও না
রেবা ।
--- কেনে কিতা অইব ।
আমরা সাপুড়া , আমরার কিচ্ছু অইত নায় ।
--- অচিনা হাত দেখলে
তারা ছাড়তা নায় । ই গাউর মাইনষে সাপ ডরাইন না , তারাও
গাউআলারে ডরাইন না ।
--- ই গাতো আছইন
একজন ।
--- তোমরা রাখছ আরি
। কেনে ইতা কর । ভালা কাম করতায় পার নানি ।
লুলা রাগলে সাজিয়ে কথা বলতে পারে । বৈতলের
রাগ চণ্ডাল । ফোঁস করে ওঠে ! বলে,
--- আমরা ইতা
রাখারাখির কাম করি না । আমরা সৎ পথো থাকি , সাপ
ধরি । ভাটির দেশ তারা ঘরো থাকইন পানিত থাকইন পথেঘাটে থাকইন । আর ভালা কামর কথা
কইরা , আপনে দিবা নি ভালা কাম ।
--- কেমনে কইমু ।
কাম দেওয়ার মালিক নি আমি ।
--- উঝা বেজ পাটনি
ইতা হুনলেউ তো ধুরধুর করি খেদাই দিবা ।
--- আইচ্ছা খেদাইতাম
নায় , কও কিতা পারবায় তুমরা ।
--- যেতা কইবা করমু
।
--- থাকবায় কই !
--- আপনার বাড়িত।
--- আমার কুনু বাড়ি
উড়ি নাই । আইজ ইখানো কাইল হিকানো । থাকি অউ শিবমন্দিরো । শিবর পুয়া আমি ।
--- জানি ।
জানি বলায় লুলা বৈতলের দিকে অবিশ্বাসের চোখে
তাকায় । তাকায় কথা বলা লোকটির দিকে । লোকটিও বিস্মিত । বলে,
--- জানো কেমনে ।
কিতা জানো ।
--- জানি , কইন
না আইজ থাকমু নি আমরা ।
--- গাউ আলা হকলরে
জিগাই লাই । তুমার লগে অহিন্দুও আছে একজন । তুমি বাঙাল নানি ।
--- অয় হে মুসলমান ।
আপনে না কইলে কেউ বুঝত নায় ।
--- বড় সিয়ানা রেবা
তুমি ।
ওদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয় শিবমন্দিরেই ।
লুলাকে মুসলমান জেনেই সম্মতি দেয় সবাই । আসলে মন্দিরটা শিবের দখলে যতটা মা মনসার
দখলে অধিক । মন্দিরের বাইরে একটা ভাঙা ছাপটা ঘর আছে , কোনমতে
মাচানের উপর থাকা যায় । দুই বন্ধুর কেউই রাতে ঘুমোয় না , জেগে
থাকে । আসলে দিনের ঘটনায় দুজনেই হতমান । বৈতল লুলাকে ধাক্কা মারে জোরে । বলে,
--- অত কষ্ট করি
বেটা থাকছি না কুনুখানো ।
--- কেনে তুইন রাজার
পুয়া নি । আমার বাড়িত দেখচছ নানি নানার বকরি ইগুইনে সারারাইত ম্যাঁ ম্যাঁ করইন ।
--- হি তো বাড়ি ।
--- কেনে মন্দিরো
থাকছি না নি আগে ।
--- থাকচছ , লুলা
দাস অইয়া থাকচছ । ইখানো তুই আমিন , তরে করি থাকত দিছে ।
--- তুই কেমনে বুঝলে
।
--- হাচা কথা কইতাম
নি ।
--- ক ।
--- আরো ছুট আসলাম ।
তখন কিগু হিন্দু আর কিগু বাঙাল বুঝতাম না । ধুমধুমাইয়া বাঙাল বাড়িত ঢুকি গেছি ।
মুরগির ছালইন খাইছি । গরু উরু কেউ খাওয়াইছে না । আর খাওয়াইলেউ কিতা । ইদ্গাত তো
খেলতাম অউ । মজিদও গেছি । পাটনি বাড়ি মাইমল বাড়ি আলাদা আছিল না । অখন মন বদলি গেছে
, আল্লা আলাদা অই গেছইন । তান নাম হুনলেউ গুসা উঠে । কেনে বে ।
--- আকতা তুইন ইতা
মাতত্রে কেনে ।
--- না, অন্যখানো
তো মান ভাড়াইয়া রইছি । কিচ্ছু অইছে না । ইখানো তারা জানিয়া হুনিয়া ফাত্রামি করলা
। কইলা মন্দিরো থাকতে দিবা । ইতা মন্দির নি, জঙ্গলর
মাঝে কইন থাকো । আমরা আরি তিনকড়া বালিগড়া । অলা বেরাত নি ফালাই দিলা শিবুদায় ।
--- অত শিবুদা
শিবুদা কররে কেনে । তুইন তানে আগে থাকি চিনছ , নানি
।
--- না বে ।
--- নাবে কইছ না ।
লুলার মনে সন্দেহ । বন্ধুত্বের শর্ত মেনেও
কোথাও একটা কাঁটা খচখচ করে । আবার বৈতল ছাড়াও তার চলবেও না । কানা ফকিরের মোকাম থেকেই বৈতলের মনে কিছু
একটা হয়েছে । কিছু তাল ভাজছে । ফকিরের সামনে লুলাকে বেইমান বলে । বেইমানি তো করেনি
লুলা , তার দোস্ত সিলেটের মেয়ের কান ছেড়ার দুঃখে গুমরে
গুমরে মরছিল । লুলা ভেবেছে যদি ফকিরকে বলে কিছু হয় , শান্তি
পায় । হিতে বিপরীত হয় । এখানে এসে শিবুদা শিবুদা করছে । আবার বলছে আল্লার নামে
গুসা আছে । এত বড় নাপাক কথা । তবে একেবারে মিছে কথাও তো বলেনি তার বন্ধু । লুলার
মনেও একটা রাগ হচ্ছে । ছোটবেলা মন্দির দেখলেই নমস্কার করত । প্রসাদ খেতে কী আনন্দ ,
খিচুড়ি আর লাবড়া । তার পর থেকে কী যে হয়ে গেল । হালাল ছাড়া মাংস মুখে
রুচে না । আদা রসুনের গন্ধ না থাকলে ছালনকে রান্নাই মনে হয় না । তবে বৈতলের সঙ্গে
থাকলে পালটিও খায় লুলা । বৈতলের সঙ্গে থাকলে ষে ভুলে যায় তার ধর্মপরিচয় । বৈতলকে
বলে মনের কথা ।
--- সারা জাহানো
যেতাই হউক আমরার সিলেটো ইতা হিন্দু বাঙাল না থাকলে কী মজা আছিল নানি ক ।
বৈতলের উচাটন কোন ভাল কথাও সুন্দর ভাবে
নিতে পারে না । লুলাকে আবার মারে । বলে,
--- না কুনু মজা নাই
। তুই মুসলমান আমি হিন্দু । তুই চাছ না আমি পুথি
পড়া শিখি । পুথি পড়লে আমি হিন্দু অই যাইমু নানি ।
--- কেমনে কইলে তুইন
ই কথা ।
--- আমি জানি তোরে ।
--- আমিও জানি ,
তুইন আমারে লুকাইরে । শিবুদারে চিনছ আগে থাকি । শিবর পুয়া কওয়ায় কইচছ
জানি । কইচছ নানি ।
--- কইছি । জানি ।
তানে সিলেটর হক্কলেউ চিনে । শিবর পুয়া কওয়ায় বুঝি লাইছি তাইন শিবনন্দন দত্ত ।
নন্দন মানে অইল পুয়া রে, পুয়া । আমি তো জানিয়া শুনিয়া গয়ঘর আইছি
। কানা ফকিরে কইলা নানি ষষ্টিবর দত্তর নাম । মা মনসায় তানে বর দিছলা ই গাউত কেউরে
সাপে কামড়াইত নায় । যে পুথি পড়া হয় শ্রাবণ মাসো , লেখচইন
তাইন , পদ্মপুরাণ । লেখাপড়া শিখছি না তেও হুনি হুনি
শিখছি , গাই লাচাড়ি গান মাতা পদ্মাবতীর,
‘মনসার চরণধূলি
শিরেতে সানন্দে
তুলি
কান্দে লখাই
লোহার বাস’
শিবুদায়ও গাইন ।
তাইন অখন সিলেটর নামকরা গাইন , নাচইন ও বালা ।
--- কিওর নাচ । ই
বেটা তো মাকুন্দা , ধজভঙ্গ । না বেটা না বেটি ।
--- অউকা না । তান
মতো গুরমি নাচ নাচতে পারবে নি ।
--- অ হালার হালা ,
আমারে খালি কিল খাওয়ার গুসাই পাইচছ নি । আমারে খালি লুকাছ আর
গাইল্লাছ । ছিলেটর এক পুড়িরে কিতা করচছ আর ইতার সব গুসা আমার উপরে ঝাড়রে । কইরে
আমি তরে পুথি পড়া শিখতাম দিয়ার না , আমি বাঙাল এর
লাগি । পুথির আবার ইতা কিতা । সবেউ ইবেটিরে মানে । খিত্তাততো সিন্নিও দেয় ।
--- ঠিক নি ।
--- তুইন বেটা
কিচ্ছু জানছ না । আগে মাত্রা পথো হাগরা , খালি বড়ম বড়ম
মাত । বিয়ানিবাজার থাকি ,পাথারকান্দি থাকি আইন বড় বড় গাইন ,
কী সুন্দর নাচইন গুরমিএ । তর ই মাকুন্দা থাকি বউত সুন্দর । আমি একজনর
লগে গেছি লাকড়ি লইয়া একবার । কী সুন্দর গান গাইন রে । খালি কুনু পুথির গান নি ,
কততা গাইছইন । একটু পাগলামি ছাইট আছে ।
--- তারা একটু পাগল
পাগল অইন । হাচন রাজায় দুপইর বেলা লেমটন জ্বালাইয়া হাটতা রাস্তাত । তে লাকড়ি কেনে
বে ।
--- ও , তাইন
তো করাতি নানি । পালং উলং বানাইন ।
--- কই বাড়ি ,
বিয়ানিবাজার নি । চৈতন্য চরণপাল নি ।
--- অইব অলাখান অউ
নাম ।
--- চল তে ইখান থাকি
ভাগি । তুই চিনছ নি বাড়ি ।
--- চিনি । চল তরে
তোর জাগাত পৌঁছাই আমি খিত্তাত যাইমু গিয়া ।
--- কেনে বে আমার
মাইরে দেখতে নানি একবার ।
যেমন কথা তেমন কাজ । রাতের বর্ণ দুই বন্ধুর
রাতের গায়ে মিশে যায় মধ্যযামে । অন্ধকার বিজয় করে সকালে পৌঁছে যায় দিঘীর পার ,
পঞ্চখণ্ড ।
চলবে
< ভাটি পর্ব ৬ পড়ুন ভাটি পর্ব ৮ পড়ুন
চলবে
< ভাটি পর্ব ৬ পড়ুন ভাটি পর্ব ৮ পড়ুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন